জীবজগতের বংশগতির ধারক ও বাহক ডিএনএ। বংশগতির প্রবাহ এবং বিবর্তনে ডিএনএ এক অনবদ্য ভূমিকা পালন করে। ডিঅক্সিরাইবো নিউক্লিক এসিড বা সংক্ষেপে ডিএনএ গঠিত হয় মূলত তিন প্রকার উপাদান দিয়ে। এগুলো হলো ফসফেট, ডিঅক্সিরাইবোজ নামক চিনি এবং ৪ ধরনের নাইট্রোজেন ক্ষারক। ক্ষারকগুলো হলো অ্যাডেনিন, গুয়ানিন, সাইটোসিন এবং থাইমিন।
ডিএনএ আমাদের আদিম পুরুষদের, অর্থাৎ আমাদের পূর্বের ইতিহাস ও গল্পগুলো ধারণ করে। আমরা কীভাবে আমাদের পরিচিত মুখগুলোর সাথে সম্পর্কিত, মানুষ ছাড়াও অন্যান্য প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীবের সাথে আমাদের কী সম্পর্ক, নিয়ান্ডারথাল মানবের সাথে হোমো স্যাপিয়েন্স এর মিলন কিংবা মানুষের আফ্রিকা মহাদেশে অভিবাসন- এসব কিছুর তথ্য লুকিয়ে আছে আমাদের ডিএনএ-তে। অর্থাৎ একইসাথে যেমন এটি বংশগতির ধারকবাহক, তেমনই এক বিপুল তথ্যের ভাণ্ডার।
যখন বিজ্ঞানী ও গবেষকগণ বলেন যে, আদিম মানুষ আফ্রিকায় এসেছিল প্রায় ২ লক্ষ বছর আগে এবং সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে ৬০ হাজার বছর আগে। মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, তারা কীভাবে সেটি বর্তমান সময়ে বসেই বলে দিলেন। সাধারণত গবেষকগণ বিভিন্ন সময়ে পাওয়া জীবাশ্ম ও আদিম মানুষের ব্যবহার্য উপাদানের ভগ্নাংশ নিয়ে গবেষণা করে মানুষের প্রাগৈতিহাসিক সময়রেখা নির্ণয় করে থাকেন। এসব জীবাশ্মের রেডিও কার্বন ডেটিং কিংবা পটাসিয়াম-আর্গন ডেটিংয়ের মাধ্যমে খুব সহজে এদের সময়কাল নির্ণয় করা যায়। কিন্তু এই পদ্ধতিগুলোর দ্বারা সময়কাল নির্ণয় করার জন্য জীবাশ্ম কিংবা নমুনাকে বিশেষ এক পরিবেশে রাখতে হয় যা বেশ জটিল। আবার সবসময় সব ধরনের জীবাশ্ম দিয়ে সঠিক সময়কাল বের করাও মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়।
এই জটিলতা দূর করার জন্যই এলো ডিএনএ ডেটিং পদ্ধতি। সাধারণত প্রতিটি প্রজন্মেই জীবের ডিএনএ একটি নির্দিষ্ট হারে পরিবর্তিত হতে থাকে। অর্থাৎ পূর্ববর্তী প্রজন্মের নারী ও পুরুষ সদস্যের মিলনে যখন নতুন প্রজন্মের আবির্ভাব হয় তখন নতুন প্রজন্মের মাঝে আগের প্রজন্মের দুজনেরই ডিএনএ থাকে। দুজনের ডিএনএ’র মিশ্রণ হয়। মিশ্রণ হবার মানে হলো ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়।এখন কল্পনা করুন, যদি বিজ্ঞানীগণ ডিএনএ’র এই পরিবর্তনের হার বের করতে সমর্থ হন, তাহলে সেই হার অনুযায়ী যদি বর্তমান প্রজন্ম থেকে পূর্ববর্তী প্রজন্মের দিকে ফেরা যায়, তাহলে কিন্তু খুব সহজে সেই সময়কাল নির্ধারণ করা সম্ভব হবে।
এবার যে পদ্ধতিতে আমরা আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম কিংবা পূর্বপুরুষদের আবির্ভাব কিংবা বয়স সম্পর্কিত নানা ধরনের তথ্য পাচ্ছি, তা যদি আমরা ভবিষ্যতের দিকে প্রয়োগ করি, তাহলে বর্তমান প্রজন্ম কবে নাগাদ কোন অবস্থায় উপনীত হবে, তা জানা সম্ভব কি? কিংবা একটু সহজ করে বলতে গেলে, কোনো মানুষ বা প্রাণীর কোন সময়ে কী ধরনের পরিবর্তন হবে বা কখন সে মৃত্যুবরণ করতে পারে, সে তথ্য পাওয়া সম্ভব হবে কিনা?
গবেষকরা দেখেছেন, জীবের পুরো জীবনকাল জুড়েই তাদের ডিএনএ-তে একটি নির্দিষ্ট হারে রাসায়নিক পরিবর্তন হয়ে থাকে। ডিএনএ’র এই নির্দিষ্ট হারে রাসায়নিক পরিবর্তন থেকে মানুষ বা অন্যান্য জীবের বয়স, এমনকি আয়ুষ্কাল নির্ণয় করা যেতে পারে বলেও গবেষকরা মনে করেন।
তাত্ত্বিক এই গবেষণার ক্ষেত্রে বেশ কিছু ব্যাপার বিবেচনা করার পরও দেখা যায় যে, যাদের অনুমিত বয়স তাদের প্রকৃত বয়সের থেকে বেশি হয়, তাদের আয়ুকাল অপেক্ষাকৃত কম হয়, অর্থাৎ তাদের দ্রুত মৃত্যু হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অন্যদিকে, যাদের ক্ষেত্রে এই অনুমিত বয়স ও সময়ানুক্রমিক প্রকৃত বয়স প্রায় সমান সমান, তারা পূর্বে বর্ণিত মানুষ বা জীবের থেকে অপেক্ষাকৃত বেশিদিন বেঁচে থাকে।
মূলত ডিএনএ এর এপিজেনেটিক পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করে গবেষকগণ কোনো ব্যক্তির জৈবিক বয়স পরিমাপ করে থাকেন। এপিজেনেটিক পরিবর্তন এমন যে, এতে জিনের অভিব্যক্তির পরিবর্তন ঘটে, যেমন জিনের থাকা এবং না থাকার সমন্বয়, কতকটা মিউটেশনের মতোই। এসময় ডিএনএ এর মূল অনুক্রম পরিবর্তন না-ও হতে পারে। এক্ষেত্রে গবেষকগণ ডিএনএ’র মিথাইলেশন প্রক্রিয়ার দিকে নজর দিয়েছেন, যা দ্বারা ডিএনএ’র মূল অনুক্রমের সাথে অন্যান্য রাসায়নিক ট্যাগ যুক্ত করা হয়। এখন আমাদের বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে এই ডিএনএ মিথাইলেশন নির্দিষ্ট হারে পরিবর্তিত হবে।
তবে সবসময় যে ডিএনএ মিথাইলেশনের পরিবর্তনের উপর আমাদের আয়ুষ্কাল নির্ভর করবে, এমন নয়। ধূমপান, ডায়াবেটিস কিংবা কার্ডিওভাস্কুলার রোগের মতো অন্য কিছু ব্যাপারও এর সাথে জড়িত থাকতে পারে। এসব কারণে মানুষের আয়ু কমে যেতে পারে। তাছাড়া এটি বয়স ও লিঙ্গের উপরও নির্ভর করে।
যদিও এসব গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা ডিএনএ ঘড়ি ও আমাদের আয়ুষ্কালের মধ্যে সম্পর্কের কথা তুলে ধরে, কিন্তু তারপরও আরো বিস্তৃত গবেষণা প্রয়োজন এই বিষয়ে। এভাবে আমাদের আয়ুষ্কাল নির্ণয়ে ডিএনএ ক্লক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। মলিক্যুলার প্রোগ্রামারদের জন্য এই ডিএনএ ক্লক কেন জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে সে বিষয়ে আসা যাক।
প্রকৃতি সবসময়ই জৈবিক যন্ত্রাদি ও সার্কিট তৈরিতে পাণ্ডিত্য প্রদর্শন করে, যা সাধারণ মানুষের কাছে বিস্ময়কর বলে মনে হয়। প্রকৃতির এরকমই এক আশ্চর্য উদ্ভাবন হচ্ছে আমাদের দেহঘড়ি। এটি সময়ের সাথে সাথে দৈহিক পরিবর্তন ঘটায়, জিনগত তথ্যের অনুলিপি তৈরি করে এবং সেগুলো বংশ পরম্পরায় প্রবাহিত করে কিংবা শরীরের কোষীয় সঞ্চালন ঘটাতে পারে। প্রকৃতির এই কাজেই অনুপ্রাণিত হয়ে এখন বিজ্ঞানীরা এসব জৈবিক যন্ত্রাদি, যেমন ন্যানোস্কেল ফ্যাক্টরি, জৈবিক সার্কিট কিংবা আণবিক কম্পিউটার আবিষ্কারের জন্য নিরলস গবেষণা করে যাচ্ছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে যথেষ্ট সাফল্যও আছে বর্তমান গবেষকদের ঝুলিতে।
এসব গবেষণা কাজের জন্য গবেষকদের বিশেষভাবে নির্ভর করতে হয় বিদ্যমান কোষীয় উপাদান, যেমন বিভিন্ন প্রকার এনজাইমের উপর। কিন্তু কেবল কোষীয় উপাদানের উপরই সকল গবেষণা চালানো হয় না। অনেক গবেষকই একদম শূন্য থেকে শুরু করতে চেষ্টা করেন। সেই সকল আণবিক প্রোগ্রামারগণের জন্য ডিএনএ হয়ে দাঁড়ায় অনেকটা প্রোগ্রামিং কোডের মতো, যা ব্যবহার করে তারা রচনা করেন নতুন সব আণবিক প্রোগ্রাম। সাম্প্রতিক সময়ে এই ডিএনএ প্রোগ্রামের ধারাবাহিকতায় তৈরি করা হয়েছে প্রথম আণবিক ঘড়ি (মলিক্যুলার ক্লক), যা সম্পূর্ণভাবেই ডিএনএ দিয়ে তৈরী।
এই যুগান্তকারী আবিষ্কার গবেষকদের নতুন করে ভাবতে শেখাচ্ছে। ডিএনএ কেবলই বংশগতির তথ্যের পরোক্ষ ধারক-বাহকই নয়, বরং এটি জটিল আচরণ প্রদর্শনকারী এক ধরনের অণু। এই ডিএনএ অসিলেটর বা আণবিক ঘড়ি তৈরির জন্য জৈবপ্রযুক্তি অবশ্যই কৃতিত্বের দাবি রাখে। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, ডিএনএ ঘড়ি কৃত্রিম জৈববিজ্ঞানে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করবে। এর সহায়তায় কৃত্রিম কোষের কার্যক্রমের একটি রুটিন তৈরি করে দেওয়া সম্ভব হবে কিংবা আণবিক কম্পিউটার নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও এর ব্যবহার হবে সর্বাপেক্ষা গ্রহণযোগ্য। অর্থাৎ সেই মানুষের আয়ুষ্কাল নির্ণয় করা সম্ভব হবে এবং সেই সাথে এর বিশেষায়ণ করাও সম্ভব হতে পারে। ফলে এর দ্বারা শারীরিক আরো অনেক কর্মকাণ্ডের উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব তৈরি করা সম্ভব হবে।
অস্টিনের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও কম্পিউটার প্রকৌশলী ডেভিড সলোভাইকিক, ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিউট অব টেকনোলজির একজন ডক্টরাল প্রার্থী নিরঞ্জন শ্রীনিবাস এবং তাদের সহকর্মীগণ একটি ডিএনএ কম্পাইলার তৈরি করেছেন। এই ডিএনএ কম্পাইলার মূলত কয়েকটি অ্যালগরিদম সিরিজের সমন্বয়ে তৈরী, যার সহায়তায় একজন আণবিক প্রোগ্রামার কম্পাইলারে জৈব রসায়নের সহায়তা ছাড়াই অণু গঠনের নির্দেশনা দিতে পারেন। এরপর কম্পাইলারের সফটওয়্যার এই নির্দেশনাকে রূপান্তরিত করে ডিএনএ অনুক্রমে এবং এই অনুক্রমের সংশ্লেষণ ও মিশ্রণের ফলে তৈরি হয় আরো অনুক্রমের। এসব অনুক্রম পরবর্তীতে আণবিক যন্ত্রটিতে নিজেরাই একত্র হয়ে গঠন করে যৌগিক ডিএনএ নির্দেশনা।
গবেষক দলটি এই কম্পাইলার ব্যবহার করে একটি ডিএনএ অসিলেটরের প্রোটোটাইপ প্রোগ্রাম করতে সক্ষম হয়েছেন। ডিএনএ অসিলেটরটি পর্যায়ক্রমিক ‘টিক’ এবং ‘টক’ প্যাটার্নের স্পন্দন উৎপন্ন করে। অর্থাৎ ঘড়িতে যেমন টিক-টক শব্দের সমন্বয় তৈরি করা হয়, এখানেও ঠিক তেমনটাই করা হয়েছে। আবার এই টিক-টক প্যাটার্নের পরিবর্তন ও বিশেষায়ণের মাধ্যমে নতুন ধরনের প্যাটার্ন তৈরি করা যায়। অনেকটা ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতিতে ব্যবহৃত বাইনারি কোডের মতো। ০ এবং ১ এর সমন্বয়ে তৈরি সব প্রোগ্রাম। এখানেও ঠিক একইরকম। রাসায়নিক সংকেতের সাহায্যে যদি এর টিক-টক প্যাটার্নের গতি বৃদ্ধি করা যায়, তাহলে সেটি অপেক্ষাকৃত জটিল আচরণ প্রদর্শন করতে পারে বলে গবেষক দলটির ধারণা।
বংশ পরম্পরায় ডিএনএ হয়ে আছে এক অপার তথ্যের ভাণ্ডার। সেই সাথে এই রাসায়নিক পদার্থের পরিবর্তন মূল্যায়ন করে আমরা যেমন আমাদের বয়সকাল জানতে পারি, তেমনি ডিএনএ ক্লকের প্রোগ্রাম করে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তনও আনা সম্ভব। এই পরিবর্তন ও বিশেষায়ণ হবে জৈবিক গবেষণার ক্ষেত্রে আরো বেশি সহায়ক।
ফিচার ইমেজ: oncology-central.com