সম্প্রতি জিম্বাবুয়েতে হয়ে গেল সামরিক অভ্যুত্থান। এক সময়ের তুমুল জনপ্রিয়, জিম্বাবুয়ের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা রবার্ট মুগাবেকে সে দেশের সেনাবাহিনী গৃহবন্দী করে দেশটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিল। তার কয়দিন পরেই পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন দীর্ঘ ৩৭ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা ৯৩ বছর বয়সী রবার্ট মুগাবে।
মুগাবের বিরুদ্ধে তার অনুগত সেনাবাহিনীর এই অভ্যুত্থানের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয় তার স্ত্রী গ্রেস মুগাবের ভূমিকাকে। গ্রেসের ক্ষমতার প্রতি উচ্চাভিলাষের কারণেই কিছুদিন আগে রবার্ট তার ভাইস প্রেসিডেন্ট এমারসন মানাঙ্গাগোয়াকে পদচ্যুত করেছিলেন, যেন রবার্টের মৃত্যুর পর প্রেসিডেন্ট হতে গ্রেসের পথে আর কোনো বাধা না থাকে। কিন্তু ঐ পদক্ষেপের পরপরই সেনাবাহিনী অভ্যুত্থান করে বসে।
বিভিন্ন দেশের একনায়করা মূলত নিজেরাই রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। কিন্তু ইতিহাস বলে, তাদের উপর অনেক বেশি প্রভাব থাকে তাদের স্ত্রীদের। স্ত্রীদের সিদ্ধান্ত এবং প্ররোচনা একদিকে যেমন কোনো স্বৈরশাসকের পতনের কারণও হতে পারে, আবার অন্যদিকে তারা তাদের ভালো কাজ এবং গণসংযোগের মাধ্যমে স্বৈরশাসকদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার ব্যাপারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। চলুন জেনে নেই দীর্ঘকালব্যাপী শাসন ক্ষমতায় থাকা আফ্রিকার পাঁচজন স্বৈরশাসক এবং তাদের ফার্স্ট লেডিদের পরিচয়।
শান্তাল বিয়া, ক্যামেরুনের ফার্স্ট লেডি
ক্যামেরুনের প্রেসিডেন্ট পল বিয়া গত ৪২ বছর ধরে ক্ষমতায় আছেন। ১৯৭৫ সালে তিনি তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আহমাদু আহিদজোর অধীনে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন এবং পরবর্তীতে আহিদজোর পদত্যাগের পর প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রথম দিকে আহিদজোর সাথে বিয়ার সম্পর্ক ভালো থাকলেও শীঘ্রই তার অবনতি ঘটে। ১৯৮৩ সালে আহিদজো ক্যু করার চেষ্টা করলে পল বিয়া ক্যু দমনের অজুহাতে তার সকল প্রতিদ্বন্দ্বীকে নিষ্ক্রিয় করতে সক্ষম হন। এরপর থেকে প্রায় প্রতিটি নির্বাচনে তিনি বিপুল ভোটে পুনর্নিবাচিত হয়ে আসছেন, যদিও প্রতিটি নির্বাচনেই বিপুল কারচুপি এবং জালিয়াতির অভিযোগ আছে।
পল বিয়ার প্রথম স্ত্রী ছিলেন জেন ইরিন বিয়া। ১৯৯২ সালে ইরিনের মৃত্যুর পর ১৯৯৪ সালে পল শান্তাল বিয়াকে বিয়ে করেন। শান্তাল বয়সে পলের চেয়ে ৩৮ বছরের ছোট। শান্তালের বাবা ছিলেন একজন ফরাসী প্রবাসী এবং তার মা ছিলেন সুন্দরী প্রতিযোগিতা বিজয়ী। সুন্দরী মায়ের রূপচর্চার অভ্যাসের কিছুটা শান্তালও পেয়েছেন। তিনি তার বাহারি চুলের স্টাইল এবং জাঁকজমকপূর্ণ পোশাকের জন্য বিখ্যাত। তার চুলের বিশেষ স্টাইলের পৃথক নামও আছে– ‘দ্য ব্যানানে’। তার পোশাক-আশাক সহ বিভিন্ন ফ্যাশনকে সম্মিলিতভাবে ‘দ্য শান্তাল বিয়া’ নামে অভিহিত করা হয়।
শান্তাল আফ্রিকান সিনার্জি নামে একটি সংগঠনের সদস্য, যেটি ২২টি আফ্রিকান রাষ্ট্রের ফার্স্ট লেডিদেরকে নিয়ে গঠিত। ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠনটির উদ্দেশ্য হচ্ছে এইচআইভি সহ অন্যান্য রোগ নিয়ে আলোচনা এবং মত বিনিময় করা। শান্তাল বেশ সামাজিক এবং অমায়িক। বিভিন্ন সময় তিনি মডেল প্যারিস হিলটন, সাবেক মার্কিন ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা এবং পোপ ফ্রান্সিসের সাথে সাক্ষাৎ এবং মত বিনিময় করেছেন।
কন্সটানসিয়া মাঙ্গু, বিষুবীয় গিনির ফার্স্ট লেডি
তেওদুরো ওবিয়াং ১৯৭৯ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তার চাচাকে ক্ষমতাচ্যুত করে বিষুবীয় গিনির ক্ষমতা দখল করেন। এরপর থেকে গত ৩৮ বছর ধরে তিনি দেশটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ২০১১-১২ সালে তিনি আফ্রিকান ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বিষুবীয় গিনির রাষ্ট্র ব্যবস্থা মূলত একদলীয়। প্রেসিডেন্ট হিসেবে ওবিয়াং প্রায় অসীম ক্ষমতা উপভোগ করেন। ২০০৩ সালে গিনির রাষ্ট্রীয় রেডিও তাকে দেশটির দেবতা হিসেবে ঘোষণা করে এবং দাবি করে, ওবিয়াংয়ের সাথে সৃষ্টিকর্তার সরাসরি যোগাযোগ আছে! তাকে বিশ্বের অন্যতম সম্পদশালী একনায়ক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ওবিয়াংয়ের স্ত্রীর সংখ্যার পাঁচ জন বলে জানা যায়। তবে এদের মধ্যে তার প্রথম স্ত্রী কন্সটানসিয়া মাঙ্গুই বেশি বিখ্যাত। তিনি একইসাথে গিনির স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং সমাজকল্যাণমন্ত্রী। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও দেশটির স্বাস্থ্যক্ষেত্রে উন্নয়নমূলক ভূমিকার কারণে তিনি প্রশংসিতও হয়েছেন। ২০১৬ সালে নেদারল্যান্ড ভিত্তিক ‘ভয়েস ম্যাগাজিন অ্যাচিভার্স অ্যাওয়ার্ড’ কমিটি তাকে ‘আফ্রিকান ওম্যান অ্যান্ড পার্সোনালিটি’ পুরস্কারে ভূষিত করে। কন্সটানসিয়া এবং ওবিয়াং দম্পতির বড় ছেলেকে গিনির পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখা হয়।
জ্যানেট মুসেভেনি, উগান্ডার ফার্স্ট লেডি
উগান্ডার প্রেসিডেন্টের নাম ইওয়েরি মুসেভেনি। তিনি ছিলেন উগান্ডার গেরিলা দল ‘ফ্রন্ট ফর ন্যাশনাল স্যালভেশন’ এর যোদ্ধা, যারা প্রথমে ১৯৭৯ সালে উগান্ডার কুখ্যাত স্বৈরশাসক ইদি আমিনকে এবং পরে ১৯৮৫ সালে মিল্টন ওবোটেকে ক্ষমতাচ্যুত করে। ওবোটের পতনের পর ১৯৮৬ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরপর থেকে গত ৩১ বছর ধরে তিনি একই পদে আছেন। সংবিধান সংশোধন করে এবং প্রেসিডেন্টের নির্বাচিত হওয়ার সীমা তুলে দিয়ে তিনি দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার পথ পরিস্কার করেছেন।
ইওয়েরি মুসেভেনির স্ত্রীর নাম জ্যানেট কাতাহা। ইদি আমিন ক্ষমতা দখল করার পর ১৯৭১ সালে জ্যানেটদের পরিবার উগান্ডা থেকে পালিয়ে তানজানিয়ায় চলে গিয়েছিল। সে সময় মুসেভেনিও ফ্রন্ট ফর ন্যাশনাল স্যালভেশনের যোদ্ধা হিসেবে তানজানিয়া থেকে উগান্ডায় আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। সেখানেই মুসেভেনির সাথে জ্যানেটের পরিচয় হয় এবং ১৯৭৩ সালে তাদের বিয়ে হয়।
জ্যানেট শুধু উগান্ডার ফার্স্ট লেডিই না, তিনি নিজেও একজন সফল রাজনীতিবিদও। তিনি ২০১১-১৬ পর্যন্ত সংসদ সদস্য এবং কারামোজা এলাকা বিষয়ক মন্ত্রী ছিলেন। ২০১৬ সাল থেকে তিনি শিক্ষা এবং ক্রীড়ামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ২০১১ সালে তিনি নিজের আত্মজীবনী ‘মাই লাইফ’স জার্নি’ প্রকাশ করেন। ১৯৮৬ সালে তিনি ‘উগান্ডা উইমেন’স এফোর্ট টু সেভ অরফ্যান্স’ নামক বেসরকারি দাতব্য সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নব্বইয়ের দশকে তিনি এইচআইভি এবং এইডস প্রতিরোধে কর্মসূচীতে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করেন।
হিন্দা দেবি, চাদের ফার্স্ট লেডি
জেনারেল ইদ্রিস দেবি গত ২৭ বছর ধরে চাদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ১৯৯০ সালে পূর্ববর্তী স্বৈরশাসককে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করার মাধ্যমে তিনি চাদের ক্ষমতা দখল করেন। সেনাবাহিনীর দায়িত্বে থাকাকালে তিনি একাধিকবার সাফল্যের সাথে লিবিয়ান সৈন্যদের আক্রমণ প্রতিহত করে দেশকে রক্ষা করেন। পরে অবশ্য প্রেসিডেন্ট হাবরের সাথে সম্পর্কের অবনতি হওয়ার পর তিনি গাদ্দাফীর সমর্থন এবং সহযোগিতা লাভ করেন।
লিবিয়া এবং সুদানের সহযোগিতায় তিনি প্যাট্রিয়টিক স্যালভেশন মুভমেন্ট নামক সশস্ত্র বিদ্রোহী সংগঠন তৈরি করেন এবং ১৯৯০ সালে অভিযান চালিয়ে রাজধানী দখল করে নেন। দেবি প্রতি পাঁচ বছর পরপর নির্বাচনের আয়োজন করে আসছেন, যদিও সেসব নির্বাচনে তিনি প্রায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। তার বিরুদ্ধে অগণিত ক্যুয়ের প্রচেষ্টা সংঘটিত হয়েছে। শাসনামলের অধিকাংশ সময়ই কেটেছে বিভিন্ন বিদ্রোহী গ্রুপগুলোকে দমন করতে গিয়ে সৃষ্টি হওয়া গৃহযুদ্ধে।
ইদ্রিস দেবির স্ত্রীর সংখ্যা একাধিক। কোনো কোনো বর্ণনামতে, তিন অথবা চারজন। সর্বশেষ ২০০৫ সালে তিনি হিন্দাকে বিয়ে করেন। তার স্ত্রীদের মধ্যে হিন্দাই সবচেয়ে আলোচিত। তার সৌন্দর্য দিয়ে তিনি মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। গণমাধ্যমে তিনি চাদের ‘নিউ ফার্স্ট লেডি’ এবং ‘ফোর্থ লেডি’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
ইদ্রিস দেবির একাধিক বিয়ের মধ্যে হিন্দার সাথে তার বিয়েকে গোত্রগত কারণে রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে কৌশলপূর্ণ হিসেবে দেখা হয়। হিন্দা চাদের রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের বেসামরিক মন্ত্রীসভায় বিশেষ সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাকে প্রায়ই অজানুলম্বিত গাউন এবং স্কার্ফ পরে প্রেসিডেন্টের সাথে বিভিন্ন সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে এবং জনসেবামূলক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দেখা যায়। জনগণের কাছে তার বেশ জনপ্রিয়তা এবং গ্রহণযোগ্যতা আছে বলে অনুমান করা হয়।
জ্যানেট কাগামে, রুয়ান্ডার ফার্স্ট লেডি
পল কাগামে ২০০০ সাল থেকে গত ১৭ বছর ধরে রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট হিসেবে আছেন। এর আগে ১৯৯৪ সাল থেকে ২০০০ পর্যন্ত যখন তিনি প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন, তখনও তাকেই ডিফ্যাক্টো প্রেসিডেন্ট মনে করা হতো। তুতসি পরিবারে জন্মগ্রহণ করা কাগামে যুবক বয়সে ইওয়েরি মুসেভেনির অধীনে প্রথমে বিদ্রোহী সেনা হিসেবে এবং পরে উগান্ডার সেনাবাহিনীর অফিসার হিসেবে লড়াই করেছিলেন। সেখান থেকে তিনি ‘রুয়ান্ডান প্যাট্রিয়টিক ফোর্স’-এ যোগদান করেন। রুয়ান্ডার গৃহযুদ্ধের সময় তারা হুতুদেরকে পরাজিত করে গণহত্যার অবসান ঘটান। পরবর্তীতে অবশ্য তার শাসনামলেও হুতু শরণার্থীদের উপর প্রতিশোধমূলক গণহত্যা সংঘটিত হয়।
উগান্ডায় থাকা অবস্থায় ১৯৮৯ সালে পল কাগামের সাথে জ্যানেট নিরামোঙ্গির বিয়ে হয়। জ্যানেটও একজন তুতসি, যার পরিবার রুয়ান্ডা থেকে পালিয়ে কেনিয়াতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। ব্যবসা এবং প্রশাসনের উপর ডিগ্রীধারী জ্যানেট ১৯৯৪ সালের গণহত্যা শেষে স্বামীর সাথে রুয়ান্ডাতে ফিরে আসেন এবং যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত এতিম এবং বিধবাদের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন।
জ্যানেট কাগামে অনেকগুলো সংগঠনের উদ্যোক্তা, প্রতিষ্ঠাতা এবং পরিচালক। দারিদ্রতা দূরীকরণ, নারী শিক্ষার উন্নয়ন, শিক্ষার জন্য বৃত্তি প্রদান, পাঠাভ্যাস গড়ে তোলা, চিকিৎসার বিস্তার, এইডস বিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টি এবং প্রতিরোধ বিষয়ক একাধিক সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সাথে তিনি জড়িত আছেন। রুয়ান্ডার প্রথম পাবলিক লাইব্রেরিও তার হাতেই প্রতিষ্ঠিত হয়।
২০১০ সালে জ্যানেটকে ‘ওকলাহোমা ক্রিশ্চিয়ান ইউনিভর্সিটি’ এইডস এবং দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রী প্রদান করে। একই বছর ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম (WFP) তাকে তাদের শিশু পুষ্টি বিভাগের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত করে। ২০০৭ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) তাকে ‘আফ্রিকা এইডস ভ্যাকসিন প্রোগ্রাম’ এর উচ্চ প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত করে। ইউনিসেফও শিশুদের জীবনের মান উন্নয়নের জন্য তাকে এবং প্রেসিডেন্ট পলকে ‘চিলড্রেন’স চ্যাম্পিয়ন অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করে।