Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জেমস জয়েস: ইংরেজি সাহিত্যের এক অমর কথাশিল্পী

স্রষ্টা অনেক কণ্ঠে তোমার সাথে কথা বলেছেন, কিন্তু তুমি শুনতে পাও নি।”  – জেমস জয়েস

ইংরেজি ভাষার যে কয়েকজন সাহিত্যিক তাদের সাহিত্যকর্মে সমাজের সব স্তরের মানুষের কথা বলেছেন এবং সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম সেরা হয়ে আছেন আইরিশ সাহিত্যিক জেমস জয়েস। জীবনকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন এই সাহিত্যিক, সমাজের বাস্তব ছবি দেখার জন্য ঘুরেছেন পথে-প্রান্তরে, দেশে দেশে। প্রচণ্ড শব্দ শক্তির অধিকারী এই প্রথিতযশা কথা সাহিত্যিক তাঁর লেখনীতে ফুটিয়ে তুলেছেন জীবনের গল্প, সমাজের গল্প। তাঁর লেখায় একধারে স্থান পেয়েছে খুব সাধারণ জীবনের বর্ণাঢ্যতা, আবার মানব মনের বিচিত্র সব চিন্তা প্রবাহ (যা stream of consciousness নামে পরিচিত)। এমনকি শেষ উপন্যাসে তিনি আবিষ্কারই করে ফেলেন এক বিচিত্র ভাষা শৈলীর। আজকের আয়োজন এই সাহিত্যিককে নিয়েই।

জন্ম ও বেড়ে ওঠা

১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে ডাবলিনে জন্মগ্রহণ করেন জয়েস। জীবনের প্রথম ২০ বছর তিনি জন্মভূমি ডাবলিনেই কাটিয়েছেন। এ সময় তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন অলিতে-গলিতে, পথে-প্রান্তরে। খুব কাছ দিয়ে দেখেছেন মানুষের জীবন। পরবর্তীতে ইউরোপের বিভিন্ন শহর যেমন- ট্রিএস্ট, জুরিখ এবং প্যারিসের মতো শহরগুলোই হয়ে ওঠে তাঁর অস্থায়ী সব ঠিকানা। দীর্ঘ তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে তিনি লিখেছেন। এগুলোর মধ্যে আছে দুটি কবিতার বই, একটি ছোটগল্পের সংকলন, একটি নাটক এবং তিনটি উপন্যাস। ‘মাত্রা ও পটভূমি’তে ভিন্ন ভিন্ন হলেও প্রিয় শহর ডাবলিনের প্রভাব ছিল তাঁর সব লেখাতেই। ডাবলিন এমনই এক শহর ছিল তাঁর কাছে, যে শহরকে তিনি একইসাথে পাগলের মতো ভালোবাসতেন এবং ঘৃণাও করতেন। তাঁর লেখাতেই উঠে এসেছে-

“Each of my books is a book about Dublin. Dublin is a city of scarcely 300,000 population, but it has become the universal city of my work.”

লেখনীর শুরু যেভাবে

ডাবলিন যে তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একটা অংশ- বিষয়টি তিনি তাঁর বাবার মতোই কখনোই মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। একটা স্বাধীন, সুন্দর ডাবলিনের স্বপ্ন দেখতেন তিনি ছোটবেলাতেই। তাঁর পড়াশোনার শুরু জেজুইটে (Jesuits), এসময়েই তিনি বিদেশি ভাষাতে অসামান্য দক্ষতা দেখাতে শুরু করেন। যখন তিনি ডাবলিনের ইউনিভার্সিটি কলেজের ছাত্র, তখন থেকেই তিনি পুরোদমে বই রিভিউ, কবিতা, ছোটগল্প এগুলো লেখা শুরু করেন। কিন্তু এতে তো আর পেট চলবে না! তিনি প্যারিসে চলে গেলেন চিকিৎসা বিজ্ঞানে পড়াশোনা করার জন্য। কিন্তু ফল হল উল্টো, লাইব্রেরিমুখী হবার বদলে সমানতালে ভিড় জমাতে শুরু করলেন মদখানা আর পতিতালয়ে।

তরুণ জেমস জয়েস; Source: Fortyfivedownstairs

প্রণয়ের সূত্রপাত যেভাবে

১৯০৪ সাল; হঠাৎ করেই জয়েসের ভালো লেগে গেল গ্যালওয়ের এক অশিক্ষিত কিন্তু অত্যন্ত আবেদনময়ী নারী নোরা বার্নাকেলকে। নোরাও পড়ে গেলেন ভালোবাসার এক মায়াবী জালে। পরবর্তীতে জয়েস সম্পর্কে নোরার অভিব্যক্তি ছিল এমনই-

”electric blue eyes, yachting cap and plimsolls. But when he spoke, well then, I knew him at once for just another worthless Dublin boaster trying to chat up a country girl.”

কিন্তু তিনি পরবর্তীতে কখনোই জয়েসকে ছেড়ে যান নি। জয়েসের অত্যন্ত জটিল এবং কঠিন জীবন সংগ্রামের সময়ে তিনি জয়েসের পাশেই ছিলেন। তাকে নিয়েই জয়েস ইউরোপে পাড়ি জমান। পরবর্তী ১০ বছর যাযাবরের মতো ঘুরতে থাকেন বিভিন্ন শহরে। সংসার পাতেন, হয়ে ওঠেন বাচ্চাকাচ্চার জন্মদাতা।

জেমস জয়েস ও তাঁর পরিবার; Source: Thebookoflife

সাফল্য

১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ; জয়েসের জীবনে আসে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য। তাঁর ২২ বার নাকচ হওয়া ছোটগল্পের বইটি ছাপাতে রাজি হন লন্ডনের এক প্রকাশক। পরবর্তীতে প্রথিতযশা মার্কিন কবি এজরা পাউন্ড তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ’A Portrait of the Artist’এর সম্পাদনার কাজ করেন। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত Ulysses করে তোলে তাঁকে সবার কাছে পরিচিত। তিনি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন আস্তে আস্তে।

জেমস জয়েসের সাহিত্য বিশ্লেষণ

চাকচিক্যময় জীবন

জেমস জয়েস তাঁর সবথেকে বড় কাজ ইউলেসিসের (Ulysses) নামকরণ করেছেন বিখ্যাত গ্রিক এক বীরত্বগাঁথা থেকে। ইউলেসিসে বর্ণনা করা হয়েছিল এক মহান গ্রিক বীরের ট্রয় যুদ্ধ জয় শেষে তাঁর নিজ দেশ ইথাকায় ফেরার উপাখ্যান। কিন্তু জয়েস পশ্চিমা উচ্চ সংস্কৃতির চর্চা থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে এসে দেখিয়েছেন এক সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপট। তাঁর ইউলিসিসের নায়ক কোন মহান সম্রাট অথবা কোন বীর নয়। তাঁর নায়ক এক সাদামাটা, দয়ালু, বোকা মানুষ; নাম তার লিওপারড ব্লুম। খুব ছোটোখাটো একটা চাকরি করা ব্লুমের চরিত্রে ত্রুটির কোন শেষ নেই। সে চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়, তার স্ত্রী অন্যের সাথে সম্পর্কে জড়িত। ক্যাথলিক সমাজে ইহুদি ব্লুম উপেক্ষার পাত্র। কেউই তার দিকে ভালো নজরে তাকায় না। তারপরও লিওপারড স্বপ্ন দেখে একটি সুন্দর, হাসিখুশি জীবনের স্বপ্ন।

জয়েসের আঁকা ব্লুম চরিত্র;Source: Joyceproject.

নায়কোচিত কোন গুণ না থাকা সত্ত্বেও জয়েস এই রকম ব্যক্তিত্বের দিকে ‘সমাজের দৃষ্টি’ নিয়ে আলোকপাত করেছেন। তাঁর মতে, ব্লুমের অধিকার রয়েছে সমাজ থেকে যোগ্য সম্মান পাবার। অবশ্যই তাকে নিয়েও সমাজের ততটা আগ্রহ থাকা উচিত যতটা আগ্রহ থাকে মানুষের গ্রিক বীর ইউলিসিসের গল্পের প্রতি। জয়েজ বলেন,

”আমাদের সমাজ অত্যন্ত হীনভাবে তার উঁচু শ্রেণী নিয়ে সবসময়ই ব্যস্ত। কিন্তু লিওপারড ব্লুমও যে একজন মানুষ, জীবন যুদ্ধের একজন নায়ক, একথা সমাজ বিবেচনা করে না।”

জেমস জয়েস এই চরিত্রের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, আমরা আমাজের জীবনে যে প্রতিদিনের কাজগুলো করি (যেমন- খাওয়া, নিজের দুঃখে ও মানুষের দুঃখে দুঃখিত হওয়া, বাজার করা, কাপড় ধোয়া ইত্যাদি) এগুলো আদৌ ছোট কোন ব্যাপার নয়। আমরা যদি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ঠিক করি তাহলে দেখতে পাবো এই ব্যাপারগুলো সুন্দর, গভীর এবং আসলেই প্রশংসার দাবীদার। আমাদের প্রতিদিনের জীবন ঐ গ্রিক বীরের তুলনায় কোন অংশে কম নয়। আমাদের প্রত্যেকের জীবনটা একেকটা ছোট ছোট যুদ্ধক্ষেত্র আর এখানে আমরাই সৈনিক। জয়েসের উপন্যাস আমাদের এই প্রচলিত নজর বা দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের কথা বলে। আমাদের নিজেদেরকেই নিজেদের সমাদর করা শিখতে হবে, এটা মেনে নিতে হবে যে আমাদের ক্ষুদ্র জীবনের নায়ক বা নিয়ন্ত্রক আমরাই।

চিন্তা প্রবাহ

সাধারণভাবে আমরা নাটক, সিনেমায় যে জীবনের প্রতিফলন দেখি, সেটাই কি আমাদের জীবনের আসল প্রতিচ্ছবি? আড়ম্বরতা, গুছিয়ে কথা বলা, সবসময় সেজেগুজে চলা- এগুলো সমাজের ক্ষুদ্র একটা অংশের চিত্র মাত্র। এখানে দেখানো জীবনটা সমাজের আসল চিত্র কখনোই নয়। ‘ব্লুম’ চরিত্রের মধ্যে জয়েস দেখিয়েছেন, ব্লুম সাইকেলে করে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে গাড়ি, ট্রাম এগুলো দেখছে আর আপনমনে ডুবে যাচ্ছে নিজের জীবনের চিন্তায়।

সমাজে বিচিত্র ধরনের মানুষের বাস। তাদের চিন্তাধারা আরও বেশি বিচিত্র। সবার চিন্তাগুলো যদি এক করা যায়, তাহলে দেখা যাবে অনেকেই একই চিন্তা করছেন ভিন্নভাবে। জেমস জয়েস বলেন,

”সবার যদি একটা সমষ্টিগত ধারণা থাকতো আমাদের সমাজের প্রতিটি মানুষের চিন্তা- মচেতনার ব্যাপারে তাহলে খুব ভালো হতো। সবাই সবার ধারণা ও অনুভূতির ব্যাপারে সচেতন থাতে পারতাম। এর ফলে আমরা খুব সহজে অন্যকে ক্ষমা করতে পারতাম, কারোর উপর রেগে যেতেও আমাদের দ্বিতীয়বার ভাবতে হতো। এই সমষ্টিগত চিন্তা-ভাবনা আমাদের জীবনকে একটা নতুন চেতনায় আলোকিত করতো, যেখানে সবাই সবাইকে নিয়েই ভাবে।”

শব্দের শক্তি

আমাদের মনের প্রকাশ মুখের ভাষাতে সবসময় ঘটে না। প্রায়ই নানা মানুষকে সন্তুষ্ট করতে আমরা আমাদের মুখের কথায় প্রয়োগ করি এক, আর আমাদের মনে থাকে অন্য কিছু। আবারো অনেক সময় দেখা যায়, আমাদের প্রয়োগ করা ভাষাতে আমাদের মনের কথাগুলো যেন প্রাণ খুঁজে পায় না অনেক সময়ই। তাই তো জয়েস তাঁর শেষ উপন্যাস Finnegans Wake-এ এক বিচিত্র ভাষাই আবিষ্কার করে ফেলেন। প্রায় চল্লিশের উপরে বিভিন্ন ভাষার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে তিনি তৈরি করে ফেলেন এই অদ্ভুত ভাষাশৈলীর। তাঁর ভাষার শব্দ লগুলো ছিল উদ্ভট রকমের! যেমন- funferall, bisexcycle ইত্যাদি।

জুনা ব্যারনের অংকনে জয়েস;Source: Thebookoflife

শিল্প কী এবং কেন?

শিল্প কী, কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়িয়েছেন তিনি সারাজীবন। তিনি তাঁর বিখ্যাত আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ‘The Portrait of the Artist as a Young Man’এ বলেছেন, একজন শিল্পীর সত্যিকারের শিল্পী হয়ে উঠতে দুটি গুণ থাকা দরকার-

১। Integritas বা শিল্পী হিসেবে একজনের শৈল্পিক সত্ত্বার অখণ্ডতা।

২। Claritas বা পাঠকের কাছে একজন শিল্পীর দায়বদ্ধতা।

মৃত্যু

১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়েন জেমস জয়েস। ঐ বছরেই জুরিখে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। ভাষার ব্যবহার এবং শব্দ শৈলীর বিচিত্র ব্যবহারে তিনি ছিলেন অনন্য এবং অদ্বিতীয়।

জেমস জয়েসের সমাধিক্ষেত্র;Source: Thebookoflife

ফিচার ইমেজ- Billboard.com

Related Articles