ধরুন, কোনো একদিন মরুভূমিতে ঘুরতে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেললেন আপনি। এমতাবস্থায় প্রখর রৌদ্রে সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটার কথা মাথায় আসবে, তা হলো পানি। খাবারদাবারের চেয়েও পানির চিন্তাটাই তখন বড় হয়ে দেখা দেবে। নিজেদের সাথে থাকা পানি হয়তো একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সাপোর্ট দিতে পারবে। কিন্তু তারপরও যদি আমরা গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে না পারি, তখন কী করবো?
‘বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সূচ্যগ্র মেদিনী’ কথাটার মতোই পানির পরিচিত উৎসের সন্ধান না পেলে খোঁজ করতে হবে পানির অপরিচিত উৎসের। ‘অপরিচিত উৎস’ বলতে এমন জায়গার কথা বুঝিয়েছি যেগুলোকে সাধারণত আমরা পানির উৎস বলে মনে করি না। কিন্তু বিপদে পড়লে ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’ প্রবাদের মতো সেই অপরিচিত উৎসগুলোই হয়ে উঠতে পারে আমাদের বেঁচে থাকার একমাত্র আশা।
পানি ছাড়া একজন মানুষ তিন দিনের মতো বেঁচে থাকতে পারে। তবে এই তিন দিনে যে তার অবস্থা কোন পর্যায়ে পৌঁছুবে, তা তো সহজেই অনুমেয়। এখন তাহলে জেনে নেয়া যাক এমনই কিছু কৌশল যার মাধ্যমে যদি কোনোদিন মরুভূমিতে পথ হারিয়ে আটকেও যান, তারপরেও কিছুটা বাড়তি সময় বেঁচে থেকে পথ খুঁজে পাবার শক্তি জোগানোর জন্য পানি সংগ্রহ করা যায়।
১) আর্দ্র এলাকার সন্ধান
আপনার শরীর থেকে পানি হারানোর মাত্রা কমান
হাঁটা-চলা, সূর্যের নিচে থাকার মতো ব্যাপারগুলো আপনার শরীর থেকে পানি হ্রাসের মাত্রাকে ত্বরান্বিত করবে। এক্ষেত্রে তাই এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও স্মার্টনেস দেখাতে হবে। দিনের সবচেয়ে গরম সময়টায় প্রখর রৌদ্রের মাঝে লোকালয়ের সন্ধান করার চেয়ে বরং কোনো ছায়াযুক্ত স্থানে বসে থাকুন। পারলে শরীরটাকে কোনোকিছু দিয়ে ঢেকে রাখুন যাতে ঘাম বাষ্পীভবনের মাধ্যমেও মূল্যবান পানি শরীর থেকে বেরিয়ে না যায়।
বন্যপ্রাণীদের অনুসরণ করুন
একদল বন্যপ্রাণীর সন্ধান পাওয়া মানে আশেপাশেই কোথাও পানির উৎস আছে। এজন্য নিচের কাজগুলো করুন-
- পাখির ডাক শোনার চেষ্টা করুন এবং খেয়াল রাখুন আকাশে কোনো নির্দিষ্ট জায়গাকে কেন্দ্র করে পাখিরা উড়ছে কিনা।
- যদি একদল মশা-মাছির দেখা পেয়ে যান, তাহলে আশেপাশে পানির উৎসের খোঁজ করতে পারেন।
- মৌমাছিরা অনেক সময়ই মৌচাক আর পানির উৎসের মাঝে সরলরেখায় উড়ে চলে।
- পশুদের পায়ের ছাপ খোঁজার চেষ্টা করুন, বিশেষ করে যেগুলো নিচু ভূমির দিকে গিয়েছে। কারণ পানির উৎস নিচু ভূমিতেই থাকবে।
গাছপালার সন্ধান করুন
অধিকাংশ গাছই পানির উৎসের কাছাকাছি অবস্থান করে। এজন্য নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি খেয়াল রাখা জরুরি।
- স্থানীয় গাছপালা সম্পর্কে ধারণা না থাকলে প্রথমে পত্রঝরা ও বড় পাতার গাছ খুঁজে বের করার চেষ্টা করুন। কারণ পাইন গাছের তুলনায় এগুলোর বেশি পানির দরকার পড়ে।
- উত্তর আমেরিকায় কটনউড, উইলো, সাইকামোর, হ্যাকবেরি, সল্ট সিডার, অ্যারো উইড এবং ক্যাটাইল গাছের সন্ধান করুন।
- অস্ট্রেলিয়াতে ডেজার্ট কুরাজং, নিড্ল বুশ, ডেজার্ট ওক এবং ওয়াটার বুশের সন্ধান করুন।
গিরিখাত এবং উপত্যকার সন্ধান করুন
কোনো গিরিখাতের সন্ধান পাওয়া গেলে হতাশার মাঝে বেঁচে থাকার আশার আলোটা হঠাৎ করেই একশ ওয়াট ক্ষমতার বাল্বের মতো জ্বলে উঠতে পারে। কারণ এ জায়গাগুলো দিনের প্রখর উত্তাপের সময় ছায়া দিতে পারে।
- উত্তর গোলার্ধে থাকলে উত্তরমুখী গিরিখাত এবং দক্ষিণ গোলার্ধে থাকলে দক্ষিণমুখী গিরিখাত খুঁজে বের করুন। সাথে ম্যাপ থাকলে এটা আপনাকে সাহায্য করবে। না থাকলে সৃষ্টিকর্তার এক অসাধারণ আশীর্বাদ চোখটি দিয়েই আশেপাশে ভালো করে তাকিয়ে সিদ্ধান্ত নিন।
- তুষারপাত ও বৃষ্টির পানি এসব গিরিখাতে জমা হয়ে থাকতে পারে। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি হলে পানি মাসখানেক ধরেও সঞ্চিত থাকতে পারে।
আর্দ্র ভূমি
আর্দ্র ভূমি ও শুকিয়ে যাওয়া নদীর সন্ধান করা যেতে পারে। এগুলো ইঙ্গিত করে যে, এদের নিচে পানি থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। কয়েক ফুট মাটি খুঁড়লেই পানি পাওয়ার কথা। সম্ভব হলে পানি ফিল্টার করে এরপর পান করুন।
পাথরের মাঝে
ভূমির ফাটল, পাহাড়ের পাদদেশ এবং বড় পাথরের উদ্গত অংশে পানি জমে থাকে। বৃষ্টির পরে বেলেপাথরের মাঝে থাকা গর্তেও পানি জমে থাকতে পারে।
উঁচু জায়গায় চলে যান
যদি উপরে উল্লেখিত কোনো উপায়েই পানির সন্ধান পাওয়া না যায়, তাহলে কোনো উঁচু ভূমিতে উঠতে চেষ্টা করুন। সেখান থেকে দাঁড়িয়ে উপরের জায়গাগুলো খুঁজতে পারেন। তবে যেহেতু সেখানে ওঠা বেশ পরিশ্রমের ব্যাপার হবে, তাই এটাকে বলা যায় আপনার লাস্ট অপশন। আর ভুলেও সেখানে পানি পাবার চিন্তা করবেন না।
- যখন সূর্য কিছুটা ঢলে পড়বে, তখন উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে নিচু জায়গায় কোথাও আলোর প্রতিফলন পান কিনা দেখুন। সেই জায়গায় পানি থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
- মরুভূমিতে গেলে অবশ্যই সাথে করে দূরবীন নিতে ভুলবেন না।
২) মাটি খনন করা
ধরে নিন, আপনি এমন একটি জায়গার সন্ধান পেয়েছেন যেখানে পানি থাকার সমূহ সম্ভাবনা আছে, তাহলে সেই জায়গাটি খোঁড়ার কাজ শুরু করতে হবে। তবে এজন্যও মানতে হবে কিছু বিশেষ নিয়ম যেহেতু জায়গাটা মরুভূমি।
উপযুক্ত সময়ের জন্য অপেক্ষা
যখন উপযুক্ত জায়গার সন্ধান পেলেন, তখনই যে মাটি খুঁড়তে ঝাঁপিয়ে পড়বেন, এমনটা হলে চলবে না। কারণ দুপুরে এ কাজটি করতে গেলে আপনি অল্পতেই হাঁপিয়ে উঠবেন। ভালো হয় খুব ভোরের দিকে কিংবা পড়ন্ত বিকেলে খননকার্যে নেমে পড়লে। সকাল বেলাতেই ভূগর্ভস্থ পানি মাটির সবচেয়ে কাছাকাছি থাকে। এ কথাটা গাছপালা ঘেরা এলাকার জন্য আরো বেশি প্রযোজ্য।
আর্দ্র মাটির সন্ধান করুন
শুরুতে কিছুটা সংকীর্ণ গর্ত খুঁড়তে হবে। যদি এক ফুটের মতো খুঁড়েও আর্দ্র মাটির সন্ধান পাওয়া না যায়, তাহলে অন্য জায়গায় খুঁড়তে হবে। আর্দ্র মাটি পেলে পরের ধাপটি অনুসরণ করুন।
গর্তটি বড় করুন
এবার আপনার কাজ হবে গর্তটি বড় করা। আনুমানিক এক ফুট ব্যাসার্ধের গর্ত খুঁড়ে ফেলুন। এ সময় গর্তের পাশ থেকে পানির দেখা পাবার কথা। না পেলেও খননকার্য চালিয়ে যান।
অপেক্ষা করুন
কয়েক ঘন্টা পর কিংবা দিনের শেষে আপনার গর্তটির কাছে ফিরে আসুন। যদি মাটি আর্দ্র হয়ে থাকে, তাহলে গর্তের তলদেশে পানি জমে থাকবে।
পানি সংগ্রহ করুন
যদি পানি সংগ্রহ করতে অসুবিধা হয়, তাহলে নিজের কাপড়কেই কাজে লাগাতে পারেন। পানিতে কাপড়টি ভিজিয়ে এরপর কোনো পাত্রের উপর সেটা চিপে নিন। এভাবেই পুরো পানি সংগ্রহ করা যেতে পারে।
পানি জীবাণুমুক্ত করে নিন
গর্ত থেকে সংগ্রহ করা পানি পানের আগে ফুটিয়ে, আয়োডিন ট্যাবলেট ব্যবহার করে কিংবা এন্টি-মাইক্রোবায়াল ফিল্টারের মাধ্যমে জীবাণুমুক্ত করে নিন। নাহলে সেই পানি পান করে বমি, ডায়রিয়া ইত্যাদির কারণে শরীরের পানি দ্রুত হারানোর আশঙ্কা থেকে যায়। তবে এ প্রতিক্রিয়াগুলো গুরুতর রুপ নিতে বেশ কিছুদিন লেগে যায় বলে খুব জরুরি হলে পানি জীবাণুমুক্ত না করেই পান করতে পারেন। সেক্ষেত্রে লোকালয়ে ফিরে গিয়ে একজন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়াটা হবে বুদ্ধির পরিচায়ক।
৩) গর্ত থেকে গাছের মাধ্যমে
আর্দ্র ভূমি
প্রথমেই কোনো আর্দ্র ভূমি খুঁজে বের করতে চেষ্টা করুন। শুকিয়ে যাওয়া নদী এক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো উৎস হতে পারে।
গর্ত খনন
এবার প্রায় ১৯ ইঞ্চি (৫০ সেন্টিমিটার) গভীরতার কয়েকটি গর্ত খুঁড়তে হবে। এটুকু পর্যন্ত খুঁড়লেই আর্দ্র মাটির সন্ধান পাওয়ার কথা। না পেলে আরেকটু গভীর পর্যন্ত খুঁড়তে পারেন। তবে খেয়াল রাখতে হবে যেন আপনার খোঁড়া গর্তটি ছায়ায় পড়ে না যায়। এ পদ্ধতিতে পানি সংগ্রহের জন্য সূর্যের আলো অবশ্যই লাগবে।
গাছ
এবার গর্তগুলোতে কিছু গাছ রেখে দিন।
পাত্র
এখন সেই গাছগুলোর মাঝে একটি মগ বা এমন কোনো পানি পানের পাত্র রাখতে হবে।
পলিথিন
এখন একটি স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে মগের উপরের দিকটা ঢেকে দিন।
মাটি দিয়ে বন্ধ করা
পলিথিনের চারদিকে মাটি দিয়ে গর্তটি বন্ধ করে দিতে হবে। কোনো ফাঁকা জায়গা থাকলে পানির ঘনীভবন ঠিকমতো হবে না।
ছোট পাথর রাখা
মগের ঠিক মাঝখানে একটি ছোট পাথর রাখুন যাতে ঐ অংশে পলিথিন কিছুটা নিচু হয়ে থাকে। পলিথিন যেন কোনোভাবেই মগকে স্পর্শ না করে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তা না হলে মগে পানি জমা হবে না।
ঘনীভবন
এবার অপেক্ষা করতে হবে পানির ঘনীভবনের জন্য। পানি প্রথমে পলিথিনে এবং পরে মগে জমা হবে।
৪) গাছ থেকে ঘনীভবন
প্লাস্টিক ব্যাগ বাঁধা
গাছের শাখার প্রান্তভাগে একটি পলিথিন ব্যাগ ভালো করে বাঁধুন। টেপ ব্যবহার না করে দড়ি জাতীয় কিছুই ব্যবহার করা ভালো।
বাষ্পত্যাগ
খেয়াল রাখতে হবে যেন বাঁধনটি ঠিকমতো থাকে। গাছ যে বাষ্প ত্যাগ করবে তা এ ব্যাগে জমা হতে থাকবে।
অপেক্ষা
সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন যাতে সর্বোচ্চ পরিমাণ পানি জমা হতে পারে। পরে সেই পানি একটি পাত্রে নিয়ে গলাধঃকরণ করে নিন।
৫) অন্যান্য উৎস
শিশির সংগ্রহ
এজন্য খুব ভোরে উঠে গাছের পাতায় জমে থাকা শিশির সংগ্রহ করতে হবে আপনাকে। একটি শোষক কাপড় ব্যবহার করে পানি প্রথমে তাতে সংগ্রহ করে পরে কোনো পাত্রের উপর চিপে নিলেই হবে।
গাছের কোটরে
গাছের কোটরে যদি কোনো পোকামাকড়কে প্রবেশ করতে দেখা যায়, তবে সেখানে পানি আছে বলে অনুমান করা করা যেতে পারে। সেখানে কোনো কাপড় পেঁচিয়ে ঢুকিয়ে দিলে তা ভিজে যাবে (যদি পানি থাকে)। পরে আগের মতো করেই চিপে নিয়ে পাত্র থেকে পানি পান করা যাবে।
পাথরের তলদেশ
পাথর সাধারণত বাষ্পীভবনের হারকে ধীর করে দেয়। এজন্য তাদের তলদেশে বৃষ্টির পানি ও শিশির তুলনামূলক বেশি সময় ধরে জমে থাকে। ভোরের আগে সেই জায়গাগুলোর সন্ধান করলে পানির খোঁজ পাওয়া যেতেও পারে। তবে পাথরের নিচের গর্তে পোকামাকড়ও থাকতে পারে। তাই এ ব্যাপারে সাবধান হতে হবে।
ক্যাকটাস ফল
চাইলে ক্যাকটাসের ফলও খেতে পারেন। এতে কোনো সমস্যা হবে না। তবে সাবধানে ছিড়তে হবে গাছ থেকে। আর খাওয়ার আগে ৩০-৬০ সেকেন্ড আগুনে পুড়িয়ে নিয়ে লোম ও কাটাগুলো বিনাশের ব্যবস্থা করতে হবে।
তথ্যসূত্র
১) wikihow.com/Make-Water-in-the-Desert
২) wikihow.com/Find-Water-in-the-Desert
৩) uk.businessinsider.com/desert-water-survivalist-guide-nature-science-2017-5