Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ফ্রিদা কাহ্‌লো: জীবন দ্বারা অনুপ্রাণিত এক চিত্রশিল্পী

জন্মের পর হয়ত কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমাদের জীবনের লক্ষ্য আমাদের কাছের মানুষদের দ্বারা নির্ধারিত হয়ে যায়। আবার কেউ কেউ হয়ত নিজেই বেছে নেয় নিজের জীবনের লক্ষ্য, ছোটবেলা থেকেই নিজেকে একটা অবস্থানে চিন্তা করেন। খুবই ভাগ্যবান যারা তাদের স্বপ্নকে বাস্তবে রুপান্তর করতে পারে। কারো কারো ক্ষেত্রে দেখা যায় তীব্র ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও জীবন তাদেরকে এমন এক পরিস্থিতির সামনে নিয়ে এসে দাঁড় করিয়ে দেয় যে, সেই লক্ষ্য পূরণ আর সম্ভব হয় না। কেউ কেউ  হয়ত ভেঙ্গে পড়েন, কেউ হয়ত ভাগ্যের দোষ দিয়ে বাকী জীবনটা ভাগ্যের কাঠপুতুল হয়েই কাটিয়ে দেন। আবার কেউ সেই ভাগ্যের সাথে পাল্লা দিয়ে নিজেকে আইকন বানিয়ে তোলে, হয়ে ওঠেন অনন্য। ফ্রিদা কাহ্‌লো হলেন জীবন দ্বারা অনুপ্রাণিত এমনি এক চিত্রশিল্পী।

ফ্রিদা কাহ্‌লো

ফ্রিদা কাহ্‌লো বিশ্বব্যাপী একজন সেলফ পোর্ট্রেইট চিত্রশিল্পী হিসেবে খ্যাতইমান। অর্থাৎ তার আঁকা ১৪৩ চিত্রকর্মের ভেতরে ৫৫টি ছিল তার নিজের ছবি। কাহ্‌লো এই ব্যাপারে বলেন যে I paint myself because I am so often alone and because I am the subject I know best. ফ্রিদা তার সেলফ পোর্ট্রেইটগুলোর মাধ্যমে  তার শারীরিক এবং মানসিক ক্ষত উপস্থাপন করতেন। তার সবচেয়ে বিখ্যাত সেলফ পোর্ট্রেইটটি হলো “Self-Portrait with Thorn Necklace and Hummingbird”

বিখ্যাত সেলফ পোর্ট্রেইট “Self-Portrait with Thorn Necklace and Hummingbird”

ফ্রিদা কাহ্‌লো জন্মগ্রহণ করেন ৬ জুলাই ১৯০৭ সালে মেক্সিকান সিটিতে। তার জন্মের তিন বছর পর মেক্সিকান রেভলুশন ঘটে। ফ্রিদা তার জন্মসালকে আধুনিক মেক্সিকোর সাথে স্মরণীয় রাখতে পরবর্তীতে তার জন্ম সাল ঘোষণা দেন ৭ জুলাই ১৯১০ সাল।

ফ্রিদা কাহ্‌লো তার পরিবারের সাথে (সবচেয়ে বামে)। ছয় কন্যার একজন ছিলেন ফ্রিদা

ছয় বছর বয়সে ফ্রিদা পোলিও রোগে আক্রান্ত হন, যার কারণে তার ডান পা বাম পায়ের চেয়ে চিকন হয়ে যায়। ফ্রিদা তার বাবার প্রশংসা করতেন এবং তার বাবার মতো পোশাক পরতেন ও চুল ছোট রাখতেন যা ঐ সময় একজন তরুণীর জন্য বেশ দুঃসাহসিক বলে বিবেচনা করা হতো। তিনি তার অসম্পূর্ণতাকে লুকিয়ে রাখার জন্য পরবর্তীতে নিজের পোশাক নিজেই ডিজাইন করতেন।

ফ্রিদার নিজস্ব ডিজাইন করা কিছু ড্রেস যা তার মৃত্যুর পর বেশ জনপ্রিয় হয়

খুব ছোটবেলা থেকেই ফ্রিদা সমাজের ছোট ছোট ব্যাপারগুলোকে চ্যালেঞ্জ দিতেন। নিজের কোনো অসম্পূর্ণতা নিয়ে দুঃখ প্রকাশের চেয়ে বরং নিজেকে বিভিন্ন দিকে দক্ষ করে তোলেন তিনি। বক্সিংয়ের মতো খেলা ছাড়াও তিনি একটি গ্যাং-এ যোগদান করেন এবং পরে সেই গ্যাং এর নেতার সঙ্গে প্রেমে পড়ে যান। রাতের পার্টিগুলোতে ফ্রিদা বেশ পরিচিত মুখ ছিলেন এবং টাকিলা চ্যালেঞ্জ ও বিভিন্ন  দুঃসাহসিক কাজ করে নিজেকে বেশ আলোচিত রাখতেন।

ফ্রিদার বয়স যখন আঠারো, তখন তিনি বাস ও ট্রলি দুর্ঘটনার সম্মুখীন হন এবং খুব খারাপভাবে হলেও বেঁচে যান। তার তলপেটে ভয়ানকভাবে একটি লোহার হ্যান্ডেল ঢুকে যায়। তার পেল্ভিস, কলারবোন, মেরুদন্ড, দুইটি পাঁজরের হাড় ভেঙ্গে যায়। প্রায় ৩৫টি অপারেশন করা হয় তার শরীরে। এই দুর্ঘটনার প্রায় তিন মাস পর থেকে ফ্রিদা বেশ কিছু চিত্রকর্ম তৈরী করেন তার বেডের সামনে আয়না রেখে। তখন থেকেই তিনি চিত্রশিল্পী হিসেবে চর্চা শুরু করেন ও ডাক্তারী পড়ার ইচ্ছা জলাঞ্জলি দেন।

দুর্ঘটনা ফ্রিদার চিত্রশিল্পে

বিছানায় পড়ে থেকে একাকীত্বকে তিনি তার চিত্রশিল্পে তুলে ধরেছিলেন সুনিপুণভাবে। তার চিত্রশিল্পে অক্ষমতা এবং মনঃকষ্টের ব্যাপারটি চমৎকারভাবে উঠে এসেছে।

চিত্রশিল্পটি তার আশাহত জীবনের এক অর্থবহন করে

নিজের ভেতরের ক্ষতকে ফ্রিদা সবসময় শিল্পের মাধ্যমে প্রকাশ করার চেষ্টা করতেন

ফ্রিদা বিখ্যাত মেক্সিকান চিত্রকার ডিয়েগো রিভেরার কাজের প্রশংসা করতেন এবং ১৯২৭ সালে তিনি প্রথমবারের মতো তাঁর সাথে পরিচিত হন। রিভেরা তার কাজকে প্রভাবিত করেছিল এবং তাকে উৎসাহিত করেন, যা পরবর্তীতে ফ্রিদাকে একজন সফল শিল্পী হয়ে উঠতে সাহায্য করেছিল। বেশ দ্রুত তাদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে এবং তারা ১৯২৯ সালের ২১ আগস্ট বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। সেই সময় ফ্রিদা ছিলেন ২২ বছর বয়সী যুবতী এবং ডিয়েগো  ছিলেন ৪২ বছরের।  ডিয়েগোর এটি ছিল তৃতীয় বিয়ে। তাদের আকারের মধ্যে পার্থক্যের দরুন এই দম্পতিকে অনেকেই “The Elephant and the Dove” বলতেন।

ফ্রিদা ও ডিয়েগো রিভেরার বিয়ের ছবি

ফ্রিদা ও ডিয়েগোর দাম্পত্য জীবন পরবর্তীতে বেশ তিক্ত হয়ে যায়, কারণ দুজনেই বিবাহিত জীবনের বাইরে অনেক সম্পর্কে জড়িত ছিলেন। ফ্রিদা ছেলেদের সাথে ছাড়াও মেয়েদের সাথে শারিরীক সম্পর্কে লিপ্ত ছিলেন এবং ডিয়েগোর সম্পর্ক ছিল ফ্রিদার ছোট বোন ক্রিস্টিনার সাথে, যার জন্য ফ্রিদা বেশ অপমানিত বোধ করেন। ফলস্বরূপ বিবাহ বিচ্ছেদ হয় এবং বিয়ের এক বছর পর আবার তারা বিয়ে করেন!

ফ্রিদার দ্বিতীয় বিয়ে ছিল প্রথমবারের চেয়ে বেশী খারাপ, তবে ফ্রিদা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আর কোনো বিয়ে করেনি। ফ্রিদা ডিয়েগোকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন এবং তিনি তার এক উদ্ধৃতিতে বলেন Diego was everything; my child, my lover, my universe।  এছাড়াও ডিয়েগো তার চিত্রশিল্পে বেশ ভালো জায়গা জুড়ে আছে। এজন্য যখন ডিয়েগোর সাথে বিচ্ছেদে ছিলেন, তখন তিনি তার চুল কেটে ফেলেন এবং তার পোশাক সেভাবে ডিজাইন করা বন্ধ করে দেন যেভাবে ডিয়েগো পছন্দ করতেন। ফ্রিদা তার এক বক্তব্যে বলেন যে There have been two great accidents in my life. One was the trolley, and the other was Diego. Diego was by far the worst.

ফ্রিদা ও ডিয়েগোর আত্নিক সম্পর্ককে ফ্রিদা চিত্রে তুলে আনার চেষ্টা করেছেন

এতদসত্ত্বেও ফ্রিদা রেড আর্মির প্রতিষ্ঠাতা লিওন ট্রটস্কি এর সাথে প্রেমে জড়িয়ে যান। ফ্রিদা তার  “Self-Portrait Dedicated to Leon Trotsky” চিত্রকর্মের মাধ্যমে ট্রটস্কির সাথে সম্পর্কের স্মৃতিরক্ষা করেন।

চিত্রকর্ম “Self-Portrait Dedicated to Leon Trotsky”

১৯৫৪ সালের ২৬ জুলাই তার ৪৭ তম জন্মদিনের ২০ দিন পর ফ্রিদা মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর কয়েকদিন আগে, তিনি তার ডায়েরিতে লিখেছিলেন I hope the exit is joyful — and I hope never to return। মৃত্যুর মাত্র কয়েক বছর পরই তার কাজ ব্যাপকভাবে প্রশংসিত ও আলোচিত হওয়া শুরু করে।

ফ্রিদা কাহ্‌লো মেক্সিকোতে নেমেক্সিকানসো আর্ট মুভমেন্টের এক কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন যা কিনা ১৯৭০ সালে জানা যায়। ঐতিহ্যবাহী উপাদানগুলির কারণে তাঁর শিল্পকে লোকশিল্প বলা হতো; যদিও অনেকে অধিবাস্তববাদী বলতো ,কিন্তু  ফ্রিদা নিজের চিত্রশিল্প নিয়ে বলেন, They thought I was a Surrealist, but I wasn’t. I never painted dreams. I painted my own reality.” ২০০৬ সালের মে মাসে তার স্ব-প্রতিকৃতি “Roots” ৫.৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে বিক্রি হয় যা লাতিন আমেরিকান শিল্পের নিলামে রেকর্ড স্থাপন করেছিল।

শিল্পকর্ম “Roots”

ফ্রিদা কাহ্‌লোর জীবন ও শিল্প সম্পর্কে অসংখ্য নিবন্ধ, বই এবং ডকুমেন্টরী তৈরি করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে বেস্টসেলার “ফ্রিদা: দ্য বায়োগ্রাফি অফ ফ্রিদা কাহ্‌লো (১৯৮৩)” লেখক হেইডেন হেরেরা। ২০০২ সালে আরেকটি বায়োগ্রাফি ফিল্ম “ফ্রিদা” তৈরী হয়, যার মধ্যে সালমা হায়াক ফ্রিদা চরিত্রে অভিনয় করেন, ৫০ মিলিয়ন ইউএস ডলারেরও বেশি ব্যবসা করে চলচিত্রটি এবং দুইটি একাডেমি পুরস্কার লাভ করে।

যদিও ফ্রিদা কাহ্‌লোর জীবনে অনেক কষ্ট সহ্য করেছিলেন, তবুও তিনি বেশ বর্ণিল জীবনযাপন করেছিলেন শিল্পের প্রতি আবেগের জন্য। তিনি জীবনের প্রতিটি আঘাতের উত্তরে আরো শক্ত প্রতিউত্তর দিয়েছিলেন এবং নিজের ভেতরের শিল্পসত্ত্বাকে কেন্দ্র করে জীবনের অর্থ খুঁজে পেয়েছিলেন। খ্যাতিমান আর্টিস্ট ভিনসেন্ট ভ্যান গগের একটি খুব সুন্দর কথা আছে, তা হলো- Art is to console those who are broken by life.” ফ্রিদা কাহ্‌লোর সাথে কথাটা মানিয়ে যায় ।

আসলে দিন শেষে আমরা যতটা কল্পনা করি, তার চেয়েও বেশী কষ্ট সহ্য করতে পারি। ফ্রিদা কাহ্‌লোর মতো ব্যক্তিত্বরা কষ্টকে উপেক্ষা করে নিজের কর্মকে পৃথিবীতে স্মরণীয় করে রেখে যান।

তথ্যসূত্র

১। mayagonzalez.com/blog/2013/08/9-interesting-frida-facts/

২। smithsonianmag.com/arts-culture/frida-kahlo-70745811/

৩। theartstory.org/artist-kahlo-frida.htm

৪। learnodo-newtonic.com/frida-kahlo-facts

৫। en.wikipedia.org/wiki/Frida_Kahlo

৬। art-sheep.com/42-quotes-by-frida-kahlo-we-love-to-read-every-day/

৭। mamiverse.com/20-quotes-by-frida-kahlo-14675/2/

৮। fridakahlo.org/frida-kahlo-quotes.jsp

Related Articles