নোবেল পুরস্কার, জ্ঞান-বিজ্ঞান-সাহিত্যে অসাধারণ অবদান এবং মানবকল্যাণে অতুলনীয় কর্মকাণ্ডের জন্য এই পুরস্কার প্রদান করা হয়। এই পর্যন্ত তিনজন বাঙালি এই পুরস্কার পেয়েছেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্যে (১৯১৩ সালে), অমর্ত্য সেন অর্থনীতিতে (২০০৬ সালে) এবং ড. মোহাম্মদ ইউনুস শান্তিতে (২০০৬ সালে) এই পুরস্কার পান। এর মধ্যে ড. মোহাম্মদ ইউনুস বাংলাদেশী। তবে আমরা যেটা জানি না তা হলো, চিকিৎসাবিজ্ঞানে ২০১৫ সালের নোবেল পুরস্কারের ভাগীদার হতে পারত বাংলাদেশও।
২০১৫ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেলজয়ী তিনজন হলেন আয়ারল্যান্ডের উইলিয়াম সি ক্যাম্পবেল, জাপানের সাতোশি ওমুরা এবং চীনের ইউইউ তু। শেষের জন নোবেল পুরস্কার পান ম্যালেরিয়ার চিকিৎসার জন্য নতুন ঔষধ আরটিমিসিনিন আবিষ্কারের জন্য। আর রাউন্ডওর্ম প্যারাসাইট দ্বারা ঘটিত রিভার ব্লাইন্ডনেস এবং লিম্ফেটিক ফাইলেরিয়াসিস (গোদরোগ) রোগের সংক্রমণ রুখতে সক্ষম আইভারমেকটিন থেরাপি আবিষ্কারের জন্য ক্যাম্পবেল এবং ওমুরাকে নোবেল পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত করা হয়।
রিভার ব্লাইন্ডনেস নামক এই ব্যাধি আফ্রিকা, ইয়েমেন এবং ল্যাটিন আমেরিকাতে হয়ে থাকে। এই ব্যাধির কারণ Onchocerca volvulus নামক এক কৃমি বা পরজীবী। ব্ল্যাক ফ্লাই নামক এক মাছি এই কৃমির বাহক। ব্ল্যাক ফ্লাইয়ের কামড়ে এই পরজীবী মানুষের লসিকানালীতে প্রবেশ করে। এই পরজীবীর বিরুদ্ধে শরীরের রোগ প্রতিরোধতন্ত্র যে অ্যান্টিবডি তৈরি করে তা মাঝে মাঝে মানুষের চোখের রেটিনার সাথে বিক্রিয়া করে রেটিনার ক্ষতি ঘটায়। এর ফলে অন্ধত্ব হয়।
অন্যদিকে গোদরোগ বা ফাইলেরিয়াসিসের কথা আমরা সবাই কম-বেশি জানি। এটা মশাবাহিত রোগ। এর মূলেও রয়েছে এক ধরণের কৃমি যার নাম Wuchereria bancrofti । এছাড়া Brugia timori এবং Brugia malayi নামক পরজীবীর কারণেও এই রোগ হয়। এই কৃমি মানুষের লসিকানালীর ভিতর ঢুকে লসিকাপ্রবাহ বন্ধ করে দেয়। এর ফলে শরীরের বিভিন্ন অংশ ফুলে যাওয়া, চামড়া ও এর নিচের টিস্যু মোটা হয়ে যায়। একে বলে গোদরোগ। এই রোগের ফলে মানুষের কর্মক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। রোগটির প্রাদুর্ভাব রয়েছে এশিয়া, আফ্রিকা, মধ্য আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার অনেক দেশে। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশেরও নাম।
গত শতাব্দীর আশির দশক পর্যন্ত এই রোগের চিকিৎসার জন্য কার্যকর কোনো ঔষধ ছিল না। সেই সময় বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ মানুষ ফাইলেরিয়া ও রিভার ব্লাইন্ডনেসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকির অন্তর্ভুক্ত ছিল। আইভারমেকটিন থেরাপি আবিষ্কারের ফলে এই দুই রোগের জন্য চিকিৎসাপদ্ধতি অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। এই মহৌষধ আবিষ্কারের জন্যই ক্যাম্পবেল এবং ওমুরাকে নোবেল পুরস্কার পান।
অথচ আমরা জানি না, এই আইভারমেকটিনের প্রথম ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের নেতৃত্ব দেন যে চিকিৎসাবিজ্ঞানী তিনি ছিলেন একজন বাংলাদেশী। তার নাম ডঃ এম এ আজিজ। পেশায় তিনি ছিলেন একজন চিকিৎসক। তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানে এমবিবিএস পাশ করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে। তিনি ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের কে ৭ ব্যাচের ছাত্র। ১৯৫৪ সালে তিনি এমবিবিএস সম্পন্ন করেন। এরপর ১৯৬২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ মিনেসোটা থেকে ক্লিনিক্যাল প্যাথলজিতে পিএইচডি করেন। এরপর জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটি থেকে পোস্ট ডক্টরাল এবং লন্ডন স্কুল অফ হাইজিন এন্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন থেকে ক্লিনিক্যাল মেডিসিন ইন দি ট্রপিকসে ডিপ্লোমা অর্জন করেন।
১৯৬২ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত তিনি ইউনিভার্সিটি অফ মিনেসোটায় একজন শিক্ষক এবং গবেষক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি সিয়েরা লিওনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭৬ সালে তিনি মার্কিন ঔষধ কোম্পানি মার্ক এন্ড কো এ ডিরেক্টর অফ দি ডোমেস্টিক রিসার্চ পদে যোগদান করেন। ১৯৮১ সালে তিনি প্রতিষ্ঠানের আন্তর্জাতিক ক্লিনিক্যাল রিসার্চ শাখার সিনিয়র ডিরেক্টর পদে অধিষ্ঠিত হন। মার্কে কাজ করার সময় তার জীবনের উল্লেখযোগ্য কিছু সাফল্য আসে। এই সময় তিনি আইভারমেকটিন থেরাপি উদ্ভাবন করেন। এই একটি ঔষধ একইসাথে পরজীবীবাহিত রিভার ব্লাইন্ডনেস এবং লিম্ফেটিক ফাইলেরিয়াসিসের চিকিৎসায় ব্যবহার করা সম্ভব। ১৯৮১ সালে সেনেগালে সর্বপ্রথম এই ঔষধের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল দেওয়া হয়। ১৯৮২ সালে সেনেগালের এই গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয় ল্যানসেটে।
এরপর সেনেগাল, মালি, ঘানা এবং লাইবেরিয়াতে এই গবেষণা চলে যা নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন এবং ল্যানসেটে প্রকাশিত হয়।
১৯৮৭ সালে ডঃ আজিজ সাত বছর ধরে চলা এই ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল প্রোগ্রামের সফল সমাপ্তি ঘোষণা করেন। কিন্তু ততদিনে তার শরীরে বাসা বেঁধেছে এক ভয়ানক মরণব্যাধি- পাকস্থলীর ক্যান্সার। ১৯৮৭ সালের ২৫ নভেম্বর তিনি পাকস্থলীর ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করেন। তার বয়স হয়েছিল মাত্র ৫৮ বছর। ততদিনে মানুষ জেনে গিয়েছে আইভারমেকটিনের উপকারিতা। বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্য কর্মসূচীতে ‘মাস ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন’ প্রজেক্টের (গণহারে বিশাল জনগোষ্ঠীকে ঔষধ খাওয়ানো) অধীনে আইভারমেকটিন থেরাপি চালু হয়ে যায়। সেই থেকে এখন পর্যন্ত ১০০ কোটি লোক এই ঔষধ দিয়ে উপকৃত হয়েছে। এখন প্রতি বছর আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা এবং পশ্চিম এশিয়ার প্রায় ৮ কোটি লোক এই ঔষধ গ্রহণ করে রিভার ব্লাইন্ডনেসের চিকিৎসায়। বর্তমানে রিভার ব্লাইন্ডনেস নামক রোগ নির্মূলের দ্বারপ্রান্তে। একইভাবে গোদরোগ বা লিম্ফেটিক ফাইলেরিয়াসিসও নির্মূলের অপেক্ষায়। এর পেছনে ডঃ আজিজের মত সেনাপতিদের অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে।
ডঃ আজিজের কাজ এগিয়ে নিয়ে যান উইলিয়াম সি ক্যাম্পবেল, যিনি ২০১৫ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন। বেঁচে থাকলে হয়তো এই বিরল সম্মানের ভাগীদার হতেন ডঃ আজিজ। সাথে যোগ হতো বাংলাদেশের নামও। উইলিয়াম সি ক্যাম্পবেল তার গুরুকে ভুলেননি। তিনি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছিলেন ডঃ এম এ আজিজের নাম। তার সাথে নোবেল কমিটিও বলেন,
“In 1981-1982 Dr. Mohammed Aziz at MDRL, an expert in River Blindness, conducted the first successful human trial (Aziz et al 1982). The results were clear. Patients given a single dose of Ivermectin showed either complete elimination or near elimination of microfilariae load, while the adult parasites were untouched.”
অথচ এই চিকিৎসাবিজ্ঞানীর নাম আমরা কয়জনই বা জানি? তবে আশার কথা এই যে, গত বছর ঢাকা মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ এই মহান চিকিৎসাবিজ্ঞানীর স্মৃতি অক্ষয় করে রাখতে কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ২০১৬ সালের ৫ মার্চ ঢাকা মেডিকেল কলেজে এই চিকিৎসাবিজ্ঞানীর স্মরণে অনুষ্ঠিত হয় এক সভা। এখানে ভাষণ রাখেন ডঃ আজিজের পুত্র প্রফেসর ডঃ শহীদ আজিজ। তিনি বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সিতে কর্মরত। তিনি ঘোষণা করেন প্রতি বছর গবেষণার জন্য ২ জন চিকিৎসককে ডঃ আজিজ স্মৃতিপদক দেয়া হবে। আশা করা যায় বাংলাদেশের চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা এই মহান গবেষকের পথ অনুসরণ করবেন এবং তাদের উদ্ভাবনীক্ষমতা দিয়ে পুরো মানবজাতির উপকার বয়ে আনবেন।