শীর্ণ দেহ, উষ্কখুষ্ক দাঁড়ি, এলোমেলো চুল, মলিন মুখ। তার হাতে খাঁচা, খাঁচায় বন্দি একটি টকটকে লাল সূর্য।
সুবোধ। সে পালিয়ে যাচ্ছে।
গত বছর আগারগাঁও, মহাখালী এবং পুরাতন বিমানবন্দরসহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকার দেয়ালে সুবোধকে দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। ‘সুবোধ সিরিজ’ নামের এই গ্রাফিতি চিত্রকর্মগুলো মানুষকে রোমাঞ্চিত করেছিল, ভাবিয়েছিলো। অথচ, এই গ্রাফিতির কারিগরের পরিচয় আজও অজানাই থেকে গেলো। সুবোধের স্রষ্টার মতো বিশ্বজুড়ে নানা আঁকিয়ে এসেছিল, আসবে, যাদের পরিচয় নানা কারণে অজানাই থেকে যাবে। এরকমই কয়েকজন শিল্পীদের নিয়ে আজকের লেখা।
১. মাস্টার অফ দ্য প্লেইং কার্ডস
তখন পঞ্চদশ শতাব্দী, সবেমাত্র ছাপাখানার প্রসার শুরু হয়েছে। প্রেসের সাথে সাথে খোদাইচিত্রের সংমিশ্রণের শুরু হয়েছিল তখন। খোদাইকর্ম নিজেই একপ্রকার শিল্প হবার কারণে বহু শিল্পীই তাদের নিজস্ব স্টাইলে করা খোদাইকর্ম বই-পুস্তক ছাপানোর ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে শুরু করেন। পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি কোনো এক সময়ে আবির্ভাব ঘটে এমন এক শিল্পীর, যিনি কি না পৃথিবীর ছাপাখানার ইতিহাসে প্রথম দক্ষ কারিগর হিসেবে বিবেচিত হবেন।
এ তালিকার সবচেয়ে প্রাচীন শিল্পীদের অন্যতম হলেন এই ব্যক্তি।
জার্মান, মতান্তরে সুইস, এই শিল্পীর নাম ‘মাস্টার অফ দ্য প্লেইং কার্ডস’ হবার কারণ হলো তার যেসব কাজের নমুনা আজ পর্যন্ত পাওয়া গিয়েছে, তার সিংহভাগই হলো প্রাচীন খেলার তাস। এ পর্যন্ত পাওয়া ৭০টিরও বেশি তাসের প্রতিটিই ছিল খেলার জন্য তৈরি। দক্ষ হাতে কাজ করা এই তাসগুলোর কোনোটিতে ছিলো মানুষ, কোনোটিতে পাখি, হরিণ, এমনকি ড্রাগনও। কার্ডগুলোর প্রতিটির নাম্বার এবং ছবি ছিল অনন্য। কার্ডের ধরন দেখে ধারণা করা হয়, এগুলো সেট ধরে পাওয়া যেত।
ছাপাখানায় ব্যবহৃত অধিকাংশ খোদাইকর্মের পেছনে যারা ছিল, তারা পূর্বে স্বর্ণকার ছিল। তবে মাস্টার অফ প্লেইং কার্ডসের বেলায় ধারণা করা হয়, তিনি এর আগে একজন আঁকিয়ে ছিলেন। এর কারণ, তার সৃষ্টির অনেকগুলোতে বিভিন্ন কায়দায় শেডের ব্যবহার আছে, আবার তার কিছু কাজ ছিল জাপানী চিত্রকর্মের সদৃশ। তার অধিকাংশ কাজই সাদা-কালো অথবা এক রঙে ছাপানো হলেও ‘নেইভ অফ ফ্লাওয়ার্স’ নামের একটি কার্ড পাওয়া গেছে, যাতে দেখা যায় একটি মেয়ে তৎকালীন মন্ত্রীসভার পোষাক পরে আছে। এই কার্ডটি রঙিন ছিল।
ছাপাখানার জগতের এই অনন্য ব্যক্তিত্বের পরিচয় যদিও জানা যায়নি, তবে তার কাজের ধরন এবং তার দ্বারা প্রভাবিত শিল্পীদের কাজ অনুসরণ করে ধারণা করা হয়, তিনি জার্মানির কোলন শহরে কাজ করতেন। এখন পর্যন্ত তার পাওয়া ১০৬টি কাজের নমুনা কুপফেরস্টিচকাবিনেট, ড্রেসডেন এবং প্যারিসের বিব্লিওথেক ন্যাশনাল দ্য ফ্রান্সে সংরক্ষিত আছে।
২. দেদে
স্ট্রিট আর্ট গোটা পৃথিবীজুড়ে শিল্প হিসেবে নাম করলেও কেবল সাম্প্রতিক সময়ে তার প্রভাব দেখা গেছে ইসরাইলে। ক্যানভাসের চাইতে তেল আবিবের দেয়ালে নিজের বক্তব্য তুলে ধরতে বেশি উৎসাহী দেদে। দেদে ওরফে ব্যান্ডএইড দেদে, ইসরাইলের সবচেয়ে পরিচিত গ্রাফিতি আঁকিয়ের অন্যতম।
পরিচয় বললে ভুল হবে, কেননা এখন পর্যন্ত দেদের আসল চেহারা দেখা যায়নি। ইসরাইলের বাধ্যতামূলক মিলিটারি সার্ভিস শেষে বেযালেল একাডেমি অফ আর্টস এন্ড ডিজাইনে আন্ডারগ্রাজুয়েট শিক্ষার্থী হিসেবে থাকাকালে দেদের গ্রাফিতি আঁকানো শুরু হয়। নিজের আদর্শ এবং চারপাশে ঘটে যাওয়া সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিষয়গুলোকে দেয়ালে ফুটিয়ে তুলেন তিনি। ব্যক্তিগতভাবে তিনি অবকাঠামো বিরোধী হবার কারণে এর ছাপ দেখা যায় তার কর্মে- তা ব্যালারিনার পোষাক পরা পুলিশ হোক কিংবা বুদবুদ নিয়ে খেলতে থাকা সেনাবাহিনীর পোশাক পরা শিশু।
দেদের গ্রাফিতিগুলো বরাবরই অন্যায়ের প্রতিবাদ করে, ছড়ায় শান্তির বার্তা। এজন্য তার গ্রাফিতিগুলোতে পায়রার ব্যবহার অনেক দেখা যায়। আঁকানোর ক্ষেত্রে প্রথমে তিনি স্টেন্সিলের ব্যবহার করলেও পরবর্তীতে তিনি খালি হাতে আঁকানোর অনুশীলন করেছেন। সাধারণত তিনি খোলা জায়গাতে নিজের গ্রাফিতিগুলো আঁকেন, তবে তার বিরুদ্ধে যেন কেউ ভ্যান্ডালিজমের অভিযোগ, তথা সম্পত্তি নষ্ট করার অভিযোগ না আনতে পারে সেদিকে তিনি খেয়াল রাখেন।
আরব বসন্ত থেকে শুরু করে ২০১৪ সালের ইসরাইল-গাজা সংকট ইত্যাদি তিনি তুলে ধরেন তার কাজে। গাজা সংকটের সময় তিনি গোটা এক পার্কিং লটকে পরিণত করেছিলেন এক মিসাইল অ্যাটাক টার্গেটে। দেদের কাজগুলো অনেকটা নির্ভর করে স্থানের ওপর। আশপাশের বিভিন্ন স্থানে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা মানুষকে স্মরণ করানোর জন্য তিনি ব্যবহার করেন গ্রাফিতি। এজন্য তার কাজের উপকরণ হিসেবে তিনি ব্যবহার করেন ফেলে দেয়া কাঠ, স্টিল, কাগজসহ অনেক কিছুই।
তার কাজগুলোর মধ্যে অবৈধ ঘোষিত হয়েছে যেগুলো তার একটি হলো ডলফিনিয়াম নামের একটি পরিত্যক্ত পার্কে আঁকা দাঁতের পাটি। আশির দশকে স্থাপিত পার্কটি লোকসানের সম্মুখীন হলে এর মালিক পার্কটির নানা অংশ বিভিন্ন ক্লাবকে ভাড়া দেয়। এ সময় পার্কটি আমোদপ্রমোদের জন্য বেশ জনপ্রিয় হলেও ২০০১ সালে বোমা হামলায় এবং ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটার পর পার্কটি পুনরায় পরিত্যক্ত অবস্থায় ফিরে যায়। পার্কটি সম্পর্কে ইসরাইল সরকারকেও কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। এ সময় দেদে এর দালানের এক অংশে বিশাল আকারের দু’পাটি দাঁতের গ্রাফিতি আঁকেন, যেন পরিত্যক্ত এ পার্কটির কথা সকলে আবার মনে করেন।
গ্রাফিতির নিচে দেদের সই অথবা ব্যান্ডএইড- এ হলো দেদের কাজ চেনার উপায়। তার নামেও ব্যান্ডএইড, দেদের এ ব্যান্ডএইড প্রীতির যথাযথ কারণ এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। তবে ‘স্ট্রিট আর্ট এনওয়াইসি’ ব্লগের এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন,
“আসলে আমি আমার নিজের কিছু ক্ষত প্রকাশ করার জন্য এবং তা থেকে আরোগ্য লাভের জন্য একটা মাধ্যম খুঁজছিলাম। একসময়ে এ ব্যান্ডএইড সব ধরনের প্রতিকূলতার প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়, তা ব্যক্তিগত হোক বা সামাজিক- যা কি না আজও তার সমাধান খুঁজেই চলেছে।”
৩. ব্ল্যাক হ্যান্ড
তেহরানের বিভিন্ন দেয়ালে অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিজের তীব্র প্রতিবাদের ভাষা এবং চলমান সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ের উপর বক্তব্যের জন্য এ গ্রাফিতি আঁকিয়েকে বলা হয় ‘ইরানের ব্যাংক্সি’। ব্যাংক্সির মতো ব্ল্যাক হ্যান্ডও আঁকার সময় স্টেনসিল ব্যবহার করে থাকেন, কেননা সকলের অগোচরে দ্রুততার সাথে কাজ করার জন্য এই পদ্ধতি বেশি কার্যকরী। ২০১৪ সাল থেকে ব্ল্যাক হ্যান্ডের কাজগুলো জনসম্মুখে আসে।
তার কাজগুলোর পেছনের বক্তব্য যেমন স্পষ্ট, তেমনই বলিষ্ঠ। আশ্চর্যজনক হলেও ইরানে স্ট্রিট আর্ট কিন্তু অবৈধ না। তবে দেয়ালে কেবলমাত্র তারাই গ্রাফিতি আঁকাতে পারবে যারা কি না প্রশাসন কর্তৃক স্বীকৃত। অর্থাৎ শাসকগোষ্ঠীর বিরোধী যেকোনো কাজই অবৈধ। এজন্য ব্ল্যাক হ্যান্ডের মতো আঁকিয়েদের জন্য কাজগুলো বড়ই বিপদজনক। অনেক সময় আছে যে, কোনো ছবি আঁকার অল্প সময়ের মধ্যে যদি তা কর্তৃপক্ষের চোখে পড়ে তবে তা তারা সাথে সাথে নষ্ট করে। কিন্তু তাতেও থামানো যায় না ব্ল্যাক হ্যান্ডকে।
প্রতিবাদী এই আঁকিয়ে তার গ্রাফিতি দিয়ে নারী জাগরণের কথা বলেছেন। খেলার মাঠ থেকে নারীদের বঞ্চিত করার প্রতিবাদে করা তার গ্রাফিতিতে দেখা গেছে যে, একজন জার্সি পরিহিতা নারী দুই হাতে ডিশওয়াসের বোতল তুলে ধরে আছেন ট্রফির মতো, তার তীব্র দৃষ্টি দর্শকের দিকে তাকিয়ে।
গার্ডিয়ানের সাথে এক সাক্ষাৎকারে ব্ল্যাক হ্যান্ড বলেন, “শিল্পের উপর গ্যালারিগুলোর একচ্ছত্র আধিপত্য দূর করতেই আমি স্ট্রিট আর্ট বেছে নিয়েছি। আমাদের বুদ্ধিজীবীসহ সমাজের উপরের কাতারের মানুষেরা সাধারণ মানুষকে সর্বদাই ছোট করে দেখছে, অগ্রাহ্য করেছে।”
আশা করা যায় যে, সর্বদাই অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে যাবেন ব্ল্যাক হ্যান্ড।
৪. স্কিড রোবট
শুধু বড় বড় বিষয় নয়, বরং আশপাশের মানুষের ছোট ছোট সুখ-দুঃখের গল্প নিয়ে যে অমূল্য শিল্পকর্ম তৈরি করা যায়, তার উদাহরণ হলেন যুক্তরাষ্ট্রের গ্রাফিতি আঁকিয়ে স্কিড রোবট। সমাজের সবচেয়ে নিগৃহীত, সবচেয়ে বেশি অবজ্ঞার শিকার হয় যে ‘হোমলেস’ তথা গৃহহারা মানুষই, তারাই তার কাজের বিষয়। অনেক সময় মানুষ তার ম্যুরালের অংশ হয়ে দাঁড়ায়।
তার সবচেয়ে আলোরণ তোলা কাজগুলোর একটি হলো হুইল চেয়ারে বসা এক ব্যক্তি, যার পিঠে গুলি লাগাতে দুটো পা অবশ হয়ে গেছে। স্কিড রোবট তার হুইলচেয়ারের পেছনের দেয়ালে সিংহাসন এঁকে তাকে রাজার সাজ দিয়েছেন। শুধুমাত্র তাদের নিয়ে শিল্পকর্ম তৈরি নয়, তাদের জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার গল্পগুলোও জানা যাবে তার কাজের সাথে সাথে, কেননা স্কিড রোবটের গোটা ইনস্টাগ্রাম একাউন্টটা তাদের গল্প নিয়েই তৈরি। গৃহহীন এ মানুষদের স্বার্থে স্কিড রোবট প্রজেক্ট চালু করেছেন এই আঁকিয়ে, যার কাজ হলো গৃহহীন মানুষের পুনর্বাসন।
নানা কারণেই বিশ্বে বিভিন্ন শিল্পীর আবির্ভাব ঘটছে, ঘটবে। এর মধ্যে অনেকেই আছে যাদের পরিচয় নিরাপত্তা অথবা অনিচ্ছার কারণে কোনোদিন জানা যাবে না। হয়তো কালের প্রবাহে তাদের পরিচয় হারিয়ে যাবে। কিন্তু তাদের সৃষ্টি এবং মানুষের উপর তাদের প্রভাব ঠিকই টিকে থাকবে।
ফিচার ইমেজ: equaltimes.org