১৯৮৬ সালের ৫ এপ্রিল, শনিবার। মাঝরাত পেরিয়ে ঘড়ির কাঁটা যতই সামনে যেতে লাগল, ওয়েস্ট বার্লিনের লা বেল (La Belle) নাইট ক্লাব যেন ততই জমজমাট হয়ে উঠতে থাকল। সেখানে উপস্থিত পাঁচ শতাধিক সদস্য মদের নেশায় আর সঙ্গীতের তালে তালে হারিয়ে যেতে লাগল অন্য এক ভুবনে। তাদের কারোই জানার কথা ছিল না, তাদের অগোচরে ডিজে বুথের পাশের একটি টেবিলের নিচে রেখে দেওয়া হয়েছিল শক্তিশালী বোমা। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই যার বিস্ফোরণে এলোমেলো হয়ে যাবে তাদের অনেকের জীবন এবং যার খেসারত দিতে হবে যুগ যুগ ধরে বিশ্বব্যাপী হাজার হাজার মানুষকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের পর এর দুই অংশের নিয়ন্ত্রণ নেয় বিজয়ী শক্তিগুলো। একদিকে ছিল সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং ফ্রান্স। ১৯৬১ সালে বার্লিন দেয়াল নির্মাণের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে জার্মানি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। দেয়ালের পূর্ব অংশে পূর্ব জার্মানি ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের নিয়ন্ত্রণে, আর পশ্চিম অংশে পশ্চিম জার্মানি ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের নিয়ন্ত্রণে। আশির দশক জুড়ে শুধুমাত্র পশ্চিম বার্লিন শহরেই মার্কিন সেনাবাহিনীর প্রায় ৭,০০০ সদস্য নিয়োজিত ছিল। আর এদের অনেকেরই চিত্ত বিনোদনের জন্য পছন্দের স্থান ছিল লা বেল নাইট ক্লাবটি।
ওদিকে আশির দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে লিবিয়ার সম্পর্ক চরম অবনতির দিকে যাচ্ছিল। ১৯৭৯ সালে ইরান সংকটকে কেন্দ্র করে লিবিয়ান জনগণ ত্রিপলীর মার্কিন দূতাবাস আক্রমণ করলে আমেরিকা দূতাবাস বন্ধ করে দেয় এবং প্রথমবারের মতো লিবিয়াকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। পুরো আশির দশক জুড়েই সিআইএ গাদ্দাফীকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। লিবিয়ান সেনাবাহিনীর সদস্যদেরকে অভ্যুত্থানে প্রলুব্ধ করা, গাদ্দাফীর প্রশাসন থেকে পদত্যাগ করে বিদেশে পালিয়ে যাওয়া কর্মকর্তাদেরকে আর্থিক সাহায্য দিয়ে সংঘটিত করা, মিসরসহ প্রতিবেশী দেশগুলোকে লিবিয়ার উপর আক্রমণ করতে উস্কানি দেওয়াসহ এমন কোনো কাজ নেই, যা সিআইএ করেনি।
অন্যদিক গাদ্দাফীও চুপচাপ বসে ছিলেন না। তিনি বিশ্বব্যাপী পশ্চিমা স্বার্থবিরোধী বিভিন্ন স্বাধীনতাকামী এবং বিপ্লবী গোষ্ঠীকে আর্থিক সাহায্য করতে শুরু করেন। একইসাথে তিনি বিভিন্ন উগ্রপন্থী এবং সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকেও অর্থায়ন করতে শুরু করেন। এরকম একটি সন্ত্রাসী সংগঠন ছিল ফিলিস্তিনের আবু নিদাল অর্গানাইজেশন, যারা প্রথমে ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বাধীন ফিলিস্তিনি মুক্তি আন্দোলন পিএলওর অংশ থাকলেও পরবর্তীতে তাদের উগ্রপন্থা এবং সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের জন্য ১৯৭৪ সালে পিএলও থেকে তাদেরকে বহিষ্কার করা হয়। আবু নিদালের একটি অপারেশন সম্পর্কে আমাদের একটি লেখা আছে এই লিংকে।
১৯৮৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর আবু নিদালের সদস্যরা একইসাথে ভিয়েনা এবং রোম এয়ারপোর্টে হামলা চালায়। রোমের লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি এয়ারপোর্টে ইসরায়েলের এল আল টিকেট কাউন্টারে এবং ভিয়েনা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে তেল আবিব গামী একটি প্লেনের যাত্রীদের উপর সন্ত্রাসীরা যথাক্রমে গুলি বর্ষণ এবং গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। রোমে ১৬ জন নিহত ও ৯৯ জন আহত এবং ভিয়েনায় ১ জন নিহত ও ৩৯ জন আহত হয়। আবু নিদাল অর্গানাইজেশন ইসরায়েলের অপারেশন ঊডেন লেগের প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে এ হামলা চালানো হয়েছে বলে দায় স্বীকার করে।
এই হামলার জন্য আবু নিদাল অর্গানাইজেশনকে অর্থায়ন করার দায়ে লিবিয়াকে অভিযুক্ত করে আমেরিকা। লিবিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে, কিন্তু তারা হামলার প্রশংসা করে এই বলে যে, সাবরা ও শাতিলার সন্তানরা বীরের মতো অপারেশন পরিচালনা করেছে। এই ঘটনার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে লিবিয়ার সম্পর্কের চূড়ান্ত অবনতি ঘটতে শুরু করে। ভূমধ্যসাগরে লিবিয়ার দাবি করা আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমায় মহড়া বৃদ্ধি করে যুক্তরাষ্ট্র, যার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের দেওয়া এসএ-৫ সার্ফেস-টু-এয়ার মিসাইল সাইটগুলোর উপর নজরদারি করা।
১৯৮৬ সালের ২৩ মার্চ যখন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি যুদ্ধবিমান সিদরা উপসাগরে লিবিয়া ঘোষিত ‘ডেথ লাইন’ অতিক্রম করে, তখন লিবিয়া সেগুলো লক্ষ্য করে মিসাইল নিক্ষেপ করে। মিসাইলগুলো লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে বেনগাজির বেনিনা এয়ারপোর্ট দুটি মিগ-২৩ মার্কিন যুদ্ধবিমানগুলোর উদ্দেশ্যে এবং কয়েকটি পেট্রোল বোট মার্কিন যুদ্ধজাহাজগুলোর উদ্দেশ্যে রওনা করে। প্লেনগুলোর মধ্যে কোনো গুলি-মিসাইল বিনিময় না হলেও পেট্রোল বোট এবং যুদ্ধজাহাজের মধ্যে গুলি বিনিময় হয়। মার্কিন জাহাজগুলোর কোনো ক্ষতি না হলেও লিবিয়ার একাধিক পেট্রোল বোট বিধ্বস্ত হয়, একটি মিসাইল সাইট ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ৩৫ জন লিবিয়ান নাবিক নিহত হয়।
সিদরা উপসাগরের ঘটনার পরপরই গাদ্দাফী পশ্চিমা লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার আহ্বান জানান। সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কায় বিশ্বব্যাপী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবগুলো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। স্বাভাবিকভাবেই বার্লিনের মার্কিন সামরিক ঘাঁটিও ছিল বিশেষ নিরাপত্তা কর্মসূচীর অধীনে। কিন্তু বার্লিনের লা বেল ডিস্কো কোনো মার্কিন স্থাপনা ছিল না। মার্কিন সেনাদের প্রিয় নাইটক্লাব হলেও সেটি ছিল সবার জন্য উন্মুক্ত। আর সে সুযোগেরই সদ্ব্যবহার করে সন্ত্রাসীরা।
সিদরা উপসাগরের হামলার মাত্র ১৩ দিন পর, ১৯৮৬ সালের ৫ এপ্রিল শনিবার মাঝরাত। পাঁচ শতাধিক মানুষ তখন লা বেল নাইট ক্লাবে আড্ডা এবং বিনোদনে মগ্ন। রাত ১টা ৪৯ মিনিটে মানুষ যখন জনপ্রিয় হিপহপ সঙ্গীত ‘ফ্লাই গার্ল’ এর সুরে মগ্ন, তখন হঠাৎ প্রচন্ড বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে লা বেল ডিস্কো। ডিজে বুথের কাছে অবস্থিত একটি টেবিলের নিচে রাখা শক্তিশালী বোমার বিস্ফোরণে ভেঙ্গে পড়ে নাইট ক্লাবের ছাদ এবং মেঝে। অনেকেই ছিটকে পড়ে আশেপাশে, কেউ কেউ ভাঙ্গা মেঝে দিয়ে গড়িয়ে পড়ে ভূগর্ভস্থ স্টোর রুমে।
ঘটনাস্থলেই নিহত হয় এক তুর্কি নারী এবং মার্কিন সেনাবাহিনীর এক সার্জেন্ট। আহত হয় আরো ২৩০ জন, যাদের মধ্যে ৭৯ জন ছিল আমেরিকান নাগরিক। এদের অন্তত ৫০ জন ছিল মার্কিন সেনা সদস্য, যাদের মধ্যে একজন দুই মাস পরে হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করে। আহতদের অনেকেই স্থায়ীভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করে। এটি ছিল সমসাময়িক কালে মার্কিন সেনাদের উপর সবচেয়ে বড় হামলাগুলোর মধ্যে একটি।
হামলার পরপরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি লিবিয়াকে দায়ী করে। ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সির গোয়েন্দাদের সংগ্রহ করা তথ্যের বরাত দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র দাবি করে, হামলার দিন রাতে পূর্ব জার্মানির লিবিয়ান দূতাবাস থেকে ত্রিপলীকে পরপর দুটি বেতার বার্তায় হামলার তথ্য জানানো হয়েছিল। প্রথমটিতে বলা হয়েছিল, পরদিন সকালেই ফলাফল পাওয়া যাবে। আর দ্বিতীয়টিতে জানানো হয়েছিল, রাত দেড়টার সময় একটি কাজ সফলভাবে সম্পন্ন করা হয়েছে। পরদিন ত্রিপলী থেকে পাল্টা বার্তায় দূতাবাসকে এর জন্য অভিনন্দন জানানো হয়েছিল।
কোনো নিশ্চিত প্রমাণ ছাড়াই তাৎক্ষণিকভাবে লিবিয়াকে দায়ী করাটাকে অবশ্য সব সময়ই যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক বক্তব্য হিসেবে দেখা হয়েছে। একমাত্র ইংল্যান্ড ছাড়া সে সময় অন্য কোনো ইউরোপীয় রাষ্ট্রও যুক্তরাষ্ট্রের এ দাবির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেনি। পশ্চিম জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী হ্যান্স ডিয়েট্রিচ জেনশ্চার প্রথমে লিবিয়ার ভূমিকা থাকতে পারে বলে সন্দেহ প্রকাশ করলেও যথেষ্ট তথ্য এবং সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করতে ব্যর্থ হন। পূর্ব জার্মানির কমিউনিস্ট সরকারের সাথে পশ্চিম জার্মানির এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুসম্পর্ক না থাকায় দীর্ঘদিন পর্যন্ত এ রহস্য অমীমাংসীতই রয়ে যায়। কিন্তু ১৯৯০ সালে বার্লিন দেয়ালের পতনের পর লা বেল ডিস্কো বম্বিং মামলার ব্যাপারে নতুন তথ্য উন্মোচিত হতে শুরু করে।
বার্লিন দেয়াল পতনের মধ্য দিয়ে দুই জার্মানি একত্রিত হওয়ার পর সাবেক পূর্ব জার্মানির বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী স্টাসির গোপন নথিপত্রগুলো উন্মুক্ত হয়ে যায়। স্টাসির ফাইল থেকে জানা যায়, হামলার সময় পূর্ব বার্লিনের লিবিয়ান দূতাবাসের কর্মচারী মেসবাহ বিলগাসেম ইতের ছিলেন দূতাবাসে নিযুক্ত লিবিয়ান গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান গুপ্তচর। ফলে নতুন করে তদন্ত শুরু হয় লা বেল ডিস্কো বম্বিংয়ের। দীর্ঘ ছয় বছর তদন্তের পর ১৯৯৬ সালে ইতের এবং তার তিন সহযোগীকে লেবানন, ইতালি, গ্রিস এবং বার্লিন থেকে আটক করা হয় এবং বার্লিনের একটি আদালতে তাদেরকে বিচারের সম্মুখীন করা হয়। আরো পাঁচ বছর মামলা চলার পর ২০০১ সালে মামলার রায় ঘোষিত হয়। আদালতে সন্দেহাতীতভাবে ইতের এবং তার সহযোগীদের সম্পৃক্ততা প্রমাণিত হয় এবং তাদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড হয়।
আদালতের রায় থেকে জানা যায়, ইতের এবং লিবিয়ান দূতাবাসের আরেকজন ফিলিস্তিনী কর্মচারী ইয়াসের শারিদি এই হামলার জন্য নিয়োগ করেছিলেন ফিলিস্তিনী-জার্মান নাগরিক আলি চানা এবং তার জার্মান স্ত্রী ভেরেনা চানাকে। ভেরেনা চানা নিজ হাতে তার বাড়িতে বসে বোমা তৈরি করেছিলেন এবং তার বোন অ্যান্দ্রিয়া হসলারকে সাথে নিয়ে বোমাটি নাইট ক্লাবে রেখে বিস্ফোরণের মাত্র পাঁচ মিনিট আগে সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। ঘটনাস্থলে অ্যান্দ্রিয়া হসলারের উপস্থিতির অভিযোগও আদালতে প্রমাণিত হয়, কিন্তু ব্যাগে বোমা থাকার বিষয়ে তিনি অবগত ছিলেন কিনা, তা প্রমাণ করতে না পারায় তাকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়।
বিচারে হত্যায় সহযোগিতার অভিযোগে মেসবাহ ইতের ও আলি চানার ১২ বছরের, ইয়াসের শারিদির ১৪ বছরের এবং হত্যাকান্ডে অংশ নেওয়ার অভিযোগে ভেরেনা চানার ১৪ বছরের কারাদন্ড হয়। শারিদির সাথেও আবু নিদালের সম্পৃক্ততাদের অভিযোগ ওঠে, যদিও তা প্রমাণিত হয়নি। বাদী পক্ষ ভেরেনার যাবজ্জীবন কারাদন্ড চেয়েছিল, কিন্তু ভেরেনার আইনজীবি তাকে মানসিকভাবে অসুস্থ প্রমাণ করায় তিনি মাত্র ১৪ বছরের কারাদন্ড লাভ করেন। আদালতে রাষ্ট্র হিসেবে লিবিয়ার সম্পৃক্ততাও প্রমাণিত হয়। বোমা তৈরির সরঞ্জাম লিবিয়া থেকে কূটনৈতিক ব্যাগে করেই পূর্ব বার্লিনের দূতাবাসে পাঠানো হয়েছিল বলেও প্রমাণ করতে সক্ষম হন বাদীপক্ষ। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে গাদ্দাফী নিজে এ হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন কিনা, আদালত তা প্রমাণ করতে পারেনি।
মামলা চলাকালীন সময়ে জার্মানির একটি পত্রিকায় গাদ্দাফীর সাথে জার্মানির তৎকালীন চ্যান্সেলর গেরহার্ড শ্রোডারের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা মাইকেল স্টাইনারের একটি কথোপকথন ফাঁস হয়। সেখানে দাবি করা হয়, গাদ্দাফী স্টাইনারকে বলেছিলেন, লিবিয়া লা বেল ডিস্কো এবং লকারবি হামলার সাথে জড়িত থাকলেও পরবর্তীতে সন্ত্রাসবাদ পরিত্যাগ করে। তাছাড়া তিনি নিজেও তার বিরুদ্ধে মৌলবাদীদের আক্রমণের আশঙ্কা করছেন, ফলে তিনি জার্মানির সাথে সমঝোতায় যেতে ইচ্ছুক। জার্মানি এবং লিবিয়া এ কথোপকথনের অভিযোগ অস্বীকার করে। জার্মানির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, সন্ত্রাসবাদ বর্জনের নীতির ব্যাপারে আলোচনা হলেও গাদ্দাফীর সাথে তাদের লা বেল অথবা লকারবি হামলার ব্যাপারে কোনো কথা হয়নি।
তবে লা বেল হামলার ব্যাপারে সম্পূর্ণ বিপরীত একটি তত্ত্বও আছে। ১৯৯৮ সালে জার্মানীর জেডডিএফ টেলিভিশন একটি ডকুমেন্টারি প্রচার করে, যেখানে দাবি করা হয়, লা বেল হামলাটি মূলত সিআইএর এজেন্টদের কাজ ছিল। ডকুমেন্টারিতে শারিদিকে নির্দোষ এবং লিবিয়ান কূটনীতিক ইতেরকে দীর্ঘদিনের সিআইএ এজেন্ট হিসেবে দাবি করা হয়। রাশিয়ান ইন্টালিজেন্সকে উদ্ধৃত করে ঐ ডকুমেন্টারিতে মোহাম্মদ আমিরি নামে আরেকজন অভিযুক্তের কথা উল্লেখ করা হয় এবং তাকে মোসাদের এজেন্ট বলে দাবি করা হয়।
লিবিয়ান সরকার প্রথমে তাদের দায় অস্বীকার করলেও লা বেল মামলার রায়ের পর ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যাপারে জার্মানির সাথে আলোচনা শুরু করে। দীর্ঘ তিন বছরের দর কষাকষির পর ২০০৪ সালের আগস্ট মাসে তারা আমেরিকান ছাড়া অন্যান্য দেশীয় নাগরিক এবং তাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৩৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দিতে সম্মত হয়। পরবর্তীতে অবশ্য লিবিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথেও সমঝোতায় যায় এবং লকারবি বোমা হামলায় লিবিয়ান নাগরিকের সম্পৃক্ততা প্রমাণিত হওয়ার পর ২০০৮ সালে মোট চারটি পৃথক পৃথক হামলার জন্য সর্বমোট ১.৫ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ প্রদান করে।
লা বেল হামলার পূর্বেও গাদ্দাফীর বিরুদ্ধে একাধিক সন্ত্রাসী হামলার অভিযোগ ছিল। কিন্তু এই হামলাটি এবং সুদূরপ্রসারী ফলাফল ছিল অন্য সবগুলোর চেয়ে ভিন্ন। এই হামলার প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে এর মাত্র ১০ দিন পরেই, ১৯৮৬ সালের ১৫ এপ্রিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবারের মতো সরাসরি লিবিয়ার উপর আক্রমণ করে, যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল গাদ্দাফীকে হত্যা করা। অপারেশন এল ডোরাডো ক্যানিয়ন নামের ঐ আক্রমণে গাদ্দাফী ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেও নিহত হয় তার দেড় বছর বয়সী শিশুকন্যা হ্যানা গাদ্দাফী। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ১৯৮৮ সালে স্কটল্যান্ডের লকারবির আকাশে মার্কিন যাত্রীবাহী বিমান প্যান অ্যাম ফ্লাইট ১০৩ উড়িয়ে দেয় লিবিয়া। নিহত হয় ২৭০ জন যাত্রী, যাদের অধিকাংশই আমেরিকান।
লকারবির হামলার পরই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে লিবিয়ার পরিচিতি স্থায়ী রূপ লাভ করে। জাতিসংঘ লিবিয়ার উপর কঠিন শর্তের অবরোধ আরোপ করে, যা স্থায়ী হয় প্রায় দেড় দশক সময় পর্যন্ত। বলা যায়, লা বেল হামলা এবং এর পরবর্তী ঘটনা প্রবাহই নির্ধারণ করে দিয়েছিল গাদ্দাফীর ভবিষ্যত পররাষ্ট্রনীতি কেমন হবে এবং তার ফলাফল কী হবে। লকারবিসহ এ সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়েই আমরা আলোচনা করব পরবর্তী বিভিন্ন ফিচার আর্টিকেলে, তবে তার আগে আগামী পর্বে আপনাদের জন্য আসছে গাদ্দাফীকে হত্যার উদ্দেশ্যে চালানো অপারেশন এল ডোরাডো ক্যানিয়নের ইতিবৃত্ত।
ফিচার ইমেজ- DPA