Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বাংলার বিস্মৃতপ্রায় গর্ব রাধাগোবিন্দ চন্দ্র

রাধাগোবিন্দ চন্দ্র ছিলেন একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী, যার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি ছিল না। ছিল না কোনো বড় সার্টিফিকেট। কিন্তু কেবলমাত্র নিজের ইচ্ছায় ভর করে তিনি নাম লিখিয়েছিলেন ইতিহাসের পাতায়। সাধনা নামক জিনিসটি থাকলে শত প্রতিবন্ধকতার মাঝেও যে মানুষ অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারে তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তিনি।

১৮৭৮ সালের ১৬ ই জুলাই তিনি জন্মগ্রহণ করেন যশোর জেলার বকচর গ্রামে। বাবা গোরাচাঁদ ছিলেন স্থানীয় একজন ডাক্তারের সহকারী। মা পদ্মামুখ ছিলেন গৃহিণী। ছোটবেলায় সমবয়সী অন্যান্যদের মতোই তিনি ছিলেন খানিকটা দুরন্ত। বিদ্যালয়ের পড়াশোনায় কিছুটা অমনোযোগী। কিন্তু যে জিনিসটিতে রাধাগোবিন্দ অন্য সকলের চেয়ে আলাদা ছিলেন সেটি হলো আকাশের প্রতি আগ্রহ। মামার বাড়ির লাইব্রেরিটা ছিল তার সবচে’ প্রিয় জায়গা। কত ধরনের বই সেখানে! আর মামার বাড়ির ছাদে দাড়িয়ে আকাশ দেখতে কী যে আনন্দ!

মামার বাড়ির একজনের কাছে তার সব প্রশ্ন আর কৌতূহল। তিনি তার দিদা, সারদা সুন্দরী ধর, এর কোলে শুয়ে রাতের আকাশ দেখতেন। পর্যবেক্ষণ জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রতি তার আগ্রহের পটভূমি রচিত হয় সেই থেকেই।

দশ বছর বয়সে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন যশোরের জিলা স্কুলে। ষষ্ঠ শ্রেণীতে তার পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে বিজ্ঞানী অক্ষয় কুমার দত্তের লেখা চারুপাঠ বইতে ‘ব্রহ্মাণ্ড কী প্রকাণ্ড!’ প্রবন্ধটি তাকে বেশ আলোড়িত করেছিল। এ প্রবন্ধ তার জ্যোতির্বিজ্ঞান পড়ার প্রতি আগ্রহ আরো তীব্র করে তোলে। এই ব্রহ্মাণ্ডের কোথায় আদি আর কোথায়ই বা অন্ত- এ প্রশ্ন তাকে স্বপ্নবিভোর করে তোলে। তার নিজের রচিত পাণ্ডুলিপিতে তিনি লিখেছেন-

অক্ষয়কুমার দত্তের চারুপাঠ তৃতীয় ভাগ পড়িয়া, নক্ষত্রবিদ হইবার জন্যে আর কাহারো বাসনা ফলবর্তী হইয়াছিল কিনা জানি না, আমার হইয়াছিল। সেই উদ্দাম ও উচ্ছৃঙ্খল বাসনার গতিরোধ করিতে আমি চেষ্টা করি নাই।

কিন্তু এই স্বপ্নবিভোরতা তাকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে পিছিয়ে দেয়। জিলা স্কুল থেকে এন্ট্রান্স দিলেন, পাশ করতে পারলেন না। তিন তিন বার চেষ্টার পরেও ব্যর্থ হলেন। এরপর ১৮৯৯ সালে ২১ বছর বয়সে তিনি বিয়ে করেন ৯ বছর বয়স্কা মুর্শিদাবাদের মেয়ে মোহিনীকে। বিয়ের পর তিনি আরেকবার এন্ট্রান্স দেওয়ার চেষ্টা করেন। এবার তিনি পড়াশোনার পাট শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। কারণ সাংসারিক দায়িত্ব তখন তার হাতে। মাত্র ১৫ টাকা বেতনে তিনি যশোর কালেক্টরেট অফিসে খাজাঞ্চির চাকরি নেন।

কিন্তু তার আকাশ দেখা থেমে থাকে না। সে সময়ে যশোরের আইনজীবী কালীনাথ মুখোপাধ্যায় তাকে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চায় সাহায্য করেন। কালীনাথ মুখোপাধ্যায় নিজে আইনজীবী হলেও তার মূল আগ্রহ ছিল আকাশচর্চায়। সংস্কৃতে ‘খগোলচিত্রম’ বাংলায় ‘তারা’ এবং ইংরেজিতে ‘পপুলার হিন্দু এস্ট্রোনমি’ নামে তিনি কিছু বই লিখেন যা সে সময়ের জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান। উল্লেখ্য, সংস্কৃতে খগোল অর্থ জ্যোতিষ্কমণ্ডল। কালীনাথবাবু তার নিজের নক্ষত্র মানচিত্রটি (স্টার ম্যাপ) দিলেন রাধাগোবিন্দকে। এতে তারা দেখতে সুবিধা হয় তার। চাকরির কাজ শেষে সন্ধ্যে হলেই তিনি উঠে যেতেন ছাদে। স্টারম্যাপ কাজে লাগিয়ে চেনার চেষ্টা করতেন নক্ষত্রগুলোকে। কখনো কখনো সফল হতেন আবার কখনো হতেন না। তবে কোনো যন্ত্রপাতি বা কোনো শিক্ষক ছাড়াই খালি চোখে আকাশ দেখে তারা চেনা শুরু করেছিলেন তিনি।

এর বেশ কিছুদিন পরের কথা। তিনি নিজে গিয়ে ‘খগোলচিত্রম’ আর ‘তারা’ বই দুটি কিনে নিয়ে আসেন। সাথে নিয়ে আসেন অল্প দামের একটি বাইনোকুলার। সামান্য এই বাইনোকুলার দিয়েই তিনি দেখেন হ্যালির ধূমকেতু। ধূমকেতু বস্তুতই তার জীবনে ধূমকেতুর ন্যায় পরিবর্তন এনে দিয়েছিল। ধূমকেতুর বর্ণনা তিনি লিপিবদ্ধ করে রাখেন যা বিস্তারিত আকারে পরবর্তীতে হিন্দু পত্রিকায় ছাপা হয়। সে সময় ধীরে ধীরে রাধাগোবিন্দ কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকায় ছোট ছোট প্রবন্ধ পাঠাতে থাকেন। তার সেসব লেখা শান্তিনিকেতনের শিক্ষক জগদানন্দ রায়ের চোখে পড়লে তিনি রাধাগোবিন্দের কাছে প্রশংসাসূচক চিঠি লিখেন এবং তাকে একটি ভালো মানের দূরবীক্ষণ যন্ত্র কিনতে পরামর্শ দিলেন।

রাধাগোবিন্দ চন্দ্র; ছবিসূত্র: jessore.info

কাজের এটুকু স্বীকৃতি পেয়ে উৎসাহিত হলেন রাধাগোবিন্দ। নিজের সামান্য কিছু জমি বিক্রি করে ২৭৫ টাকা দিয়ে একটি তিন ইঞ্চি ব্যাসের দূরবীক্ষণ যন্ত্র কিনলেন। ১৯১২ সালের সেপ্টেম্বরে দূরবীক্ষণ যন্ত্রটি ইংল্যান্ড থেকে মেসার্স কক্স শিপিং এজেন্সি লিমিটেডের মাধ্যমে রাগাগোবিন্দের কাছে এসে পৌঁছায়। স্বল্প আয়ের রাধাগোবিন্দকে খুব হিসেব করে চলতে হতো। জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চায় তার যা ব্যয় হতো তা লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। সম্পূর্ণ যন্ত্রটির দাম পড়েছিল ১৬০ টাকা ১০ আনা ৬ পাই। প্রথমে মূল দূরবীনটির টিউব ছিল কার্ডবোর্ডের তৈরি যা পরে তিনি ইংল্যান্ডের মেসার্স ব্রহার্স্ট এণ্ড ক্লার্কসন থেকে পিতলের টিউব আনিয়ে নেন অতিরিক্ত ৯৬ টাকা ১০ আনা খরচ করে। পাশাপাশি এর উন্নতিও সাধন করে নেন। আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন-

সন ১৩১৯ সালের আশ্বিন মাসে দুরবিন আসার পরে আমার নক্ষত্রবিদ্যা অনুশীলনের ৪র্থ পর্ব আরম্ভ। এই সময়ে আমি কালীনাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘খগোলচিত্রম’ ও ‘তারা’ পুস্তকের সাহায্যে এটা-ওটা করিয়া যুগল নক্ষত্র, নক্ষত্র-পুঞ্চ নীহারিকা, শনি, মঙ্গল প্রভৃতি গ্রহ দেখিতাম। পরে জগদানন্দ রায়ের উপদেশ মত স্টার অ্যাটলাস এবং ওয়েব’স সিলেসিয়াল অবজেক্ট ক্রয় করিয়া যথারীতি গগন পর্যবেক্ষণ করিতে আরম্ভ করি। কিন্তু ইহাতেও আমার কার্য্য বেশীদূর অগ্রসর হয় নাই। তবে আমি এই সময়ে গগনের সমস্তরাশি নক্ষত্র ও যাবতীয় তারা চিনিয়া লইয়াছিলাম এবং কোনো নির্দিষ্ট তারায় দুরবিন স্থাপনা করিতে পারিতাম।

এরপর থেকে নতুন উদ্যমে তিনি পর্যবেক্ষণ করে চললেন ভ্যারিয়েবল স্টারদের। মহাকাশে কিছু তারা রয়েছে যাদের ঔজ্জ্বল্য নিয়ত পরিবর্তনশীল। এদেরকে বলে ভেরিয়েবল স্টার। ‘আমেরিকান এসোসিয়েশন অব ভ্যারিয়েবল স্টারস অবজারভারস’ বা এভসোর দেয়া তথ্য অনুযায়ী এখন পর্যন্ত মোটামুটি দেড় লক্ষের মতো ভ্যারিয়েবল স্টারের সন্ধান মিলেছে। রাধাগোবিন্দ ভ্যারিয়েবল স্টারদের বাংলা নাম দিয়েছিলেন ‘বহুরূপ তারা’।

আকাশ দেখতে দেখতে এলো ১৯১৮ সালের ৭ই জুন। অন্যদিনের মতোই রাধাগোবিন্দ বহুরূপ তারাদের পর্যবেক্ষণ করছিলেন। কিন্তু সেদিনকার আকাশটা অন্যদিনের চেয়ে বেশি উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল। কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলেন না এই উজ্জ্বলতার উৎস ঠিক কোথায়। উৎসটা ঠিক কী এটা নিয়ে তার মনে যখন গজিয়ে উঠছে নানা প্রশ্ন, সে সময় তিনি আকাশে ঝলমলে একটি তারা দেখতে পান এবং সেটিকে দেখামাত্র পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করেন। ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার পর তিনি বুঝতে পারেন আসলে ঐ উজ্জ্বল তারাটি একটি নোভা যার নাম পরে দেয়া হয় ‘নোভা একুইলা ১৯১৮’ বা ‘নোভা একুইলা ৩’।

প্রবাসী পত্রিকাতে তিনি এটি নিয়ে লেখালেখিও করেন। আবার জগনানন্দ রায়ের উপদেশে রাধাগোবিন্দ তার লিপিবদ্ধ বিস্তারিত বিবরণ পাঠিয়ে দেন হার্ভার্ড মহাকাশ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের চার্লস পিকারিং এর কাছে। তখনকার দিনে যাতায়াতের সুব্যবস্থা না থাকার ফলে সে চিঠি পৌঁছাতে অনেক সময় লেগে যায়। কিন্তু হার্ভার্ড পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের কর্তৃপক্ষ তাকে অভিনন্দন জানায় এবং বেশ কিছু তারা মানচিত্র ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপর বই পাঠিয়ে তাকে সম্মানিত করেন। চিঠিতে হার্ভার্ড মহাকাশ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের পরিচালক হারলো শ্যাপলি অভিনন্দন জানিয়ে বলেছিলেন

বিদেশ থেকে পরিবর্তনশীল নক্ষত্র সম্পর্কে আমরা যেসব পর্যবেক্ষণমূলক তথ্য পেয়ে থাকি তার মধ্যে আপনার দান অন্যতম। আপনাকে আমরা আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।

এরপর আমেরিকান এসোসিয়েশন অব ভ্যারিয়েবল স্টার অবজার্ভার এর সদস্য করে নেয়া হয় তাকে। ১৯২৬ সালে চার্লস এলমার এভসো থেকে তাকে একটি ৬ ইঞ্চি টেলিস্কোপ উপহার দেন। এলমারের দেওয়া সে টেলিস্কোপটি তার মৃত্যুর পরে দক্ষিণ ভারতীয় জ্যোতির্বিদ ভেইনু বাপ্পুর কাছে কিছুদিন থাকার পর এখন পরম যত্নে রাখা আছে দক্ষিণ ভারতের কাভালুর মানমন্দিরে।

এরপরে ফরাসি সরকার ভ্যারিয়েবল স্টারের উপর তার পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে, ১৯২৮ সালে তাকে OARF (Officers Academic republican francaise) সম্মানসূচক উপাধি ও পদক প্রদান করেন। কলকাতায় ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত মারফত তাকে এ সম্মান জানানো হয়। এর আগে কোনো বাঙ্গালি ফ্রান্স সরকারের এমন সম্মান অর্জন করার সৌভাগ্য লাভ করেননি। তাকে সদস্য করে নেয়া হয় Association francaise des Observateurs d’etoiles Variables (AFOEV) এবং ব্রিটিশ এস্ট্রোনমিক্যাল এসোসিয়েশনে।

১৯২০ থেকে ১৯৫৪ সালের ভেতর প্রায় ৩৮ হাজার ভ্যারিয়েবল স্টার পর্যবেক্ষণ করে এ সমস্ত সংগঠনকে তার পর্যবেক্ষণ সম্বন্ধে জানান। এত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও একজন বাঙালি জ্যোতির্বিদের এমন অসাধারণ কর্মকে বিশ্ব নতশিরে সম্মান জানায়।

দেশে-বিদেশে তার অসাধারণ কীর্তি নিয়ে তাকে প্রশংসার জলে ভাসানো হলেও শেষ জীবনটা তার কেটেছিল অনেক দারিদ্র্য আর অবহেলার মধ্য দিয়ে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তিনি ভারতে চলে যান। আভসো থেকে পাঠানো সেই টেলিস্কোপটি বেনাপোল স্থলবন্দর থেকে কর্মকর্তারা তার কাছ থেকে কেড়ে রেখে দেয়। পরে যদিও যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স সরকারের সাথে যোগাযোগের পর যশোরের জেলা প্রশাসক নিজে গিয়ে তার বাড়িতে টেলিস্কোপটি তাকে ফেরত দিয়ে আসেন।

ভারতে যাওয়ার পর তিনি যথেষ্ট আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে পড়েন। অভাব অনটনে খাবারের সংস্থান করতেও তার সংগ্রাম করতে হতো। বারাসাতের দুর্গাপল্লীতে ১৯৭৫ সালে ৯৭ বছর বয়সে প্রায় বিনা চিকিৎসায় তিনি মারা যান। মৃত্যুর সময় তার প্রায় সমস্ত বইপত্র এবং তিন ইঞ্চির সেই দূরবীক্ষণ যন্ত্রটি তিনি দান করে দিয়ে যান বারাসাতের সত্যভারতী বিদ্যাপীঠে। কোনোরকম ডিগ্রি বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই তিনি যে প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার সাথে সকল সীমাবদ্ধতার মধ্যেও জ্যোতির্বিজ্ঞানে অসামান্য অবদান রেখেছেন এর জন্যে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন আমাদের হৃদয়ে।

তথ্যসূত্র

  1. Rajesh Kochhar and Jayant Narlikar, Astronomy in India: Past, Present and Future (IUCAA, Pune and IIA, Bangalore, 1993)
  2. Otto Struve and Velta Zebres, Astronomy in the 20th Century (Macmillan Co., New York, p. 354, 1962)
  3. Nature, Vol. 107, No. 2700, p. 694 (1921)
  4. Monthly Reports and Annual Reports of the American Association of Variable Star Observers, p. 133 (1926)
  5. বিজ্ঞান সাধক রাধাগোবিন্দ, অমলেন্দু বন্দোপাধ্যায়
  6. বাংলার জ্যোতির্বিদ রাধাগোবিন্দ চন্দ্র- নাঈমুল ইসলাম অপু
  7. তিন অবহেলিত জ্যোতিষ্ক- রণতোষ চক্রবর্তী

ফিচার ছবি- সম্পাদিত

Related Articles