১৯৯৯ সালে ‘ফিজিক্স ওয়ার্ল্ড’ ম্যাগাজিন থেকে অদ্ভুত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এক জরিপ করা হয়। তখনকার সময়ের সেরা সব পদার্থবিজ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞাসা করা হয় ইতিহাসের সেরা পদার্থবিজ্ঞানী কে ছিলেন। জরিপে স্বাভাবিকভাবেই সবচেয়ে বেশি নাম আসে বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের, তারপর আসে নিউটনের। কিন্তু তৃতীয় নামটা যার, এদেশে উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগে পড়া মানুষদের বাদ দিলে খুব কম মানুষই তাঁর নাম শুনেছে। অথচ অনেক পদার্থবিজ্ঞানীদের মতে, তিনিই নাকি আইনস্টাইন নিউটনকে ছাপিয়ে ইতিহাসের সেরা পদার্থবিজ্ঞানী! হ্যাঁ, কথা হচ্ছে জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েলকে নিয়ে।
সত্যিকার অর্থেও আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানে জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েলের চেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন এমন পদার্থবিজ্ঞানীর জুড়ি মেলা ভার। আইনইস্টাইনই বলেছিলেন, “তিনি নিউটন নয়, জেমস ম্যাক্সওয়েলের ঘাড়ে বসে পৃথিবীকে দেখেছেন।” অর্থাৎ জেমস ম্যাক্সওয়েলের রেখে যাওয়া জ্ঞানই আইনস্টাইন ব্যবহার করেছেন পৃথিবীকে বুঝতে। কীভাবে ম্যাক্সওয়েল আমাদের সামনে আনলেন এসব যুগান্তকারী জ্ঞানগুলোকে, তাঁর অসামান্য গল্পই আমরা আজ শুনব।
একজন ক্ষুদে বিজ্ঞানী
ম্যাক্সওয়েলের জন্ম ১৮৩১ সালে, স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গে, ধনবান এক স্কটিশ পরিবারে। ছোটবেলা থেকেই তার বুদ্ধি এবং স্মৃতিশক্তি ছিল প্রডিজিস্বরূপ। আট বছর বয়সেই কবি জন মিল্টনের বড় বড় কবিতা, কিংবা বাইবেলের সবচেয়ে লম্বা স্তব তিনি মুখস্ত আবৃত্তি করতেন। তাঁর প্রথম অ্যাকাডেমিক পেপার বের হয় মাত্র ১৪ বছর বয়সে, সেখানে তিনি গাণিতিক গ্রাফ প্লট করার নতুন কিছু উপায় দেখিয়েছিলেন। সেই পেপার আবার রয়েল সোসাইটি অফ এডিনবার্গে পড়াও হয়েছিল, তিনি বয়সে বেশিই ছোট ছিলেন বলে তাকে নিজের পেপার নিজেকে পড়তে দেয়া হয়নি।
অনুষদ প্রধানের চোখে শনির বলয়
জেমস ম্যাক্সওয়েল উচ্চতর শিক্ষার জন্য পড়েছিলেন ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে, সেখানেও তিনি গণিত আর পদার্থবিজ্ঞানে সেরা পারফর্মেন্সের জন্য পেয়েছিলেন স্মিথস প্রাইজ।
২৫ বছর বয়সে তিনি ইউনিভার্সিটি অফ এবারডিনের ‘চেয়ার অফ ন্যাচারাল ফিলোসফি’ হিসেবে নিযুক্ত হন। তখন পদার্থবিজ্ঞানের নাম ছিল ‘ন্যাচারাল ফিলোসফি’। অর্থাৎ ২৫ বছর বয়সেই তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান অনুষদের প্রধান হয়ে গিয়েছিলেন!
এর দু’বছরের মাথায় তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানের এক বড়সড় আবিষ্কার করেন ফেললেন। তখনকার সময়ের অনেক বড় একটি রহস্য ছিল শনিগ্রহের চারপাশের বলয়গুলো। কেউই ঠিকঠাক ব্যাখ্যা করতে পারছিলেন না সেই বলয়টাকে। এটা যদি কঠিন কয়েকটা বলয় হয়, যেমনটা দূরবীক্ষণ যন্ত্রে দেখা যায় আর কি, তবে তো মাধ্যাকর্ষণের সূত্রানুযায়ী তাদের নিজেদের মাঝে এবং গ্রহের সাথেও সংঘর্ষ হয়ে যাবার কথা। ম্যাক্সওয়েল তখন অংক কষে দেখিয়ে দিলেন, শনিগ্রহের বলয়গুলো শুধু একটি উপায়েই আসলে স্থিতিশীল থাকতে পারে, যখন তার চারপাশের বলয়টা অনেকগুলো ক্ষুদ্র গ্রহাণুর সম্মিলনে গঠিত হয়, যেখানে প্রতিটি গ্রহাণুই শনির উপগ্রহস্বরূপ কাজ করে। তিনি বললেন, একই বলয়ের গ্রহাণুগুলো একইদিকে একই গতিতে চলে এবং এভাবেই পুরো বিষয়ে ভারসাম্য থাকে।
ম্যাক্সওয়েল তখন এটাও ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, এই বলয় আস্তে আস্তে ছড়িয়ে যেতে যেতে একসময় মিলিয়ে যাবে। এবং এখন এর প্রমাণও মিলেছে, বলয়গুলো আসলেই আস্তে আস্তে দূরে সরে যাচ্ছে!
১৮৬০ সালে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে মিলিত হয়ে যায় এবং সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘চেয়ার অফ ন্যাচারাল ফিলোসফি’ ম্যাক্সওয়েলের চাকরিটি নিয়ে নেন। তবে এই চাকরি হারিয়ে তিনি হারানোর তুলনায় পেয়েছিলেনই বেশি। কারণ এরপরে তিনি লন্ডনের কিংস কলেজে প্রফেসর হিসেবে জয়েন করেন, যেখান থেকে তিনি প্রকাশ করেন তাঁর আবিষ্কৃত কয়েকটি সমীকরণ ‘ম্যাক্সওয়েলস ইক্যুয়েশন্স’। আলবার্ট আইনস্টাইন, রিচার্ড ফাইনম্যান এবং ম্যাক্স প্ল্যাংক একে বলেছেন “বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার।”
ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া ম্যাক্সওয়েলস ইক্যুয়েশন্স
ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণগুলোর প্রকাশ হচ্ছে পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসের সবচেয়ে বৈপ্লবিক ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি। সমীকরণগুলো প্রথম গাণিতিকভাবে প্রমাণ করে আলো, তড়িৎ, আর চৌম্বকত্ব আসলে একই বল থেকে আসে- তড়িৎচৌম্বক বল। বর্তমানে পদার্থবিজ্ঞানের একমাত্র উদ্দেশ্যই হচ্ছে মৌলিক বলগুলোকে একীভূত করা, এবং এই কাজটি ম্যাক্সওয়েল সেই ১৮৬১ সালে যতটা এগিয়ে দিতে পেরেছিলেন, এরপর কেউই আর আর অতটা এগোতে পারেননি।
এখন আমরা জানি, ইলেকট্রন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গেলে যা হয় তা তড়িৎ, ইলেকট্রনেরা একই দিকে ঘুরলে আমরা পাই চৌম্বকত্ব আর ইলেকট্রনকে উচ্চ শক্তিস্তর থেকে নিম্ন শক্তিস্তরে নিয়ে আসলে আমরা পাই আলো বা ফোটন। সবকিছুই আসলে একই বলের বিভিন্ন রূপ- তড়িৎচৌম্বক বল। ইলেকট্রনের মাধ্যমেই তার প্রকাশ।
এখন পাঠক ভেবে দেখুন, এ সবকিছুই তিনি কিছু গাণিতিক সমীকরণ দিয়ে প্রকাশ করে ফেলেছিলেন, অথচ ইলেকট্রন তখনও আবিষ্কারই হয়নি। এর আবিষ্কার হতে তখনো বাকি ৩০ বছর! তিনি বিদ্যুতের উপর চুম্বকের প্রভাব আর চুম্বকের উপর বিদ্যুতের প্রভাবকে পর্যবেক্ষণ করে এসব বুঝে ফেলেছিলেন। এই প্রভাবকে তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন তড়িতচুম্বক তরঙ্গ দিয়ে। তিনি সেই তরঙ্গের গতিও মেপে ফেলেছিলেন, দেখা গেল সেই গতি আলোর গতিরই সমান, আর যেহেতু আলোর গতিই সর্বোচ্চ গতি, তাই বলা গেল যে তড়িতচুম্বক তরঙ্গ আর আলো আসলে একই জিনিস।
নিউটনিয়ান পদার্থবিজ্ঞানকে তামাদি করে দিল ম্যাক্সওয়েলের এই সমীকরণগুলো। দেখা গেল, শক্তিও এভাবে শূন্য দিয়ে ভ্রমণ করতে পারে। এখান থেকেই একসময় জন্ম নেয় কোয়ান্টাম মেকানিক্স, আইনস্টাইনের সব কাজই এই সমীকরণগুলো ছাড়া অচল।
আইনস্টাইন নিজেই বলেছিলেন, “আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্বটি উদ্ভবের জন্য আসলে ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণগুলোর কাছে ঋণী।”
আর আমাদের দৈনন্দিন জীবনের যত প্রযুক্তি আমরা ব্যবহার করি, কোনোটিই তড়িতচৌম্বক বল বোঝা ছাড়া বানানো সম্ভব নয়। ক্যাম্ব্রিজের ইমেরিটাস প্রফেসর পদার্থবিদ ম্যালকম লঙ্গেয়ারের ভাষায়,
“প্রতিটি কম্পিউটারের পর্দা, প্রতিটি মোবাইল ফোন ম্যাক্সওয়েলের সেই ১৮৬০ এর দশকের পেপারের নীতিগুলো অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে।”
ম্যাক্সওয়েলের কিন্তু অন্যান্য আবিষ্কারও ছিল, সেগুলোও নিতান্ত ছোট নয়।
গতির বিজ্ঞানী, আবার ছবির কারিগর
তিনি ছিলেন গ্যাসের গতিতত্ত্বের প্রবক্তা। এই গতিতত্ত্ব থেকেই শুরু স্ট্যাটিস্টিক্যাল ফিজিক্সের, যেখানে প্রব্যাবিলিটি দিয়ে ক্ষুদ্র কণাকে ফেলা হয় বৈজ্ঞানিক দৃষ্টির নিচে। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাথে মিলটা নিশ্চয়ই পাঠক টের পাচ্ছেন? হ্যাঁ, কোয়ান্টাম মেকানিক্সের উদ্ভবে গ্যাসের গতিতত্ত্বেরও রয়েছে ম্যাক্সওয়েলের অবদান। ‘ম্যাক্সওয়েলস থার্মোডাইনামিক রিলেশন্স’ গুলো তৈরি করার মাধ্যমেও তাপগতিবিদ্যায় অবদান রেখেছেন তিনি।
তিনিই পৃথিবীর সর্বপ্রথম রঙিন ছবিটি তৈরি করেন; সেই গল্পও বেশ বুদ্ধিদীপ্ত। বৈজ্ঞানিক ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই মানুষ রঙ কিভাবে দেখে তা নিয়ে তাঁর অনেক আকর্ষণ ছিল। গবেষণা করতে করতে তিনি একদিন বুঝতে পারলেন, মানুষের চোখ শুধু তিনটি রঙই দেখে- লাল, নীল আর সবুজ। তাই তিনি বললেন, লাল, নীল, সবুজ রঙের ঠিকঠাক ফিল্টার করা তিনটি ছবিকে একসাথে পর্দায় প্রজেক্ট করা গেলে, আমরা সেখানে রঙিন ছবি দেখতে পাব। সেই চিন্তা থেকে তিনি তৈরি করে ফেললেন মানবসভ্যতার ইতিহাসের প্রথম রঙিন ছবি। আমাদের টেলিভিশনের রঙ আনার প্রক্রিয়াটিও কিন্তু এই চিন্তারই আরেক রূপ।
কতকিছুই না করেছেন ম্যাক্সওয়েল। জীবনী পড়তে পড়তে পাঠক হয়তো ভাবছেন, অনেকদিন বোধহয় বেঁচেছেন এই প্রতিভাবান বিজ্ঞানী। কিন্তু ম্যাক্সওয়েল বেঁচেছিলেন মাত্র ৪৮ বছর। অ্যাবডোমিনাল ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৮৭৯ সালে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন এই ধীমান পদার্থবিদ। কিন্তু এই ক্ষুদ্র জীবনের মধ্যেই তিনি পদার্থবিজ্ঞানের জগতকে বদলে দিয়েছেন চিরদিনের জন্য, পরবর্তী প্রজন্মের জীবন সহজ করে দিয়ে গেছেন অনেক অনেকগুণ। পদার্থবিজ্ঞানের প্রতিটি নতুন নতুন সাফল্যেই একবার পেছন ফিরে ম্যাক্সওয়েলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হয়েছে তাঁর পরবর্তী পদার্থবিদদের।
আর এ কারণেই পৃথিবীর অধিকাংশ পদার্থবিজ্ঞানীদের মতে, আইনস্টাইন আর নিউটনের মতো কিংবদন্তীদের পাশেই থাকা উচিৎ তাঁর নাম।
ফিচার ইমেজ: frontiersmagazine.org