মাদুর পাতা প্রশস্ত ঘরটিতে পিনপতন নিস্তব্ধতা। প্রায় ডজন দুয়েক মানুষ আনুষ্ঠানিক ভঙ্গিতে হাঁটু গেড়ে হাতে ভর দিয়ে মুখোমুখি বসে আছে। দূর থেকে তাদের দেখলে ঠিক মূর্তির মতো লাগে! এমন রুদ্ধশ্বাস পরিবেশে বসে থাকা মানুষগুলোর দিকে ভালোভাবে তাকালে দেখা যাবে তারা সবাই জাপানের ঐতিহ্যবাহী পোশাক কিমোনো কিংবা হাকামা পরে আছে। বাহারী নকশার জেল্লাদার এই কিমোনোগুলোর মধ্যে যেমন আছে একটু বয়স্কদের জন্য মানানসই গাঢ় মার্জিত রঙের কিমোনো, তেমন আছে অল্প বয়সী মেয়েদের পছন্দের বিচিত্র কারুকার্য আর লম্বা হাতার কিমোনো। রঙ আর নকশার এই তারতম্য বুঝিয়ে দিচ্ছে সব বয়সী মানুষের উপস্থিতিই আছে এই ঘরে। কিন্তু বয়স যা-ই হোক না কেন, সবার লক্ষ্য এক দিকেই। সবাই মেঝের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে আছে যেখানে সারি সারি ছোট ছোট কার্ড সুন্দর করে সাজানো আছে। সবাই যেন বরফের মতো জমাট বেঁধে আছে যার যার জায়গায়!
হাকামা পরা ছোটখাটো বয়স্ক এক ভদ্রলোক বসে আছেন সবার সামনে। তার হাতে অনেকগুলো কার্ড। আচমকাই ঘরের নীরবতা ভেঙ্গে তিনি আবৃতি করা শুরু করেন-
ওয়াগা কোরোমোদে নি (আমার জামার হাতা ভিজে যাচ্ছে)
কণ্ঠস্বর কিছুটা প্রাচীন এবং রুক্ষ। প্রতি লাইনের শেষে স্বর তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর হচ্ছে।
ইউকি ওয়া ফুরি ৎসুৎসু (তুষার কণার প্রতিটি ফোঁটায় ফোঁটায়)
শব্দ ধীরে ধীরে মিশে গেল নিঃশব্দতার মাঝে। তবুও কেউ এক চুল নড়লো না।
নানিওয়া গাতা (নানিওয়া নদীতে)
ঠিক সেই মুহূর্তে, ঠিক ঠিক ‘গা’ শব্দটি উচ্চারণের সাথে সাথে যেন পুরো ঘরে বোমা পড়লো! বুড়ো লোকটি তখনও কবিতার বাকি পংক্তি বলে চলছেন, কিন্তু চারিদিকের হুটোপুটির মধ্যে সেটা শোনাই দায়। একটু আগে মূর্তির মতো চুপ করে থাকা মানুষগুলোর হাত এখন অসীম দক্ষতার সাথে বাতাসে সাঁই সাঁই শব্দ করে, সাজানো কার্ডগুলো ছুড়ে দিচ্ছে ঘরের অন্য প্রান্তে। সবাই উচ্চস্বরে কথা বলছে, ভারী পোশাকের খসখস শব্দ তুলে তারা ছুটে যাচ্ছে ছুঁড়ে দেয়া কার্ডগুলো কুড়িয়ে নিয়ে আসতে। মিনিটখানেক পর ঘর একটু শান্ত হলো বটে। তছনছ হয়ে যাওয়া কার্ডের সারিগুলো আবার সাজানো হচ্ছে। এরপর আবার পিনপতন নীরবতা। একদম শুরুর মতো। সবাই ঢিবঢিব বুকে কান খাড়া করে আছে পরের পংক্তি শোনার জন্য।
কোনো হিতো ও (সেই মানুষটা…)
পাঠক নিশ্চয়ই মনে মনে ভাবছেন, কী এমন পংক্তি আবৃত্তি হচ্ছে, যেগুলো শোনার সাথে সাথে এরকম বিষ্ফোরক অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে? শুনে তো কবিতাই মনে হয়! হ্যাঁ, কবিতাই বটে! ‘নানিওয়া নদীতে’ কবিতাটি লেডী ইসে’র কলম থেকে বের হয়েছিল, আজ থেকে প্রায় ১,১০০ বছর আগে। এই প্রেমের কবিতাটি এত প্রজন্মের পরেও সবার মুখে মুখে, বইয়ের পাতায় পাতায়। তিনি সহ আরো ৯৯ জন কবির লেখা ঠাঁই পেয়েছে ‘হাক্কিউ-নিন-ইশশু’ তথা ‘শত কবিতার বই’-এ, যেটি কিনা কারুতা খেলার মূল ঘুঁটি। হ্যাঁ, কারুতা একটি খেলাই বটে! কিন্তু প্রাচীন সব কবিতা, শান্ত সমাধিত কিমানো- এটা কি আসলেই খেলা, নাকি কোনো সাহিত্যচর্চার আসর?
সেভাবে চিন্তা করলে এটি আসলে দু’টোরই এক অপূর্ব সংমিশ্রণ।
কারুতার ইতিহাস
কারুতা সম্পর্কে জানতে হলে মোটামুটি তিনটি বিষয়ের দিকে আলোকপাত করতে হবে।
প্রথমটি হলো ‘শত কবিতার বই’। এই বইটির মধ্যে যে কবিতাগুলো আছে তা সংকলনের কাজ করা হয়েছিল ১২৩৫ সনে ফুজিওয়ারা নো তেইকা নামের একজন সম্ভ্রান্ত বংশের লোকের হাত ধরে। তিনি সপ্তম শতাব্দী থেকে বর্তমান পর্যন্ত যত কবিতা লিখেছিলেন সেগুলোর মধ্য থেকে বাছাই করে এই ১০০টি কবিতার সংকলন তৈরি করেন। এই একশটি কিন্তু এখনকার জনপ্রিয় হাইকু (৫-৭-৫ ছন্দ) ধাঁচে লেখা হয়নি। বরং আরেকটু পুরোনো ওয়াকা (৫-৭-৫-৭-৭ ছন্দ) ধাঁচে লেখা।
ঠিক কেন এই ১০০টি কবিতাই নিলেন, এটা নিয়ে রয়েছে ব্যাপক বিতর্ক। অনেক গবেষণা, অনেক বই লেখা হয়েছে এই পর্যন্ত, শুধুমাত্র এই ঘটনা ব্যাখ্যা করার জন্য। কেউ কেউ দেখিয়েছেন, মূলভাবের উপর নির্ভর করে এই ১০০টি কবিতাকে সমান ভাগে ভাগ করা যায়। আবার আরেক গবেষকের পর্যালোচনা অনুযায়ী, এই ১০০টি কবিতায় আসলে বিখ্যাত জাপানী উপন্যাস ‘গেঞ্জি মোনোগাতারি’’র বিভিন্ন সময়কে তুলে ধরা হয়েছে। কোনো কারণ থাকুক কিংবা সম্পূর্ণ কাকতালীয়, যা-ই হোক না কেন, বিনা তর্কে একটা কথাই বলা যায়, এই ১০০টি কবিতাই সাহিত্য জগতে রত্নের মতো মূল্যবান।
দ্বিতীয় ঘটনার সময়কাল হেইয়ান পিরিয়ড। খুব শান্তির সময় ছিল তখন। দিনগুলো লম্বা আর ক্লান্তিকর। জবড়জং কাপড় পরে রাজপরিবার আর তাদের সহচরদের গ্যাঁট হয়ে বসে থাকতে হতো। কথাবার্তা কম এবং মেপে মেপে বলার এই সময়টাতে মানুষজনের বিরক্তি আসবে বৈকি! আর তখন সেখান থেকে বাঁচতে অলস মাথা থেকে বের হবে নানা রকম খেলা, এটাই তো স্বাভাবিক। যত নতুন খেলা আবিষ্কার হয়েছিল এই সময়ে। এর মধ্যে জনপ্রিয় ছিল ‘কাই আওয়াসে’ কিংবা ‘শামুক মিলানো’ খেলা।
নিয়ম বেশ সোজা। শামুকের দুই খোলসের নিচের দিকে আঁকা থাকতো একই ছবি কিংবা খোদাই করা থাকতো একই শব্দমালা। আঁকা শেষে সবগুলো খোলস একসাথে মিশিয়ে দেয়া হতো। এখন একই শামুকের খোলসগুলো মিলাতে হবে। মোটামুটি এটাই ছিল খেলা। সময়ের সমুদ্রের বালুবেলায় আটকে থাকা এই শামুকের কিছু নিদর্শন এখনো দেখতে পাওয়া যায় জাদুঘরে। খোলসের সূক্ষ্ম রুচিশীল কারুকাজ দেখলে আন্দাজ করা যায়, সে যুগের মানুষের হাতের দক্ষতা আর অবসর কত বেশি ছিল!
তৃতীয় ঘটনার পূর্বাভাস কিছুটা ‘কারুতা’ নাম থেকে বোঝা যায়। জাপানি ভাষায় ‘কারুতা’ লেখা হয় কাতাকানা অক্ষরে। কাতাকানা অক্ষরগুলো শুধু মাত্র বরাদ্দ বিদেশী শব্দ লেখার জন্য। অর্থাৎ কারুতা একটি বিদেশী শব্দ। প্রকৃতপক্ষে ইউরোপ-আমেরিকার মানুষজন যে কার্ড খেলা খেলে সেটাই ষোড়শ শতাব্দীতে পর্তুগীজদের হাত ধরে জাপানে এসে হয়ে গেল ‘কারুতা’। শুধু যে নাম পরিবর্তন হলো তা নয়! পালটে গেলে খেলার নিয়মও। নানা সময়ে নানা ঢঙে শুরু হলো কারুতা খেলা।
৭২ কার্ডের ডেক নিয়ে তৈরি ‘তেন-শো’ কার্ড ছিল একদম শুরুর দিকের জনপ্রিয় খেলা। মূলত পর্তুগীজরা যেভাবে খেলতো সেই আদলেই তৈরি এটি। কিন্তু শীঘ্রই তার জায়গায় চলে আসলো ‘উন সান কারুতা’– পুরোপুরি জাপানি কায়দার খেলা। আর সেটাও দুদিন পর ভোল পাল্টে হয়ে গেল ‘হানাফুদা’ বা ফুলের কার্ড। কারুতার এই রকম ভেদের আসল কারণ কিন্তু খেলায় বৈচিত্র্য আনার জন্য নয়। কান টানলে মাথা এসে পড়ার মতো কার্ডের সাথে সাথে চলে আসে জুয়া খেলার কথা। এই জুয়া ঠেকাতে রাজ্য পুলিশের কত হম্বিতম্বি! তাই বারবার বোতল বদলে আসল মদ বেচার মতো করে বাড়তে থাকলো এই রকমভেদ।
এর মধ্যে একটি রকম ভেদ হচ্ছে ‘কাই আওয়াসে’র আদলে বানানো ‘ই-আওয়াসে’, যার মানে হলো ছবি মিলানোর কারুতা খেলা। জোড়ায় জোড়ায় বানানো হতো একই ছবিওয়ালা কার্ড। এরপর সব একসাথে করে, এখন মিলাও যে যত তাড়াতাড়ি পারো! সূর্যের নিচে বাস করে হেন কিছু নাই যার ছবি এঁকে এই কার্ড খেলা হয়নি। প্রথম দিকে হাতেই বানানো হতো, পরে এদো পিরিয়ডে শুরু হয় কাঠের কার্ডের উপর প্রিন্ট করা। এতে একসাথে অনেক কার্ড তুলনামূলক কম সময়ে বানানো যেত। সময়ের সাথে সাথে এই ছবি মেলানোর খেলা গিয়ে মিললো কবিতার লাইন মেলানোর খেলায়। আর এভাবেই জন্ম হলো শত কবিতার কার্ড খেলা।
দিনক্ষণ ঠিকঠাক বলা যায় না কখন সব রকম কারুতার মধ্য থেকে এই কবিতা মিলানোর কারুতাই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেল। হয়তো কবিতা বাছাইয়ের অপূর্ব দক্ষতা অথবা কবিতার সহজ গভীর কথাগুলো মানুষের মনে দাগ কেটেছিল কিংবা অন্য সব রকম ভেদের মধ্যে এটাই ছিল সবচেয়ে কঠিন। আসল কারণ যে কী তা কে জানে! তবে এটা নিশ্চিত হয়ে বলা যায়, যুগের চালুনির ফাঁকা গলে এটি সব সময়রেখা ধরে বয়ে চলেছে।
কারুতার প্রভাব
কেউ চিন্তাও করতে পারেনি কারুতার এই নতুন রূপ কী পরিমাণ নাড়া দেবে মানুষকে। আগে শুধু সাহিত্যপ্রেমীদের মুখে ছিল এই একশ কবিতা। কিন্তু এই খেলা চালুর পরে দাবানলের মতো সবার ঘরে ঘরে পৌঁছে গেল সেগুলো। এমনকি এখনো, এই আধুনিক যান্ত্রিক জাপানের মানুষের কথায়, উপকথায়, বাগধারায় আর উপমায় মিশে আছে এই কবিতায় আঁকা প্রেমগুলো, সেই নানিওয়া নদী কিংবা ইনাবা পাহাড়।
মেইজি পিরিয়ড আসতে আসতে সব পরিবারেও স্থান পেল এক সেট কারুতা। তখনকার দিনে, এমনকি এখনো এই ১০০টি কবিতা মুখস্থ থাকাকে ধরা হয় সাহিত্যের প্রতি অনুরাগের নিদর্শন হিসেবে। তার ফলশ্রুতিতে সাধারণ মানুষও পুরনো দিনের ছোট ছোট এই কবিতাগুলো পড়া শুরু করলো।
কারুতার জনপ্রিয়তার সাথে সাথে বাড়তে থাকলো এই বিষয়ক হরেক রকম পুস্তিকার সংখ্যা- ১০০টি কবিতা মনে রাখার লক্ষ্যভেদী নিয়ম, কার্ড সাজানোর নিয়ম, প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করার ৫০টি উপায় ইত্যাদি কত যে চটকদার শিরোনাম তাদের!
কারুতা খেলার নিয়ম
গৌরচন্দ্রিকা এতদূর টানার পর খেলার নিয়ম এই পর্যায়ে এসে ব্যাখ্যা করাটা বাধ্যতামূলকই বটে। মোট ২০০ কার্ড লাগে এই খেলায়। সামনে যিনি কবিতা পড়েন তার কাছে থাকে ১০০টি। এই ১০০টি পেস্টবোর্ড কার্ডের মধ্যে থাকে পুরো কবিতা লেখা, সাথে কবিদের কাল্পনিক ছবি। আর ১০০টি থাকে খেলোয়াড়দের সামনে, যাকে বলা হয় ‘তোরি ফুদা’। এই ১০০টি কার্ডে শুধুমাত্র কবিতাগুলোর শেষ পংক্তিগুলো (৭-৭ অংশটি) লেখা থাকে।
লেখার শুরুতে যে পরিবেশের বর্ণনা দেয়া হয়েছে তার নাম ‘কিয়োগি কারুতা’ অথবা প্রতিযোগিতামূলক কারুতা। ১০০টি ‘তোরি ফুদা’ ৫০-৫০ করে ভাগ করে দেয়া থাকে দুই প্রতিযোগীর মধ্যে (অথবা ২৫ করে ৪ জনের মাঝে বন্টন করে দেয়া হয়)। খেলা শুরুর আগে যে যার ভাগের কার্ড নিজের মতো করে সাজাবে, যাতে চোখে না দেখেও বুঝতে পারা যায় কোথায় কোন কবিতার কার্ড আছে।
কবিতা আবৃতির শুরুতে বলা হয় সংশ্লিষ্ট কবিতার আগের কবিতার শেষ অংশটুকু। এরপর একটু বিরতি। কোনো নড়চড় হয় না খেলোয়াড়দের হাতের। গুমোট একটি পরিবেশ। নীরবতা ঝুলতে থাকে ঘোষকের ঠোঁটে। এরপর নতুন কবিতা শুরুর সাথে সাথে যে যত আগে বুঝতে পারে কোন কবিতার কথা বলা হচ্ছে সে তত দ্রুত তার সামনে রাখা কার্ডগুলোর মাঝ থেকে সেই কবিতার বাকি অংশ লেখা কার্ডটি হাতের ধাক্কায় আলাদা করবে। মোটামুটি এই হচ্ছে কবিতা মিলানোর খেলা। প্রথম লাইন শুনে পরের লাইন লেখা কার্ড আলাদা করা।
দুজন বা চারজন, যতজন খেলোয়াড় থাকুক না কেন, তাদের প্রথম লক্ষ্য থাকে নিজের কার্ডগুলো যেন খেয়ে ফেলতে পারে না, যেটাকে বলা যায় ডিফেন্স। আর অ্যাটাক হচ্ছে নিজের সীমানার বাইরে অন্য প্রতিযোগীদের কার্ড বাকিদের আগে হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে সরানো। যারা খেলতে আসে তারা সবাই ভালোভাবে মুখস্থ করে আসে ১০০টি কবিতা। তাই পুরোটা তাদের শুনতেও হয় না। প্রথম শব্দ শুনেই বুঝে যায় সেটা কোন কবিতা এবং সেটা তার কাছে আছে নাকি প্রতিপক্ষের কাছে আছে।
তবে যে কবিতার প্রথম দিকের শব্দ অন্য কবিতার সাথে মিল আছে, সেগুলোর জন্য তিন-চার অক্ষর শোনা পর্যন্ত অপেক্ষা করে খেলোয়াড়রা। যেমন ‘নানিওয়া গাতা’ দিয়ে শুরু যে কবিতা তার ‘গা’ শোনা পর্যন্ত অপেক্ষা করে সবাই। কারণ একই কথা অন্য কবিতার শুরুতেও আছে যেমন- ‘নানিওয়া এনো’। তবে যদি ‘নানিওয়া এনো’ র কার্ড আগেই খাওয়া থাকে তবে আর ‘গা’ পর্যন্ত অপেক্ষা করবে না পাকা খেলুড়েরা। তাই কবিতা মুখস্থের সাথে সাথে হিসেবও রাখতে হবে কোন কোন কার্ড ইতোমধ্যেই ডেকে ফেলা হয়েছে।
খেলা শেষে হার-জিত নির্ধারণ করা হয় সহজেই। যে যত বেশি কার্ড ‘খেতে’ পারে সে জয়ী।
ম্যাচ চলাকালীন সময়ে প্রচন্ড শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা বিরাজ করে। আস্তে আস্তে কার্ড মিলানোর নেই কোনো অবসর। জিততে হলে থাকতে হবে প্রখর স্মরণ শক্তি, স্নায়ুযুদ্ধে দাঁড়ানোর মানসিকতা, চোখ কান রাখতে হবে খোলা, মন থাকবে দীঘির জলের মতো শান্ত একাগ্র আর হাত নাড়াতে হবে দ্রুততার সাথে যেন মনে হয় কিমোনোর আড়াল থেকে কোনো সাপের ছোবলে তছনছ হচ্ছে কার্ডের সারি! শরীর, মন আর মস্তিষ্কের এক অভূতপূর্ব মেলবন্ধন ঘটে এই কারুতা খেলায়।
কারুতার প্রকারভেদ
কবিতার এই কারুতাও বিভিন্নভাবে খেলা হয়। যেমন ‘চিরাশি তোরি’। ১০০টি কার্ড ইচ্ছামত বিছানো থাকে মেঝেতে। খেলোয়াড়ের সংখ্যার কোনো নির্দিষ্টতা নেই। আরেকটি আছে ‘গেনপাই গাসসেন’, যেখানে ৫০টি কার্ড দুজনের মধ্যে ভাগ না করে দুই দলের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়। ছোট ছোট বাচ্চা, যারা এখনো কবিতার ‘ক’-ও জানে না, তাদের জন্য আছে ‘বযু-মেগুরি’। ঘোষকের কাছে ছবিওয়ালা যে কার্ডগুলো থাকে, তারা সেগুলো নিয়ে খেলে। ছবি দেখে আলাদা করে কার্ডগুলো। পরে এরাই যখন বড় হয়, তখন নতুনদের চেয়ে দ্রুত চিনে ফেলে কোন কবিতার কোন কার্ড।
কারুতার কার্ড
কার্ডের চেহারা নিয়ে কথা বলতে গেলে শুরুতেই বলতে হয়, যদিও একটা নির্দিষ্ট মাপ এ আমলে ঠিক করা হয়েছে, কিন্তু পূর্বে এই কার্ডের নির্দিষ্ট কোনো মাপ ছিল না। পেস্টবোর্ডের তৈরি বাদেও, আগে যেগুলো তৈরি হত কাগজ অথবা পাতলা কাঠ দিয়ে। যার যেমন অর্থ-বিত্ত, তার কার্ড তত বেশি জমকালো আর সূক্ষ্ম কাজের। এমনকি সোনায় মোড়ানো কারুতা সেটও ছিল, যার দাম পড়তো তখনকার সময়ে ১১,০০,০০০ ইয়েন (টাকায় প্রায় ৮ লক্ষ)। পূর্বে জটিল চায়নিজ বর্ণ ‘কাঞ্জি’ ব্যবহার করে কার্ডের উপর নানা রকম ক্যালিগ্রাফির কারিকুরি করে লেখা হতো কবিতাগুলো। এখন অবশ্য হিরাগানা বর্মাণলার কার্ডও পাওয়া যায়, যাতে ছোট ছোট বাচ্চারা কিংবা স্বল্প পড়াশোনা জানা মানুষও খেলতে পারে।
নববর্ষ ও কারুতা
নববর্ষের সাথে কারুতার সম্পর্ক বেঁধে দেয়ার অনেকখানি কৃতিত্ব মেইজি পিরিয়ডের খবরের কাগজগুলোর। যদিও অনেক জাপানীর মতে, বছরের শুরুতে কারুতা খেলা আসলে শতবর্ষের ঐতিহ্য। উৎস যা-ই হোক, বর্তমানে নববর্ষকে সামনে রেখে এই খেলার জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতা হয়। সারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রথম হওয়া ছেলেমেয়েদের নিয়ে বসে বছরের শেষ আসর। এ আসরে প্রতিবছর একজনকে কারুতার ‘রাজা’ আর একজন মেয়েকে কারুতার ‘রানী’ উপাধি দেয়া হয়। শুনতে কী রাজকীয় লাগে, তাই না? এই সম্মানের আসনটি নিজের দখলে নিতে বছরব্যাপী চলে কত পরিশ্রম আর সাধনা!
তবে শুধু এক মৌসুমেই আটকে নেই কারুতা। সারা বছরই জুনিয়র, হাই স্কুলে বসছে প্রতিযোগিতার আসর। আর তা নিয়ে বাবা-মায়েদের আগ্রহের শেষ নেই। এই পশ্চিমা জ্বরে আক্রান্ত তরুণরা এই খেলার বরাতে কিছু তো শিখছে তাদের হাজার বছরের গরিমাময় শিল্প, সংস্কৃতি, সাহিত্য থেকে! হয়তো এই ক্ষুদে কারুতা খেলোয়াড় থেকে একসময় বের হয়ে আসবে মেধাবী কোনো সাহিত্যিক, গবেষক, সংস্কৃতি প্রেমিক। আর তার হাতেখড়ি হোক এই একশ কবিতা থেকেই। গভীর ভাব না বুঝুক, তবু ঠোঁটের আগায় থাকুক অক্ষরগুলো, সুরগুলো- একদিন না হয় ঠিকই ঠোঁট গলে পৌঁছাবে হৃদয়ে!
কালজয়ী কারুতা
‘আজি হইতে শতবর্ষ পরে
কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি
কৌতূহল ভরে’
কবিগুরুর এই লাইনগুলো যেমন তার লেখার জন্য সত্য, তেমনি সত্য এই একশ কবিতার জনকদের জন্যও। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো এই কবিতাগুলোর বিস্তৃতি! সবচেয়ে পুরনো কবিতটি লিখেছিলেন সম্রাট তেনচি, সেই সপ্তম শতাব্দীতে, আজ থেকে প্রায় ১,৩০০ বছর আগে। সেই কবিতা এখনো পঞ্চাশ প্রজন্ম পরেও বুকে ধারণ করে আছে এই ছোট্ট দ্বীপবাসীরা। এরকম উদাহরণ পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। গ্রিক সাহিত্য কিন্তু দু’হাজার বছর পর এখনো আমাদের হাতের নাগালে। কিন্তু রাস্তা থেকে কোনো মানুষকে থামিয়ে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় সেগুলো নিয়ে, কেউ সঠিক উত্তর দিতে পারবে এমন সম্ভাবনা খুবই কম। কিন্তু এদের ক্ষেত্রে চিত্রটি কিন্তু উল্টো। কারুতার মাহাত্ম্য এখানেই!
সম্রাট তেনচি যদি কখনো জানতেন তার সময়ের লেখা এত বছর পরেও মুখে মুখে ফিরবে। তবে তার মনোভাব কেমন হতো? খুব অবাক হতেন তা বোঝাই যায়। আজ কারুতার কল্যাণে লাইব্রেরিতে খটমটে সাহিত্যের পাশে রাখা ১০০ কবিতার বইগুলো ঘাঁটছে মানুষ, জানছে, পড়ছে। এমনকি ছড়িয়ে পড়ছে দেশের সীমানা অতিক্রম করে। কবিতা আর কবিতার পটভূমির অনুদিত হয়েছে অনেক ভাষায়। যদিও একটি নির্দিষ্ট ভাষায় লেখা হয়েছে, কিন্তু সাহিত্যের অমূল্য রতন কোনো নির্দিষ্ট সময়ের না, কোনো নির্দিষ্ট জনপদের না। বরং পুরো বিশ্বের।
তবে কারুতা কোনো একদিন জুডোর মতো অলিম্পিকে স্থান করে নিবে- এমন স্বপ্ন দিবাস্বপ্নের মতোই। হাজার হলেও এই খেলা খেলতে হলে আপনার মুখস্থ থাকতে হবে ১০০টি কবিতা, জানতে হবে সবগুলোর সুর, হৃদয়ঙ্গম করতে হবে এর ভেতরের রস! তাই এই আশা দুরাশাই বলা চলে!
কিন্তু নিজ আগ্রহ থেকে নতুন কিছু খুঁজতে খুঁজতে কারুতার দোরগোড়ায় পৌঁছালে কত যে লুকানো রত্নের সন্ধান পাওয়া যাবে, কে জানে? কবিতাগুলোয় চোখ বুলাতে থাকলে একসময় নিজে থেকেই আপনার কানে বাজবে তাদের গভীর, শান্ত সমাধিত পংক্তিগুলো-
“তাচি ওয়াকারে
ইনাবা নো ইয়ামা নো
মিনে নি ওরু
মাৎসু তো শি কিকাবা
ইমা কায়েরু কোন ”
ফিচার ইমেজ – asahishinbun.com