খ্যাতনামা তলোয়ারগুলো যেন একেকটা রূপকথার চারাগাছ। অজস্র শোণিতধারা আর বিজয়ের উপাখ্যান মেশানো এই তরবারিগুলো যুগে যুগে রীতিমতো পৌরাণিক চরিত্রে পরিণত হয়েছে। প্রতিটি তলোয়ারের পেছনের গল্পের সাথে বাস্তবতা আর কল্পনা এমনভাবে মিশে গিয়েছে যে তাদেরকে আলাদা করে সেখান থেকে সত্যের প্রকৃত নির্যাসটুকু খুঁজে বের করা এখন প্রায় অসম্ভব। মানুষের মুখে মুখে ফেরা গল্পের মাধ্যমে এমনই এক বিখ্যাত (পড়ুন কুখ্যাত) হয়ে ওঠা তরবারির নামে ইতিহাসে নিজের জায়গা করে নিয়েছেন সামুরাই মুরামাসা।
জাপানে তখন চলছিল মুরোমাছির রাজত্ব, সময়টা চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শতাব্দীর মাঝমাঝি। সে সময়ে জাপানে খুব বিখ্যাত একজন তরবারি নির্মাতা ছিলেন মাসামুনে, তারই শিষ্য সামুরাই মুরামাসা। অস্কার রট্টি এবং অ্যাডেলে ওয়েস্টব্রুক মুরামাসা সম্পর্কে বলেন, “তিনি ছিলেন খুব দক্ষ একজন তলোয়ার কারিগর, তবে তার মানসিক বিকারগ্রস্ততার ছাপ ছড়িয়ে পড়ে তার বানানো তরবারিগুলোতে। লোকমুখে প্রচলিত আছে, দু’প্রান্ত প্রচণ্ড সূচালো এই তলোয়ারগুলো এতোটাই রক্তপিপাসু যে দিনশেষে যোদ্ধাদের হত্যা কিংবা আত্মহত্যা করতে তা দারুণ প্রলুব্ধ করে।”
সামুরাই মুরামাসা সেঙ্গোকে একজন শিল্পী বললে খুব একটা ভুল বলা হবে না। তলোয়ার নির্মাণকে তিনি প্রকৃত অর্থেই শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করেন। তার বানানো প্রতিটি তলোয়ারই এমন ধারালো ও তীক্ষ্ণ ছিল যে তা যেকোনো যোদ্ধার স্বপ্নের হাতিয়ার হতে পারে। মুরামাসা প্রতিদিন তার তলোয়ারগুলো পূজা-অর্চনার মাধ্যমে পরিশোধন করতেন। বলা হয়, তিনি ঐ লৌহ খণ্ডগুলোর মাঝে নিজের আত্মা এবং শক্তি সঁপে দিয়েছিলেন। পানির মধ্য দিয়ে তরবারি চালিয়ে মাছ শিকার করা, পাহাড়ে-বনে জঙ্গলে গিয়ে যুদ্ধ করা এ সবই যেন তার কাছে ধর্মীয় উপাসনার চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না।
তলোয়ারগুলো নিয়ে মুরামাসা এতোটাই মেতে উঠেছিলেন যে তার বাস্তব হিতাহিতজ্ঞান ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে থাকে। জাপানের কিংবা বলা যায় পুরো পৃথিবীর সেরা তলোয়ার কারিগর হিসেবে মুরামাসার পরেই মাসামুনে গোরোর নাম আসে। গুরু মাসামুনেকে পিছনে ফেলে ইতিহাসে নিজের জায়গা করে নিতে মুরামাসা এমনই খুনে কিছু তলোয়ার বানান যে তাদের ধ্বংসাত্মক ক্ষমতাবলে একসময় তিনি নিজেই পুরোপুরি পাগল হয়ে ওঠেন রক্তের নেশায়। পরবর্তীতে মুরামাসার তলোয়ার যখন যার কাছে গেছে, তাকেই মুরামাসার মতো রক্তপিপাসু বানিয়ে আত্মহত্যা পর্যন্ত করতে বাধ্য করেছে!
জাপানের উপকথা থেকে জানা যায়, মুরামাসা একবার তার গুরু মাসামুনেকে তলোয়ার বানানোর প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার চ্যালেঞ্জ দেয়। এই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কে দেশের সেরা তলোয়ার নির্মাতা তা নির্ধারিত হবে। দুজনই তাদের বানানো তলোয়ার নিয়ে ময়দানে হাজির হয়। এবার পালা তরবারির ক্ষমতা বিচারের।
প্রতিযোগিতার সারমর্ম অনেকটা এমন ছিল যে বিজয়ীর তলোয়ার এতটা ধারালো হতে হবে যাতে ঝর্ণার মধ্য দিয়ে তলোয়ার চালালে ঝর্ণার স্রোত গতিপথ বদলাতে বাধ্য হয়। দুজনের তলোয়ার পরীক্ষা করার সময় দেখা গেল মুরামাসার তলোয়ারের প্রান্ত এতোটাই তীক্ষ্ণ ও ধারালো যে তা যার মধ্যে দিয়ে চালানো হচ্ছে তা-ই ভেদ করে চলে যাচ্ছে। নদীর স্রোত, গাছের পাতা, বাতাসের মধ্যে ভেসে থাকা ফুলের রেণু কিছুই বাদ যাচ্ছে না। অপরদিকে মাসামুনের তলোয়ার সেখানে খুব বেশি কার্যকারিতা দেখাতে পারল না। অথচ ফলাফল ঘোষণার সময় মাসামুনেকে বিজয়ী ঘোষণা করা হলে চমকে যায় উপস্থিত সবাই।
যেহেতু মুরামাসার তলোয়ার প্রচণ্ড রক্তপিপাসু আর নির্বিচারে সবকিছু বধ করছিল যেখানে মাসামুনের তলোয়ার প্রয়োজন ছাড়া একটি বস্তুকেও আঘাত করেনি, সেই বিচারে মাসামুনেকেই এই প্রতিযোগিতার বিজয়ী হিসেবে ভূষিত করা হয়। তবে মানের দিক থেকে মাসামুনের তলোয়ার যে মুরামাসার তলোয়ারের চেয়ে ভালো ছিল না তার বড় প্রমাণ পরবর্তী ২০০ বছর ধরে মুরামাসার তলোয়ারের তুমুল জনপ্রিয়তা।
প্রতিযোগিতাটি হয়েছিল তোগুগাওয়া ইয়েসুর শাসনামলে। ইয়েসুর, যিনি ছিলেন জাপানের প্রথম শগুন বা কমান্ডার ইন চীফ, পক্ষপাতিত্বের ফলে হেরে যায় মুরামাসা। ঠিক যেন তার প্রতিশোধ নিতেই শগুনের বাবা মাৎসুদাইরা হিরোতোডা এবং দাদা মাৎসুদাইরা কিয়োয়াসু উভয়েই রহস্যজনকভাবে এই তলোয়ারের দ্বারা নিহত হন। এমনকি শগুন নিজেও অস্ত্র পরিচালনার প্রশিক্ষণ দিতে গিয়ে দুর্ঘটনাক্রমে এক জেনারেলের হাতে মুরামাসার তলোয়ারের আঘাতে প্রাণ হারান। তারপর থেকে শগুন পরিবার আর এই অভিশপ্ত তরবারি নিজেদের জিম্মায় রাখার সাহস দেখাননি। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে মুরামাসা তরবারি যারা কাছে রাখবে তাদের জন্যও শাস্তির ব্যবস্থা করতে বাধ্য হয়েছিল রাজপরিবার। তখন থেকে তরবারির মালিকানা নিয়ে লুকোচুরি খেলতে খেলতে এখন সত্যিকারের মুরামাসার তরবারিগুলো কোথায় আছে তা চিহ্নিত করা মুশকিল। শেষবারের মতো তরবারিটি দেখা গেছে এডোর সময়ে। শিন্টোর পণ্ডিত মাৎসুয়োকা মাসানাও তার কয়েকজন সঙ্গীসহ মুরামাসার তরবারিটি একবার দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেন। তাদের ভাষ্যমতে, রাজা আকিহিতোর দরবারে খাপ বদলানোর সময় এক ঝলক তরবারিটি দেখেই তারা চিনতে পারেন এটি মুরামাসার সেই বিখ্যাত তরবারি। তবে মজার ব্যাপার হলো মুরামাসা তরবারি যারা দেখে ফেলেন তাদের কপালেও জোটে দুর্ভাগ্যের ফাঁড়া। সেদিন দরবারে যারা যারা মুরামাসা তরবারি দেখেছিলেন রাতের মধ্যে সবাই ভয়ঙ্কর অসুস্থ হয়ে পড়ে আর সকালের মধ্যে মারা যান। একটু বেশি সময় বেঁচে থাকা মাৎসুয়োকা ঘটনাটি সবাইকে জানিয়ে যান। এটি ছিল ১৯৮৯ সালের ঘটনা। তারপর থেকে আর হদিস মেলেনি মুরামাসার তরবারির।
জাপানি গণমাধ্যমে প্রায়ই মুরামাসার তরবারিকে মাসামুনের তরবারির সাথে মিলিয়ে ফেলা হয়। মাসামুনের নির্মিত তরবারির নাম ‘হনজো মাসামুনে‘। ঐতিহাসিক দিক থেকে এই তরবারিটিও সর্বকালের সেরা তরবারির একটি হিসেবে বিবেচিত হয়। সূক্ষ্মতম ধার এবং কারুকার্যের জন্য এই তরবারি বিশেষভাবে সমাদৃত। ‘হনজো মাসামুনে’ নামটি এসেছে ‘হনজো শিগেনাগা’ নামটি থেকে। হনজো ছিলেন ষোড়শ শতাব্দীর উয়েসুগি ক্ল্যানের এক বিখ্যাত জেনারেল, দুর্ধর্ষ যোদ্ধা হিসেবে দারুণ খ্যাতি আছে তার। একবার এক যুদ্ধে উমানোসুকে নামক আরেক বিখ্যাত যোদ্ধার আক্রমণে হনজোর শিরস্ত্রাণ ছিঁড়ে যায়। নিজের প্রাণ বাজি রেখে সেই যুদ্ধে জয়ী হওয়া হনজোকে পুরস্কার হিসেবে একটি তলোয়ার প্রদান করা হয়। এই তরবারিটি এর আগে অনেক বিখ্যাত যুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছে বলা জানা যায়। আসলে হনজোকে উপহার দেয়া এই তরবারিটিই ছিল ‘হনজো মাসামুনে’। অর্থাভাবে পড়ে এক সময় তরবারিটি বিক্রি করতে বাধ্য হন হনজো। তারপর থেকেই হাত থেকে হাতে ঘুরতে থাকে বিখ্যাত এই তরবারি। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষদিকে নির্মিত এই তলোয়ারটিকে ১৯৩৯ সালে জাপানের জাতীয় সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সার্জেন্ট কোল্ডি বাইমোর নামক এক ব্যক্তির কাছে তরবারিটি আছে বলে খোঁজ পাওয়া যায়, কিন্তু রেকর্ড বই অনুসারে এমন কোনো তথ্যের যথার্থ প্রমাণ না থাকায় তরবারিটি হাতছাড়া হয়ে যায় জাপানের। জাপানের হারিয়ে যাওয়া বিখ্যাত তরবারিগুলোর মধ্যে ‘হনজো মাসামুনে’ এবং ‘মুরামাসা’ দুটোরই নাম আছে। দুটি তরবারি প্রায় একই সময়ে তৈরি বলে তথ্যগত দিক থেকে প্রায়শ ভুল করে বসে গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ।
মুরামাসার তলোয়ারগুলো খাপে ঢোকানোর আগে প্রতিদিন একবার রক্ত দিয়ে স্নান করানো হতো সেগুলো। সেই ধারা মেনে যখন তার মালিকানা হাতবদল হতো, তখন সে মালিকের রক্তে নিজেকে রঞ্জিত করতেও কুণ্ঠাবোধ করত না। জাপানের ইতিহাসে তাই শয়তানের অভিশপ্ত তরবারি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে সামুরাই মুরামাসার তলোয়ারগুলো। ভিডিও গেম, অ্যানিমে এমনকি মারভেলের জগতেও কিংবদন্তী হিসেবে এখনও বীরদর্পে বিরাজ করছে মুরামাসার তলোয়ার। আমরা জানি না মুরামাসার তরবারি আসলে অভিশপ্ত কিংবা রক্তপিপাসু ছিল কিনা, তবে রহস্যে ঘেরা এই তরবারি আমাদের মনে যে কৌতূহলের সৃষ্টি করে সেটিই মারামুসাকে বাঁচিয়ে রাখবে আজীবন।