Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

রাবাদার নিষেধাজ্ঞা, সংকটে দক্ষিণ আফ্রিকা

১৯৯১-৯২ সালে প্রথমবারের মতো যখন আইসিসি ‘কোড অফ কনডাক্ট‘ প্রচলন করে, তখন এর মূল উদ্দেশ্য ছিলো খেলোয়াড়দেরকে একটি নির্দিষ্ট আচরণবিধির মধ্যে বেঁধে ফেলা। বহুদিন ধরে চলে আসা এই আইনবিধি নানা যুগে রূপ নিয়েছে নানা রকম, কিন্তু পেছনের মুখ্য উদ্দেশ্য অক্ষুণ্ণ ছিলো বরাবরই, ‘স্পিরিট অফ ক্রিকেট’ বজায় রাখা।

কোড অফ কনডাক্ট বারবারই জন্ম দিয়েছে নানা বিতর্কের। ছবি: Ryan Pierse / Getty Image

খেলোয়াড়দের ‘কোড অফ কনডাক্ট’ নিয়ে বিতর্কের বিশেষ অভাব নেই। একদিকে স্লেজিংয়ের উপর বিধিনিষেধ নেই, অন্যদিকে অশোভন শব্দ ব্যবহারেও কড়াকড়ি। স্বাভাবিক হতাশার প্রকাশও কখনো কখনো শাস্তি বয়ে আনে, আবার ‘আগ্রাসী আবেদন’ কখনো কখনো হয়ে ওঠে প্যাশনের অপর নাম। ফলে যুগে যুগে এই আইনবিধির উপর বিতর্ক ছিলো, ভবিষ্যতেও হয়তো থাকবে। আর সেই বিতর্কের তালিকাতেই নতুন সংযোজন দক্ষিণ আফ্রিকার পেস বোলার কাগিসো রাবাদার নাম।

বেন স্টোকসকে বলা হয়ে থাকে ইংলিশ ক্রিকেটের ‘ব্যাড বয়’। দুর্দান্ত ক্রিকেটার হলেও বদমেজাজি বলে তার কিছুটা কুখ্যাতি রয়েছে, সেটা অস্বীকার করার কিছু নেই। তবে পারফরমেন্সের দিক থেকে এই মুহূর্তে গোটা বিশ্বের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার তিনি। তাকে ফিরিয়ে দিয়ে তাই দক্ষিণ আফ্রিকার নতুন ফাস্ট বোলিং সেনসেশন কাগিসো রাবাদা বাঁধভাঙা উল্লাসে মাতবেন, তাতে বিস্ময়ের কিছুই নেই। তবে এ দফায় সেই উল্লাসটা খুব একটা ভালো কিছু বয়ে আনলো না।

স্টোকসকে ফিরিয়ে দেওয়ার পথে ‘অসৌজন্যমূলক’ শব্দ বলায় আবারও বিতর্কে রাবাদা। ছবি: ক্রিকইনফো

৭৬ রানেই ৪ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর অধিনায়ক জো রুটের সঙ্গে জুটি গড়ে দারুণভাবে দলকে শক্ত অবস্থানে পৌঁছে দিচ্ছিলেন বেন স্টোকস, নিজের স্বভাববিরুদ্ধ ব্যাটিংয়ে ১০৭ বলে ৫৬ রানও তুলে ফেলেছিলেন। ফলে দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য এই উইকেটটা ছিলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে রাবাদাও শুরুতে সেভাবে সুবিধা করে উঠতে পারছিলেন না, রীতিমত ভেতরে ভেতরে ফুঁসছিলেন। ফলে তার বলে স্টোকস যখন উইকেটের পিছনে কুইন্টন ডি কককে ক্যাচ দিয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরে যাচ্ছিলেন, উল্লাস এবং ক্ষোভের আতিশয্যে কিঞ্চিত দুর্বাক্য ব্যবহার করে ফেলেন এই ২১ বছর বয়সী ফাস্ট বোলার। আর সেটা মাইক্রোফোনে এতটাই স্পষ্টভাবে শোনা গিয়েছে যে, সেভাবে বিশদ কোনো শুনানিরও প্রয়োজন পড়েনি।

আইসিসির বিবৃতি অনুসারে, “লর্ডস টেস্টের প্রথম দিনে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে রাবাদা আইসিসি কোড অফ কনডাক্ট ফর প্লেয়ার অ্যান্ড প্লেয়ার সাপোর্ট পারসোনেল-এর ২.১.৭ নং ধারা ভঙ্গ করেন, যাতে তিনি আন্তর্জাতিক ম্যাচ চলাকালীন ব্যাটসম্যানের ডিসমিসালের পর অপ্রীতিকর ভাষা, শব্দ, অঙ্গভঙ্গি, উসকানি কিংবা আচরণজনিত কারণে দোষী সাব্যস্ত হন।” এর ফলে তাকে ১৫ শতাংশ ম্যাচ ফি জরিমানা করা হয় এবং একটি ডিমেরিট পয়েন্ট তার নামের পাশে যুক্ত হয়।

অশোভন আচরণের জন্য পরের টেস্ট মিস করতে চলেছেন রাবাদা। ছবি: ক্রিকইনফো

এর আগে ফেব্রুয়ারি মাসে কেপ টাউনে শ্রীলংকার বিপক্ষে টেস্টে নিরোশান ডিকওয়েলার সঙ্গে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের কারণে তিনি কোড অব কনডাক্ট-এর ২.২.৭ নং ধারা ভঙ্গ করার অভিযোগে দোষী বলে সাব্যস্ত হন। সেবারও তাকে এবং ডিকওয়েলাকে ম্যাচ ফির পঞ্চাশ শতাংশ জরিমানা করা হয় এবং দুজনের ডিসিপ্লিনারি রেকর্ডসেও তিনটি করে ডিমেরিট পয়েন্ট যোগ হয়।

আইসিসির বর্তমান নিয়ম অনুসারে, কোনো ক্রিকেটারের ডিসিপ্লিনারি রেকর্ডে যদি দুই বছর সময়কালের মধ্যে চারটি ডিমেরিট পয়েন্ট যোগ হয়, তাহলে তিনি স্বয়ংক্রিয়ভাবেই একটি টেস্ট, দুটি ওয়ানডে কিংবা দুটি টি-টোয়েন্টি মিস করবেন। যেহেতু এই ডিমেরিট পয়েন্টের মাধ্যমে তার সেই কোটা পূর্ণ হয়েছে, ফলে আপাতত পরবর্তী টেস্টে দক্ষিণ আফ্রিকা রাবাদাকে হারাতে যাচ্ছে।

গত বেশ কিছুদিনে অধিনায়ক ডু প্লেসিসের সবচেয়ে বড় ভরসা হয়ে উঠেছেন রাবাদা। ছবি: ক্রিকইনফো

গত ইনিংসেও তিন উইকেট পাওয়া রাবাদার এই ম্যাচে প্রথম উইকেট ছিলেন বেন স্টোকস, এর আগে তার সহজাত বোলিং সক্ষমতা সেভাবে দেখাতে পারেননি তিনি। তবে গতিতে নাস্তানাবুদ করার দিক থেকে তিনি মোটেই পিছিয়ে ছিলেন না, নিয়মিত নব্বই মাইলের চেয়েও দ্রুতগতিতে বোলিং করে গেছেন। এ সফর শুরুর ঠিক আগেভাগে নিয়মিত অধিনায়ক ফ্যাফ ডু প্লেসিস উড়ে গেছেন প্রথম সন্তানের জন্মগ্রহণজনিত কারণে। পরবর্তী ট্রেন্টব্রিজ টেস্টে তিনি ফিরলেও, নিশ্চিতভাবেই মিস করতে চলেছেন দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বোলিং অস্ত্র কাগিসো রাবাদাকে।

রাবাদার বিকল্প হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকা দলে রয়েছেন অনভিজ্ঞ পেস বোলার ডুয়ান অলিভিয়ের, অভিজ্ঞ অলরাউন্ডার ক্রিস মরিস এবং অনভিষিক্ত আন্দিলে ফেহলুকায়ো। প্রত্যেকেই এই স্থানটির জন্য যোগ্য এবং সামর্থ্যসম্পন্ন, তবে খুব সম্ভবত অলিভিয়েরের ভাগ্যেই শিঁকে ছিড়তে চলেছে। অলিভিয়ের তরুণ, দারুণ গতিশীল, সম্ভাবনাময় এবং দারুণ বাউন্সারও ছুড়তে জানেন। ওয়ান্ডারার্সে এমনকি শ্রীলংকার বিপক্ষে অভিষেকও হয়ে গিয়েছে তার। তবে দক্ষিণ আফ্রিকা ব্যাটিং গভীরতা আরও কিছুটা বাড়াতে চাইলে ক্রিস মরিসের কপালও খুলে যেতে পারে। আপাতদৃষ্টিতে ফেহলুকায়োর একাদশে সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা কিছুটা ধূসর বলেই মনে হচ্ছে।

তবে আরও একটা ব্যাপার বিশেষ প্রভাব ফেলতে পারে দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য। তাদের মূল একাদশে ছয়জন কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটারকে রাখতেই হবে, আর সেই ছয়জনের মধ্যে দুজনকে হতে হবে কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান। এই নিয়মটাও বেশ অদ্ভুত। তাত্ত্বিকভাবে এটা বোঝা খুব সহজ, দলের অন্তত ৫৪ শতাংশ ক্রিকেটারকে হতে হবে কৃষ্ণাঙ্গ। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, ক্রিকেটে গাত্রবর্ণের চেয়ে ক্রিকেটীয় মেধা এবং সামর্থ্যই অধিকতর গুরুত্ব পাওয়ার কথা নয় কি? সাধারণ মস্তিষ্কে সেটা মনে হলেও, কোনো এক অদ্ভুত কারণে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রীড়া ও বিনোদনমন্ত্রী ফিকিলে এমবালুলার কাছে সেটা মুখ্য বলে মনে হয়নি। তার ভাষ্যটাও অদ্ভুত, “মেধা এখানে আনা চলবে না, কারণ মেধা তো আগে থেকেই নির্দিষ্ট করে দেয় যে সকলের জন্য সমান সুযোগ!” 

কোটা পদ্ধতি না থাকলে হয়তো স্টেইন-এলিয়ট একসাথে হাসিমুখেই মাঠ ছাড়তেন ২০১৫ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে! ছবি: REUTERS/Anthony Phelps

ইতিমধ্যেই এই বর্ণপ্রথার কারণে দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকাকে। সবচেয়ে বড় ক্ষতির নাম সম্ভবত কেভিন পিটারসেন।  ইংল্যান্ডের হয়ে খেলা ব্যাটসম্যান পিটারসেন একজন দক্ষিণ আফ্রিকান বংশোদ্ভূত, যাকে এই কোটা পদ্ধতির জন্য দেশ ছেড়ে ইংলিশ নাগরিকত্ব নিয়ে খেলতে হয়। এই তালিকায় আরও একটি সংযোজন অকালেই ঝড়ে যাওয়া ব্যাটসম্যান জোনাথন ট্রট। এমনকি দক্ষিণ আফ্রিকার সর্বশেষ বিশ্বকাপ আসরের স্বপ্ন-হন্তারক গ্রান্ট এলিয়ট নিজেও ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকান বংশোদ্ভূত, তিনিও এই কোটা পদ্ধতির শিকার। এছাড়া রোলফ ভ্যান ডার মারউই, কাইল অ্যাবট, রাইলি রশো, জ্যাক রুডলফ সহ আরো অনেক ক্রিকেটারই এই অদ্ভুত কোটা পদ্ধতির শিকার হয়ে, দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট না খেলে অকালেই সরে গিয়েছেন। অবসর নেবার পর বর্ণবাদী এই অদ্ভুত নিয়ম নিয়ে হতাশ হয়ে জ্যাক ক্যালিস বলেছেন, তিনি ‘দক্ষিণ আফ্রিকান’ হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে মাঝেমধ্যে কুণ্ঠাবোধ করেন। আর এর উত্তরও ফিকিলে এমবালুলা বেশ কড়াভাবেই দিয়েছেন, “স্পষ্টতই আমরা যখন তাকে নায়ক ভেবেছি, গোটা সময়টাই সে অভিনয় করেই কাটিয়ে দিয়েছে।” এরপরও তিনি এই নিয়মের ভিত্তি নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তিত নন!

রাবাদার এই নিষেধাজ্ঞার কারণে তাই ক্রিস মরিসের পক্ষে পরের ম্যাচে সুযোগ পাওয়াটা কিছুটা কঠিন হয়ে যেতে পারে, আর শিঁকে ছিড়তে পারে অলিভিয়েরের ভাগ্যে। আর সেক্ষেত্রে রাবাদা-ডি ভিলিয়ার্স-ডেল স্টেইনবিহীন প্রোটিয়াসদের পরবর্তী ম্যাচে হয়তো অভিজ্ঞতার দিক থেকে কিছুটা সংকটেই পড়তে হতে পারে।

 

ফিচার ছবি-২০১৬ সালে নিকোলাস কম্পটনকে আউট করার পর রাবাদা। সূত্র: skysports.com

Related Articles