মনে আছে জনাব বাদির কথা? পাহাড়ি এক বিরানভূমিতে নিজের কবর খুঁড়ে রেখে এসে যিনি লোক খুঁজছিলেন, যে তাকে কবর দিয়ে আসতে পারবে। সব ব্যবস্থা করে রেখেছেন তিনি, কীভাবে মারা যাবেন তাও পূর্বপরিকল্পিত, ঘুমের ওষুধ খাবেন আর পৃথিবী থেকে বিদায় নেবেন। কিন্তু বিপুল অর্থের বিনিময়েও কেউ তাকে মাটিচাপা দিতে রাজি হচ্ছিল না। উল্টো তাকে এই পথ থেকে ফিরানোর চেষ্টা করেন তারা। শেষে এক বয়স্ক প্রফেসর এসে শুধুমাত্র চেরি ফলের লোভে নিজে কীভাবে আত্মহত্যার পথ থেকে ফিরে এসেছেন সেই গল্প শোনালেন বাদিকে। শুনে বেশ ভাবান্তর হল বাদির। তবুও বৃষ্টির মধ্যে সে আশ্রয় নিল সেই কবরেই। কী হলো তার শেষ পর্যন্ত? সে কি আদৌ মরতে পেরেছিল?
হয়তোবা মনে আছে বেহজাদ, জাহান, আলি আর কেভিয়ানের কথা। এই সাংবাদিকরা এক কুর্দি গ্রামে গিয়ে এক বৃদ্ধার মৃত্যু পরবর্তী অনুষ্ঠান নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করতে চেয়েছিল। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল একটি মানুষের মৃত্যুর জন্য। শেষ পর্যন্ত ঐ মৃত ব্যক্তির লাশ নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করার আদৌ কি কোনো উৎসাহ ছিল তাদের? সেই বহুল প্রতীক্ষিত অনুষ্ঠানই তাদের কাছে হারিয়ে ফেলে জাগতিক সব আকর্ষণ।
একটি চলচ্চিত্র মানুষের মনে তৈরি করতে পারে হাজারো প্রশ্ন, কিন্তু তার উত্তর জানতে হলে খাটাতে হবে নিজের মাথা। সহসা কি এমনটি কেউ ভাবতে পারে? এমন চিন্তাধারা মাথায় নিয়েই কান চলচ্চিত্র উৎসব মাতিয়ে রেখেছিলেন এক ব্যক্তি, যিনি একই সঙ্গে চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার, চিত্রগ্রাহক, আলোকচিত্রশিল্পী এতগুলো পদ ধারণকারী; যার প্রয়াণে সরব হয়ে উঠেছিল বিশ্বমিডিয়া। বলছিলাম আব্বাস কিয়রোস্তামির কথা। গত বছরের ৪ জুলাই ইহলোক ত্যাগ করা ইরানি নবতরঙ্গ আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি কিয়রোস্তামিকে ঘিরে যখন বিশ্বব্যাপী হৈচৈ চলছে, তখন আমরাও নাহয় একটু দেখে নেই এই মহান সিনেমাটোগ্রাফারের নিজস্ব কিছু কথা।
শিশু চরিত্রের প্রাধান্য, প্রামাণ্য চিত্রের মতো সিনেমাটোগ্রাফি, গ্রাম্য এলাকায় শুটিং এবং গাড়ি বিশেষ করে ব্যক্তিগত গাড়ির ভেতর কথোপকথনের মতো একের পর এক নতুনত্ব নিয়ে ১৯৭০ সাল থেকে দর্শকদের সামনে হাজির হয়েছেন কিয়রোস্তামি। নিজের চলচ্চিত্রের রচনা, পরিচালনা, চিত্রগ্রহণ, সম্পাদনা, সঙ্গীত ও শব্দ সংযোগ সবকিছুতেই তার একচ্ছত্র প্রভাব থাকে, তার জীবনকাহিনী লিখতে গিয়ে সত্যজিৎ রায়ের কথা যেন খানিকটা মনে পড়ে যায়। দুজনেই নিজের চলচ্চিত্রের প্রায় সবটা দায়দায়িত্ব তুলে নিতেন নিজ হাতে। ফলাফল, দুজনেই আজ বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে নিজস্ব মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে আছেন।
“In the total darkness, poetry is still there, and it is there for you” কবিতার প্রতি কিয়রোস্তামির অগাধ ভালোবাসা বোঝাতে তার এই একটি উদ্ধৃতিই কি যথেষ্ট নয়? সমসাময়িক ইরানি কবিতা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন বারংবার, যার প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে তার নির্মিত অধিকাংশ চলচ্চিত্রের ডায়লগ, টাইটেল ও থিমে। কবিতার মতোই দুর্বোধ্য যেন তার ছবি, হাজারো প্রশ্ন আছে সেখানে, কিন্তু উত্তর? উত্তর খুঁজতে হলে ডুব দিতে হবে নিজের মনের গহীনে, যেখানে বাস করে শুধুই যুক্তিরা। শত হলেও তিনি নিজেও যে একজন কবি, তা তিনি দর্শকদের ভুলতে দেবেন কেন?
৭০ এর দশকে নব্য বাস্তবতাবাদী ছবি ‘ব্রেড অ্যান্ড অ্যালি’ নির্মাণ করেন তিনি। ছবিটির কাহিনী দোকান থেকে রুটি কিনে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরতে থাকা এক শিশুর সাথে রাস্তায় একটি কুকুরের মোকাবেলা নিয়ে। সেই থেকে শুরু করে ব্রেকটাইম, ক্লোজআপ, কোকের ত্রয়ী (হোয়ার ইজ দ্য ফ্রেন্ডস হোম?, অ্যান্ড লাইফ গোস অন এবং থ্রু দি অলিভ ট্রিস), টেস্ট অব চেরি এবং দ্য উইন্ড উইল ক্যারি আসের মতো কালজয়ী সব মাস্টারপিসের নির্মাতা কিয়রোস্তামি। এসব চলচ্চিত্র তাকে বিশ্বব্যাপী সুখ্যাতির পাশাপাশি ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে সিলভার লায়ন, কান চলচ্চিত্র উৎসবে পাম দোর, আকিরা কুরোসাওয়ার মতো পুরস্কার এবং ইউনিভারসিটি অব প্যারিস থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রী এনে দিয়েছে।
২০০০ সালে ডেভিড স্টারিটকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন প্রত্যেকটি চলচ্চিত্রের একটি গল্প আছে, কিন্তু সেই গল্পটির চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল গল্পটি কীভাবে বলা হচ্ছে। আকিরা কুরোসাওয়া পুরস্কারটি নিতে সান ফ্রান্সিস্কোতে অবস্থানকালে দেয়া সাক্ষাৎকারটিতে উঠে আসে নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো সম্পর্কে তার নিজস্ব চিন্তাধারা। সাক্ষাৎকারটির চুম্বক অংশ এখানে তুলে ধরা হলো।
আপনি তো আকিরা কুরোসাওয়ার আজীবন সম্মাননা পুরস্কারটি নিতে সান ফ্রান্সিস্কোতে এসেছেন, কুরোসাওয়ার চলচ্চিত্রের প্রতি কোনো আকর্ষণ অনুভব করেন কি?
না, কিন্তু আমি মনে করি এক ঘরানার চলচ্চিত্র নির্মাতারা ভিন্ন ঘরানার চলচ্চিত্র নির্মাতাদের তৈরি চলচ্চিত্র বেশ উপভোগ করেন। যেমন আমার নিজের পছন্দের সিনেমার তালিকায় রয়েছে ‘দ্য গডফাদার’ সিনেমাটি, আর এ কথা শুনে যে কেউ অবাক হয়ে যান!
আপনি যে ধরণের চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন, তা সত্বেও এরকম একটি চলচ্চিত্র আপনি কিভাবে পছন্দ করতে পারেন?
সেটিই তো চলচ্চিত্র জগতের মজা! (হাসি)
জাতীয় চলচ্চিত্র শব্দটি কি এখনও ব্যবহার করা যায়? নাকি চলচ্চিত্রের ব্যাপ্তি এতোটাই আন্তর্জাতিক হয়ে গেছে যে এ ধরণের লেবেলিং উঠিয়ে দেয়া উচিৎ?
প্রত্যেকটি চলচ্চিত্রেরই একটি জন্ম পরিচয় আছে, একটি আইডি আছে। চলচ্চিত্র তৈরি হয় মানুষকে নিয়ে, মনুষ্যত্বকে নিয়ে। পৃথিবীর সব জাতি আলাদা, তাদের ধর্ম, ভাষা, জীবনাচরণ সবই আলাদা। তারপরও একটা খুব কমন জিনিস আছে, আমাদের সবার মধ্যেই এটা আছে। ভিন্ন ভিন্ন মানুষকে নিয়ে যদি এক্স-রে মেশিনে ঢুকানো হয়, তাহলে কিন্তু বোঝা যাবে না কার ধর্ম কী, কার ভাষা কী, আর কে কোন ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে উঠে এসেছে। আমাদের সবার শরীরে ঠিক একইভাবে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে, আমাদের নার্ভাস সিস্টেম একই, সবার চোখ একইভাবে দেখে, সবাই একইভাবে হাসি আর কাঁদি, ব্যথা অনুভব করি। আমাদের মুখে যে দাঁত আছে, দেশ বা ব্যাকগ্রাউন্ড নির্বিশেষে, ঠিক একইভাবে ব্যথা করে। এখন যদি আমরা সিনেমা বা সিনেমা সংক্রান্ত বিষয়গুলোকে আলাদা করতে যাই, তাহলে অবশ্যই সুখ-দুঃখের কথাগুলো আগে আসবে। কিন্তু এগুলো তো সব দেশেই কমন।
মাঝে মাঝে আপনার ফিল্মগুলো চরিত্র বা গল্প সম্পর্কে পুরোপুরি তথ্য দেয় না, এবং এ সম্পর্কে কোথাও আপনি বলেছেন যে এর অন্যতম একটি কারণ হলো দর্শকরাও এই সৃষ্টিশীল প্রক্রিয়াটির অংশবিশেষ। কে কোন চেতনা থেকে সিনেমাটি দেখছে তার উপরই চলচ্চিত্রের বৈষয়িক ব্যাপারগুলো নির্ভর করে, আর তাই আমরা সবাই ভিন্ন ভিন্নভাবে চলচ্চিত্রগুলোর মানে দাঁড় করাই। এই আইডিয়াটা কীভাবে প্রত্যেকটি মানুষের একটি চলচ্চিত্রকে ভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করার সাথে ম্যাচ করে, যখন আমরা সবাই মূলত একটি সাধারণ মনুষ্যধর্মের অধিকারী?
এটি একটি বেশ কঠিন প্রশ্ন। একেকজনের একেকরকম আইডিয়া আছে এবং ব্যক্তিগতভাবে আমি চাই সব দর্শক তাদের কল্পনায় একই রকমভাবে সিনেমাটির পরিসমাপ্তি না টানুক। তবে ক্রসওয়ার্ড পাজলের মতো যেই তার সামধান করতে যাক না কেন শেষটা কিন্তু প্রায় একই হয়। যদি কেউ পুরোপুরি ভুলভাবে মুভিটা ব্যাখ্যা করেন, কিন্তু তার কথায় যুক্তি থাকে, তাহলেও কিন্তু প্রকৃত অর্থে আমার তৈরি চলচ্চিত্রগুলোর মূল্যমান ঠিকই থাকবে। শুধুমাত্র দর্শক কিছু একটা ভেবে কাহিনী শেষ করে দেবে, সেজন্য কিন্তু আমি আমার চলচ্চিত্রে খালি জায়গাটুকু রাখি না। আমি খালি জায়গা এজন্য রাখি যাতে দর্শক যা ভাবে বা যা চায় সেই অনুযায়ী শূন্যস্থানটুকু পূরণ করতে পারে। আমার মতে শিল্পের অন্যান্য ফর্ম, যেমন- পেইন্টিং, ভাস্কর্য, সঙ্গীত, কবিতা সবই সিনেমায় জায়গা করে নিতে পারে। আমি সিনেমাকে সপ্তম শিল্প হিসেবে অনুভব করি যেখানে বাকি সবগুলো শিল্পের সমাহার রয়েছে। তবে আজকাল সিনেমা পুরোপুরি একটা গল্প বলার প্ল্যাটফর্ম হয়ে গেছে, শিল্প এখান থেকে প্রায় উঠে যেতে বসেছে।
কয়েকজন চলচ্চিত্র নির্মাতা আছেন যাদের ধারণা আপনার নির্মাণ করা চলচ্চিত্র পুরোপুরি বিমূর্ত, তার রঙ আছে, ফর্ম আছে, গতি আছে, কিন্তু ছবিগুলো কোনো গল্প বলে না, কাহিনী বর্ণনা করে না। এই বিষয়টি কি কখনও আপনাকে ভাবিয়েছে বা আগ্রহী করে তুলেছে?
প্রত্যেক চলচ্চিত্রের একটি গল্প আছে। কিন্তু ঐ গল্পের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ গল্পটি কীভাবে বলা হচ্ছে। হতে পারে এটি কবিসুলভ বা অন্য যেরকমই হোক না কেন, গল্প বলার ধরণ অবশ্যই ভিন্ন হতে হবে। আমি এমন অনেক সিনেমা দেখেছি যা আমাকে একটুও আকর্ষণ করেনি অথবা আমি দীর্ঘক্ষণ ধরে তাকিয়ে থেকে অনেক কিছু ভেবেছি, কিন্তু সেখানে এমন অনেক মুহূর্ত ছিল যা আমার কল্পনার জগতে একের পর এক নতুন জানালা খুলে দিয়েছে। আমি মাঝপথে অনেক সিনেমা ছেড়ে দিয়েছি কারণ আমার মনে হয়েছে গল্পটার শেষ আমি দেখে ফেলেছি। নিজেকে তখন আমার পরিপূর্ণ মনে হয়েছে। যদি আমি আরও কিছুক্ষণ এই সিনেমাগুলো টেনে নিয়ে যেতাম তাহলে পুরো গল্পটাই নষ্ট হয়ে যেত, কারণ তখন আমি ভাবতে বসতাম কে ভালো, কে খারাপ, তাদের ভাগ্যে কী ঘটতে পারে। আমি হয়তো তাদের জাজ করা শুরু করতাম। কাজেই আমি আমার মতো করে কাজটি শেষ করে ফেলতেই বেশি পছন্দ করি!
আপনার বেশিরভাগ কথাই উপন্যাসের চেয়ে কবিতা কীভাবে মানুষকে প্রভাবিত করে তা বুঝিয়ে দিচ্ছে। একটি বিষয় বেশ ইন্টারেস্টিং যে আপনার সাম্প্রতিক একটি চলচ্চিত্র ‘দ্য উইন্ড উইল ক্যারি আস’ এর শিরোনাম এবং কিছু টেক্সট কবিতা থেকে নেয়া হয়েছে। আপনি কি ভবিষ্যতে এ ধরণের চলচ্চিত্র নির্মাণেই বেশি আগ্রহী যেখানে চলচ্চিত্র কোনো উপন্যাস নয় বরং চলচ্চিত্র হবে কবিতা?
হ্যাঁ, আমি বিশ্বাস করি শুধুমাত্র গল্প বলে যাওয়া চলচ্চিত্রগুলোর চেয়ে কাব্যিক চলচ্চিত্র মানুষের মনে দীর্ঘস্থায়ী হবে। বাড়িতে আমার লাইব্রেরিতে যেয়ে দেখবেন উপন্যাস বা গল্পের বই দেখলে মনে হবে মাত্র দোকান থেকে আনা হলো কারণ আমি মাত্র একবার ওগুলো পড়েই ফেলে রেখে দেই। কিন্তু আমার কবিতার বই ঘরের প্রত্যেক কোণায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, কেননা আমি তাদের বারংবার পড়েছি। কবিতা সবসময় আপনার কাছ থেকে দূরে পালাতে চায়, একে ধরা খুব কষ্টকর। আর প্রত্যেকবার যখন আপনি একই কবিতা পড়তে যাবেন, খেয়াল করে দেখবেন আপনার মানসিক অবস্থার উপর নির্ভর করে একেকবার একেক অর্থ মনে উঁকি দেবে। অপরদিকে একটি উপন্যাস আপনি একবার পড়লেও যা বুঝবেন, দশবার পড়লেও ঠিক তাই বুঝবেন। অবশ্যই আমি সব উপন্যাসের কথা বলছি না, ব্যতিক্রমও কিছু আছে। কিছু গল্পের মধ্যেও কাব্যিক একটা আবহ থাকে, পড়লে মনে হয় আমি হয়তো উপন্যাসের আদলে একটি কবিতা পড়ছি। স্কুলে আমরা যেসব কবিতা পড়ি- শুঁয়োপোকা ও মাকড়শার মধ্যে কথোপকথন বা এরকম আরও অনেক কবিতা, সেগুলো কিন্তু আমাদের সত্যিকার অর্থে কবিতা শেখানোর চেষ্টা করেনি। বরং এসব কবিতা আমাদের শিখিয়েছে কবিতার মাধ্যমে কিভাবে মানসিক, আত্মিক উন্নতি লাভ করা যায়।
সিনেমা আর কবিতার মধ্যে একটা প্রধান পার্থক্য হলো, বেশিরভাগ মানুষ মনে করে যে একটি সিনেমা একবার বা দু’বার দেখলে তারা গোটা ব্যাপারটা বুঝতে পারবে। যদি আপনি লাগাতার কাব্যিক ফর্মে সিনেমা তৈরি করতে থাকেন, তাহলে কি মূল বক্তব্যটি দর্শকদের পর্যন্ত পৌঁছানোটা কষ্টকর হয়ে যাবে না? যেহেতু একই চলচ্চিত্র একাধিকবার দেখতে আমাদের দর্শকরা অভ্যস্ত নয়। এখন দর্শকরা যে আপনার চলচ্চিত্রগুলো বারবার দেখবে তাদের কাছে কি এটা আপনার প্রত্যাশা না আশা?
আমি যদি বলি যে প্রত্যেককেই আমার চলচ্চিত্রগুলো বারবার দেখতে হবে, তাহলে তো সেটা স্বার্থপরের মতোই শোনাবে। তখন মনে হবে আমি শুধু আমার কাজটার মার্কেটিং করে যাচ্ছি! আমি কেন এ ধরণের চলচ্চিত্র বানাই তা আমি নিজেও বলতে পারব না। আমি শুধু এটুকুই বলতে পারি যে জিনিসটা এরকমই হওয়া উচিৎ ছিল বলেই তা হয়েছে। একটা সিনেমা বানানোর সময় কখনই আমার মনে হয় না যে শেষটা কেমন হবে বা মানুষ সেটি একবার দেখবে না দশবার দেখবে বা তাদের প্রতিক্রিয়া কি হবে। আমি শুধু সিনেমা বানিয়ে যাই আর তার ফলাফলের সাথে বাস করি। সবসময় যে শেষটা মধুর হয় তা কিন্তু না! আমি শুধু একটা কথা জানি, অনেক দর্শকই হয়তো পরিতৃপ্ত হয়ে হল থেকে বের হবেন না তবে তারা চাইলেও সহজে সিনেমাটির কথা ভুলতে পারবেন না। আমি জানি পরবর্তী ডিনারে তাদেরকে সিনেমাটি নিয়ে আলোচনা করতেই হবে। আমি শুধু এটুকুই চাই যে আমার ছবিগুলো যেন দর্শকদের কিছুটা অস্থির করে তোলে। তারা যেন ছবিটার ভিতর থেকে কিছু খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করে।
আপনি তো সেই ছোট একটি গ্রুপের সদস্য, যারা একটি নির্দিষ্ট নীতি ও আইডিয়া মাথায় রেখে দর্শকদের শেখাচ্ছেন। আপনাদের প্ররোচনায় দর্শকরা চ্যালেঞ্জিং সিনেমাগুলোর তারিফ করতে শিখছে। প্রত্যেকটি চলচ্চিত্রের সাথে আমরা একটু একটু করে আপনার কাজগুলোর সাথে জড়িয়ে যাচ্ছি।
আমি মনে করি এ ধরণের চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য এখন যে সুযোগটা রয়েছে, আজ থেকে ২০ বছর আগেও তা ছিল না। আজকাল দর্শকরা একই ধরণের চলচ্চিত্র দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। তারা নতুন কিছু, ভিন্ন কিছু দেখতে চাচ্ছে। যদিও ইরানে এরকম কাব্যিক ছবি শুধুমাত্র একটি থিয়েটারে দেখান হয় আর ইউএসএতে দুটি থিয়েটারে, তাও আমি খুশি। বেশির ভাগ মানুষ চায় সরলতা, তারা হাসতে চায়, কাঁদতে চায়, উত্তেজিত হতে চায়। এবং আমরা নিশ্চয় কাব্যিক সিনেমাতে দর্শকদের কাছ থেকে এ ধরণের উদ্দীপনা আশা করতে পারি না। আমি আমার কাজকে তাদের কাজের সাথে তুলনা করছি না। কিন্তু যদি একটি পার্কে কান্দিনস্কি, ব্রাক বা পিকাসোর চিত্রকর্ম পড়ে থাকে, তাহলে তার দাম মাত্র ১০০ ডলার হলেও কয়জন তা কিনতে চাবে? ছবিগুলো কেনার আগে ছবি সম্পর্কে একটা বাস্তববাদী ধারণা তো থাকতে হবে, সব জায়গায় বিনোদন খুঁজলে তো চলে না। একটা ছবির মধ্যে কি আছে, ছবিটা কি বলতে চেয়েছে তাই যদি লোকে না বোঝে তাহলে তারা যে ছবিটা কিনবে না এটাই তো স্বাভাবিক।
এবার আসা যাক ‘দ্য উইন্ড উইল ক্যারি আস’ চলচ্চিত্রটির কথায়। সিনেমাটির একটি থিম আমাকে বেশ আগ্রহী করে তুলেছে; দুর্দান্ত উত্তেজনা বা ডায়লগ, শারীরিক, বস্তুগত, পার্থিব বিষয়গুলো, আর এই প্রত্যেকটি জিনিসের বাহ্যিক বহিঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে অপারগতা- সব কিছু মিলিয়ে বেশ সুন্দর একটা প্যাকেজ। এখানে একই সাথে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ লেভেল উঠে এসেছে, যার মধ্যে একটির কথা না বললেই নয়। আমাদের গ্রামগুলোতে এখনও মানুষ পরস্পরের সাথে সাক্ষাতে কথা বলে আর জিনিসপত্র আদান-প্রদান করে স্বশরীরে। তার ঠিক উল্টোভাবে শহরের মানুষ কথা বলে সেলফোনে, বলতে গেলে তাদের কথা ভেসে আসে বাতাসের মাধ্যমে। আমি আপনার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি, বিমূর্ত এই বিষয়গুলোকে শারীরিক জীবনের সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও কীভাবে আপনি সংযুক্ত করেছেন? আপনার সিনেমায় কি শারীরিক ও আত্মিক এই দুটি বিষয়ের মধ্যে কোনো টেনশন দেখান হয়েছে?
মুভিটা আমার এখনও দেখা হয়নি। এক বছর ধরে একজন টেকনিশিয়ান হিসেবে আমি সিনেমাটি পর্যবেক্ষণ করেছি এবং এখনও পর্যন্ত আমি মোটামুটি ঐ পর্যায়েই রয়ে গেছি, কাজেই আমার উচিৎ হবে না ছবিটিকে বিচার করা। কিন্তু আমার একজন দর্শক আমাকে জানিয়েছেন যে এটি আত্মা নিয়ে, যারা মারা গেছে, যাদের কোনো অস্তিত্ব নেই তাদের নিয়ে বানানো হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় সেই লোকটির কথা যে খানা খুঁড়ছিল বা সেই বৃদ্ধাটির কথা যে মারা যাচ্ছিল। আমরা তাদের জীবন দেখতে পাই না। হ্যাঁ, ঠিক যেমনটি আপনি বললেন, সিনেমাটিতে শারীরিক এক ধরণের সুবাস রয়েছে যার পাশাপাশি রয়েছে অশরীরী বা আত্মিক একটা আবহ। কিছু চরিত্র আমরা দেখতে পাই না কিন্তু অনুভব করতে পারি। এখান থেকে একটা সম্ভাবনা তৈরি হয় যে কিছু না হয়েও অনেক কিছু হওয়া যায়। আমার মতে, এটিই সিনেমাটির মূল থিম।
কিছু না হয়েও অনেক কিছু হওয়া যায় মানে? বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করবেন কি?
এ ধরণের সিনেমার ক্ষেত্রে- যেসব জিনিস দেখা যায় না, আমরা দেখতে পাই না- দর্শক হিসেবে আমরা আমাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা অনুযায়ী সেই ঘটনাগুলো ব্যাখ্যা করি। এই চলচ্চিত্রটিতে এগারো জন মানুষ আছেন যাদের দেখা যায় না। ছবির শেষে এসে আপনি বুঝতে পারবেন তাদেরকে আপনি দেখেননি, কিন্তু ঠিকই আপনি বুঝতে পারছেন তারা কারা এবং তারা কেন ছিলেন। আমি এমন ছবি বানাতে চাই যেখানে দৃশ্যত কিছু না দেখিয়েও অনেক কিছু দেখাতে পারব। আজকালকার অনেক ছবির থেকেই এ ছবিগুলো আলাদা। এখনকার ছবিগুলো অনেকটা এরকম যাকে এক কথায় পর্ণোগ্রাফি বলা যায় না, কিন্তু তাতে পর্ণোগ্রাফির পুরোপুরি আবহ আছে। কথাটা এজন্য বলছি কারণ তারা এতো বেশি করে দেখায় যে দর্শকদের নিজের মতো করে কিছুর ভাবার সুযোগই দেয় না। আমার লক্ষ্য হলো দর্শকরা যেন নিজের সৃজনশীলতা আর কল্পনাশক্তি কাজে লাগানোর যথেষ্ট সুযোগ পায়। আমি চাই আপনার মনের ভিতরে যে গোপন তথ্য লুকিয়ে আছে, যার অস্তিত্ব সম্পর্কে আপনি নিজেও জানেন না সেই জায়গাটাতে আঘাত করতে। ইরানী একটা প্রবাদ আছে যে যদি কেউ নিজের মন থেকে কিছু খুঁজে বের করার চেষ্টা করে, তাহলে নিজের দুই চোখের সাথে আরও দুটি চোখ সে ধার করে আনে। আমি চাই এই ধার করা চোখ দুটোকে খুলে দিতে। দর্শকরা যেন পর্দায় কি হচ্ছে, কি দেখান হচ্ছে আর কি বোঝানো হচ্ছে তা চার চোখ দিয়েই দেখতে পারে, অনুভব করতে পারে।
আপনার মতো একই চিন্তাধারায় কাজ করছেন এমন একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা সম্পর্কে বলুন?
হৌ সিয়াও-সিয়েন এরকম একজন। তারকভস্কি কাজগুলো আমাকে শারীরিক জগত থেকে একদম বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। তার তৈরি আধ্যাত্মিক চলচ্চিত্রগুলো আমি দেখেছি- তার চলচ্চিত্রে ফেলিনি যা করেছে বা স্বপ্নের জগতটাকে ফিল্মে দেখানো- এগুলো সহজ কথা নয়। থিয়া এঞ্জেলোপলাসের চলচ্চিত্রের কিছু মুহূর্তেও এরকম আধ্যাত্মিকতার ছোঁয়া পেয়েছি। এক কথায় বলতে গেলে, চলচ্চিত্র এবং সিনেমা এমন হওয়া উচিৎ যা আমাদেরকে দৈনন্দিন জীবন থেকে দূরে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে, জীবনের অন্য একটি পর্যায়ের সাথে পরিচিত করাবে। আমাদের শান্তি আর সান্ত্বনা দেয়ার এটি একটি ভালো উপায়। রাজা ও শেহেরেজাদে- এরকম গল্প বলার দিন এখন শেষ।
‘টেস্ট অফ চেরি’ চলচ্চিত্রটিকে এর বিষয়বস্তুর জন্য সেন্সরবোর্ডের রোষের মুখে পড়তে হয়নি?
চলচ্চিত্রটি নিয়ে বেশ বিতর্ক ছিল, কিন্তু কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে আমি তাদের বুঝিয়ে বলি যে সিনেমাটি আত্মহত্যাকে কেন্দ্র করে নয় বরং জীবন আমাদের কি কি সুযোগ দিচ্ছে, কীভাবে আমরা জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি সে সম্পর্কে বানানো হয়েছে। আমাদের সবার সামনেই একটি দরজা রয়েছে, চাইলেই যেকোনো মুহূর্তে আমরা তা খুলতে পারি। কিন্তু আমরা তা না করে অপেক্ষা করি, আমরা সৃষ্টিকর্তার দয়ার মুখাপেক্ষী হয়ে বসে থাকি। সৃষ্টিকর্তা নিঃসন্দেহে দয়ালু, কেননা তিনি আমদের সামনে ঐ দরজাটা খোলা রেখেছেন। কর্তৃপক্ষ এই ব্যাখ্যা শুনে খুশি হয়। রোমানিয়ান এক দার্শনিকের একটি উক্তি সেদিন আমার খুব কাজে লেগেছিল, “আত্মহত্যার সম্ভাবনা না থাকলে আমি অনেক আগেই নিজেকে শেষ করে ফেলতাম।” সিনেমাটি তৈরি করা হয়েছে বেঁচে থাকাকে উৎসাহিত করতে। জীবন আমাদের উপর কেউ চাপিয়ে দেয়নি, এটি একটি উপহার- এটিই ছিল আমার চলচ্চিত্রের মূল থিম।
শেষ প্রশ্ন, একটি চিত্রনাট্য নিয়ে কাজ না করে কয়েক পাতার একটি নির্দেশনা নিয়ে কাজ করার জন্য আপনার বেশ নাম ডাক রয়েছে। একেবারে শেষ মুহূর্তে অভিনয় ও ডায়লগ সব কিছু বানিয়ে ফেলেন আপনি। এভাবে কাজ করার সুবিধা কি?
অকুস্থলে দাঁড়িয়ে কাজ করাটা বা ডায়লগ বানানোটা জরুরি, কেননা শুধুমাত্র এভাবেই আমি অপেশাদার অভিনেতাদের সাথে মিশে যেতে পারি। আমার ছবির কিছু কিছু মুহূর্ত হয়তো আপনাকে বিস্মিত করবে, মাঝে মাঝে আমি নিজেও অবাক হয়ে যাই। আমি অভিনেতাদের কোনো ডায়লগ বলে দেই না, একবার হয়তো পুরো ব্যাপারটি তাদেরকে বুঝিয়ে দেই, বাকিটা তারা এমনভাবে কথা বলা শুরু করে যা আমার নিজের কল্পনাকেও ছাড়িয়ে যায়। এটা একটা চক্রের মতো, কোথায় শুরু হচ্ছে আর কোথায় শেষ হচ্ছে, আমি নিজেও ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। আমি জানি না আমি তাদেরকে শিখাচ্ছি কী বলতে হবে নাকি তারা আমাকে শেখাচ্ছে কী দেখতে হবে!
ফিচার ইমেজ: moviemezzanine.com