অধিকাংশ সৌখিন মানুষের অ্যাকুয়ারিয়ামের শখ থাকে। বাড়িতে বা অফিসে, রেস্টুরেন্টে কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, অ্যাকুয়ারিয়ামের ব্যবহার আজকাল চোখে পড়ার মতো। তবে শুধু সুন্দর গঠনের একটি অ্যাকুয়ারিয়াম স্থাপন করলেই সব কাজ শেষ হয়ে গেল না। বরং অ্যাকুয়ারিয়ামের বাহিরের চাকচিক্যের চেয়ে ভেতরে কিছু সুন্দর মাছের গুরুত্ব অধিক। এরকমই ১০টি মাছের কথা জেনে আসি চলুন।
ডিসকাস মাছ
অ্যামাজন নদীর অববাহিকায় সচরাচর দেখতে পাওয়া সিক্লিড মাছের স্বজাতি এই ডিসকাস মাছ। এর দেহের গোলাকৃতির জন্য এর নামই হয়েছে ‘ডিসকাস’ মাছ (‘ডিসক’ অর্থ চাকতি)। স্বচ্ছ পানিতে মাছগুলোকে যখন দেখবেন, তখন মনে হবে যেন কোনো শিল্পী তার মনের মাধুরী মিশিয়ে, নানা রঙে এঁকে দিয়েছেন এই মাছের দেহ। উজ্জ্বল বর্ণের এই মাছের বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে রয়েছে রঙের ব্যাপক বৈচিত্র্য। ফলে অ্যাকুয়ারিয়ামের মাছ হিসেবে এর রয়েছে সুখ্যাতি। তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় ডিসকাস মাছ হচ্ছে লাল, নীল আর ফিরোজা রঙের ডোরা বিশিষ্ট মাছগুলো। একটি পূর্ণবয়স্ক ডিসকাস মাছের দৈর্ঘ্য সর্বোচ্চ ১০ ইঞ্চি। একে অ্যাকুয়ারিয়ামে রাখার অন্যতম কারণ হচ্ছে এর বিশেষ ক্ষমতা। এই মাছ অন্যান্য গৃহপালিত পশুর মতো কয়েক দিনেই আপনাকে চিনে নিতে এবং মনে রাখতে সক্ষম হবে! ফলে যখনই অ্যাকুয়ারিয়ামের স্বচ্ছ কাঁচের কাছে যাবেন, কোনো উদ্ভট ভঙ্গিমা করে আপনাকে অভ্যর্থনা জানাবে ডিসকাস মাছ!
ড্যাটনয়েড
সমুদ্রের বাঘের কথা শুনেছেন কখনো? ড্যাটনয়েড মাছই হচ্ছে সমুদ্রের বাঘ! একে বলা হয় ‘টাইগার ফিশ’। সমুদ্রে বসবাসকারী এই বাঘের কিন্তু বিশাল দেহ বা শক্তিশালী থাবা, কোনোটিই নেই। কিন্তু পুরো দেহ জুড়ে বাঘের মতো বড় বড় কালো ডোরা এর দেহকে দেখতে বাঘ সদৃশ করেছে। তবে ক্ষুদে এই জলের বাঘ কিন্তু অন্যান্য অ্যাকুয়ারিয়ামের মাছের তুলনায় বেশ বড়। প্রাপ্তবয়স্ক ড্যাটনয়েডের দৈর্ঘ্য ৬৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়। তাই আকারে বড় অ্যাকুয়ারিয়াম তো লাগবেই। সাথে এর পরিচর্যার জন্য বিশেষ ব্যবস্থাও থাকা চাই। বিশেষ করে এদের জন্য লুকাবার জন্য ভালো ব্যবস্থা রাখতে হবে অ্যাকুয়ারিয়ামে। অন্যদিকে নিরীহ স্বভাবের এই মাছকে অন্য যেকোনো মাছের সাথেই রাখা সম্ভব।
এক্সোলটল
অদ্ভুত আকৃতি আর অনন্য বৈশিষ্ট্য ভালোবাসেন? তাহলে অ্যাকুয়ারিয়ামে রাখুন এক্সোলটল। মেক্সিকান এই মাছ, আসলে মাছ না! এটি ‘অ্যাম্ফিবিয়ান’ বা উভচর শ্রেণীর প্রাণী। তাই অনেক সময় একে ‘মেক্সিকান স্যালামান্ডার’ও বলা হয়। তবে এই মাছের পরিচর্যায় একটু কসরত করতে হবে। কেননা এটি মাংসাশী প্রাণী এবং একে কীটপতঙ্গ আর কেঁচো খেতে দিতে হবে তিনবেলা। অন্যদিকে অ্যাকুয়ারিয়ামের নিচে স্বচ্ছ বালি থাকলেই এক্সোলটলের জন্য যথেষ্ট। আর কোনো বাড়তি ব্যবস্থার প্রয়োজন নেই। সবশেষে, দিনে অন্তত তিনবার পানি বদল করতে হবে যদি এক্সোলটল এর স্বাস্থ্য ভালো রাখতে চান।
মালাবি সিক্লিড
পূর্ব আফ্রিকার মালাবি হ্রদে প্রাকৃতিকভাবে বসবাস করা সিক্লিড মাছের একটি বিশেষ প্রজাতিকে বলা হয় মালাবি সিক্লিড। উজ্জ্বল হলুদ কিংবা নীল বর্ণের এই মালাবি সিক্লিড মাছ যেকোনো অ্যাকুয়ারিয়ামের জন্য উপযুক্ত। ১২ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হওয়া এই মাছ মোহনীয় রঙ আর মনোমুগ্ধকারী অঙ্গভঙ্গির কারণে সহজেই স্থান করে নিতে পারে যেকোনো অ্যাকুয়ারিয়ামে। তবে এই মাছের পরিচর্যার জন্য কিছু বিষয় মাথায় রাখা আবশ্যক। প্রথমত, অ্যাকুয়ারিয়ামের পানি ঘন ঘন পরিবর্তন করার ব্যবস্থা থাকতে হবে। পানির তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থাও আবশ্যক। অন্যদিকে, অ্যাকুয়ারিয়ামে যথেষ্ট পরিমাণ পাথর, লুকাবার স্থান ও উদ্ভিদ থাকা জরুরী। সবচেয়ে জরুরী যে বিষয়টি তা হলো এর সঙ্গীর ব্যবস্থা করা। মালাবি সিক্লিড দল বেঁধে থাকতে পছন্দ করে। তাই কমপক্ষে পাঁচটি মালাবি সিক্লিড অ্যাকুয়ারিয়ামে রাখতেই হবে।
অস্কার
সিনেমা জগতের সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার অস্কার কিন্তু দেখতেও খুব সুন্দর। তেমনি মাছের জগতের অস্কারও দেখতে অন্যান্য মাছের চেয়ে অধিকতর সুন্দর। দক্ষিণ আমেরিকার স্থানীয় এ মাছটি সিক্লিড পরিবারের আরো একজন সদস্য। বেশিরভাগ অস্কার মাছই উজ্জ্বল কমলা রঙের হলেও কিছু প্রজাতি লাল, হলুদ এমনকি কালো রঙেরও হয়। ১০/১২ ইঞ্চি লম্বা এক একটি অস্কার মাছের দেহ মনে হতে পারে কোনো খেয়ালী শিল্পীর এলোমেলো তুলির আঁচড়ে ভরা ক্যানভাস। তবে সেই ক্যানভাসকে নিজের অ্যাকুয়ারিয়ামে মুক্তভাবে ভাসতে দেখতে চাইলে, অবশ্যই পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অ্যাকুয়ারিয়াম হতে হবে বড়সড় আকৃতির, অন্তত ৫৫ লিটার পানি ধারণ করতে পারে এমন। অন্যদিকে অস্কার মাছ অত্যন্ত দুষ্টু এবং চঞ্চল প্রকৃতির মাছ। তাই অ্যাকুয়ারিয়ামের ভেতরে কোনো হালকা বস্তু বা দুর্বল উদ্ভিদ স্থাপন করা যাবে না। সবকিছু অবশ্যই মজবুত হতে হবে। আর সবশেষে যে বিষয়টি মাথায় রাখা প্রয়োজন তা হলো, অ্যাকুয়ারিয়ামে মাছের সংখ্যা। ঘনবসতি কিন্তু অস্কার মাছের মোটেই পছন্দ না!
রেড টেক্সাস সিক্লিড
আবারো সিক্লিড পরিবারে ফিরে আসতে হচ্ছে। তবে এবার মৌলিক সিক্লিড নয়, শংকর প্রজাতির সিক্লিড মাছ দেখবো আমরা। টেক্সাসের এক প্রজাতির স্থানীয় সিক্লিডের সাথে ফ্লাওয়ারহর্ন সিক্লিডের প্রজনন ঘটিয়ে উৎপাদন করা হয়েছে রেড টেক্সাস সিক্লিড। টকটকে লাল রঙের এই মাছের গায়ে সাদা সাদা দাগ, আর লেজ ও পাখায় নীলাভ আবরণ, এই মাছের বিশেষত্ব। ১২ ইঞ্চি লম্বা এই মাছের জন্য কমপক্ষে ৭৫ লিটার আয়তনের অ্যাকুয়ারিয়াম ব্যবহার করতে হবে। আর এর হিংস্র স্বভাবের কারণে রেড টেক্সাসকে অ্যাকুয়ারিয়ামে কেবল স্বজাতির সাথেই রাখা হয়। অন্যদিকে প্রাকৃতিকভাবে এই মাছ পাওয়া যায় না। মাছের খামারেও সচরাচর পাওয়া যায় না রেড টেক্সাস। ফলে এর দামও বেশ চওড়া।
ফ্লাওয়ারহর্ন সিক্লিড
সিক্লিড পরিবারের মাছগুলো সম্ভবত অ্যাকুয়ারিয়ামের সৌন্দর্য বর্ধনের জন্যই সৃষ্টি হয়েছে। ফ্লাওয়ারহর্ন মাছ এই উক্তির পক্ষে সমর্থন দেয়া আরো একটি মাছ। এই অনন্য সুন্দর সিক্লিডের আদি বাসস্থান মালয়েশিয়ায়। এর প্রধান বিশেষত্ব হচ্ছে এই যে, একই ফ্লাওয়ার হর্নের গায়ে লাল, নীল, হলুদ, কমলা সহ আরো একাধিক রঙ থাকতে পারে। তাই অ্যাকুয়ারিয়ামের স্বচ্ছ পানিতে ঘুরতে থাকা একটি সিক্লিডকে দেখলে মনে হতেই পারে, এই মাছের গায়ে কেউ রঙিন আল্পনা এঁকে দিয়েছে। সৌন্দর্যের পাশাপাশি এই মাছের দীর্ঘায়ুও অ্যাকুয়ারিয়ামের জন্য একে উপযোগী করে তোলে। একেকটি ফ্লাওয়ারহর্ন সিক্লিড ৭ বছরের অধিক সময় বেঁচে থাকে। তবে সমস্যা হচ্ছে এর স্বভাব উগ্র। নিজের প্রজাতির সাথেই তো অহরহ মারামারি করে এই মাছ, অন্য প্রজাতি হলে তো কথাই নেই! ৭০/৮০ লিটারের অ্যাকুয়ারিয়ামও অনেক সময় অপর্যাপ্ত মনে হতে পারে ফ্লাওয়ারহর্নের জন্য। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা এর দাম। একটি ফ্লাওয়ারহর্নের মূল্য বাংলাদেশি টাকায় ৩০-৪০,০০০ টাকা বা তারও বেশি!
প্লেকো
অ্যাকুয়ারিয়ামের শখ যাদের আছে, তারা অবশ্যই অ্যাকুয়ারিয়ামের উপযোগী নানা মাছের খোঁজ রাখেন। সেক্ষেত্রে প্লেকোর নাম সকলের জানা। অন্তত ইউরোপীয় দেশগুলোতে কিংবা আমেরিকায়, স্নোবল, জেবরা, গোল্ডেন নাগেট কিংবা রয়্যাল প্লেকোর ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। সৌখিন মানুষের ঘরের দেয়ালের বাহারি রঙের কার্পেটের মতো প্লেকোর দেহও কারুকার্যময়। আর দামের ক্ষেত্রে তো প্লেকো ছাড়িয়ে যায় সকলকে। ৮ হাজার থেকে শুরু করে ৮ লক্ষ টাকাও হয় একেকটি প্লেকোর দাম! তবে এর জীবনকাল এই দামকে কিছুটা হলেও প্রশমিত করবে। কারণ প্লেকোর গড় আয়ুই যে ২০ বছর!
জাপানি কৈ
কৈ মাছ ভাজা, খেতে ভীষণ মজা। তবে কৈ মাছের স্বাদ যতই ভালো হোক না কেন, অ্যাকুয়ারিয়ামের মাছের আলোচনায় কৈ মাছ আসবার কথা না। কারণ কৈ মাছ দেখতে খুব একটা সুন্দর না। কিন্তু যে কৈ মাছের কথা এখন বলা হবে, তা আসলে অ্যাকুয়ারিয়ামের জন্যই জুতসই। এগুলো হচ্ছে জাপানি কৈ। জাপানে তো এই মাছকে রীতিমতো ‘মহত্ব’ এবং ‘সাহসীকতা’র প্রতীক ধরা হয়। কারণ লোককথা প্রচলিত আছে যে, শক্তিশালী জলপ্রপাত উপেক্ষা করেও পাহাড় বেয়ে উঠে যেতে পারে এই মাছ। বাহারি রঙের এই মাছগুলোকে রাখতে ১ হাজার লিটারের সুবিশাল অ্যাকুয়ারিয়াম প্রয়োজন। অন্যদিকে ৩ ফুট পর্যন্ত লম্বা হওয়া একটি জাপানি কৈ মাছ ৩০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে! বিশ্বের অন্যান্য দেশে যা-ই হোক না কেন, জাপানে অ্যাকুয়ারিয়ামের জন্য কৈ মাছের চাহিদা সবচেয়ে বেশি।
ইলেকট্রিক ব্লু লবস্টার
নাম ‘লবস্টার’ বা গলদা চিংড়ি হলেও, এই মাছটি আসলে এক প্রজাতির বাগদা চিংড়ি। নাম কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে সে ব্যাপারে কোনো সন্তোষজনক তথ্য পাওয়া যায় না। ফ্লোরিডার স্থানীয় অধিবাসী এই মাছ সাধারণ চিংড়ির মতো এত সুস্বাদুও না। কিন্তু এটি যে কারণে বিখ্যাত তা হচ্ছে এর জ্বলজ্বলে নীল রঙ। অন্ধকারের মধ্যেও একটি ব্লু লবস্টারকে মনে হবে যেন একটি নীলকান্তমণি। ছোটখাটো অ্যাকুয়ারিয়ামেও অনায়াসে বেঁচে থাকতে পারে এই মাছ। শুধু বাড়তি যে বিষয়টি প্রয়োজন তা হলো পর্যাপ্ত লুকানোর স্থান। সঠিক পরিচর্যা আর পুষ্টি সরবরাহ করতে পারলে একটি ব্লু লবস্টার ৫ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে।
ফিচার ছবি: nano-reef.com