চারিদিকে যখন আধুনিক পুঁজিবাদের জয়গান ঠিক সেই সময়ে তিনি দেখিয়েছেন এই সমাজ ব্যবস্থার অসংগতিগুলো। পুঁজিপতি এবং শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যকার শ্রেণী বৈষম্যের দিকে আঙ্গুল তুলেছেন তিনি। পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি সম্পত্তি মাত্র এক শতাংশ পুঁজিপতিদের দখলে থাকার নির্মম সত্য উঠে এসেছে তার লেখায়। শ্রমজীবী মানুষের দুঃখ, কষ্ট, হাহাকার, দারিদ্রের কষাঘাতের মতো বিষয়গুলো নিয়ে আজীবন কাজ করেছেন তিনি। আধুনিক পুঁজিবাদের এক কট্টর সমালোচক এই ব্যক্তি হলেন কার্ল মার্ক্স।
জন্ম এবং ব্যক্তিগত জীবন
কার্ল মার্ক্স ১৮১৮ সালে জার্মানির ট্রিয়র শহরে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মসূত্রে ইহুদিদের পণ্ডিত সম্প্রদায়ভুক্ত হলেও জার্মান সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য মার্ক্সের বয়স যখন মাত্র ৬ বছর তখন তার পুরো পরিবারই খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে। বন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনাকালে মার্ক্স দেনায় জর্জরিত হয়ে পড়েন। মদ্যপান এবং দ্বন্দ্ব-কলহে লিপ্ত হওয়ার কারণে তাকে হাজতবাসও করতে হয়। ইচ্ছা ছিল, একজন নাট্য সমালোচক হবেন। কার্লের উপর ত্যাক্ত -বিরক্ত হয়ে তার পিতা তাকে কঠিন অনুশাসনের বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পাঠিয়ে দেন। সেখানে তিনি ভিড়ে যান একদল ‘তরুণ হেগেলিয়ান’দের সংশয়বাদে বিশ্বাসী দলে।
কার্ল মার্ক্স পরবর্তীতে শ্রেণী ব্যবস্থা এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে অবিশ্বাসীদের ছোট একটি বুদ্ধিজীবীদের দলে যোগ দেন। দলটির নাম- কমিউনিস্ট পার্টি। এই দলের একজন গোপন সাংবাদিক দিসেবে কাজ করার সময় জেনি ভন নামের অভিজাত এক মহিলার সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন তিনি। রাজনৈতিক কারণে জার্মানি থেকে পালাতে হয় তাদের। পরবর্তীতে লন্ডনে বসবাস শুরু করেন তারা।
লেখনী
কার্ল মার্ক্স মূলত পুঁজিবাদের উপরে প্রচুর বই এবং প্রবন্ধ লিখেছেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-
- ক্রিটিক অব হেগেল’স ফিলসফি অব রাইট (১৮৪৩)
- ইকোনমিক অ্যান্ড ফিলসফিক ম্যানাসক্রিপ্টস (১৮৪৪)
- দ্য হলি ফ্যামিলি (১৮৪৫)
- থিসিস অন ফয়েরবাক (১৮৪৫)
- দ্য জার্মান ইডিওলজি (১৮৪৫)
- দ্য কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো (১৮৪৮)
- ক্রিটিক অব দ্য গোথা প্রোগ্রাম (১৮৭৫)
- দ্য ভেরি লং ক্যাপিটাল (১৮৬৭-৯৪)
লেখালিখির ক্ষেত্রে তিনি তারই বন্ধুপ্রতিম ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস এর সাথে বেশ কিছু কাজ করেছেন।
জীবিতাবস্থায় জনপ্রিয়তা না পেলেও পরবর্তীতে কার্ল মাক্সের ধারণাগুলো সমগ্র পৃথিবীজুড়েই ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। পশ্চিমা পুঁজিবাদ নিয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী এবং রক্ষণশীল। মৃত্যু পরবর্তীকালীন কয়েক যুগ পর থেকে শুরু করে এমনকি বর্তমান সময়েও মার্ক্স প্রবর্তিত ধারণাগুলো নিয়ে সমালোচকদের আগ্রহের কমতি নেই। তার লেখায় ‘পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা’ নিয়ে বেশ কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা উঠে এসেছে। আজ তারই কয়েকটি নিয়ে আলোচনা করা হবে।
আধুনিক পুঁজিবাদ প্রচণ্ড স্বার্থপর
কাজের ব্যাপারে কার্লের ধারণা ছিল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। আধুনিক উৎপাদনমুখী যান্ত্রিক কর্মজীবনকে তিনি আজীবন ঘৃণা করেছেন। তিনি লিখেছেন-
শ্রমিকদের কাজ বা শ্রমের মধ্যে সৃজনশীলতা বিষয়টি থাকা আবশ্যক। যিনি যে কাজটি করছেন, সেই কাজের মধ্যে তার ব্যক্তিত্বের প্রতিফলন থাকা উচিত।
এই বিষয়টির ব্যাখ্যা হিসেবে তিনি বলেন, শ্রম আমাদের মনন, যুক্তি, সৃজনশীলতা, কাঠিন্যের বহিঃপ্রকাশের মাধ্যমে আমাদের নিজস্ব সত্তা থেকে সম্পূর্ণ পৃথক এক ‘স্বাধীন এবং সহজাত’ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন পণ্য অথবা সেবার ক্ষেত্র তৈরি করে। এক্ষেত্রে আমাদের দক্ষতার দিকটা কাজে আসে বলেই আমরা প্রতিনিয়ত সেই বিশেষ জায়গাটিতে উন্নতি করি।
উদাহরণস্বরূপ, তিনি একজন কাঠমিস্ত্রির একটি চেয়ার তৈরি করার কথা বলেছেন। চেয়ার সাধারণত একটি শক্ত, মজবুত এবং কাঠের তৈরি বসার স্থান। এক্ষেত্রে চেয়ারের বৈশিষ্ট্য কাঠমিস্ত্রির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন হতে পারে। কাঠমিস্ত্রিটি হতে পারেন কোনো নরম স্বভাবের মানুষ অথবা বদমেজাজি কোনো ব্যক্তি। এক্ষেত্রে চেয়ারটি ঐ ব্যক্তির ‘ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা’ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং ব্যক্তির বিশেষ পারঙ্গমতার ফলাফল হিসেবে তৈরি হচ্ছে। কাজের ক্ষেত্রে কার্ল মার্ক্সের দৃষ্টিভঙ্গি এমনই ছিল। তিনি তার বিভিন্ন লেখায় তুলে ধরেছেন কিভাবে আধুনিক উৎপাদনমুখী কর্ম ব্যবস্থা মানুষের প্রতিভাকে কাজে না লাগিয়ে বরং দিনকে দিন শেষ করে দিচ্ছে।
আধুনিক শ্রম ব্যবস্থা খুব বেশি শাখায় বিভক্ত। এ ব্যবস্থায় বিভিন্ন উদ্ভট সব কাজের শ্রেণী রয়েছে। যেমন- বেভারেজ প্রচারণা বিষয়ক কোনো অফিসার কিংবা কোনো প্যাকেজিং প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ। মার্ক্স বলেন-
এই ধরনের শ্রম বিভাজন সাধারণত প্রচুর সময় এবং টাকা নষ্ট করে। যে যে কাজে পারদর্শী নয় তাকে সেই কাজের জন্য প্রস্তুত করতে অনেকটা সময় লেগে যায়। মানুষের প্রতিভার বিষয়টি অস্বীকার করা হয় এবং এভাবে প্রতিভার অপমৃত্যু ঘটানো হয়।
আধুনিক পেশাজীবন খুব বেশি নিরাপত্তাহীন
রক্ষণশীল পুঁজিবাদ মানুষের কর্মক্ষেত্রকে দিন দিন সংকুচিত করছে। নিত্যনতুন প্রযুক্তি আসার ফলে আমাদের কাজের ক্ষেত্র এবং সৃজনশীলতার পরিধি অনেকাংশেই ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হচ্ছে। যান্ত্রিক কর্মক্ষমতার কারণে শ্রমিকের থেকে যন্ত্রের মাধ্যমে উৎপাদনের ক্ষেত্রে উৎপাদন ব্যয় কম হচ্ছে, ফলশ্রুতিতে শ্রমিককে কাজ থেকে ছাঁটাই করা হচ্ছে।
পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় ‘চাকরি সুরক্ষা‘ বলে কোনো শব্দ নেই। মার্ক্স ভালোভাবেই জানতেন যে, মানুষের যেহেতু কাজে এবং একটি সুশৃঙ্খল জীবনের প্রতি ভালোবাসা কাজ করে। সেই সূত্রে আমরা সবাই একটি নিরাপদ কর্মজীবন প্রত্যাশা করি। কেউই চায় না হঠাৎ করে কর্মক্ষেত্র থেকে জোরপূর্বক অপসারিত হতে। কিন্তু আমাদের শ্রম ব্যবস্থাটাই এভাবে গড়ে তোলা হয়েছে যেখানে প্রত্যেকের কর্মজীবনই সবসময় একটি মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে থাকে। হিসাবটা শুধু উৎপাদন খরচ এবং উপযোগিতার।
মার্ক্সের লেখায় শ্রমজীবী মানুষের চাকরি খোয়ানোর আশঙ্কা এবং হাহাকারের বিষয়টি প্রকট হয়ে উঠে এসেছে। এসব সমস্যা থেকে আধুনিক পৃথিবীতে কমিউনিজমের ধারণা এসেছে। কমিউনিজমে সবার স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য একটি বিশেষ সামাজিক ব্যবস্থায় বিশ্বাস করা হয় যেখানে সবার অধিকার সমুন্নত থাকবে।
শ্রমিকের পারিশ্রমিকের তুলনায় পুঁজিপতির লভ্যাংশ অনেক বেশি
কার্ল মার্ক্সের দৃষ্টিভঙ্গিতে পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার আরও একটি বেশ বড় সমস্যা হচ্ছে, এই ব্যবস্থায় নামমাত্র মূল্যে শ্রমিকের শ্রম কেনা হয়। এক্ষেত্রে শ্রমিককে তার ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করার একটি বিশেষ প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। অধিকতর মুনাফা লাভের আশায় মালিকপক্ষ থেকে সস্তায় শ্রম কেনার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। তারা দরিদ্র এবং স্বল্পোন্নত দেশকে কারখানা স্থাপনের জন্য বেছে নেন। নামমাত্র পারিশ্রমিকের বিনিময়ে পণ্য উৎপাদন করে লাভের অনুপাত বাড়ান তারা। এই সমস্যাটিকে ইংরেজিতে ‘Primitive accumulation‘ এবং জার্মান ভাষায় ‘Ursprüngliche Akkumulation‘ বলা হয়। এই প্রসঙ্গে কার্ল মার্ক্স বলেন-
শ্রমিককে তার ন্যায্য অধিকার থেকে রহিত করা, তাদের কণ্ঠস্বর দাবিয়ে রাখা, তাদের যে কোনো অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে পণ্ড করে দেওয়াসহ সামগ্রিকভাবে ইচ্ছাপূর্বক শুধুমাত্র স্বার্থসিদ্ধির জন্য তাদের দারিদ্রচক্রের মধ্যে আবদ্ধ রাখা হয়। এভাবে শ্রমজীবী মানুষেরা চক্রান্তমূলকভাবে আজীবন নির্যাতনের শিকার হন।
পুঁজিবাদ কখনোই স্থির নয়
বর্তমান সময়ের অনেক আগেই কার্ল মার্ক্স বলেছিলেন–
পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা কখনোই স্থির নয়।
মার্ক্সের মৃত্যুর পরে অনেক সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর আজ তার কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হচ্ছে। আসলে পুঁজিবাদ কতগুলো ভ্রান্ত বা ভুল ধারণার উপরে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এখানে অনেকগুলো সংশয়ের ক্ষেত্রও কাজ করে। পুঁজিপতি অধিক মুনাফা লাভের আশায় যেকোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা বোধ করেন না। এই ধরনের পদক্ষেপ পণ্য বা সেবার সঠিক মূল্য এবং কর্মসংস্থানের উপরে সাধারণত নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। মার্ক্স এ সম্পর্কে বলেন-
এক্ষেত্রে পুঁজিপতি হচ্ছেন এক পাগল জাদুকরের মতো, যার নিজের সৃষ্ট জাদুকরী দুনিয়ার উপরে একপর্যায়ে কোনো ধরণের নিয়ন্ত্রণ থাকে না।
পুঁজিবাদ পুঁজিপতিদের জন্যই হুমকিস্বরূপ
কার্ল মার্ক্স তার লেখাগুলোয় পুঁজিপতি এবং বুর্জোয়াদের ‘ভ্যাম্পায়ার’ এবং ‘শত্রুপক্ষীয় ভাই’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তবুও তিনি তাদের হৃদয় যে পুরোপুরি কলুষিত, এ কথা বলেননি। তার মতে-
পুঁজিপতি এবং বুর্জোয়ারা মূলত একটি বিশেষ ধরনের সামাজিক অব্যবস্থাপনার শিকার।
উদাহরণস্বরূপ, তিনি এই সমাজের পারিবারিক অব্যবস্থাপনার দিকে ইঙ্গিত দিয়েছেন। সবসময় ‘পুঁজি এবং মুনাফার’ পেছনে ছুটতে ছুটতে এসব পুঁজিপতি তাদের পত্নী, সন্তান এবং পরিবার থেকে অনেকটা দূরে সরে আসেন। এক রকমের যান্ত্রিক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন তারা। ঠিকমতো পরিবারকে সময় দিতে পারেন না, একধরনের মানসিক অশান্তি সবসময় কাজ করে তাদের মধ্যে। তাদের অর্থ আছে, সবকিছুই তাদের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে, তারপরও তাদের কোনো মানসিক শান্তি নেই। ফলশ্রুতিতে, এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা তাদের জন্যই হুমকিস্বরূপ।
ফিচার ইমেজ- medium.com