Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সার্জিও বুস্কেটস: বার্সেলোনা ও স্পেনের সাফল্যের এক স্বল্পনন্দিত নেপথ্য কারিগর

সার্জিও বুক্সেটস কে? একজন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার। দারুণ ড্রিবলিং করতে পারেন? না। দারুণ স্কিল? তা-ও না। ডিফেন্সচেরা পাস দিতে পারেন? উঁহু, সেটাও না। আবার তাঁকে নিয়েই স্পেন ও বার্সেলোনা সাফল্যের অন্যতম কান্ডারী জাভি হার্নান্দেজের বক্তব্য হলো, “সার্জিওকে ছাড়া স্পেন বা বার্সেলোনার এই সাফল্য সম্ভব ছিলো না।” স্পেনকে বিশ্বকাপ জেতানো কোচ দেল বস্কের ভাষায়, “আপনি পুরো খেলাটি দেখেন, বুস্কেটসকে পাবেন না। আর যদি আপনি বুস্কেটসকে দেখেন তাহলে পুরো খেলাই দেখতে পারবেন।” আসলেই কে এই বুস্কেটস? কেনইবা তাঁকে নিয়ে এত সুবচন?

বার্সার সাফল্যের মূল স্তম্ভ এই চতুষ্টয়; Source:FC Barcelona

প্রত্যেক জাদুকরের নেপথ্যেই একজন সহকারী থাকেন। জাদুকরের মোহনীয় সব হাতের কাজে মুগ্ধ দর্শক যখন হাততালি দেয়, তখন নেপথ্যের ঐ ব্যক্তিটি যেন অপ্রশংসিতই থেকে যান। সার্জিও বুস্কেটস তেমনই একজন। ২০০৮ সাল থেকে পেপ গার্দিওলার বার্সেলোনার সাফল্য দিয়ে যে যুগের শুরু, যার রেশ এখনো চলমান, সেই সাফল্যের জন্য মেসি, জাভি, ইনিয়েস্তা, নেইমার, সুয়ারেজ, পেদ্রো একেকসময় একেকজন পেয়েছেন বন্দনা, কিন্তু যেন বারবারই উহ্য থেকে যেতেন সার্জিও। অথচ পেপ গার্দিওলা যখন যুবদলের কোচ, তখন বুস্কেটসকে তাঁর অধীনে প্রথম খেলান তিনি। পরবর্তী সাফল্যের বীজগুলো সেখানেই মহীরুহে পরিণত হচ্ছিল। পেপ গার্দিওলা যখন বার্সেলোনা মূল দলের কোচ হয়ে আসেন, তখন সাথে নিয়ে আসেন বুস্কেটসকেও আরো বড় পরিসরে মেলতে দেয়ার পরিকল্পনা মাথায় নিয়ে। কেউই ভাবতে পারেননি সার্জিও মূল দলে জায়গা করে নিতে পারবেন। তখন বার্সায় ইয়াইয়া তোরে, সেয়েড্যু কেইটা ছিল তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার জায়গাটির জন্য। বার্সা সমর্থকদের কাছেও খুব বেশি পরিচিত ছিলেন না তিনি। কিন্তু পেপ গার্দিওলা বিশ্বাস রাখলেন তাঁর উপরই। সবাইকে অবাক করে দিয়ে মূল দলেই খেলতে লাগলেন তরুণ এই মিডফিল্ডার। গড়ে উঠলো জাভি-বুস্কেটস-ইনিয়েস্তার ‘অল মাসিয়ান’ মিডফিল্ড, মানে হলো সেই মাঝমাঠের তিনজনই বার্সার লা মাসিয়া একাডেমি থেকে আগত! বাকিটা ইতিহাস।

অনেক বার্সা কোচের মতেই বুস্কেটস হলো মাঠের কোচ; Source:The Sun

২০০৮ সাল থেকে বার্সার তিকিতাকায় বিধ্বস্ত হতে থাকে একের পর এক দল। তিকিতাকার মূল মন্ত্রই ছিল ছোট ছোট পাসে বল নিজেদের পায়ে রেখে খেলা। মোদ্দাকথায় পুরো খেলাটাই ছিল মাঝমাঠ-নির্ভর। দলের ‘হার্টবিট’ বলা হতো জাভিকে, ইনিয়েস্তা ছিলো চকিতে ডিফেন্সচেরা পাস বা দারুণ কিছু পায়ের কাজে জায়গা করে নিতে, মেসি তো মেসিই। তো বুস্কেটস কীসের জন্য? বুস্কেটসই ছিলেন সেই কারণ, যার জন্য জাভি-ইনিয়েস্তা এত স্বাধীনতা পেতেন। সোজা ভাষায় বলা যাক। আপনাদের তিনজনের উপর দায়িত্ব মাঝমাঠ সামলানো। মাঝমাঠ যারা সামলায়, তাদের অলিখিত এক দায়িত্ব হলো দল যেন কোনো ভুলের কারণে প্রতি-আক্রমণের শিকার না হয়, তা খেয়াল রাখা। এখন আপনার সাথের দুজন একটু বেশি প্রতিভাবান আক্রমণে। তারা প্রায়ই উপরে উঠে যায়। আপনি নিজেও কম প্রতিভাবান নন, তা সত্ত্বেও আপনি বাকি দুজনকে স্বাধীনতা দিলেন উপরে খেলার। যে বেশি উপরে চলে যেত, আপনি তাঁর জায়গাটাই বেশি কভার করেন। তবে আপনিই সেই তিনজনের মধ্যে বুস্কেটস-গোত্রীয়। এমনও হয়েছে যে, দলের কোনো একজন আক্রমণভাগের খেলোয়াড়ের ইতিমধ্যে একটি হলুদ কার্ড পাওয়া হয়ে গিয়েছে, এই অবস্থায় আরেকটি ফাউল করে বসলো সে। সেকেন্ড কার্ড পেয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে- এই সম্ভাবনার সময় বুস্কেটস এসে রেফারির সাথে তর্ক জুড়ে দিতেন, যেন ‘লাগলে আমাকে কার্ড দাও, ওকে না’! এতটা দলের জন্য দায়বদ্ধ তিনি। বার্সার দুই উইংব্যাক দানি আলভেজ ও আবিদাল প্রচুর উপরে খেলতেন, তাদেরকেও কভার করার জন্য দুই সেন্টারব্যাকের সাথে নিচেই থেকে যেতেন তিনি। এবার দেখে নেয়া যাক তাঁর খেলার কিছু অনন্য বিশেষত্ব।

সদা সতর্ক হিসেব

মেসি ও বুস্কেটস; Source: FC Barcelona

যদি সার্জিওকে বলা হয় বিপদের ঝুঁকি এড়ানো নাকি বন্দনার লোভ, কীসে বেশি মোহ? নিশ্চিত উত্তর আসবে- বিপদের ঝুঁকি এড়ানো। ৯০ মিনিটের প্রতিটি সময়ই তাঁর কাছে বিভিন্ন ঝুঁকির হিসেব। খেলার মাঠে বুস্কেটসকে লক্ষ্য করলে দেখবেন অনবরত মাথা এদিক-ওদিক করছেন। বার্সার ট্রেবল জয়ী কোচ লুইস এনরিকের এক ডকুমেন্টারিতে বলেছিলেন, তিনি বার্সা যুবদলে থাকার সময় তরুণ মিডফিল্ডারদের বুস্কেটসের খেলার ভিডিও দেখাতেন আর জোর দিতেন একটি পাস নেয়ার আগে বুস্কেটস কীভাবে চারপাশটা চকিতে দেখে নেন, তার উপর! বল পায়ে এলে যেদিকে দলকে খেলাতে চাইতেন, সেদিকে বলটা পাঠিয়ে দিতেন।

জায়গা করে নেয়া

প্রথম মৌসুমেই জেতা ট্রেবলের সাথে বুস্কেটস; Source: FC Barcelona

একজন সাধারণ ব্যাক্তি ১৮০ ডিগ্রি পর্যন্ত জায়গা স্বাভাবিকভাবে দেখতে পারেন। কিন্তু বল পায়ে নেওয়ার সময় বুস্কেটস নিজের শরীরকে এমনভাবে রাখেন যে, আধা সেকেন্ডে গড়ে ২৭০ ডিগ্রী পর্যন্ত দেখে নিতে পারেন। দলের অন্য খেলোয়াড়ের কাছে যখন বল থাকে বা সেই খেলোয়াড় যদি বল হারানোর আশঙ্কায় থাকেন, তবে নিরাপদতম জায়গাটা বেছে নেন এবং এমন একটা জায়গা নেন, যেখানে প্রতিপক্ষের প্রেসিং সর্বনিম্ন। পেপ গার্দিওলার ভাষায়, “পরবর্তী পাসের জন্য সদা প্রস্তুত থাকে ও”। ঠিক এ গুণের জন্যই বার্সার তিকিতাকা অন্য মাত্রা পেয়েছিল। জাভি, ইনিয়েস্তারা চোখ বন্ধ করে তাঁকে পাসের জন্য পেয়ে যেত, ফলে বার্সা এত সহজে বল হারাতো না।

বল না হারানো

গত চার বছরের একটা পরিসংখ্যান দেয়া যাক। বুস্কেটসের পাস সফলতার হার ৯০.৭ ভাগ। মানে প্রতিপক্ষকে তাঁর পা থেকে বল কেড়ে নেয়ার কোনো সুযোগ দেননি বলতে গেলে, অর্থাৎ বার্সা বুস্কেটসের পায়ে বল থাকলে প্রতি-আক্রমণ থেকে প্রায় নিরাপদ বলাই যায়। অনেকেই বলে থাকেন, বুস্কেটসের পা থেকে বল নেয়ার একটাই উপায়- তাঁকে ফাউল করা। পাসিং এঙ্গেল বিবেচনা করলে বুস্কেটস অনবদ্য, দুই-তিনটি অপশন বিবেচনা করে যে জায়গাটায় তাঁর চেয়ে অধিক দক্ষ আক্রমণাত্মক খেলোয়াড় আছে, সেই অপশনটিই বেছে নিতে পারঙ্গম বুস্কেটস। নিচের ভিডিওতে বুস্কেটসের কিছু পাসিং এঙ্গেল ও অন্যান্য দিক দেয়া হলো।

রক্ষণাত্মক কাজ

বার্সেলোনার তিকিতাকা বা বর্তমান যেকোনো বার্সা সিস্টেমেই দলের মাঝমাঠের মূল রক্ষণাত্মক দায়িত্বটা থাকে তাঁর। বুস্কেটসের ভরসাতেই জাভি, ইনিয়েস্তারা মাঝমাঠ থেকে অনেকটা উপরে উঠে দলকে খেলাতে পারতেন। ফুটবলে ‘ট্যাকটিকাল ফাউল’ নামে একটি শব্দ আছে, যার মানে হচ্ছে আপনার দলকে অকস্মাৎ আক্রমণ করে বসেছে প্রতিপক্ষ, এমন একটি অবস্থা যে আপনাকে কাটিয়ে যেতে পারলেই নিচে পুরো রক্ষণ ফাঁকা। ঠিক সেই সময় জেনে বুঝে একটি ফাউল করা হয় নিশ্চিত গোল থেকে বাঁচার জন্য, একেই বলে ‘ট্যাকটিকাল ফাউল’। এমন প্রচুর ফাউল করে থাকেন বুস্কেটস। গোলের জন্য হাততালি পেলেও ফাউলের জন্য তা কদাচিৎই মেলে, অথচ এই কদর্য কাজটি দলের জন্য অতীব জরুরি। দলের স্বার্থে অনেকবার বুস্কেটস এটি করেছেন।

২০০৮ সালের ইউরোজয়ী স্পেন দলের ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার ছিলেন মার্কোস সেনা। দেল বস্ক দায়িত্ব নিয়েই অভিজ্ঞ মার্কোসের জায়গায় নিয়ে আসেন সদ্য বার্সায় এক মৌসুম খেলা অনভিজ্ঞ বুস্কেটসকে। সেই থেকে শুরু, এরপর টানা বিশ্বকাপ ও ইউরো জয়ী স্পেন দলের সবচেয়ে নিয়মিত সদস্য তিনি। ২০১০ বিশ্বকাপের ফাইনালে সবচেয়ে বেশি সময় বল ছিল তাঁরই পায়ে। জাভি-বুস্কেটস-আলোন্সো-ইনিয়েস্তাদের নিয়ে গঠিত মাঝমাঠ থেকে বল নেয়া ছিল ফুটবল বিশ্বের অন্যতম কঠিন কাজ। স্পেন ও বার্সেলোনায় তাঁর জায়গা নেবে এমন কেউ এখনও উঠে আসেনি। ২০০৮ সালে যখন অভিষিক্ত হন, সেই বছর বার্সা সম্ভাব্য ছয়টি শিরোপার সবকটিই জিতে নেয়। সেই দলটির মাঝমাঠের অকথিত কারিগর ছিলেন এই ২০ বছর বয়সী বুস্কেটস। তাঁর অভিষেকের পর থেকে বার্সার জেতা ৬টি লীগ, ৩টি চ্যাম্পিয়ন্স লীগ, ৫টি কোপা দেল রে এবং স্পেনের জেতা ২০১০ বিশ্বকাপ ও ২০১২ ইউরোতে ছিল তাঁর সরাসরি অবদান। বার্সায় মেসির ১ ম্যাচ খারাপ গেলে ইতো, পেদ্রো, সুয়ারেজ বা নেইমাররা মিলে তা পুষিয়ে দিতেন। কিন্তু বুস্কেটসের খারাপ দিন মানে বার্সার ডিফেন্সের খারাপ দিন, পুরো দলের খারাপ দিন। এখনও অনেক বোদ্ধার মতে, গত ২০১৬-১৭ মৌসুমে বার্সার ব্যর্থতার অন্যতম কারণ ছিল একটা বড় সময় ধরে বুস্কেটসের বাজে ফর্ম। এটুকু সময় বাদ দিলে বুস্কেটসের বাজে পারফর্মেন্স হাতে গোনা যায়। সেই ২০০৮ সাল থেকেই দলগুলা বুঝে যায় যে বার্সার এক অপ্রকাশিত শক্তি তিনি, প্রচুর হিসেব করা হয় তাঁকে আটকাতে। তবুও ঠিকই তিনি জায়গা খুঁজে নিয়ে নিজের খেলাটা খেলতেই থাকেন। এ ব্যাপারটি নিয়ে গার্দিওলা বলেছিলেন, “প্রতিপক্ষ যখন কৌশল বদলায়, সার্জিওকে ইশারাও দেয়া লাগে না কীভাবে খেলতে হবে। ও নিজেই দলকে সেভাবে খেলাতে থাকে।

বার্সা সাফল্যে বুস্কেটসের অবদান অনস্বীকার্য; Source: Barca Blaugranes

আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপজয়ী কোচ লুইস সিজার মেনত্তি একবার বলেছিলেন, “আমি যখন প্রথম ওর খেলা দেখি, তাড়াতাড়ি ফোন হাতে নিয়ে কয়েকজন বন্ধুকে ফোন করে বলি, দেখো, দেখো, বার্সায় এমন এক ছেলে খেলছে যার মতো খেলোয়াড় ‘প্রায় বিপন্ন’।” মেনত্তিকে হতাশ করেননি বুস্কেটস, হতাশ করেছেন তোরে বা কেইটার মতো মিডফিল্ডারদের, যারা এক ২০ বছরের তরুণের জন্য বার্সায় আর নিয়মিত হতে পারেনি। যদি পাসিংয়ের কথা বলেন, বুস্কেটসের মতো পাসিংওয়ালা খেলোয়াড় আপনি পাবেন, যদি ডিফেন্সিভ কাজের কথা ধরেন, তবেও বুস্কেটসের মতো খেলোয়াড় পাবেন, যদি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন খেলোয়াড়ের কথা ধরেন, সেক্ষেত্রেও বুস্কেটসের চেয়ে ভালো খেলোয়াড় পাবেন, কিন্তু এমন একজন পাবেন না, যার মধ্যে এই সব গুণ একসাথে বিদ্যমান। এ জায়গায়ই বুস্কেটস অনন্য। কখনো তোরে, কখনো কান্তে, কখনো ক্যাসেমিরো এমন অনেকের সাথে তাঁর তুলনা করা হয়। কোনো কোনো মৌসুমে তারা বুস্কেটসের চেয়ে ভালোই খেলে থাকেন, কিন্তু সেই একই রকম ধারাবাহিকতা নিয়ে দশটি বছর খেলতে থাকা- এটা কয়জন পারে? স্পেন ও বার্সায় যে কোচই আসেন, একটা নাম প্রথমেই একাদশে থাকে- সার্জিও বুস্কেটস।

পুরো বার্সেলোনা ও স্পেন দলের দিকে খেয়াল করলেই দেখা যাবে, সবচেয়ে কম বন্দিত খেলোয়াড়ের তালিকায় উপরের দিকেই থাকবেন তিনি। নিজের খেলাকে দর্শকনন্দিত করার দিকে তাঁর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই, বরং দলের খেলা ও ফলফলকে নন্দিত করতেই তাঁর পুরো প্রচেষ্টা। বুস্কেটস যেন সেই জাদুকরদের নেপথ্যের অপ্রকাশিত সহকারী, বার্সেলোনা ও স্পেনের সাফল্যের স্বল্প-নন্দিত কারিগর।

ফিচার ইমেজ- Youtube

Related Articles