‘দ্য কোরিয়ান ওয়ার’ ইতিহাসের একটি অন্যতম বর্বর যুদ্ধ। একে ‘দ্য ফরগটেন ওয়ার’ও বলা হয়ে থাকে। কারণ তীব্র ভয়াবহতা সত্ত্বেও মানুষ প্রায় ভুলেই যেতে বসেছে যুদ্ধটির কথা। এই যুদ্ধে প্রায় ৪০,০০০ আমেরিকান সেনা নিহত হয়েছিলো, সাথে আহত হয়েছিলো এক লক্ষেরও বেশি। তবে অনেক সেনাই নিরাপদে ঘরে ফিরতে পেরেছিল, যার পেছনে ‘রেকলেস’ নামের এক ঘোড়ার ছিল অসামান্য অবদান।
চলুন আজ রেকলেসের সেই বীরত্বপূর্ণ ইতিহাস সম্পর্কে জানা যাক।
২৫০ মার্কিন ডলারের ঘোড়া
লেফটেন্যান্ট এরিক পিডারসন ছিলেন পঞ্চম মেরিন রেজিমেন্টের ‘রিকয়লেস রাইফেল প্লাটুন’ এর নেতা। ১৯৫২ সালের ২৬ অক্টোবর তিনি একটি কোরিয়ান ছেলে কিম হুক মুনের কাছ থেকে বাদামী এই ছোট্ট অশ্বশাবকটিকে কিনে নেন। কিমের খুবই কাছের এবং প্রিয় ছিল ঘোড়াটি। কিন্তু তবুও সে তাকে ২৫০ মার্কিন ডলারে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়, কারণ তার টাকার খুব দরকার ছিল। তার বোন একটি ল্যান্ডমাইন দুর্ঘটনার শিকার হয়ে এক পা হারায়। বোনের জন্য একটি কৃত্রিম পা কেনার তাড়নায় কিম তার একমাত্র আদরের সঙ্গীটিকে বিক্রি করে দেয়।
নিয়ে আসার পর তিন বছর বয়সী ঘোড়াটির নাম রাখা হয় প্রথমে ‘ফ্লেম অব দ্য মর্নিং’ বা প্রভাতের অগ্নিশিখা। তাকে মূলত রিকয়লেস (গুলি ছোঁড়ার সময় পেছনে ধাক্কা মারে না এমন) রাইফেল বহন করার জন্য কেনা হয়েছিলো। আর এ ধরনের রিকয়লেস রাইফেলকে তখন ‘রেকলেস রাইফেল’ ডাকা হতো। কারণ এই শক্তিশালী রাইফেলগুলো ধ্বংস করতে পারতো ট্যাংক, বাংকার। এতে ব্যবহৃত একটি শেলের ওজনই ছিল প্রায় ১১ কেজি। তাই এই রেকলেস রাইফেল বহন করার কাজে নিযুক্ত ছোট্ট এই ঘোড়াটির নামই পরবর্তীতে রেকলেস রাখা হয়।
যুদ্ধের প্রশিক্ষণ
সার্জেন্ট জো লাথাম ছিলেন একজন অভিজ্ঞ অশ্বারোহী। রেকলেসের প্রশিক্ষণের ভার তার উপরেই অর্পণ করা হয়। তিনি রেকলেসকে ঘোড়াদের প্রশিক্ষণকেন্দ্র ‘হুফ ক্যাম্প’ এ নিয়ে আসেন এবং বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করেন। তিনি তাকে শিক্ষা দেন কীভাবে একটি জিপ-ট্রেলারে লাফ দিয়ে বেরোতে এবং ঢুকতে হবে। বিভিন্ন কাঁটাতারের বেড়া এবং যোগাযোগের লাইন সফলভাবে পার হওয়া, গোলাগুলির সময়ে শুয়ে পড়া, গোলাগুলি এবং রিকয়লেস রাইফেলের তীব্র শব্দের সাথে অভ্যস্ততা তৈরি, বাংকারে সুযোগ বুঝে দৌড় দিয়ে আশ্রয় নেয়া এবং ‘ইনকামিং’ বলে চিৎকার দিলে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ার মতো প্রশিক্ষণও তাকে দেয়া হয়।
তাদের দুজনের মধ্যকার সম্পর্ক এতটাই গভীর হয়ে পড়ে যে, জো পরবর্তীতে শুধু হাত উঁচু করে সংকেত দিলেই রেকলেস কী করতে হবে সব বুঝে যেত। যুদ্ধক্ষেত্রে রেকলেসের মূল কাজ ছিল গোলাবারুদ পৌঁছে দেয়া এবং পরে নিজেই একা একা ফেরত আসা। সৈন্য যেখানেই থাকুক না কেন রেকলেস নিজেই খুঁজে বের করতে পারতো তাদের অবস্থান।
যুদ্ধক্ষেত্রে রেকলেস
১৯৫৩ সালে মার্চের ২৬ থেকে ২৮ তারিখে সংঘটিত কোরিয়ান ওয়ারের ‘দ্য ব্যাটল অব আউটপোস্ট ভেগাস’ ছিল সবচাইতে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। রেকলেসের জন্য এই যুদ্ধই ছিল সবচাইতে উল্লেখযোগ্য। কারণ এ যুদ্ধেই সে একটি ‘যোদ্ধা ঘোড়া’ হিসেবে পরিচিতি পায়। শুধুমাত্র একদিনেই সে মোট ৫১ বার যাতায়াত করেছে গোলাবারুদ মজুত স্থান থেকে যুদ্ধক্ষেত্রে। তার এই যাত্রায় সে ৩৮৬ রাউন্ড গুলি বহন করেছে। শত্রুদের গোলাগুলির ভেতরেই তাকে এত ভারি ভারি জিনিস নিয়ে দৌড়াতে হয়েছে ধানক্ষেতের মাঝখান দিয়ে, ৪৫ ডিগ্রি কোণাকৃতি পাহাড় বেয়েও উঠতে হয়েছে। ফেরত আসার সময় প্রায়ই তাকে পিঠে করে আহত সৈন্যও বহন করে নিয়ে আসতে হয়েছে। বেশিরভাগ সময়েই তাকে একা একাই এ রকম যাতায়াত করতে হয়েছে। এমনকি দু’বার গায়ে গুলি লাগা সত্ত্বেও সে ঠিকমতোই নিজের কাজ সম্পন্ন করেছে।
এই যুদ্ধে তার এমন সাহসিকতা, বুদ্ধিমত্তা এবং অবদানের জন্য সে সকলের শ্রদ্ধা, সম্মানের পাশাপাশি র্যাংকেও পদোন্নতিপ্রাপ্ত হয়। সে হয়ে যায় সার্জেন্ট রেকলেস। মেরিন সেনারা তাকে এতটাই ভালবাসতো যে মাঝে মাঝে ভারি গোলাগুলির সময় তারা নিজেদের গায়ের ফ্ল্যাক জ্যাকেট খুলে রেকলেসের গায়ে জড়িয়ে দিতো। নিজেদের জীবন ঝুঁকির মাঝে ফেলেও তারা চাইতো রেকলেস বেঁচে থাক।
পেটুক রেকলেস
রেকলেস তার অসাধারণ বীরত্বের পাশাপাশি আরেকটি বৈশিষ্ট্যের কারণে বেশ পরিচিতি লাভ করে। তা হচ্ছে তার দুর্নিবার ক্ষুধা! এমন কিছু ছিল না যা সে খেত না। সে মাঝে মাঝে সেনা হলে প্রবেশ করতো নিজে থেকেই এবং সামনে যা পেত তাই গপাগপ খেতে শুরু করতো। ডিম ভাজি এবং কফি ভেজানো বেকন খেতে সে খুবই ভালবাসতো। পাশাপাশি প্যানকেক, হারশে বার, কেক, পিনাট বাটার স্যান্ডউইচ, কাটা গম, আলু ভর্তা এবং কোকাকোলাও ছিল তার পছন্দের খাবারের তালিকায়।
অন্যান্য মেরিন সেনাদের সাথে সে বিয়ার পান করতেও পছন্দ করতো। এমনকি সেনারা কয়েকবার তাকে বিয়ার খাইয়ে মাতালও বানিয়েছিল! এসবের পাশাপাশি সে পোকার খেলার চিপস, কম্বল, জামাকাপড় এমনকি সেনাদের টুপিও চিবিয়ে শেষ করে ফেলতো যদি তার মনে হতো কেউ তাকে উপেক্ষা করছে বা তার প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ দেয়া হচ্ছে না!
অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী
রেকলেসের আচার ব্যবহারে বোঝা যেত ওর ছিল নিজস্ব বুদ্ধিমত্তা, খেয়াল এবং মন-মানসিকতা। ডক্টর রজারস তার কথায় রেকলেসের কিছু অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেন। তিনি বলেন,
“মাঝে মাঝে আমরা কয়েকজন দলবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করতাম। রেকলেস তখন আমাদের দেখে কাছে চলে আসতো এবং আমাদের সাথে দাঁড়িয়ে থাকতো। যখন কেউ কথা বলতো তখন সে তার দিকে তাকিয়ে থাকতো। অন্য কেউ কথা বলে শুরু করলে সে মুখ ফিরিয়ে তার দিকে তাকাতো। এরপর আবার অপর কেউ কথা বললে সে তার দিকে ফিরতো। তাকে দেখে মনে হতো সে যেন বোঝানোর চেষ্টা করছে, “হেই, আমিও মেরিন, তোমাদেরই একজন।”
তিনি আরেকটি ঘটনার অবতারণা করে বলেন-
“একদিন রাতে আমরা সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলাম। আমাদের সাথে লেফটেন্যান্ট লুই নামে একজন মেরিন লেফটেন্যান্টও ছিলেন। কথা বলার এক পর্যায়ে রেকলেস একজন সেনার পেছনে নিঃশব্দে এসে দাঁড়ায়। এসে সেই সেনার ঘাড়ের পেছনটা খুঁটতে শুরু করে। আচমকা এমন হওয়ায় সেনাটি চমকে গিয়ে ভয়ে প্রায় আধমরা হয়ে যায়। পেছন ফিরে তাকালে রেকলেসের সাথে সে মুখোমুখি হয়। চিৎকার দিয়ে বলে ফেলে, “এই পাগলা ঘোড়াটিকে কেউ সরিয়ে ফেল এখান থেকে!”
লেফটেন্যান্ট লুই সেনাটির এমন ব্যবহারে রাগে ফেটে পড়েন। বলেন,
“এই ঘোড়াটি আমেরিকান মেরিন কর্প-এ তোমার থেকেও বেশি অবদান রেখেছে। বাকি জীবনটা মেরিনে কাটিয়ে দিলেও তুমি এই প্রাণীটির অবদানের ধারে কাছেও আসতে পারবে না। এছাড়াও রেকলেস তোমার থেকে পদমর্যাদাতেও উঁচুতে। এরপর যদি কখনো শুনি তুমি ঘোড়াটির সাথে এমনভাবে কথা বলছো, আমি তোমার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ আনবো এবং কোর্টমার্শাল করবো।”
এ থেকেই বোঝা যায় রেকলেস কতটা প্রিয় হয়েছিল সকলের।
বাকি জীবন
রেকলেস তার অবদানের জন্য দুইটি ‘পার্পল হার্ট’ পেয়েছিল, যা মেরিনে বরাদ্দকৃত সর্বোচ্চ পদক। এছাড়াও সে গুড কন্ডাক্ট মেডেল, তারকাখচিত প্রেসিডেন্সিয়াল ইউনিট সাইটেশন, ন্যাশনাল ডিফেন্স সার্ভিস মেডেল, কোরিয়ান সার্ভিস মেডেল, ইউনাইটেড ন্যাশনস সার্ভিস মেডেল, নেভি ইউনিট কমেন্ডেশন এবং রিপাবলিক অফ কোরিয়া প্রেসিডেন্সিয়াল ইউনিট সাইটেশনও পেয়েছিল। এতসব পদক সে তার জন্য তৈরিকৃত লাল এবং সোনালী রঙের কম্বলে সাজিয়ে নিয়ে পরেছিল।
১৯৫৩ সালের ২৭ জুলাই যুদ্ধ শেষ হবার পর অনেক মেরিন সেনা অনুরোধ করেছিল রেকলেসকে যেন যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে সরকারি তহবিল থেকে অনুমতি দেয়া হয়নি, কারণ রেকলেস ছিল বিদেশী ঘোড়া। কিন্তু প্যাসিফিক ট্রান্সপোর্টের ভাইস প্রেসিডেন্ট স্ট্যান কপেল যখন জানতে পারেন রেকলেস সম্পর্কে, তখন তিনি রাজি হন রেকলেসকে বিনামূল্যে তার যেকোনো একটি জাহাজে করে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যেতে। ফলে ১৯৫৪ সালের ১০ নভেম্বর রেকলেস যুক্তরাষ্ট্রে পদার্পণ করে। সেখানে তাকে একজন বীরের মর্যাদায় গ্রহণ করা হয়।
দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার মেরিন কর্পস বেজ ক্যাম্পের একটি আস্তাবলে সে বাকি জীবন কাটায়। এ সময় তাকে একটি কম্বল ছাড়া আর কিছুই পিঠে নিতে হয়নি। বছরখানেকের মধ্যেই তার সাথে প্রায় হাজারখানেক মানুষ দেখা করতে আসছিল। যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা অনেক সেনাও পরবর্তীতে তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে রেকলেসের সাথে সাক্ষাৎ করতে এসেছিলেন। মাঝে মাঝে সে বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানেও অংশ নিতো। ১৯৫৯ সালের ৩১ আগস্ট জেনারেল প্যাট রেকলেসকে স্টাফ সার্জেন্ট হিসেবে স্বীকৃতি দেন।
মৃত্যু
রেকলেস মোট চার সন্তানের মা হয়, যার মধ্যে তিনটির নাম রাখা হয় ফিয়ারলেস বা অকুতোভয়, ডন্টলেস বা দুর্বার এবং চেস্টি বা একগুঁয়ে। কিন্তু তার শেষ বাচ্চাটি জন্মের মাত্র এক মাসের মাথায় মারা যায়। তাই তার কোনো নাম রাখা হয়নি। ১৯৬৮ সালের ১৩ মে, রেকলেস এক কাঁটাতারে জড়িয়ে গেলে মারাত্মকভাবে জখম হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থাতেই তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ১৯-২০ বছর। মৃত্যুর পর পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় তাকে দাফন করা হয়। ১৯৯৭ সালে লাইফ ম্যাগাজিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ১০০ জন বীরের তালিকায় রেকলেসকেও স্থান দেয়। রবিন হুটোন ২০১৪ সালে ‘Sgt Reckless: America’s War Horse‘ নামে রেকলেসকে নিয়ে একটি বইও বের করেন।
রেকলেসের মেরিনে যোগদান করার ঠিক ৬৩ বছর পর, ২০১৬ সালের ২৬ অক্টোবর পেন্ডলটন ক্যাম্পে ১,৬৫,০০০ মার্কিন ডলার মূল্যের একটি ভাস্কর্যের উন্মোচন করা হয়। কারণ কোরিয়ার সেই যুদ্ধের কথা সবাই ভুলতে বসলেও আকারে ছোট কিন্তু হৃদয়ে বড়, সাহসী এবং নির্ভীক রেকলেস নামের ছোট্ট ঘোড়াটির গল্প সকলের জানার এবং মনে রাখার প্রয়োজন রয়েছে। তার স্মৃতি রক্ষার্থে এই ভাস্কর্য সবাইকে মনে করিয়ে দেবে রেকলেস কোনো সাধারণ ঘোড়া ছিল না, সে ছিল একজন মেরিন!
ফিচার ইমেজ: bigcommerce.com