আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এমন অনেক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রয়েছে যা আমরা অনেকটাই অবহেলার সাথে ফেলে দেই ডাস্টবিনে। কিন্তু একটু চিন্তা করলে অথবা সচেতন হলে এসব থেকেও তৈরি করা যায় বেশ ব্যবহারোপযোগী কিছু জিনিস। আজ তেমনই এক নিত্যদিনের খাবারের কথা নিয়ে আলোচনা করব, যার অবশিষ্টাংশ দিয়ে তৈরি হতে পারে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রী।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ডিমের কোনো বিকল্প নেই। ডাক্তারের বারণ কিংবা নিরামিষভোজী ছাড়া ডিম পছন্দ করেন না এমন লোকের সংখ্যা নিতান্তই হাতেগোনা। ডিম মানুষের শরীরের প্রোটিন ঘাটতি কমাতে এবং ত্বকের সৌন্দর্যে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মজার ব্যাপার হলো ডিমের ভেতরের অংশটাই আমরা কেবল ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু ডিমের বাইরের অংশেরও রয়েছে নানাবিধ গুণাগুণ।
ডিমে খোসা ছাড়ানোর পদ্ধতি
অনেকেই ভাবতে পারেন, ডিমের খোসা ছাড়ানো আবার কোনো ব্যাপার হলো নাকি? কিন্তু আমাদের অনেকেরই এমনটা হয়েছে যে ডিমের খোসার সাথে ডিমের সাদা অংশের অনেকটা উঠে আসে অথবা ডিমের খোলসটা সহজে উঠে আসতে চাই না। তাই ডিম সিদ্ধ করার জন্যে কিছু সহজ পদ্ধতি রয়েছে। প্রথমে পাত্রে পানি ঢেলে তাতে হাফ টেবিল চামচ বেকিং পাউডার মিশিয়ে দিয়ে ডিম সিদ্ধ হতে দিতে হবে। তাহলে খুব সহজেই ডিমের খোসা উঠে আসবে। আরেকটি পদ্ধতিতে ডিম সিদ্ধ করার সময় যদি পানির সাথে কিছু লবণ মিশিয়ে দেয়া যায় তবে ডিমের শরীরে অনেক ফাটলের সৃষ্টি হবে। তখন ডিমগুলো নামিয়ে ঠান্ডা পানিতে কিছুক্ষণ রেখে ডিমের খোসা তুলে আনতে হবে। দেখবেন ডিম ছাড়াতে কোনো সমস্যাই হচ্ছে না। এছাড়াও ডিম যদি ফ্রিজ থেকে বের করে সরাসরি গরম পানিতে দেয়া যায়, সেক্ষেত্রেও ডিমের খোসা খুব সহজেই ডিম থেকে ছাড়ানো সম্ভব।
ত্বকের পরিচর্যায়
ডিমের খোসা আমাদের ত্বকের যত্নে খুব উপকারী। ত্বকে ব্যবহার উপযোগী করার জন্য একটি ডিমের সাদা অংশের সাথে একটি বা দুটি ডিমের খোসার গুঁড়ো একসাথে মিশিয়ে নিতে হবে। এই মিশ্রণটি ত্বকে মেখে কিছু সময়ের জন্যে রেখে দিতে হবে। তারপর হালকা গরম পানিতে মুখ ধুয়ে ফেলতে হবে। এটি অনেকটাই ফেস ওয়াশের মতোই কাজ করে।
হাড়ের ব্যথা উপশমে
একটি পাত্রে কিছুটা ভিনেগার এবং একটি ডিমের খোসা ভেঙে গুঁড়ো করে নিতে হবে। এবার এটিকে প্রায় দুই দিনের মতো রেখে দিতে হবে যাতে ডিমের খোসাগুলো ভিনেগারের সাথে মিশে যায়। তারপর মিশ্রণটি হাড়ের ব্যথার স্থানে লাগিয়ে নিতে হবে। ডিমের খোসায় থাকে কোলাজেন ও গ্লুকোসামিন যা ভিনেগারের সাথে মিশে শরীরে ব্যথা কমাতে সাহায্য করে।
সাদা কাপড়ের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে
সাদা কাপড়ের উজ্জ্বলতা ফেরাতে আমাদের অনেককেই বিচলিত হতে দেখা যায়। কিছুদিন ব্যবহারের পর সাদা পোশাকে কেন জানি আগের ঔজ্জ্বল্য আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয় না। কিন্তু এই কাজে বেশ সফলতার সাথে কাজ করতে পারে ডিমের খোসা। ডিটারজেন্টের সাথে ডিমের খোসার গুঁড়ো মিশিয়ে তার মধ্যে সাদা কাপড় ভিজিয়ে রাখুন। কিছু সময় পর ধুলেই দেখবেন আগের চাইতে অনেক বেশি উজ্জ্বল দেখাচ্ছে।
মাটির উর্বরতা বাড়ায়
ডিমের খোসার নানাবিধ ব্যবহারের মধ্যে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি অন্যতম। ঘরের ছাদে বা বাড়ির আঙ্গিনায় যদি ছোট একটা বাগান থাকে, তবে সারের বিকল্প হিসেবে খুব সহজেই ব্যবহার করা যায় ডিমের ফেলে দেয়া অংশটি। এছাড়াও ডিমের খোসা গাছের যেকোনো পোকামাকড় দূর করতে খুব কার্যকরী ভূমিকা পালন করে থাকে। আর এজন্য শুধুমাত্র ডিমের খোসা গুঁড়ো করে গাছের চারপাশে ছড়িয়ে দিলেই হলো।
ক্যালসিয়ামের উৎস
ডিমের ভেতরের অংশে যেমন অনেক গুণাগুণ রয়েছে তেমনি এর বাইরের অংশেও প্রচুর গুণ রয়েছে। ডিমের খোসা ক্যালসিয়ামের একটি অন্যতম উৎস। এছাড়াও এতে রয়েছে আয়রন, কপার, ম্যাঙ্গানিজ, জিঙ্ক, ফ্লোরিন, ক্রোমিয়াম এবং মলিবডেনাম। ডিমের খোসা ভালোভাবে সেদ্ধ করে নিয়ে ওভেনে অথবা চুলায় গরম করে নিয়ে এর গুঁড়ো তৈরি করতে হবে। এই গুঁড়ো লেবুর রস অথবা ভিনেগারের সাথে মিশিয়ে সালাদে অথবা বিভিন্ন রান্নায় ব্যবহার করা যেতে পারে।
হাড়ি-পাতিল পরিষ্কারক হিসেবে
ডিমের খোসার আরেকটি কাজ রয়েছে যেটি স্ক্রাবার নামে পরিচিত। রান্নাঘরের বাসনপত্র প্যাকেটজাত পরিষ্কারক দিয়ে পরিষ্কার করতে না চাইলে ডিমের খোসার গুঁড়ো ব্যবহার করলেও বেশ ভালো ফল পাওয়া যাবে।
কফি মিষ্টি করতে
ডিমের খোসার আরেক ধরনের অদ্ভুত ব্যবহার রয়েছে। আমরা অনেকেই কফি পান করতে পছন্দ করি। কিন্তু অনেকেই এর তেতো স্বাদের জন্যে ভালোভাবে পান করতে পারেন না। তাদের জন্য ডিমের খোসার ব্যবহার বেশ কার্যকরী এক উপায়। কফির সাথে ডিমের খোসার গুঁড়ো মিশিয়ে নিলে কফির তেতো স্বাদ অনেকটাই দূর হয়ে যায়।
ড্রেন পরিষ্কার
রান্নাঘরে প্রায় সময়ই একটি সাধারণ সমস্যার কথা গৃহিণীদের কাছ থেকে শুনতে পাওয়া যায়। সেটি হলো রান্নঘরের সিঙ্ক ময়লায় জমে যাওয়া। অনেক কষ্ট করে এই সিঙ্ক পরিষ্কার করতে হয়। এক্ষেত্রে ডিমের খোসা মিহি গুঁড়ো করে ময়লা জমা সিঙ্কের মধ্যে দিয়ে কিছুক্ষণ রাখতে হবে। এরপর উপর থেকে বেশি করে পানি ঢালতে হবে। এতে খুব সহজেই সিঙ্কের পাইপের ময়লা পরিষ্কার হয়ে যাবে।
খোসায় ভাস্কর্য
ডিমের খোসার উপর ভাস্কর্য বা কারুকার্য করতে হলে একটি পূর্ণ ডিম থেকে খুব সাবধানতার সাথে ভেতরের অংশ বের করে নিয়ে আসতে হবে। এরপর ডিমের খোসার উপর খুব সূক্ষ্ম হাতে কারুকাজ করতে হবে। এজন্য প্রথমে পেন্সিল দিয়ে হালকাভাবে নকশা এঁকে নিতে হয়। পরে ধারালো কোনো দন্ড দিয়ে বিভিন্ন জায়গা খোদাই করে বানানো হয় অপরূপ সব কারুকার্য। এছাড়া ডিমের খোসার উপর বিভিন্ন রঙের মোম দিয়ে কারুকাজ করা হয় যা ফিশাংকি নামেও পরিচিত। এসবের বাইরেও ডিমের খোসা ঘরের বিভিন্ন আসবাবপত্র সাজাতে বা ছোট গাছ রাখার জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে যা খুবই দৃষ্টিনন্দন।
ডিম আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি খাদ্যোপাদান। আমাদের খাদ্যতালিকায় ডিমের উপস্থিতি খুব সাধারণ বিষয়। তবে ডিমের ভেতরের অংশটি আমরা খেলেও এর বাইরের অংশটি আমরা খুব অযত্নে ও অবহেলায় ডাস্টবিনে ফেলে দেই। কিন্তু একটু বুদ্ধি খাটিয়ে আমরা ডিমের খোসাও ব্যবহার করতে পারি খুব সহজেই। ডিমের খোসার ব্যবহার তাই পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ফিচার ইমেজ: yndajanecakes.blogspot.com