কোনো প্রতিভাবান মানুষকে যখন আমরা দেখি বা তার কথা শুনি, তখন নিশ্চিতভাবে একটি কথা মাথায় আসে। তা হলো, এ মানুষটার দিন কীভাবে কাটে? মনে হয় অসাধারণ কাজ করেই কেটে যায় তার দিন। কিন্তু তাদের জীবনও আমাদের মতো ছোটোখাট বিষয় নিয়ে তৈরি হয়। আমাদের একটি ভুল ধারণা আছে যে, প্রতিভাবান মানুষরা কোনো রুটিন অনুসরণ করেন না। অগোছালো, লাগামহীন জীবনযাপন করলেই প্রতিভাবান হওয়া যায় এমন ভুল ধারণাও অনেকের আছে। পছন্দের লেখক ধূমপান বলে অনেকে লেখক হবার আশায় নিজেরাও সিগারেট খান। কিন্তু আসলে ব্যাপারটি এমন নয়। সৃষ্টিশীল মানুষদের অনেকে জীবন কাটান কঠিন নিয়ম কানুনের মধ্যে। আবার অনেকের লাগামহীন জীবনের মাঝেও আছে একধরনের রুটিন। তবে একটি ব্যাপার তাদের সবার মধ্যে এক। তা হলো, তারা তাদের কাজের ব্যাপারে আপোষহীন।
আর্নেস্ট হেমিংওয়ে
Early to bed, early to rise
Makes a man healthy wealthy and wise
আমরা ছোটবেলা থেকেই এ কথা জানি। কিন্তু এ কথার পাকাপোক্ত অনুসারী ছিলেন নোবেল বিজয়ী আমেরিকান লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, যার লেখনীতে বিংশ শতাব্দীর সাহিত্য নতুন মোড় নিয়েছিলো। জীবনকে তিনি দেখেছেন খুব কাছ থেকে। বিখ্যাত উপন্যাস ‘ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সি’ এর লেখক প্রতিদিন সকাল ৫.৩০ থেকে ৬ টার মধ্যে উঠে যেতেন। তারপর লেগে যেতেন লেখালেখিতে। প্যারিস রিভিউকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে হেমিংওয়ে বলেন,
আমি যখন কোনো গল্প বা বইয়ের উপর কাজ করি তখন ভোরের প্রথম আলো ফোটার সাথে সাথে আমি লেখালেখি শুরু করে দিই। ঐ সময় আপনাকে বিরক্ত করার মতো কেউ থাকে না। পরিবেশ ঠাণ্ডা থাকে। আপনি লিখতে বসেন আর ভেতর থেকে উষ্ণতা অনুভব করেন। আপনি যা লিখেছেন তা আবার পড়তে থাকেন। যখন আপনি বুঝতে পারেন এ লেখার পর কী হবে তখন আপনি আবার লেখা শুরু করেন। … আপনি সকাল থেকে শুরু করে দুপুর পর্যন্ত কাজ করতে পারেন অথবা এর আগেই শেষ করতে পারেন। যখন আপনি লেখা থামান তখন আপনার ভেতরটা খালি হয়ে যায়। কিন্তু তা একইসাথে পরিপূর্ণতার স্বাদ। ভালোবাসার মানুষটির সাথে সঙ্গমের পর যেমন অনুভূতি ঠিক তেমন। পরদিন সকালে আপনি লেখা শুরু করার আগপর্যন্ত আর কোনোকিছুই আপনাকে কষ্ট দিতে পারে না। কোনোকিছু খুব একটা মানেও রাখে না আপনার কাছে সকালের আগপর্যন্ত। কিন্তু সকাল হওয়ার অপেক্ষায় থাকাটাই সবচেয়ে কঠিন।
যখন তার লেখালেখি ভালো যেত না, তখন তিনি চিঠিপত্রের উত্তর দিতেন। হেমিংওয়ে অল্প কিছু লেখকের মধ্যে ছিলেন যারা দাঁড়িয়ে লিখতেন। তিনি দাঁড়িয়ে টাইপরাইটারে লেখালেখি করতেন।
হারুকি মুরাকামি
হারুকি মুরাকামি জাপানের জনপ্রিয় একজন লেখক। দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার মতে, তিনি জীবিত ঔপন্যাসিকদের শ্রেষ্ঠদের একজন। মুরাকামিও নিয়মিত একটা নির্দিষ্ট ছক মেনে চলেন। মুরাকামি কোনো লেখক সংঘের অংশ নন। তার জীবন অনেকটা নিভৃতচারী। গানকে ভালোবাসেন। তার মতে লেখালেখিতে গান তাকে সাহায্য করে। তার লেখার প্রথম পাঠক তার স্ত্রী। যখন তিনি কোনো উপন্যাস লেখেন, তখন ভোর চারটায় উঠে লেখালেখি শুরু করে দেন। এরপর চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা লেখালেখি করেন।
পুনরাবৃত্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। এটা এক ধরনের সম্মোহন। আমি এই সম্মোহনের মাধ্যমে মনের গভীর স্তরে পৌঁছানোর চেষ্টা করি।
জীবনকে সহজ সরলভাবে অতিবাহিত করতেই ভালোবাসেন মুরাকামি। ধূমপান ছেড়ে দিয়েছেন। খাবার খান মূলত নিরামিষ এবং মাছ। বাইরে দৌঁড়াতে যান প্রতিদিন। তিনি দীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে নিয়মিত দৌঁড়ান। একনিষ্ঠভাবে কাজ করে আরও ভালো উপন্যাস লেখাই তাঁর মূল লক্ষ্য।
একটা উপন্যাস লিখতে আমার এক-দুই বছর লেগে যায়। তখন আমি দিনের পর দিন লিখি। যখন আমি লিখতে লিখতে ক্লান্ত হয়ে যাই, তখন জানালাটা খুলে দিই তাজা বাতাসের জন্য। তারপর নিজেকে আনন্দ দেয়ার জন্য আবার আরেকটা লাইন লিখি। আর আশা করি তাতে পাঠকরাও আনন্দ পাবেন।
স্টিফেন কিং
শাইনিং, ইট, গ্রিন মাইলের মতো বিখ্যাত বইয়ের লেখক স্টিফেন কিং। তাঁর বই রূপান্তরিত হয়েছে চলচিত্রে। অসংখ্য পুরষ্কার বিজেতা এই লেখক বছরের ৩৬৫ দিনই লেখালেখি করেন। প্রতিদিন দু’হাজার শব্দ করে লেখেন।
“আপনার শোবার ঘরের মতো আপনার লেখার ঘরও ব্যক্তিগত হওয়া উচিত। লেখার ঘরে আপনি স্বপ্ন দেখতে যান। আপনি প্রতিদিন একই রুটিনে লেখালেখি করেন যতক্ষণ না হাজার শব্দ আপনার কাগজে উঠে আসছে। অনেকটা শোবার আগে যেমন প্রতিদিন বিছানা তৈরি করেন, ঠিক তেমনই আপনি হাজার শব্দ লেখার একটা অভ্যাস তৈরি করেন, যাতে আপনি স্বপ্ন দেখার জন্য প্রস্তুত হতে পারেন। ঘুম এবং লেখালেখি দুটোতেই আমরা শরীরকে স্থির করি আর যৌক্তিক চিন্তাকে ভেদ করে নতুন দুয়ার উন্মোচন করি।”
ডাব্লিও বি ইটস
আরেক নোবেল বিজয়ী আইরিশ কবি ডাব্লিও বি ইটস এর জীবনও ছিলো ছকে বাঁধা। ইটস আরেক কবি এডইউন এলিসকে চিঠিতে লিখেছিলেন,
আমি সকাল ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত পড়ি। তারপর এগারোটা থেকে দুইটা পর্যন্ত লেখালেখি করি। দুপুরের খাবার খাওয়ার পর সাড়ে তিনটা পর্যন্ত পড়ি। তারপর জঙ্গলে হাঁটতে যাই অথবা মাছ ধরি বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত। তারপর আমি চিঠি লিখি অথবা সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত লেখালেখি করি। তারপর আমি রাতে খাবার আগে একটু বাইরে বের হই।
এমনই রুটিন মেনে চলতেন ইটস। তার লেখার গতি ছিল খুবই ধীর। দিনে তিনি একটি কবিতার ৬ থেকে ৭ লাইন লিখতেন মাত্র।
লিও তলস্তয়
লিও তলস্তয় সাহিত্যের ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। ওয়ার এন্ড পিস, আন্না কারেনিনার মতো বিখ্যাত কাজের স্রষ্টা তিনি। সাহিত্যপ্রেমীদের চোখের মধ্যমণি তলস্তয়। তিনিও তার ছকে বাঁধা জীবন থেকে বের হতে চাইতেন না। তার ডায়েরিতে তিনি লিখেছেন,
আমাকে প্রতিদিন লিখতে হয়। কাজের সাফল্যের জন্য নয়। এজন্য লিখি যাতে আমি আমার প্রতিদিনকার রুটিন থেকে বিচ্যুত না হয়ে যাই।
মজার ব্যাপার হলো, তলস্তয় তার সকালের নাস্তায় দুটি ডিম সিদ্ধ খেতেন। এরপর বিকাল পাঁচটার আগে আর কিছু খেতেন না। ১৮৮০ সাল থেকে তিনি দুপুরের খাবার খাওয়া শুরু করেন। সকালে খাবারের সময় কোনো কথা বলতেন না। তবে দিনের লেখা শেষ হবার পর রাতে তিনি পরিবারের সাথে সময় কাটাতেন। কোনো অতিথি থাকলে তাদের সময় দিতেন।
খালেদ হোসেনি
খালেদ হোসেনি আফগান বংশোদ্ভূত আমেরিকান লেখক। তার প্রথম বই ‘দ্য কাইট রানার’ নিউইয়র্ক টাইমস বেস্ট সেলার হয়েছিলো। তার তিনটি বইয়ের তিনটিই সফল। খালেদ হোসেনির মতে,
অনেক মানুষ আমাকে বলেছে তাদের মনের মধ্যে একটা বই আছে। কিন্তু তারা কখনও একটা শব্দও লিখে নি। আমি পুরনো কথাটিই বলবো। লেখক হওয়ার জন্য আপনাকে লিখতে হবে। প্রতিদিন লিখতে হবে। আপনার ইচ্ছে হোক কিংবা না হোক। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নিজের জন্য লেখা। যে গল্পটি আপনি বলতে চান, পড়তে চান, সে গল্পটিই লিখুন। আরেকজন কী চায় তা জানা অসম্ভব। তাই এতে সময় নষ্ট করবেন না। সে বিষয় নিয়েই লিখুন যা আপনার আত্মার সাথে যুক্ত, যা আপনাকে রাতে জাগিয়ে রাখে”
ইবি হোয়াইট
ইবি হোয়াইট একজন আমেরিকান লেখক। শিশুদের জন্য বই লেখার জন্য পুরস্কৃত হয়েছেন। পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করেছেন ‘দ্য নিউইয়র্কার’-এ।
কাজ করার সময় আমি কখনও গান শুনি না। গান শোনার সাথে সাথে আমার মনোযোগ কাজ করে না। আমার এটা পছন্দ নয়। কিন্তু ছোটখাট বিচ্যুতির মধ্য দিয়ে আমি কাজ করতে পারি। আমার বাড়িতে একটা শয়নকক্ষ আছে যা বাড়িটির কেন্দ্রবিন্দু। রান্নাঘর যাওয়ার জন্য, ফোন ধরার জন্য আমার এই কক্ষের মাঝখান দিয়েই যেতে হয়। এই কক্ষটি সদা উজ্জ্বল ও আনন্দপূর্ণ থাকে। আমার চারপাশে এতকিছু হওয়ার পরেও আমি এই কক্ষটিকে লেখার জন্য ব্যবহার করি।
কোনো মেয়ে যদি আমার টেবিলের নিচে কার্পেট ঝাড়ু দেয়ার মেশিন দিয়ে কার্পেট পরিষ্কার করে আমি তাতে কখনও বিরক্ত হই নি। এতে আমার লেখাতেও কোনো ব্যঘাত ঘটে নি। তবে যদি মেয়েটি খুব সুন্দর কিংবা খুব কদাকার হয় তাহলে ভিন্ন কথা! ভাগ্য ভালো, আমার স্ত্রী আমাকে নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামায় না। আমি শুনেছি অন্যান্য লেখকদের স্ত্রীরা নাকি এমন হয়। এর ফলে যা হয়েছে আমি লেখক এই কথাটা আমার পরিবারের কারও মাথায় কাজ করে না। তাই তারা আমার চারপাশে যেভাবে চায় সেভাবেই হট্টগোল করে। আমি যদি এই সব কিছু থেকে বিরক্ত হয়ে যাই তখন আমার যাওয়ার মতো জায়গা আছে। যে লেখক লেখার জন্য সঠিক পরিবেশের অপেক্ষায় থাকে, সে কাগজে একটা শব্দ না লিখেই মৃত্যুবরণ করবে।
ফিচার ইমেজ- Biography