প্রথমেই বলে নেই কর্মজীবি নারীর সংজ্ঞাটি- “অর্থের বিনিময়ে একটি নির্দিষ্ট কর্মক্ষেত্রে নিজের মেধা ও মননের অকাট্য প্রমাণ রেখে কাজ করে যাওয়াকে বলে কর্ম। আর এই বিরাট গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত নারীদেরকে বলা হয় কর্মজীবি নারী।”
বর্তমান যুগে নারীরা গৃহস্থালী কাজের পাশাপাশি ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করছে বাণিজ্যিক কর্মক্ষেত্রে। এখানে বাণিজ্যিক বলছি, কারণ আমাদের সমাজে একজন নারীর সংসারের যাবতীয় কাজ, সন্তান পালন, ঘরের বাইরের কাজ, বুনন, শৈল্পিক কাজ সহ যাবতীয় অবৈতনিক কাজকে ঠিক ‘কর্ম’ বলে মনে করা হয় না। আমি সম্মান জানাই সেসব কর্মজীবি নারীদের, যারা ঘরের কাজ সামলে অফিসের কাজও সামলে চলেছেন, কারণ এটা খুব কষ্টসাধ্য। বাসা-অফিস সামলে উঠতে গিয়ে রীতিমত নাভিশ্বাস উঠে যায়।
বাবার বাড়ির সকলের কাছ থেকে যথেষ্ট সাপোর্ট পাওয়া গেলেও দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য থাকে শ্বশুরবাড়ির সকলের। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চরম অসন্তোষের শিকার হতে হয়। সুযোগ পেলেই সামনে অথবা আড়ালে তারা তাদের অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে থাকেন।
একজন কর্মজীবি নারী তার উপার্জিত অর্থ নিজের সিদ্ধান্ত ও প্রয়োজন অনুযায়ী খরচ করতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে তাকে অনেক লাঞ্চনা-বঞ্চনা সহ্য করতে হয়। বেশিরভাগ সময়ই স্বামীকে হিসেব দিতে হয় তার উপার্জিত অর্থ ব্যয়ের খাত সম্পর্কে। বাড়তি বা অনর্থক খরচের অভিযোগ শুনতে হয় যদি বাবা, মা, ভাই বা বোনের জন্য কোনো কিছু কেনা হয়। নারীর বুক চিড়ে বেরিয়ে আসে নীরব দীর্ঘঃশ্বাস।
স্ত্রীর অভিভাবক স্বামী বলে বোধকরি তার উপার্জনের একমাত্র দাবিদারও তিনি। এমন অনেক পরিবার আছে যেখানে একজন নারীকে অনেকটা সংগ্রাম করতে হয় তার চাকরিটা টিকিয়ে রাখার জন্য। প্রতিনিয়ত মানসিক দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়ে পার করতে হয় দিন। অনেককে এমনও বলতে শুনেছি যে, “আমি যেহেতু তোমাকে চাকরি করার অনুমতি দিয়েছি, তাই আমি যখন চাইব, তখনই তোমার চাকরি থেকে অবসর নিতে হবে। এর জন্য মানসিকভাবে তৈরি থেকো।”
পুরুষরা কি পারে না তাকে বিন্দুমাত্র সম্মান দিতে? পারে না তাকে উৎসাহ দিতে? পারে না তার অনুপ্রেরণা হয়ে উঠতে? পারে না তার জন্য কিঞ্চিৎ গর্ববোধ করতে? পারে না তার মানসিক নির্যাতনের কারণ না হয়ে মানসিক শক্তি হয়ে উঠতে? পারে না তার কিছুটা শান্তির কারণ হতে? হয়তবা কিছু পুরুষ পারে, কিন্তু আমাদের সমাজে তাদের সংখ্যাটা নেহায়েতই হাতে গোণা।
বর্তমান যুগে বাস করেও অনেক পুরুষের ধারণা আজও মধ্যযুগীয়। শিক্ষার আলো তাদের বিবেককে জাগ্রত করতে পারেনি আজও। তারা বেরিয়ে আসতে পারেনি অন্ধ ধ্যান-ধারণার বলয় থেকে। একজন নারীর কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার পেছনে অনেকগুলো কারণ থাকে। আত্মনির্ভরশীলতা, অর্থ উপার্জন, ক্যারিয়ার, উন্নয়ন, সমাজ সচেতনতা, দায়িত্ব প্রভৃতি কারণ থাকে একজন নারীর কর্মজীবি নারী হয়ে ওঠার পেছনে। নারীর কর্মজীবনে প্রবেশ করা যতটা না আর্থিক প্রয়োজনের তার থেকেও অনেক বেশি তার আত্মপরিচয়ের, আত্মমর্যাদার, ব্যক্তিত্ব বিকাশের।
অনেক নারীই আছেন যারা পেশাজীবনে সফল, শিক্ষাগত যোগ্যতাও নেহায়েত কম না। কিন্তু বাড়িতে স্বামীর কাছ থেকে কটু কথা শুনতে হয় প্রায়ই। অনেকে গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করেন না। এ যেন পুরুষের অস্তিত্ব এবং আধিপত্য স্থাপনের অনন্য কীর্তি।
জাহান (ছদ্মনাম), বিয়ে হয়েছে ৩০ বছর হলো। একসময় ব্যাংকে চাকরি করতেন। স্বামীর চাপের মুখে তাকে এক সময় চাকরি ছাড়তে হয়। সংসার, স্বামী-সন্তান নিয়ে তার দিন কেটে যাচ্ছিল। একসময় ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেন। তাকে মাঝে মাঝেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শোনা যায়, কখনো জিজ্ঞেস করা হয়ে ওঠে নি তার আঁচল চাপা কান্নার কারণ। একদিন সাহস করে জিজ্ঞেস করে ফেললাম। উত্তরে যা শুনলাম তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না।
তিনি বলেন, “তিরিশ বছর ধরে সংসার করছি, মাঝে মাঝেই শুনতে হয়, “তোমাকে আমার বাসা থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিব, এক্ষুনি বের হয়ে যাও! এটা আমার বাসা, আমার টাকায় কেনা।” কষ্টটা কী জানো? এই যে আমাকে কথায় কথায় বড় গলায় শোনায় যে এইটা তার বাসা, তার টাকায় কেনা আর আমাকে সে চাইলেই ঘাড় ধরে বের করে দিতে পারে- এই কথাগুলো যে কতটা কষ্টের, কতটা অপমানের, কতটা নির্ভরতাহীনতার! আজ যদি আমি চাকরিটা না ছাড়তাম, তাহলে আমি নিজেই নিজের জন্য একটা বাড়ি বানাতে পারতাম। কেউ আমাকে ঘাড় ধাক্কা দেয়ার কথা মুখেও আনত না। এখন কাঁদছি নিজের জন্য, নিজের বোকামির জন্য।”
“বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ভায়োলেন্স এগেইন্সট উইমেন (ভিএডব্লিউ) ২০১১ শীর্ষক জরিপে এ সম্পর্কে একটি তথ্য প্রকাশিত হয়। জরিপে উপস্থাপিত তথ্যে দেখা যায়, কর্মজীবী নারীর প্রায় ২৪ শতাংশেরই নিজের আয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই। এ জরিপে আরও বলা হয়, ৮৫ শতাংশ নারীর উপার্জনের স্বাধীনতা নেই। মাত্র ১৫ শতাংশই কেবল উপার্জনের স্বাধীনতা পান। আবার নারীকে কর্মক্ষেত্রে যেতে অনুমতি দেন এমন পরিবারের মধ্যে ৯৩.১৯ শতাংশ নারীর উপার্জনের বিষয়টিকে ভাল চোখে দেখেন না। এত বাধা-বিপত্তি আর চোখ রাঙানি উপেক্ষা করেও নারী কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছে, উপার্জন করছে, অথচ তা স্বাধীনভাবে ভোগের অধিকার সে পাচ্ছে না। “
অনেক পরিবারে একজন নারীকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেয়া হয় না। ঘরের কোনো কাজে বিন্দুমাত্র ত্রুটি হলে প্রথমত, শাস্তিস্বরূপ কিছু বদবাক্য ব্যয় করা করা হয় এবং দ্বিতীয়ত, সব দোষ গিয়ে পরে চাকরির ওপর। তার চাকরি ছাড়ার আল্টিমেটাম দিয়ে দেয়া হয়। মেশিনও বোধকরি সব সময় একরূপ কাজ করতে পারে না, গন্ডগোল তাতেও হয়। মেশিনকেও মাঝে মাঝে কিছুদিন বিশ্রামে রাখা হয় এই ভেবে যে, এটা তো অনেকদিন ধরেই চলছে। আমাদের সমাজে গৃহকর্মীর স্বামী গৃহকর্মীকে পেটায় যৌতুকের জন্য, আর কিছু ভদ্রলোক তাদের কর্মজীবি বউকে পেটায় কারণে অকারণে (সব কিছুর জন্য সে-ই দোষী, কারণ সে কর্মজীবি নারী)। খুব কি বেশি পার্থক্য আছে এই দুই ধরনের পুরুষের মনমানসিকতার মধ্যে।
শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি ভয়াবহ মানসিক নির্যাতনের নজির আমাদের দেশে নেহায়েতই কম নয়। এর পাশাপাশি বিবাহিত নারীদের শ্বশুরবাড়ি থেকে প্রাপ্য নানা রকম ব্যঙ্গবিদ্রুপ, শ্বশুরবাড়ির লোকদের ঠিকমত সময় দিতে না পারা, আত্মীয়স্বজনদেরকে ঠিকভাবে আদর আপ্যায়ন করতে না পারা, রান্নাবান্না করতে দেরি হওয়া- এমন নানা অভিযোগ তো আছেই।
আমাদের সমাজ বদলেছে সময়ের সাথে সাথে, আধুনিকায়নের ছোঁয়া সর্বত্র। কিন্তু আমাদের মন মানসিকতা পাল্টায় নি। আমরা আজও কিছু প্রাচীন ধ্যান ধারণা নিয়ে পড়ে আছি। একজন নারীকে আমরা মানুষ ভাবতে পারি না, তার কাজকে সম্মান দিতে পারি না আজও। আজও কর্মজীবি নারীকে বাঁকা চোখে দেখে সবাই। হোক না সে একজন গার্মেন্টস কর্মী, হোক না সে একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা।
আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির সামান্য পরিবর্তন সমাজে একজন নারীকে ঘরের কাজ সম্পন্ন করে ঘরের বাইরেও নির্বিঘ্নে এবং নিশ্চিন্তে কাজ করার সুযোগ করে দিতে পারে। আসুন আমরা পাল্টাই, আমাদের চিন্তার পরিসরটাকে একটু বড় করি।
তথ্যসূত্রঃ
১) oldsite.dailyjanakantha.com/news_view.php?nc=38&dd=2014-08-15&ni=182055