Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

হিজড়া কারা এবং কেন?

ব্যস্ত শহরের মোড়ে ওদের প্রায়ই দেখা যায়, রঙিন মুখে সাবলীল ভাষায় আবদার করে ওরা। “ট্যাকা দে…, অ্যাই দিবি না?“- রাস্তাঘাটে চলাচল করতে গিয়ে এ ধরনের কথা মাঝেমাঝেই আমাদের কানে আসে বা এরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হই আমরা। রক্ত-মাংসের তৈরি হলেও তাদের পরিচয় কিছুটা আলাদা। কেউ তাদের বলে ‘হিজড়া’, কেউ বলে ‘তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ’, কেউ বা বলে ‘নপুংশক’। এই মানুষগুলো পুরুষ বা নারী কোনো পরিচয়েরই পরিচায়ক নয়। কেন তাদের এই পরিচয়গত ভিন্নতা? চলুন তা আজ জেনে নেয়া যাক।

হিজড়ারা সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত মানবগোষ্ঠী। শারীরিক গঠনগত কিছু প্রতিবন্ধকতার কারণে সমাজ তাদের অস্পৃশ্য বলে মনে করে। আর তাই এক অদৃশ্য দেয়াল দ্বারা পৃথক করে রাখে তাদের। তাদের জন্য শিক্ষা বা চিকিৎসা তো অনেক দূরের কথা, নূন্যতম মৌলিক চাহিদা পূরণেরও কোনো সুযোগ নেই। জীবিকা নির্বাহের জন্য কোনো ব্যবস্থা গ্রহণও সুশীল সমাজের কাছে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ বলে মনে হয় না কখনো। এর ফলস্বরূপ আমাদের নানা ধরনের ভোগান্তির শিকার হতে হয়, যা হিজড়াদের কাছে আয়ের উৎস।

ছবিসূত্রঃ youtube.com

ছবিসূত্রঃ youtube.com

নতুন শিশুর জন্ম হলে ঘরে ঘরে গিয়ে সেসব পরিবারের কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থ আদায়, বিভিন্ন পরিবহনে বিশেষ করে ট্রেনে তাদের দাবীকৃত চাঁদার স্বীকার হওয়া, বিভিন্ন দোকানে গিয়ে দোকান মালিকদের জোরপূর্বক অর্থপ্রদানে বাধ্য করা, রাস্তাঘাটে সামনে এসে উপস্থিত হয়ে টাকা আদায়- এ ঘটনাগুলো আমাদের কাছে রীতিমতো হয়রানির নামান্তর। এমনকি কর্মসংস্থানের অভাবে তারা অনেক সময় নানা অপকর্মেও জড়িয়ে পড়ে।

ছবিসূত্রঃ youtube.com

হিজড়া

এ মানুষগুলোকে বাংলায় ‘হিজড়া’ আর ইংরেজীতে ‘ট্রান্সজেন্ডার’ বলা হয়। কিছু কিছু মানুষের জন্মগতভাবে লিঙ্গের গঠনগত কিছু অসামঞ্জস্যতা থাকে, যার ফলে তাদেরকে ঠিক পুরুষ বা নারী হিসেবে নির্ধারণ করা যায় না। এদেরকে এক হিসেবে যৌন প্রতিবন্ধীও বলা যায়।

কীভাবে একজন বুঝতে পারে যে সে হিজড়া

ছবিসূত্রঃ speakingtree.in

তৃতীয় লিঙ্গের একজন যেকোনো বয়সেই অনুধাবন করতে পারে যে সে দৈহিক গঠনগত দিক দিয়ে যেকোনো নারী বা পুরুষের থেকে আলাদা। আসলে এটা নির্ভর করে নিজের জ্ঞান বা সচেতনতার উপর। কেউ পূর্বের শোনা কোনো ঘটনা স্মরণ করে খুব অল্প বয়সেই বুঝে যায়, কারো অনেকটা সময় লেগে যায় বুঝতে, কেউ আবার অনেকটা সময় পার করে দেয় এই ভেবে যে তাদের শারীরিক গঠনটা বাকিদের মতো নয় এবং অনেক সময় ভয় বা লোকলজ্জার কারণে এই বিষয় নিয়ে তারা চিন্তা করতে বা অন্যের সাথে শেয়ার করতে চায় না। একজন মানুষের যখন এই বিশেষ পরিচয়টির প্রকাশ ঘটে, তখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তার বাবা-মা, ভাই-বোন, সহকর্মী, বন্ধু-বান্ধব ও প্রিয়জন তাকে পরিত্যাগ করে। এক অস্বস্তিকর মানসিক চাপ, লাঞ্চনা, সামাজিকভাবে হেনস্থা এবং বৈষম্যের স্বীকার হয়ে থাকে তারা।

বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে হিজড়া সন্তান জন্মের কারণ

ছবিসূূত্রঃ speakingtree.in

বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ভ্রূণ বিকাশের সময় অস্বাভাবিক হরমোনের নিঃসরণের কারণে হিজড়া সন্তানের জন্ম হয়ে থাকে। পেনিস, টেস্টিস এবং ক্লিটোরিসে জিনগত ত্রুটির কারণে ফিটাসে অস্বাভাবিক সেক্স হরমোনের নিঃসরণ হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এই অস্বাভাবিক ঘটনাটিকে ‘কনজেনিটাল অ্যাড্রেনাল হাইপারপ্লাসিয়া’ বলা হয়, যার ফলশ্রুতিতে অস্বাভাবিক ক্রোমোজোমের বিভাজন হয়।

হরমোনগত ব্যাখ্যা

সাধারণত জন্মের সময় ভ্রুণের একই টিস্যু থেকে পুরুষ এবং স্ত্রী জননাঙ্গের সৃষ্টি হয়। ভ্রূণ বিকাশকালে যদি টেস্টোস্টেরন হরমোন নিঃসরণের মাত্রা অধিক হয়, তাহলে পুং জননাঙ্গ তথা পেনিস, স্ক্রোটাম ও পিনাইল ইউরেথ্রা তৈরি হয় যা পুরুষের পরিচয় বহন করে। আর যদি টেস্টোস্টেরন হরমোন কম নিঃসৃত হয় বা একেবারেই নিঃসৃত না হয়, তাহলে স্ত্রী জননাঙ্গ তথা ক্লিটোরিস, লেবিয়া মেজোরা এবং ভ্যাজাইনা তৈরি হয়, যা একজন নারীর পরিচয় বহন করে।

ব্যতিক্রম ঘটে তখন, যখন টেস্টোস্টেরন হরমোন নিঃসরণের পরিমাণ খুব বেশিও হয় না, আবার কমও হয় না, একটি মাঝামাঝি পর্যায়ে থাকে। এর ফলে জীনগতভাবে পুরুষের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত ছোট পেনিস ও টেস্টিস তৈরি হয় এবং পেনিস ছোট হওয়ার কারণে তা স্ক্রোটাম এর সাথে সংলগ্ন না থেকে বেশ খানিকটা উপরে থাকে। নারীদের ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে প্রশস্ত ক্লিটোরিস থাকে যা লেবিয়ার সাথে সংযুক্ত অবস্থায় থাকে। আবার কিছু মানুষের অপরিণত পুং এবং স্ত্রী জননাঙ্গ উভয়ই থাকে।

ক্রোমোজোমগত ব্যাখ্যা

ক্রোমোজোম হলো বংশগতির ধারক ও বাহক। এর কাজ হচ্ছে মাতা-পিতার জিনগত বৈশিষ্ট্য সন্তানের মাঝে বহন করে নিয়ে যাওয়া।মানুষের প্রতিটি দেহকোষে ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম রয়েছে। এর মধ্যে সেক্স ক্রোমোজোম অন্যতম যা সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণ করে। প্রতিটি মানুষের শরীরে ২৩ জোড়া ক্রোমোজোমের মধ্যে একজোড়া সেক্স ক্রোমোজোম থাকে। সেক্স ক্রোমোজোম দুটিকে X এবং Y দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। ভাবছেন বাকি ক্রোমোজোমগুলোর কাজ কী? বাকি ক্রোমোজোমগুলো জীবের অন্যান্য বৈশিষ্ট্য বহন করে থাকে।

মায়ের শরীরে এক জোড়া XX সেক্স ক্রোমোজোম এবং বাবার শরীরে XY সেক্স ক্রোমোজোম থাকে। মা ও বাবা উভয়ের X ক্রোমোজোম মিলিত হলে কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। আর মায়ের X ক্রোমোজোম ও বাবার Y ক্রোমোজোম মিলিত হলে পুত্র সন্তানের জন্ম হয়।

বিপত্তিটা ঘটে তখন, যখন ক্রোমোজোম স্বাভাবিক নিয়মে বিন্যস্ত হয় না। যার ফলে ভূমিষ্ট সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণ নিয়ে তৈরি হয় এক ধরনের জটিলতা। সন্তানটিকে মেয়ে বা ছেলে হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না। ক্রোমোজোমের অস্বাভাবিক বিন্যাসের উপর ভিত্তি করে লিঙ্গ জটিলতা সম্পন্ন মানুষ অর্থাৎ হিজড়াদের ৫টি গোত্রে ভাগ করা যায়।

১) XXY পুরুষ – এরা পুরুষদের মতো দেখতে হলেও শারীরিক গঠনে পুরুষদের সাথে রয়েছে ভিন্নতা। স্বাভাবিকের তুলনায় লম্বা হয় এবং পুরুষের ন্যায় জননাঙ্গ থাকলেও তা পরিপূর্ণ নয়। একজোড়া সেক্স ক্রোমোজোমের জায়গায় এদের শরীরে আরও একটি সেক্স ক্রোমোজোম বেশি থাকে অর্থাৎ দুটি X ক্রোমোজোম ও একটি Y ক্রোমোজোম থাকে।

২) XX পুরুষ – এদের ঈষৎ স্ফীত বক্ষ থাকে, তবে তা কখনোই সুডৌল হয় না। এরা বেঁটে আকৃতির হয় এবং অনেকটা স্বাভাবিকের ন্যায় পুরুষাঙ্গ থাকলেও শুক্রাশয়ে শুক্রাণু উৎপন্ন হয়  না। XX ক্রোমোজোম থাকলেও অস্বাভাবিক ক্রোমোজোম বিন্যাসের কারণে এরা কখনো পুরোপুরি নারী হয়ে উঠতে পারে না। পুরুষালি গুণ বেশি প্রকাশিত হয়।

৩) ক্লাইনেফেলটার সিনড্রোম – এদের স্ফীত বক্ষ থাকে এবং অপেক্ষাকৃত ছোট পুরুষাঙ্গ থাকে। এদের দাঁড়ি-গোঁফ খুবই কম গজায় এবং জননাঙ্গের আশেপাশেও চুলের পরিমাণ অনেক কম থাকে। এরা স্বভাবত লম্বা হয়ে থাকে। এদের শরীরে দুটি X ক্রোমোজোম ও একটি Y ক্রোমোজোম থাকে এবং X ক্রোমোজোমের প্রকটতার কারণে নারীর গুণ অধিক প্রকাশ পায়।

৪) টার্নার সিনড্রোম – এদের প্রথম দেখায় নারী বলে মনে হলেও স্ত্রী যৌনাঙ্গের সাথে তাদের যৌনাঙ্গের অনেক অমিল রয়েছে। এদের বুকের ছাতি পুরুষদের মতো প্রশস্ত হলেও তাতে স্ফীত বক্ষ পরিলক্ষিত হয়। এরা খাটো প্রকৃতির হয়ে থাকে। এদের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র একটি X ক্রোমোজোম অর্থাৎ একটি সেক্স ক্রোমোজোম থাকে। প্রয়োজনীয় আরও একটি সেক্স ক্রোমোজোমের অভাবে পুরুষ এবং নারী উভয়েরই বৈশিষ্ট্য দেখা যায়।

৫) মিশ্র যৌনগ্রন্থির বিকৃতি – এদের দেখতে পুরুষের মতোই মনে হয় এবং অনেকটা স্বাভাবিক পুরুষাঙ্গই থাকে। কিন্তু এর সাথে স্ত্রী জননাঙ্গও বিদ্যমান থাকে। অ্যাড্রেনাল গ্ল্যান্ডের অস্বাভাবিক নিঃসরণ এবং অস্বাভাবিক ক্রোমোজোম বিকাশের কারণেই এমন যৌনাঙ্গ জটিলতা তৈরি হয়।

ছবিসূূত্রঃ speakingtree.in

জন্মগত ত্রুটির কারণে হিজড়া নামক উপাধি পাওয়া এই মানুষগুলো আমাদেরই মতো বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ। শুধু ভিন্নতা রয়েছে শারীরিক গঠনে, আর তাই আমাদের সমাজ তাদের ভাগ্যলিপি হিসেবে এক অমোঘ নির্বাসনকে নিশ্চিত করে।

একবার ভেবে দেখুন তো, ক্ষুধার্ত ও আশ্রয়হীন মানুষগুলো কি তিনবেলা আহার আর মাথার উপর এক চিলতে ছাদের আশা করতে পারে না! জীবদ্দশায় না-ই বা পেলো স্থান, মৃত্যুর পরে সঠিকভাবে সৎকারটুকুও কি তাদের প্রাপ্য নয়?

Related Articles