২০০০ সালের আগস্ট মাসের ঘটনা। রাশিয়ার উত্তর দিকে বেরেন্ট সাগরে রাশিয়ার একটি নৌবহরের সামরিক কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হচ্ছিলো। সেখানেই রাশিয়ার তৈরি কুরস্ক নামের একটি নিউক্লিয়ার সাবমেরিন রহস্যজনকভাবে ডুবে যায়।
‘রহস্যজনক’ শব্দটি ব্যবহার করা হচ্ছে, কারণ এই দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর পৃথিবীর উত্তরাঞ্চলীয় সকল ভূকম্পনবিদ ডুবে যাওয়ার দিনের সিসমোলজি গ্রাফ পরীক্ষা করেন এবং বুঝতে পারেন যে কুরস্কের দুর্ঘটনার দিন বেরেন্ট সাগরের ডুবে যাওয়ার অংশ থেকে কিছু অস্বাভাবিক সিসমিক বা ভু-কম্পনজনিত তরঙ্গের উৎপত্তি হয়। সিসমোলজি গ্রাফের ডাটা পরীক্ষা এবং বিশ্লেষণ করে সাবমেরিনটির ডুবে যাওয়ার কারণ বোঝা যায়। কিন্তু সবচেয়ে বেশী আশ্চর্যের ঘটনা ছিল এই যে, এই ডাটা থেকে ডুবে যাওয়ার পর সাবমেরিনটি কতটুকু গভীরে চলে গিয়েছিলো সেটাও জানা যায়।
এই ঘটনাটি রহস্যজনক কারণ এত দূর থেকে শুধুমাত্র কম্পন তরঙ্গের তথ্য এবং উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ডুবে যাওয়ার পর ডুবে যাওয়া সাবমেরিনের গভীরতা বের হবার কথা না। কিন্তু এই ক্ষেত্রে এমনটি ঘটেছিল। কী ঘটেছিল আসলে সেদিন? কী ছিল সেই উপাত্তের মধ্যে? সাবমেরিনের সাথে ভূকম্পনের কী সম্পর্ক?
কুরস্ক সাবমেরিনটি ছিল অত্যন্ত আধুনিক একটি নিউক্লিয়ার সাবমেরিন। এটি ছিল অস্কার টাইপ ২ জলযান। মোটামুটি ২৪টি পর্যন্ত মিসাইল ধারণ করতে পারত এই বাহন। এগুলোর নিউক্লিয়ার মিসাইল ধারণক্ষমতা ছিল প্রায় ৫,০০০ কিলোটন এর মতো। যেদিন এই দুর্ঘটনা ঘটে সেদিন দু’বারে ভিন্ন তীব্রতার কয়েকটি ভূ-কম্পন তরঙ্গ শনাক্ত করা যায়। প্রথমটি ছিল অপেক্ষাকৃত দুর্বল। কিন্তু দ্বিতীয়টি ছিল প্রথমটি থেকে প্রায় ২৫০ গুণ শক্তিশালী যেটা ঘটনাস্থল থেকে ৫,০০০ কিলোমিটার দূরের স্টেশন থেকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছিলো। এখানে উল্লেখ্য যে, সাবমেরিনটিতে বিস্ফোরক পদার্থ ছিল প্রায় ৭৫০ কিলোগ্রাম এর মতো এবং দ্বিতীয় যে বিস্ফোরণ হয় সেটা ছিল প্রায় ৩ থেকে ৫ টন টিএনটি (ট্রাই নাইট্রো টলুইন) বিস্ফোরণের সমান [১]।
এবার ঘটনার বর্ণনায় আসা যাক। সিসমিক বা ভূ-কম্পনজনিত তরঙ্গের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই তরঙ্গ হয় পৃথিবীর মাটির ভিতর দিয়ে যাবে না হয় ভূমির সাথে লাগোয়া অবস্থায় প্রবাহিত হবে, যে কারণে ভূমি কেঁপে কেঁপে উঠবে। ভূমির কম্পন তরঙ্গ শনাক্তকরণ এবং পরীক্ষা করার জন্য যে সিসমোলজি স্টেশন তৈরি করা হয় সেগুলো মূলত ভূমিকম্পের (Earthquake) ফলে যে তরঙ্গ সৃষ্টি হয় সেগুলোর ডাটা সংরক্ষণ এবং সেগুলোর গ্রাফ তৈরি করে। কিন্তু এই যন্ত্রগুলো পৃথিবীর পৃষ্ঠে বা পৃষ্ঠের কাছাকাছি বড় কোনো শক্তির নিঃসরণ ঘটলে, যেমন বড় কোনো বিস্ফোরণের ফলে যে সিসমিক তরঙ্গ তৈরি হয় সেগুলোও পরিজ্ঞান করে। যখনই এই তরঙ্গগুলো স্টেশনের কাছাকছি দিয়ে যায় তখন তা কলমের মতো একটি যন্ত্রকে আন্দোলিত করে এবং কলমটি সাথে সাথে তরঙ্গটির রূপরেখা এঁকে ফেলে যেটা দেখে তরঙ্গের বিস্তার এবং অন্যান্য সব তথ্য সম্বন্ধে জানা যায়। কুরস্ক সাবমেরিনটির ক্ষেত্রে প্রথমে ছোট ছোট বিস্তারের দোলন শনাক্ত করা হয়। কিন্তু ১৩৫ সেকেন্ড পর অনেক বড় বড় বিস্তারের দোলন আসতে শুরু করে। এই জায়গাটিই বিজ্ঞানীদের খটকার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
পরবর্তীতে বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, প্রথম যে ভূকম্পন তরঙ্গ সংকেত পাওয়া যায় সেটা সৃষ্টি হয়েছিলো সাবমেরিনের ভিতরের বিস্ফোরণের ফলে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে, কোনো টর্পেডো উৎক্ষেপণ করার সময় সেটা কাজ করতে ব্যর্থ হয় এবং সে কারণে সেখানে বিস্ফোরণ হয়। এই আকস্মিক বিস্ফোরণের ফলে সাবমেরিনের কাঠামো ভেঙ্গে যায়, আগুন ধরে যায় এবং প্রচণ্ড ঢেউয়ের কারণে সাবমেরিনটি তাল না সামলাতে পেরে সাগরে ডুবে যায়। ডুবে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে বেশ বড় বড় বিস্তারের তরঙ্গ সংকেত ধরা পড়ে। বিজ্ঞানীরা পরে পরীক্ষা এবং বিশ্লেষণ করে দেখেছেন যে, প্রথম বিস্ফোরণের ফলে টর্পেডোতে যে আগুন ধরে যায় তার ফলে সাবমেরিনটি ডুবে যাওয়ার পর প্রায় পাঁচটি অনবোর্ড মিসাইলের একসাথে বিস্ফোরণ ঘটে। একসাথে বিস্ফোরণের ফলে সেখানে প্রচুর শক্তির ক্ষয় হয় এবং প্রায় একইসাথে শক্তিশালী তরঙ্গ সিসমোলজি স্টেশনে ধরা পড়তে থাকে। হিসাব করে দেখা গেছে, এই শক্তিশালী তরঙ্গের স্পন্দন ০.১১ সেকেন্ড পর পর স্টেশনে ধরা পড়ছিল।
বিজ্ঞানীরা এই সময় পার্থক্য হিসেব করে ডুবন্ত সাবমেরিনটি কতটুকু গভীরতায় ডুবে আছে সেটা বের করে ফেলেন। আসলে দ্বিতীয়বার যে শক্তিশালী কয়েকটি ভূকম্পন তরঙ্গ তৈরি হলো সেগুলো ঘটেছিল যখন সাবমেরিনটি সাগরের একদম নিম্নপৃষ্ঠে মাটির উপর অবস্থান করছিলো। বিস্ফোরণের পর যে পালস তৈরি হয়েছিলো সেগুলো সাবমেরিনটি থেকে সমুদ্রের নিম্নপৃষ্ঠে এবং পানির মধ্য দিয়ে উপরের দিকে প্রবাহমান ছিল। পানির ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময় শক্তিশালী তরঙ্গগুলো কয়েকবার সমুদ্রের মাটি এবং পানির পৃষ্ঠ এই দুই মাধ্যমের মাঝে লাফাতে (Bounced) শুরু করেছিলো। যতবার এই তরঙ্গগুলো সমুদ্রের মাটিতে পতিত হয়েছে ততবার সেটা সিসমোলজি স্টেশনে ধরা পড়তে থাকে। সংকেত পাওয়ার পর দুটি তরঙ্গ স্পন্দনের সময়ের পার্থক্য যে ০.১১ সেকেন্ড বলা হয়েছে সেটা ছিল আসলে তরঙ্গগুলোর সাবমেরিন থেকে পানির উপরিতল পর্যন্ত এসে আবার সমুদ্রের নিম্নপৃষ্ঠে যেতে যে সময় লেগেছে তার সমান। এই সময় পার্থক্য ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা নিউক্লিয়ার সাবমেরিনটির সমুদ্রের নিচের অবস্থান বের করেন ৮০ মিটার গভীরতায়। পরে তদন্ত করার সময় বের হয় যে, আসল গভীরতা ছিল ১১৫ মিটার। হিসেবটিকে মোটামুটি নিখুঁতই বলা যায়। প্রায় ৭০% শুদ্ধতার সাথে হিসেবটি করা হয়।
যারা ভূমিকম্প নিয়ে গবেষণা করে তারা মাঝে মাঝে তাদের যন্ত্রে এরকম তরঙ্গ সংকেত পেয়ে থাকে। সবসময় যে ভূমিকম্প থেকেই সিসমোলজি যন্ত্রে শক্তিশালী তরঙ্গ সংকেত ধরা পড়বে তা কিন্তু না। এরকম বড় বড় বিস্ফোরণ, যেগুলো ভূমির খুব কাছে ঘটে, সেগুলোর কারণেও সিসমিক তরঙ্গ তৈরি হতে পারে। এরকম আরও কিছু উদাহরণ দেয়া যায়, যেমন ১৯৯৮ সালে নাইরোবিতে অবস্থিত আমেরিকান দূতাবাসে ট্রাকবোমা বিস্ফোরিত হয়। সেসময়ও এরকম তরঙ্গ সংকেত ধরা পড়ে। ১৯৮৯ সালেও লস এঞ্জেলেসে এরকম শক্তিশালী শকওয়েভ ধরা পড়ে যখন স্পেস শাটল কলম্বিয়া মহাকাশে তার সফল ভ্রমণ শেষে এই শহরের উপর দিয়ে এডওয়ার্ড বিমান ঘাটিতে ফিরছিল। ২০০১ সালের নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে যখন শক্তিশালী দুটি বিমান হামলা হলো এবং ভবন দুটি মাটিতে পতিত হয়ে ধ্বংস হয়ে গেলো, তখনও সিসমোলজিস্টরা সেটা থেকে উৎপন্ন শক্তিশালী স্পন্দন ধরতে পেরেছিলেন [২, ৩]।
তথ্যসূত্র:
[১] Koper, K. D., T. C. Wallace, S. R. Taylor, and H. E. Hartse (2001). Forensic seismology and the sinking of the Kursk. EOS, 82, No. 4, 45-46
[২] Savage, B., and D. V. Helmberger (2001). Kursk explosion. Bulletin of the Seismological Society of America, 91, No. 4, 753-759
[৩] Walker, J. (2007). Flying Circus of Physics. John Wiley & Sons, Inc.
ফিচার ছবি: rferl.org