গত ৭ জুন নাগপুরে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস-এর মুখ্য কার্যালয়ে ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির আগমন নিয়ে সম্প্রতি ঝড় বয়ে গেল সেখানকার রাজনীতি, সমাজ জীবনে। আরএসএস-এর বাৎসরিক ‘শিক্ষা বর্গ’ প্রশিক্ষণ শিবিরের সমাপ্তি অনুষ্ঠানে প্রণববাবুকে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হলে তিনি তা সাদরে গ্রহণ করেন। কিন্তু তার সিদ্ধান্তে বিতর্ক দেখা দেয় ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের অন্দরে।
প্রশ্ন উঠতে থাকে, কী ভেবে এই বর্ষীয়ান নেতা আরএসএস-এর মতো ‘সাম্প্রদায়িক’ একটি সংগঠনের আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন। তাকে তার প্রাক্তন দল কংগ্রেস থেকে অনুরোধ করা হয় সিদ্ধান্তটিকে পুনর্বিবেচনা করতে; এমনকি তার মেয়ে- যিনি কংগ্রেসের একজন নেত্রী- তার এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন। তার আশঙ্কা, তার পিতার নাগপুর সফর আরএসএস এবং শাসকদল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সুবিধা করে দেবে। অসন্তোষ প্রকাশ করেন আরেক বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা আহমেদ প্যাটেলও। বলা হচ্ছে কংগ্রেসের প্রাক্তন সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীও নাকি নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রণববাবুর নাগপুর সফরকে সমালোচনা করে টুইট করতে।
প্রণব মুখার্জি অবশ্য এই সমস্ত নিন্দায় কর্ণপাত না করে তার নাগপুর সফর শেষ করেন যথাসময়েই। সেখানে তার ভাষণে ভারতের এই প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি আলোকপাত করেন ভারতের বহুত্ববাদী সংস্কৃতি, সহনশীলতা ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রীতিনীতির উপরে। কংগ্রেসের এক নেতা পরে মন্তব্য করেন যে প্রণববাবু আরএসএস-এর ঘরে গিয়ে তাদের মুখোশটি খুলে দিয়ে এসেছেন।
প্রণববাবুর নাগপুর সফর নিয়ে এই বিতর্কের অর্থ কী?
প্রণববাবুর এই সফরকে নিয়ে এত হৈচৈ-বিতর্ক এটাই প্রমাণিত করে যে, বর্তমান ভারতের রাজনৈতিক-ধর্মনৈতিক-সামাজিক পরিসরটি কতটা সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের এক বছর আগে এদেশের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, যুযুধান দল, গোষ্ঠীরা সুচাগ্র মেদিনী পর্যন্ত ছাড়তে রাজি নয়। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও তার দল বিজেপির বিরোধীদের আশঙ্কা, প্রণববাবুর মতো নেতারা এই প্রাক-নির্বাচনী বাতাবরণে আরএসএস-এর শিবিরে গেলে তা তাদের ভাবমূর্তিকেই চরম আঘাত হানতে পারে। তাই তাদের মনে এই নিরাপত্তাহীনতা।
এই ব্যাপারে কয়েকটি বক্তব্য রাখা প্রয়োজন। প্রথমত, প্রণব মুখার্জির আরএসএস-এর মুখ্য কার্যালয়ে যাওয়া নিয়ে কংগ্রেসের এত দুশ্চিন্তার কী হয়েছে তা বোঝা বেশ দুরূহ। হ্যাঁ, যদি প্রণববাবু কোনো প্রাক্তন প্রধানমন্ত্র্রী বা কংগ্রেসের কোনো উচ্চ আধিকারিক হতেন, তাহলেও নাহয় বোঝা যেত এই আপত্তির কারণ। কিন্তু, তার সাম্প্রতিকতম পরিচয় যে তিনি দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি, যিনি দলীয় রাজনীতি-পরিচয়ের ঊর্ধে। সেখানে “উনি আমাদের দলে ছিলেন এতকাল” বলে আপত্তি করাটা কোনো ধোপেই টেকে না। বরং, একজন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি- অর্থাৎ স্টেটসম্যান হয়ে যদি তিনি দেশের ক্রমশ আলগা হতে থাকা সামাজিক-মানসিক বাঁধুনিটা শক্ত করার হেতু আরএসএস-এর সদর দফতরে গিয়ে ঐক্যের ডাক দেন, তবে তা নিঃসন্দেহে একটি বড় কাজ।
এদেশের পুরোনো দিনের যে ক’জন রাজনৈতিক নেতা এখনও বেঁচে রয়েছেন, তাদের অন্যতম একজন প্রণব মুখার্জি তার এই নাগপুর ভ্রমণের মধ্য দিয়ে যথেষ্ঠ পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন, সেকথা কোনোভাবেই অনস্বীকার্য নয়। প্রশ্ন ওঠে বরং কংগ্রেসের অহেতুক ওজর-আপত্তি নিয়ে। মুখে তারা নিজেদেরকে আরএসএস-বিজেপির চেয়ে কম গোঁড়া প্রমাণ করার চেষ্টা করলেও, আসলে এই ঘটনা এটাই দেখাল যে, রাজনীতির এই পাঞ্জা লড়াইয়ে তারাও কিছু কম রক্ষণশীল নয়।
২০০৫ সালে আরএসএসও একইরকমভাবে লালকৃষ্ণ আদভানির সমালোচনা করেছিল
প্রায় দেড় দশক আগে এরকমই একটি পরিস্থিতি দেখা গিয়েছিল গেরুয়া শিবিরে। বিজেপির তৎকালীন অধ্যক্ষ হিসেবে পাকিস্তান সফরে যান লালকৃষ্ণ আদভানি। বিজেপি তখন দিল্লিতে ক্ষমতাচ্যুত এবং তাদের জনপ্রিয় নেতা অটলবিহারি বাজপেয়ী তখন সক্রিয় রাজনীতি থেকে সন্ন্যাস নিয়ে ফেলেছেন। বিজেপির পরবর্তী নেতা হিসেবে আদভানি তখন তৈরি হচ্ছেন দলকে নেতৃত্ব দিতে।
আদভানির ভাবমূর্তি ছিল কট্টরপন্থী এবং তিনি ভেবেছিলেন পাকিস্তানে গিয়ে সেদেশের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে প্রশংসা করে তিনি তার ভাবমূর্তিকে বদলাবেন, যাতে ভবিষ্যতে তিনি ভারতের রাষ্ট্রনেতা হিসেবে সকল মহলেই গৃহীত হন, তাকে কেউ যেন হিন্দুত্ববাদী লৌহপুরুষ হিসেবে না দেখে। সেই পরিকল্পনামাফিক আদভানি পাকিস্তানে জিন্নাহর ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ভাবমূর্তির বন্দনা করেন নিজের উদারবাদী মুখটিকে প্রমাণ করার জন্য। কিন্তু আদভানির সেই প্রয়াস বুমেরাংয়ের মতো ধেয়ে আসে তারই দিকে, কারণ তার জিন্নাহ স্তুতি ক্ষেপিয়ে তোলে আরএসএসকে। আদভানি দেশে ফেরা মাত্রই আরএসএস-এর দূত বিমানবন্দরেই তাকে বলে জিন্নাহ সম্পর্কে তার বক্তব্যকে খারিজ করতে, কিন্তু আদভানি তাতে কান দেননি।
ফলস্বরুপ, আদবানিকেই পিছু হঠতে হয়; পদত্যাগ করতে হয় বিজেপির অধ্যক্ষের পদ থেকে; দলের মধ্যেও তার একসময়ের প্রভাব কমতে থাকে। এরপর আসে ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে আদবানির নেতৃত্বে বিজেপির মহাপতন এবং তার কয়েক বছর পরেই হয় মোদীর উত্থান। আদভানি চলে যান পাদপ্রদীপের আলো থেকে অনেক দূরে।
রাজনৈতিক দলগুলোর এই নিরাপত্তাহীনতা কেন?
আজকে প্রণব মুখার্জির নাগপুরের অনুষ্ঠানে যোগদান নিয়ে বিতর্কের ঢেউ উঠলে যে আরএসএস এই বিতর্ককে ‘অর্থহীন’ আখ্যা দিয়েছে, সেই আরএসএসও কিন্তু ২০০৫-এ আদভানির জিন্নাহ স্তুতির সময়ে কোনোরকম উদারবাদের ধার ধারেনি; ভুগেছে আজকের কংগ্রেসের মতো সেই একই নিরাপত্তাহীনতায়। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে আকচা-আকচি থাকবেই; মতের অমিলও থাকবে- কিন্তু একজন বর্ষীয়ান নেতা যদি এই অনৈক্যের মধ্যে একটি সেতু গড়তে চান; দেশের মধ্যে চলতে থাকা হানাহানির মধ্যে মিলনের বার্তা বয়ে আনেন, তাহলে তাতে কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়। কিন্তু ২০০৫ এ আদভানি এবং ২০১৮-তে প্রণব মুখার্জির অভিজ্ঞতা অন্য কথা বলে।
তাদের এই অনভিপ্রেত অভিজ্ঞতার মূল কারণ হচ্ছে সর্বস্তরে লাগামছাড়া রাজনীতিকরণ। আজকে ভারতের রাজনীতিতে বিজেপি, কংগ্রেস বা অন্য যেকোনো আঞ্চলিক দলের কথাই বলা হোক না কেন, ভোটব্যাঙ্ক হাতানোর প্রতিযোগিতাটাই শেষ কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনীতিতে ক্ষমতাই শেষ কথা সেটা আমরা সকলেই জানি, কিন্তু সেই ক্ষমতা দখলের লড়াইতে দেশের-সমাজের হিতের কথা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করার প্রবণতা খুবই ভয়ঙ্কর আর সেটাই আজকের ভারতে হচ্ছে।
অতীতে আরএসএস-এর প্রতি জওহরলাল নেহেরু বা লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মতো কংগ্রেসি প্রধানমন্ত্রীরা যেমন প্রশংসাসূচক বাক্য ব্যয় করেছেন, তেমনি অটলবিহারি বাজপেয়ির প্রতি নেহেরুর বাৎসল্য বা পরবর্তীকালে নেহেরুর প্রতি প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ির সম্মান প্রদর্শনের ঘটনার সাক্ষীও থেকেছে ভারতের রাজনীতি। ভিন্ন আদর্শ-চিন্তা থাকা সত্ত্বেও এই রাজনৈতিক সৌজন্যবোধ তৎকালীন রাষ্ট্রনেতাদের মধ্যে ছিল, কারণ তারা শুধু ভোট এবং নির্বাচন জিতে ক্ষমতার মালিক হওয়ার চিন্তাতেই বিভোর থাকতেন না।
বর্তমানে সেই পরিস্থিতি আমূল বদলে গিয়েছে। রাষ্ট্রনেতার দায়িত্ব পালন করা এখনকার রাজনীতির কারবারিদের কাছে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসা, কারণ, চূড়ান্ত মেরুকরণের এই যুগে সামান্য সৌজন্যতাবোধ তাদের ভাবমূর্তির চূড়ান্ত ক্ষতি করতে পারে বলে তাদের ধারনা। বিশেষ করে যে দল ক্ষমতায় নেই, তাদের কাছে এমন কাজ তো রীতিমতো দুঃসাহসী। তাছাড়া, সমস্ত শিষ্টতা-ভদ্রতাকে জলাঞ্জলি দিয়ে ক্রমাগত একে অপরকে কড়া ভাষায় আক্রমণ করতে করতে সৌজন্যবোধেরও দফারফা হয় এক সময়। একমুখী এই নেতিবাচক রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে উল্টোমুখী কোনো প্রয়াস দেখলে যে হৈ-চৈ পড়ে যাবে সর্বত্র, তাতে আর সন্দেহ কী? প্রণববাবুর নাগপুর যাত্রা নিয়েও তাই হয়েছে।
আরএসএস মানে যেমন শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ নয়, সামাজিক নির্মাণও বটে, তেমনই কংগ্রেস মানে শুধুমাত্র রাহুল গান্ধীর ব্যর্থতা নয়, নেহেরুর বহুত্ববাদীকে গ্রহণ করার আধুনিক নেতৃত্বও বটে। ক্রমাগত একে অপরের দোষ না ধরে আজ প্রয়োজন দেশের সমস্ত রাজনৈতিক শক্তিগুলিকে একজোট হওয়া, যাতে দেশের বৃহত্তর স্বার্থ উপেক্ষিত না হয়। কিন্তু সেই পর্যায়ের কাজ সম্পন্ন করতে হলে যে সদিচ্ছা এবং দূরদর্শিতা প্রয়োজন, তা আজ কোথায়?
Featured Image Source: DNA India