অ্যাডাম স্মিথের দর্শনের মধ্যেও তার অর্থনীতির চিন্তাগুলো নিহিত আছে। তার পুরো দর্শনে অর্থনীতির প্রভাব লক্ষ্য করা যায় ‘স্বার্থ’ নামক ধারণাটির মধ্য দিয়ে। প্রতিটি মানুষই যে সকল অর্থনৈতিক কাজ করে, তা স্ব-স্বার্থ রক্ষার জন্যই করে। আর এই প্রক্রিয়ার সমগ্র পৃথিবীকে স্মিথ কল্পনা করেছেন একটি বিশাল কর্মশালা হিসেবে, যেখানে স্বার্থ অনুযায়ী শ্রমবিভাগ হয়। মানুষের প্রতিটি কাজই তার আত্মানুরাগ, মুক্তির আকাঙ্ক্ষা এবং মালিকানার লোভ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। আর এই চাহিদাগুলো মেটানোর জন্য মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিই তাকে বিভিন্ন কাজে নিয়োগ করে। ফলে, পূর্ণ স্বাধীনতাপ্রাপ্ত একজন মানুষ নিজের চাহিদা মেটানোর পর, স্বাভাবিকভাবেই দশজনের চাহিদা নিয়েও ভাবতে শুরু করে। আর তাই মানুষের সকল অর্থনৈতিক কাজ, সরকারের ‘হস্তক্ষেপমুক্ত’ রাখাকে সমর্থন করেছেন স্মিথ।
“আমরা রুটি প্রস্তুতকারীর রুটি তার দান হিসেবে গ্রহণ করি না। বরং তাদের স্বার্থেই তারা তা উৎপাদন করে এবং বিক্রয় করে।” – অ্যাডাম স্মিথ
স্মিথ এই উক্তিটি দ্বারা বোঝাতে চাইছেন যে, সমাজে শ্রমবণ্টন কারো তৈরি করে দেয়া নয়। শ্রমবণ্টন স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানুষের নিজেদের স্বার্থেই সৃষ্টি হয়েছে। একই প্রক্রিয়ায় উদ্ভব হয়েছে অর্থের। স্বার্থ রক্ষার্থে মানুষের আদান-প্রদানের প্রয়োজন হয়। আর আদান-প্রদানের জটিলতা দূর করতেই অর্থের উৎপত্তি। আর অর্থের উৎপত্তি মূলধন বা পুঁজির ধারণার বিকাশ ঘটায়। কারণ, কেবল বর্তমান নিয়েই পড়ে থাকে না মানুষ, বরং ভবিষ্যতের দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্যই মানুষ অর্থ জমা রাখতে শুরু করে, যা একসময় বিনিয়োগকৃত মূলধনে রূপ নেয়।
এই ধারার সবার শেষে আসে চাহিদা এবং যোগানের ব্যাপারগুলো। চাহিদা আর যোগানের মধ্যে ভারসাম্য থাকলেই কেবল বাজারে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল থাকে, যা ক্রেতা বিক্রেতা উভয়ের জন্য উপকারী। এখন এই আলোচনার ফলাফল কী দাঁড়ালো? ফলাফল এই যে, শ্রমবণ্টন, অর্থ, মূলধন আর চাহিদা-যোগানের মতো ব্যাপারগুলোকে কখনোই মানুষের নিয়ন্ত্রণ করবার প্রয়োজন পড়েনি। এগুলো আপনা থেকেই সৃষ্টি হয়েছিল এবং স্বনিয়ন্ত্রিতভাবে চলছে। আর স্মিথ এই ব্যাপারটির নাম দিয়েছেন ‘ন্যাচারালিজম’। বলা হয় যে, কোনো এক অদৃশ্য হাত এই ন্যাচারালিজম নিয়ন্ত্রণ করে। তাই একে বলা হচ্ছে ‘ইনভিজিবল হ্যান্ড থিওরি’।
এই ন্যাচারালিজমের সাথে আরো একটি ব্যাপার স্মিথ যোগ করেছেন, সেটি হচ্ছে ‘অপটিমিজম’ বা আশাবাদ। প্রতিটি অর্থনৈতিক কাজের পেছনেই স্ব-স্বার্থের সাথে জড়িত কোনো না কোনো আশাবাদ কাজ করে। সে আশাবাদ একসময় নিজের চাহিদা পূরণ করে জাতীয় অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলে। তাই স্মিথের মতে, অপটিমিজম আর ন্যাচারালিজম পরস্পর সম্পর্কযুক্ত।
১৭৭৬ সালে প্রকাশিত হয় স্মিথের যুগান্তকারী গ্রন্থ ‘অ্যান এনকোয়ারি ইনটু দ্য ন্যাচার অ্যান্ড কজেজ অব দ্য ওয়েলথ অব নেশনস’। সংক্ষেপে ওয়েলথ অব নেশনস নামে পরিচিত এই বই অর্থনীতির গতিপথই পাল্টে দিয়েছিল। বিভিন্ন অর্থনৈতিক তত্ত্বের এক অনুপম সম্ভার এই ওয়েলথ অব নেশনস। বইটি শুধু জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অর্থনীতিই আলোচনা করে না, বরং মানুষের প্রতিটি অর্থনৈতিক কাজের পেছনের সমস্যাবলী, তাদের সমাধান, আইনশাস্ত্র এবং নৈতিকতা নিয়েও আলোচনা করে। ইউরোপের অর্থনীতির ইতিহাস, কৃষি ও শহরায়ন, উৎপাদন ও বন্টন ব্যবস্থা, বাণিজ্যবাদের সমালোচনা, কর ব্যবস্থা, অর্থনীতিতে সরকারের হস্তক্ষেপ, সবই সুনিপুণভাবে আলোচনা করেছেন স্মিথ। এই বইয়ে তার আলোচিত কিছু অর্থনৈতিক ধারণাই সংক্ষেপে আলোচনা করা হবে।
শ্রম ও শ্রমবণ্টন
স্মিথের মতে, শ্রম হচ্ছে একটি জাতির সামগ্রিক উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি। কোনো জাতির বার্ষিক মোট শ্রমের পরিমাণ দ্বারাই সেই জাতির অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিমাপ করা সম্ভব। তবে সকল প্রকার শ্রম কিন্তু এর অন্তর্ভুক্ত হবে না। উৎপাদনশীল বা ফলদায়ক শ্রমের পাশাপাশি অনুৎপাদনশীল বা নিষ্ফল শ্রমকেও তাই চিহ্নিত করতে হবে। স্মিথ ফলদায়ক শ্রমকে দুটি মানদণ্ডে প্রকাশ করেছেন।
- দীর্ঘস্থায়ীতা-বিক্রয়যোগ্যতা: এই মানদণ্ডে, পণ্য যত টেকসই হবে এবং বিক্রয়যোগ্য হবে, সে পণ্যের পেছনে শ্রম তত ফলদায়ক গণ্য করা হবে।
- মূল্য বৃদ্ধিকারক- যে শ্রম কোনো উৎপাদিত পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি করতে পারে, তাকে মূল্য বৃদ্ধিকারক শ্রম বলে।
ফলদায়ক শ্রম মালিকের জন্য অর্থ আনয়ন করবে। কিন্তু নিষ্ফল শ্রম থেকে মালিকের কোনো অর্থ আয় হবে না, যেমন- গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে একজন শ্রমিকের তৈরি পোশাক তার মালিকের জন্য অর্থ আনয়ন করবে। কিন্তু কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত ভৃত্য তার জন্য কোনো অর্থ আয় করবে না। আর এটা ছিল স্মিথের একটি বিশাল ভুল। কারণ তিনি যাবতীয় সেবামূলক শ্রমকেই উৎপাদনশীলতার বাইরে রেখেছেন!
অন্যদিকে শ্রমবণ্টন হচ্ছে একপ্রকার সামাজিক সহযোগিতা। যখন কোনো পণ্য কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত চাহিদা মেটাতে সক্ষম হয়, তখন সে পণ্যটির পেছনের শ্রমকে সামাজিক শ্রমে পরিণত করা হয়, এবং পণ্যটি সমাজের সকলের জন্য উৎপাদন করা হয়। আর এভাবে, শ্রমবণ্টন শ্রমিকের কাজের দক্ষতা এবং গতিশীলতা বাড়ায়। এক্ষেত্রে স্মিথের বিখ্যাত পিন উৎপাদনের উদাহরণটির কথা না বললেই নয়। একটি পিন তৈরি করতে ১৮টি পৃথক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। একজন শ্রমিক একা একদিনে কেবল ২০টিই পিন উৎপাদনে সক্ষম। ফলে সে কারখানায় ১০ জন শ্রমিক কাজ করলে, প্রত্যেকে একা একাই সব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পিন উৎপাদন করলে, একদিনে মাত্র ২০০টি পিন উৎপাদিত হয়। কিন্তু যথাযথ শ্রমবণ্টন এই সংখ্যাটাকে নিয়ে যায় ৪,৮০০ তে!
শ্রমবণ্টনের কিছু সুবিধা স্মিথ উল্লেখ করেছেন-
- শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে।
- উৎপাদনের গতি বৃদ্ধি পায়।
- পুরো কাজের একটি ছোট অংশ যখন একজন শ্রমিক বারবার করতে থাকে, তখন তার দক্ষতাও বৃদ্ধি পায়।
- সময় এবং এবং ব্যবহার্য যন্ত্রপাতির সাশ্রয় হয়।
এই সুবিধাগুলোর পাশাপাশি স্মিথ, অসুবিধাগুলো দেখাতেও ভোলেননি-
- সামান্য পরিমাণ কাজ বারংবার করার ফলে শ্রমিকের মানসিক প্রশস্তি থাকে না এবং একঘেয়েমির সৃষ্টি হয়।
- শ্রমের বিশেষায়নের জন্য একধরনের অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়।
- শ্রমিকদের সৃষ্টিশীলতা এবং চিন্তাশীলতার কোনো জায়গা থাকে না।
মূলধন
স্মিথের মতে, কোনো জাতির সামগ্রিক সম্পদের উৎপত্তিস্থল হচ্ছে মূলধন। সম্পদ নির্ভর করে শ্রমবণ্টনের উপর, আর শ্রমবণ্টন নিয়ন্ত্রিত হয় মূলধন দ্বারা। এই মূলধন আবার তিনভাবে কাজ করতে পারে।
- উৎপাদন যন্ত্র হিসেবে।
- শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণকারী একটি তহবিল হিসেবে।
- করের উৎস হিসেবে।
মূলধন আবার দুই প্রকারের হয়। স্থায়ী মূলধন এবং চলতি মূলধন। মূলধনের চারটি প্রধান ব্যবহার দেখিয়েছেন স্মিথ। কাঁচামাল ক্রয় করতে, কাঁচামাল উৎপাদন করতে, উৎপাদিত পণ্য পরিবহণে এবং উৎপাদিত পণ্য বিতরণে মূলধন ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ কৃষিকাজ, মৎস্য উৎপাদন, খনিজ উত্তোলন, খনিজ ব্যবহার করে নতুন পণ্য উৎপাদন এবং এসব পণ্যের পরিবহণ এবং বিতরণেই মূলধন ব্যয় করা হবে।
কৃষিকাজ
আঠারো শতকে ফ্রান্সে একদল ‘এনলাইটমেন্ট’ অর্থনীতিবিদ একটি ধারণার প্রবর্তন করেন। সকল সম্পদ এবং উন্নয়নের মূলে হচ্ছে ভূমি চাষ এবং কৃষিজ উৎপাদন। এই ধারণাকে বলা হয় অর্থনীতির ‘ফিজিওক্রেটিক’ ধারণা। অ্যাডাম স্মিথ ফিজিওক্রেটিক ধারণার একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। তার অর্থনীতি বিষয়ক প্রধান চিন্তাগুলোর মধ্যে তাই কৃষিও একটি। তার মতে, যেকোনো কৃষিজ পণ্যকে অবশ্যই বাজারের অন্যান্য পণ্যের চেয়ে অধিক মূল্য দিতে হবে। কৃষি হচ্ছে বিনিয়োগের জন্য সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ক্ষেত্র। কারণ এখানে বিনিয়োগ করলে নিজের শ্রমের পাশাপাশি প্রকৃতির সহায়তাও পাওয়া যায়।
থিওরি অব ভ্যালু
অ্যাডাম স্মিথের ‘থিওরি অব ভ্যালু’ বা মূল্যতত্ত্ব ব্যাপারটি বেশ মজার। কোনো দ্রব্যের মূল্য দুই প্রকারের হয়। একটি ব্যবহারিক মূল্য, অপরটি বিনিময় মূল্য। এই দুয়ের মধ্যে অনেক সময় বিপরীত সম্পর্ক বিরাজ করে। দৈনন্দিন জীবনে পানির ব্যবহার অসীম এবং এর ব্যবহারিক মূল্যও অসীম। কিন্তু পানির বিনিময় মূল্য খুবই কম। আবার হীরার ব্যবহারের ক্ষেত্র অত্যন্ত কম, কিন্তু এর বিনিময় মূল্য অনেক বেশি। এই মূল্যের রয়েছে দুটি নির্ণায়ক।
- পণ্য উৎপাদনে ব্যয়িত শ্রম।
- পণ্য উৎপাদনের খরচ।
“The toil and trouble in acquiring something, determines the value”- Adam Smith
সোজা বাংলায়, যে বস্তু উৎপাদনে যত পরিশ্রম এবং জটিলতা থাকবে, সে বস্তুর মূল্য তত বেশি হবে। প্রাচীন সমাজে, যখন বাজার ব্যবস্থায় আজকের মতো জটিলতা ছিল না, তখন কোনো বস্তুর মূল্য নির্ধারণের একমাত্র নির্ণায়ক ছিল শ্রম। কিন্তু বর্তমানে কোনো পণ্যের পেছনে শ্রম ছাড়াও আরো অনেক কিছু কাজ করে। তাই এখানে স্মিথের দ্বিতীয় নির্ণায়কটি কাজ করে। অর্থাৎ কোনো পণ্য উৎপাদনে মোট খরচ এর মূল্য নির্ধারণ করে।
বণ্টন
বণ্টন বা বিতরণ নিয়ে স্মিথ কিছুটা এলোমেলো আলোচনা করেছেন। প্রথমেই তিনি ভাড়া বা খাজনা নিয়ে আলোচনা করেছেন। খাজনা হচ্ছে একটি একতরফা অর্থ, যা জমির মালিককে জমি চাষের বিনিময়ে দিতে হয়। স্মিথের মতে, এই খাজনা ব্যবস্থা, কলকারখানার মজুরি বা বেতন পদ্ধতির চেয়ে ভালো। কারণ একজন শ্রমিক কারখানায় শ্রম দিয়ে কেবল নির্দিষ্ট অঙ্কের বেতন লাভ করবে। কিন্তু একই টাকায় যদি সে জমি ভাড়া নিয়ে কাজ করে, তাহলে একই শ্রমে দ্বিগুণ ফল লাভ করতে পারবে, যেহেতু প্রকৃতি তখন শ্রমিককে সহায়তা করবে!
বেতনের ধারণাটি আলোচনা করতে গিয়ে স্মিথ বলেন যে, যখন শ্রমিকের চাহিদা বেশি হবে, তখন বেতন বেড়ে যাবে। আবার যখন শ্রমিকের চাহিদা কমে যাবে, তখন বেতনও কিছুটা কমে যাবে। বিপরীতক্রমে, চাহিদার চেয়ে শ্রমিকের সংখ্যা কম হলে বেতন বাড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। কিন্তু চাহিদার চেয়ে শ্রমিকের সংখ্যা বেশি হলে বেতন অবশ্যম্ভাবীভাবে কমে যায়। এই চাহিদা আবার নিয়ন্ত্রিত হয় পণ্যের মজুদ দ্বারা। যথেষ্ট পণ্য মজুদ থাকলে, নতুন শ্রমিকের প্রয়োজন পড়ে না। মজুদে ঘাটতি হলে, শ্রমিকের চাহিদা সৃষ্টি হয়। এভাবেই একেকটি বিষয় পরস্পরের সাথে আন্তঃসম্পর্কযুক্ত।
লেসে ফেয়ার
“আমাকে আমার মতো থাকতে দাও, আমি নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছি!”
‘লেসে ফেয়ার’ বা অবাধ বাণিজ্য, অর্থনীতির সবচেয়ে আলোচিত বিষয়গুলোর একটি। অবাধ বাণিজ্য কী? অনুপম রায়ের একটি গানের, উপরোক্ত চরণ দুটি এই অবাধ বাণিজ্যেরই মূল কথা বলে। হ্যাঁ, বাজারকে বাজারের মতো থাকতে দিন, বাজার নিজের মতো নিয়ন্ত্রিত হবে। এটাই অবাধ বাণিজ্যের মূল কথা। বাজার অর্থনীতিতে সরকারের কোনোরূপ হস্তক্ষেপের প্রয়োজন নেই, বাজার নিজের রাস্তা নিজেই ঠিক করে নেবে। আর এই ধারণার উৎপত্তিও অ্যাডাম স্মিথের মাথা থেকেই, যিনি মুক্ত অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সমর্থক ছিলেন।
আধুনিককালের অনেক বিশ্লেষক বলেন যে, স্মিথের অর্থনীতি আলোচনার প্রতিটি লাইনই যেন কোনো না কোনো অজুহাত দিয়ে মুক্ত বাজার আর মুক্ত অর্থনীতির কথা বলেছে। তার সকল দর্শন এবং অর্থনৈতিক চিন্তার পেছনে, স্বাধীনতা ও সরকারি হস্তক্ষেপহীনতার কথা বদ্ধমূল। তার মতে, সরকার অর্থনীতি বিকাশের পরিপন্থী। বাজার ও বাণিজ্যের গতিবিধি আপনাআপনিই নিয়ন্ত্রিত হতে পারে। সরকার এতে হস্তক্ষেপ করলেই জটিলতার সৃষ্টি হয়। আর, মোটের উপর সরকারি দুর্নীতি, ঘুষ এবং অব্যবস্থাপনা তো আছেই। অবাধ বাণিজ্যের পক্ষে স্মিথের মূল যুক্তিগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরছি-
- মুক্ত বাণিজ্য সারা দেশে মূলধনের যথার্থ বণ্টন নিশ্চিত করে। কিন্তু সরকারি হস্তক্ষেপ এই বণ্টনে বাধা দেয় এবং মূলধন এক স্থানে আঁটকে থাকে।
- মুক্ত বাণিজ্য শ্রমের স্থানিক বিভাজন সৃষ্টি করে। ফলে দেশব্যাপী সুষমভাবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পায়, যা দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করে।
- যেকোনো শিল্প ও ব্যবসার ক্ষেত্রে ন্যূনতম হস্তক্ষেপও ক্ষতিকর। ব্যবসা নিজেই ঠিক করে নেবে তার গতিপথ, ঠিক যেমনি বহমান নদী তার গতিপথ ঠিক করে নেয়।
- মুক্ত বাণিজ্য ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষা করে। যেকোনো দেশের পণ্যের সহজলভ্যতার কারণে বাজারে সব পণ্যের একটি তুলনামূলক সুলভ দাম স্থির হয়।
অর্থনৈতিক চিন্তা বিকাশের ইতিহাসে অ্যাডাম স্মিথ প্রবাদতুল্য। ১৭২৩ সালের ১৬ জুন, স্কটল্যান্ডের কার্কাল্ডি গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয় এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেন তিনি। গণিত, প্রাকৃতিক দর্শন, নৈতিক দর্শন এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা শেষ করেন। পড়ালেখা শেষ করে গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে নৈতিক দর্শনের অধ্যাপক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন স্মিথ।
১৭৫৯ সালে স্মিথ প্রথম তার আগমনী বার্তা জানান দেন, ‘থিওরি অব মোরাল সেন্টিমেন্টস’ রচনা করে। ১৭৬৪ সালে তিনি স্কটল্যান্ডের ‘ডিউক অব বুক্লেয়াহ’র গৃহশিক্ষক হন। পরের বছর তিনি ডিউকের সাথে ইউরোপ ভ্রমণে বের হন। এই ভ্রমণই তার চিন্তা-ভাবনাকে সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে দেয়। তিনি ফ্রান্সে গিয়ে কুয়েসনে, টারগট, ভলটেয়ারের মতো বিখ্যাত ফিজিওক্র্যাটদের সাথে দেখা করেন। আর তখন থেকেই তার মাথায় ফিজিওক্রেসির ভুত চেপে বসে।
স্কটল্যান্ডে ফিরে তিনি একমনে ‘ওয়েলথ অব নেশনস’ লেখার কাজ শুরু করেন। টানা আট বছর দিন-রাত চিন্তা ভাবনা করে তিনি রচনা করেন এই বিখ্যাত গ্রন্থ। ১৭৭৬ সালে প্রকাশিত এই বইকে তো অনেক সময় ‘বাইবেল অব ইকোনমিকস’ও বলা হয়। এই বই প্রকাশের পরই বিশ্বজোড়া তার প্রশংসা ছড়িয়ে পড়ে। ১৭৭৮ সালে তিনি এডিনবার্গে কাস্টমস কর্মকতা হিসেবে কাজ শুরু করেন। এই কাজ তিনি আমৃত্যু করে যান।
১৭৯০ সালের ১৭ জুলাই, এডিনবার্গে মৃত্যুবরণ করেন এই মহান অর্থনীতিবিদ। ইতিহাসে অর্থনীতির জনক হিসেবে তার নাম চিরভাস্বর হয়ে আছে।
ফিচার ছবি: Adam Smith Institute