সুমিষ্ট গলা আর তার চেয়েও মিষ্টি চেহারার টেইলর সুইফট সারা বিশ্বের সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে এক অতি পরিচিত নাম। সোনালী চুল, গাঢ় নীল চোখ আর পাতলা গড়নের টেইলরকে হঠাৎ দেখলে রূপকথার পাতা থেকে উঠে আসা পরীদের মতোই মনে হয়। রূপকথার আবেশ থাকে তার প্রতিটি গানের কথা জুড়ে। এক নতুন দিন, নতুন আশা, নতুন সম্ভাবনা আর নতুন প্রতিজ্ঞার কথাই থাকে তার প্রতিটি গানের কথায়। মাত্র ২৮ বছরের জীবনেই টেইলরের আকাশছোঁয়া খ্যাতি, অঢেল অর্জন আর পৃথিবীজোড়া কোটি ভক্তের ভালোবাসা প্রাপ্তি। চলুন জানা যাক একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা এই সঙ্গীতজ্ঞ সম্পর্কে জানা ও অজানা কিছু কথা।
টেইলর অ্যালিসন সুইফট ১৯৮৯ সালের ১৩ ডিসেম্বর পেনসিলভানিয়ার রিডিং-এ জন্ম নেন। ছোটবেলা কাটে উয়্যামিসিংয়ের অনতিদূরে তার পারিবারিক ক্রিসমাস ট্রি ফার্মে। বাবা স্কট কিংসলে সুইফট ও মা আন্দ্রিয়া ফিনলের আদরের মেয়ে টেইলরের উপর তার অপেরা শিল্পী নানী মেজরি ফিনলের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। তবে সঙ্গীতের মূল প্রভাবটা টেইলর পান প্যাস্টি ক্লাইন, ডলি পার্টন, লে অ্যান রাইমস, শানিয়া টোয়াইন ও ডিক্সি চিকস এর মতো নামকরা সব শিল্পীদের কাছ থেকে। টেইলরের নামটিও ‘টেইলর’ রাখা হয় প্রখ্যাত আমেরিকান শিল্পী, গীতিকার ও গিটারিস্ট জেমস টেইলরের নামানুসারে। সঙ্গীতের প্রতি তীব্র আকর্ষণ যে তার পরিবারে বরাবর বিরাজমান ছিল, তা বলাই বাহুল্য। কান্ট্রি মিউজিক দিয়েই টেইলরের সঙ্গীত সাধনা শুরু। কান্ট্রি মিউজিক হলো আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলে উদ্ভূত একধরনের পপুলার মিউজিক, যাতে নৃত্যের সাথে তাল মিলিয়ে কোনো লোকগাঁথা বা গল্প বর্ণিত হয়। বাঁশি, ব্যাঞ্জো, গিটার ও বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার হয় এতে।
১০ বছর বয়স থেকেই টেইলর সুইফট বিভিন্ন স্থানীয় অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করতেন। লে অ্যান রাইমস এর ‘বিগ ডিল’ গেয়ে একটি লোকাল ট্যালেন্ট প্রতিযোগিতা জিতে নেন তিনি। ১২ বছর বয়সেই তিনি গিটারের তারের উপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন। একই সময়ে গান লিখতেও শুরু করেন ছোট্ট টেইলর। তার প্রথম লেখা গান ছিল ‘লাকি ইউ’। লেখালেখির হাতটা ভালোই ছিল তার; স্কুলে পড়ার সময় জাতীয় কবিতা প্রতিযোগিতায় অংশও নিয়েছিলেন। ‘মনস্টার ইন মাই ক্লোজেট’ নামের কবিতাটি লিখে জাতীয় পুরষ্কার অনায়াসে বাগিয়ে নেন মাধুকরী টেইলর। শুধু তা-ই নয়, সেই ১২ বছর বয়সেই টেইলর ৩৫০ পৃষ্ঠার একটি উপন্যাসও লিখেছিলেন। কিন্তু এটি তিনি প্রকাশ করেননি।
টেইলরের মেধার দ্যুতি যেন ঠিকরে বেরুচ্ছিল। তার সম্ভাবনাকে অবজ্ঞা করেননি তার বাবা মা। যথেষ্ট প্রেরণা তারা দিয়েছেন, সেই সাথে বিভিন্ন ক্যাম্পেইনে অংশ নিতে ও বিভিন্ন রেকর্ডিং লেবেলে ইন্টারভিউ দিতে সাহায্য করেন। সেই ১১ বছর বয়স থেকেই বাড়িতে তৈরি টেপ নিয়ে টেইলর ন্যাশভিলে যাতায়াত শুরু করেন। টেনেসি অঙ্গরাজ্যের রাজধানী ন্যাশভিল কান্ট্রি মিউজিকের স্বর্গ বলা চলে। তিন বছর পর টেইলরের পরিবার স্থায়ীভাবে ন্যাশভিলে এসে বসবাস করতে শুরু করে। একদিন প্রখ্যাত ব্লু বার্ড ক্যাফেতে গান পরিবেশন করার সময় স্কট ব্রচেটার নজর কাড়েন টেইলর। স্কট তখন সদ্য ‘বিগ মেশিন লেবেল’ নামে একটি রেকর্ডিং গ্রুপ গড়ে তুলেছেন। তার নতুন রেকর্ডিং গ্রুপে প্রথম শিল্পী হিসেবে তিনি টেইলরকে সাইন করান। ইন্ডাস্ট্রিতে টেইলরের যাত্রা সেই শুরু। উল্লেখ্য, টেইলরের বয়স তখন মাত্র ১৪। এক ফুটন্ত কলির মাঝে নতুন দিনের মহীরূহ দেখতে পেয়েছিলেন স্কট। ভুল হয়নি তার।
২০০৬ এর অক্টোবরে বের হয় ‘Taylor Swift’ নামে টেইলরের প্রথম অ্যালবাম। এই অ্যালবামটি বিলবোর্ডে ৫ম স্থান দখল করে নেয় আর এর গানগুলো ১৫৭ সপ্তাহ ধরে চলতে থাকে। ১৬ বছরের টেইলর এরপর নিজের ক্যারিয়ার তৈরি করতে থাকেন ‘Our song’, ‘Tear drops on my guitar’, ‘You belong with me’ এর মতো অনন্য সব গান দ্বারা। কিশোরী মনের অনুভূতি, একেবারে সাদামাটা মনের কথা সোজাসাপ্টা ভাষায় এভাবে হয়তো আর কেউ উপস্থাপন করতে পারেনি আগে। অদ্ভুত এক সারল্য আছে তার গানগুলোয়। টিনএজারদের মধ্যে সাড়া জাগাতে তাই বেগ পেতে হয়নি টেইলরের। ‘Our song’ গানটির মাধ্যমে টেইলর কোনো প্রথম স্থান দখল করা কান্ট্রি সং এর সবচেয়ে কমবয়সী গায়িকা ও গীতিকার হিসেবে পরিচিত হন।
এরপর একে একে আসতে থাকে টেইলরের অনবদ্য একেকটি অ্যালবাম। ২০০৮-এ আসে তার ‘Fearless’। কান্ট্রি মিউজিকের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক অ্যাওয়ার্ড অর্জন করা অ্যালবাম এই ‘Fearless’। একইসাথে আমেরিকা, কানাডা ও নিউজিল্যান্ডের মিউজিক চার্টে প্রথম স্থান দখল করে নেয় এটি। এই অ্যালবামের ‘Love Story’ টেইলরের ১ম স্থান দখলকারী একক বা সিংগেল হয় অস্ট্রেলিয়ায়। কানাডায় অনুরূপ ১ম স্থানে আসে একই অ্যালবামের ‘Today was a fairy tale’। টেইলরের ৩য় অ্যালবাম ‘Speak Now’ আসে ২০১০-এ। এর সবগুলো টেইলরের নিজের লেখা। এটিও প্রকাশিত হওয়ার পরপরই আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও নিউজিল্যান্ডে চার্টের ১ম স্থান দখল করে। এই অ্যালবামের ‘Mine’, ‘Back to December’, ‘Mean’ ঘুরতে থাকে সবার মুখে মুখে।
নিজের রাজ্যে অদ্বিতীয় হয়েই যেন এসেছিলেন টেইলর সুইফট। রেকর্ড ভাঙার, নতুন রেকর্ড গড়ার আর প্রথম স্থান নিজের দখলে রাখার ধারা অব্যাহত রইল তার পরবর্তী অ্যালবামগুলোর মধ্যে দিয়ে। ২০১২ সালে এলো ৪র্থ অ্যালবাম ‘Red’। এর ১৬টি গানের মধ্যে ৯টি টেইলরের লেখা। ‘We are never ever getting back together’, ‘I knew you were trouble’ এই অ্যালবামের উল্লেখযোগ্য গান। এই অ্যালবাম দিয়ে টেইলর দেখিয়ে দেন শুধু কান্ট্রি মিউজিকে নয়, ড্যান্স পপ, হার্টল্যান্ড রক ও ডাবস্টেপ ট্র্যাকেও তিনি সমান পারদর্শী। ‘Red’ এর মাধ্যমে টেইলর প্রথম নারী শিল্পী হিসেবে ২ মিলিয়ন অ্যালবাম বিক্রি হওয়ার গিনেস রেকর্ডে নাম লেখান। ২০১৪ সালে টেইলর নিয়ে আসেন ‘1989’; উল্লেখ্য, এটি তার জন্মসাল। এটি প্রকাশের মাধ্যমে প্রথম নারী হিসেবে পরপর তিনটি অ্যালবামের এক মিলিয়নের বেশি কপি বিক্রি হওয়ার রেকর্ড করেন টেইলর। টেইলরের ৬ষ্ঠ অ্যালবাম ‘Reputation’ প্রকাশিত হয় ২০১৭ সালের নভেম্বরে। এই অ্যালবামের ‘Look what you made me do’, ‘I did something bad’, ‘Don’t blame me’ এখনও শ্রোতাদের মাতিয়ে যাচ্ছে। এড শিরানের সাথে মিলে গাওয়া ‘End Game’ এই অ্যালবামের অন্যতম চমক।
একজন সুকন্ঠী গায়িকার সাথে সাথে টেইলর একজন অসাধারণ অভিনেত্রীও। ২০০৯-এ ‘হানা মনটানা’ মুভিতে টেইলর অতিথি চরিত্রে অভিনয় করেন। ২০১০ সালে ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’ মুভিতে জেসিকা অ্যালবা, অ্যানি হ্যাথওয়ে, ব্র্যাডলি কুপারের পাশাপশি টেইলর অভিনয় করেন। তার মনোমুগ্ধকর উপস্থিতি ও অভিনয় এককথায় তুলনাবিহীন। এছাড়া নিজের অভিনীত মিউজিক ভিডিওগুলোও টেইলরের অভিনয় প্রতিভার অনন্য নিদর্শন। ‘Love Story’ গানের ভিডিওতে সেই সোনালী চুলের রাজকুমারী বা ‘Crazier’ এর সেই গিটার হাতে সুরের ঢেউ তোলা স্টেজ শিল্পী বা ‘You belong with me’ এর সেই গোবেচারা চশমিশ মেয়েটা, অথবা ‘Bad Blood’ এর দুরন্ত অবতার সব রূপেই নিজেকে সমান সুচারুরূপে ফুটিয়ে তুলেছেন টেইলর। সদ্য বেরোনো ‘Reputation’ অ্যালবামের ‘Look what you made me do’ গানের ভিডিওতে টেইলরকে একইসাথে বহুরূপে দেখা যায়। এর মধ্যে জোম্বি রূপেও টেইলর উপস্থিত হয়েছেন। যেকোনো অবতারেই দুর্দান্ত মানিয়ে যান তিনি।
৫ ফুট ১০ ইঞ্চি উচ্চতার টেইলর যতটা কমনীয়, ঠিক ততটাই দুর্দান্ত। তার ৯ মাস বয়সে তার মা তাকে ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে দিয়েছিলেন। সেই থেকে ঘোড়ার প্রতি যেন আলাদা টান তৈরি হয়ে যায় তার। ছোটবেলায় ‘জিঞ্জার’ নামে তার একটা টাট্টু ঘোড়াও ছিল। ঘোড়দৌড় এখন তার প্রধান শখ। বেশ কিছু ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতায় বিজয়ীও হয়েছেন টেইলর। এছাড়া বই পড়তে ভালোবাসেন টেইলর। রহস্য কাহিনী তার বেশি পছন্দ। আগাথা ক্রিস্টির ‘Murder on the Orient Express’ ও ‘And Then There Were None’ তার সবচেয়ে প্রিয় বই। এছাড়া তার প্রিয় বইয়ের তালিকায় আছে ‘The Hunger Games’ এবং ‘To Kill a Mockingbird’। ‘The Hunger Games’ মুভিতে টেইলরের দেয়া ‘Safe and Sound’ ও ‘Eyes Open’ নামে দুটি গান আছে। যেকোনো ডিজনি মুভি এবং ডিজনি সম্পর্কিত সবকিছুই টেইলরের প্রিয়।
কোটি সঙ্গীতপ্রেমীর হৃদয়ের রানী টেইলরের অর্জনের ঝুলি দিনকে দিন ভারি হয়েই চলেছে। এখনও অবধি তার ঝুলিতে রয়েছে ১০টি গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড, ২৩টি বিলবোর্ড মিউজিক অ্যাওয়ার্ড, ১১টি কান্ট্রি মিউজিক অ্যাসোসিয়েশন অ্যাওয়ার্ড, ৮টি একাডেমি অব কান্ট্রি মিউজিক অ্যাওয়ার্ড, ১৯টি আমেরিকান মিউজিক অ্যাওয়ার্ড, ১টি ব্রিট অ্যাওয়ার্ড এবং ১টি এমি অ্যাওয়ার্ডসহ আরও অনেক পুরষ্কার ও পুরষ্কারের মনোনয়ন। ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সী গ্র্যামি বিজেতা শিল্পীও টেইলর সুইফট। ২০১০ সালে, মাত্র ২০ বছর বয়সে, তিনি এই অর্জন নিজের করে নেন। অনন্যসাধারণ লিখনশৈলী দিয়ে ‘দ্য সংরাইটার্স হল অব ফেম’-এ জায়গাও করে নিয়েছেন সুইফট।
দিনে দিনে নিজেকে ভেঙে যেন নতুন করে গড়ছেন টেইলর। নিজেকে নিত্য-নতুনভাবে আবিষ্কার করে চলেছেন। নতুন বছরে ভক্তদের জন্য কী নতুন চমক আনেন টেইলর সুইফট, তাই এখন দেখার অপেক্ষা। ততদিন চলুক তার সর্বশেষ অ্যালবামের জাদু।
ফিচার ইমেজ: dailymotion.com