‘অলস্টার টিম’ আসলে কী? অল স্টার টিম বলতে আমরা আসলে কী বুঝি? নাম দেখেই আন্দাজ করা যাচ্ছে যে, এই টিমটি মূলত স্টার তথা তারকাদের নিয়ে গড়া। এখন এই স্টার মানে শুধুমাত্র নামে স্টার নয়, বরং একটি টুর্নামেন্টে যেসব খেলোয়াড় দুর্দান্ত খেলে সবার নজর কাড়েন, তাদের নিয়ে গড়ে ওঠা একাদশ। বর্তমানে প্রায় প্রতিটি টুর্নামেন্ট শেষেই এমন একাদশ করা হয়ে থাকে। কোনো একাদশ হয়তো নির্বাচিত হয় জুরিদের সিদ্ধান্তে, আবার কোনো একাদশ নির্বাচিত হয় ফুটবল ভক্তদের ভোটের মাধ্যমে। তবে একটি কথা অনস্বীকার্য যে, ভক্তদের ভোটের চেয়ে জুরিদের মতামতের উপর ভিত্তি করে নির্বাচিত একাদশ অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। কারণ, বিশেষজ্ঞদের নির্বাচনে আবেগের আশ্রয় তুলনামূলকভাবে অনেক কম থাকে।
প্রতিটি বিশ্বকাপ শেষে বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়দের নিয়েও একটি একাদশ গঠন করা হয়। তবে কালের পরিক্রমায় এই নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। ১৯৩০ সাল থেকে শুরু করে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত জুরি বোর্ডের সদস্য থাকতেন ইউরোপ এবং আমেরিকার সাংবাদিকরা আর বিভিন্ন ফুটবল বিশেষজ্ঞ। ১৯৯৪ বিশ্বকাপ থেকে ফিফা টেকনিক্যাল গ্রুপের সাথে অফিশিয়াল স্পন্সর হিসেবে ‘মাস্টার কার্ড’ যুক্ত হয়। পরবর্তীতে ২০১০ বিশ্বকাপ থেকে স্পন্সর ‘মাস্টার কার্ড’ থেকে পরিবর্তিত হয়ে ‘ভিসা’ যুক্ত হয়।
১৯৩০ সাল থেকে শুরু করে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত অলস্টার টিমে মোট ১১ জন করে খেলোয়াড়ই সুযোগ পেতেন। কিন্তু ১৯৯৮ আর ২০০২ বিশ্বকাপে সেই সংখ্যা বেড়ে ১৬-তে আর ২০০৬ বিশ্বকাপে সংখ্যাটি ২৩ এ উন্নীত হয়। ২০১০ আর ২০১৪ বিশ্বকাপে আবারও ১১ জনের দলে ফিরে আসে, তবে এই দু’বার টেকনিক্যাল গ্রুপ বাদ দিয়ে নির্বাচনটা হয় ফিফার অনলাইনে দর্শকের ভোটে।
চলুন একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক অলস্টার টিমগুলোর খুঁটিনাটি দিকগুলোতে।
বিশ্বকাপের ইতিহাসে মাত্র দুজন খেলোয়াড় তিনটি অলস্টার টিমে সুযোগ পেয়েছেন। একজন ব্রাজিলের সান্তোস (১৯৫৪, ১৯৫৮ আর ১৯৬২); আরেকজন জার্মানির বেকেনবাওয়ার (১৯৬৬, ১৯৭০ আর ১৯৭৪)। এই দুজন ছাড়াও জার্মানির ফিলিপ লাম তিনবার (২০০৬, ২০১০ আর ২০১৪) একাদশে সুযোগ পেয়েছেন, তবে ২০০৬ সালের দল ছিল ২৩ জনের আর ২০১৪ বিশ্বকাপে দুটো একাদশ দেওয়া হয় যার একটিতে লামের সুযোগ হলেও অন্যটিতে হয়নি।
২১ জন খেলোয়াড় আছেন যারা অন্তত দুটো অলস্টার টিমে সুযোগ পেয়েছেন। তারা হলেন-
লুইস মন্তি (১৯৩০ সালে আর্জেন্টিনা আর ১৯৩৪ সালে ইতালির হয়ে)
গারিঞ্চা ( ১৯৫৮ আর ১৯৬২ সালে ব্রাজিলের হয়ে)
পেলে (১৯৫৮ আর ১৯৭০ সালে ব্রাজিলের হয়ে)
ববি চার্লটন (১৯৬৬ আর ১৯৭০ সালে ইংল্যান্ডের হয়ে)
রুড ক্রল ও রব রেন্সেনব্রিঙ্ক (১৯৭৪ আর ১৯৭৮ সালে নেদারল্যান্ডের হয়ে)
ভেরটি বোগটস (১৯৭৪ আর ১৯৭৮ সালে জার্মানির হয়ে)
পাওলো রসি (১৯৭৮ আর ১৯৮২ সালে ইতালির হয়ে)
মিশেল প্লাতিনি (১৯৮২ আর ১৯৮৬ সালে ফ্রান্সের হয়ে)
দিয়েগো ম্যারাডোনা (১৯৮৬ আর ১৯৯০ সালে আর্জেন্টিনার হয়ে)
পাওলো মালদিনি (১৯৯০ আর ১৯৯৪ সালে ইতালির হয়ে)
দুঙ্গা (১৯৯৪ আর ১৯৯৮ সালে ব্রাজিলের হয়ে)
রবার্তো কার্লোস, রিভালদো এবং রোনালদো (১৯৯৮ আর ২০০২ সালে ব্রাজিলের হয়ে)
থুরাম এবং জিনেদিন জিদান (১৯৯৮ আর ২০০৬ সালে ফ্রান্সের হয়ে)
মাইকেল বালাক এবং মিরোস্লাভ ক্লোসা (২০০২ আর ২০০৬ সালে জার্মানির হয়ে)
১৯৩০ এবং ১৯৫০ সালের বিশ্বকাপে উরুগুয়ে, ২০১০ বিশ্বকাপে স্পেন এবং ২০১৪ বিশ্বকাপের জার্মানি দল থেকে কমপক্ষে একজন খেলোয়াড় অলস্টার একাদশের প্রতিটি পজিশনে জায়গা পেয়েছেন। ২০০৬ সালের জার্মানি এবং ইতালি দল থেকেও এমনটা হয়েছে, তবে সেই বিশ্বকাপের অলস্টার দল ছিল ২৩ জনের।
১৯৩০ সালের একাদশে উরুগুয়ে থেকে মোট ৭ জন খেলোয়াড় অলস্টার টিমে সুযোগ পান। এছাড়া ২০০৬ বিশ্বকাপের অলস্টার টিমেও ইতালি থেকে ৭ জন খেলোয়াড় সুযোগ পান।
সচরাচর বিশ্বকাপের ফাইনালিস্ট দুই দলের খেলোয়াড়রাই অলস্টার দলে বেশি সুযোগ পান; এর মাঝে চ্যাম্পিয়ন দল থেকেই সুযোগ পান বেশি খেলোয়াড়। তবে ১৯৮৬ বিশ্বকাপের বিশ্বজয়ী দল আর্জেন্টিনা থেকে মাত্র একজন খেলোয়াড় অলস্টার টিমে সুযোগ পান; দিয়েগো ম্যারাডোনা। এরকম একটি একাদশে চ্যাম্পিয়ন দল থেকে মাত্র একজন খেলোয়াড় সুযোগ পাওয়ার ঘটনাটি এখন পর্যন্ত রেকর্ড।
এশীয় খেলোয়াড়দের মাঝে মাত্র দুজন খেলোয়াড় অলস্টার টিমে সুযোগ পেয়েছেন। তারা হলেন দক্ষিন কোরিয়ার হং মিয়ুং বো আর ইয়ো সাং ছুল। এছাড়া হিদেতোশি নাকাত রিজার্ভ একাদশে জায়গা পেয়েছিলেন।
পেলে একমাত্র খেলোয়াড়, যিনি বারো বছরের ব্যবধানে দুটো অলস্টার টিমে সুযোগ পেয়েছিলেন, ১৯৫৮ বিশ্বকাপ আর ১৯৭০ বিশ্বকাপে।
১৯৯৮ বিশ্বকাপের অলস্টার টিমে ডেনমার্ক দল থেকে দুই ভাই ব্রায়ান লাউড্রপ আর মাইকেল লাউড্রপ জায়গা পান।
সিজার মালদিনি আর পাওলো মালদিনি হচ্ছেন একমাত্র পিতাপুত্র, যারা দুজনেই অলস্টার টিমে সুযোগ পেয়েছিলেন। সিজার মালদিনি ১৯৬২ সালে আর পাওলো মালদিনি ১৯৯০ আর ১৯৯৪ বিশ্বকাপের অলস্টার টিমে জায়গা করে নেন।
ব্রাজিল থেকে সর্বোচ্চ ৩৭ জন খেলোয়াড় অলস্টার টিমে সুযোগ পেয়েছেন। এছাড়া সবচেয়ে বেশি মনোনয়ন (৪৪ জন) পেয়েছেন এই দল থেকেই।
আফ্রিকান একাদশ থেকেও মাত্র দুজন খেলোয়াড় অলস্টার টিমে সুযোগ পেয়েছেন। ১৯৯০ সালে ক্যামেরুন থেকে রজার মিলা আর ২০০২ বিশ্বকাপে সেনেগাল থেকে এল হাজি দিয়ুফ।
বিভিন্ন বিশ্বকাপে আলাদা আলাদা একাদশ করলেও ১৯৯৪ আর ২০০২ সালে সেই পর্যন্ত হওয়া বিশ্বকাপের দুটো একাদশ প্রকাশিত করে ফিফা। ১৯৯৪ সালের সেই একাদশটির দিকে একটু লক্ষ্য করা যাক।
এছাড়া ২০০২ সালে ইন্টারনেটে পাঠকদের ভোটিংয়ে একটি একাদশ নির্বাচিত হয়, যেটি কিনা ওয়ার্ল্ড কাপ ড্রিম টিম নামে পরিচিত।
এখানে উল্লেখ্য যে, আগের একাদশে ম্যারাডোনা সুযোগ না পেলেও এই একাদশে তিনিই সর্বোচ্চ ভোট পান।
তবে বিশ্বকাপের সর্বশেষ একাদশটি করা হয় ২০১৪ সালে স্প্যানিশ পত্রিকা মার্কার অধীনে, যেখানে ২,০০,০০০ দর্শক ভোট দিয়েছিলেন।
সেই একাদশটির দিকে একটু দৃষ্টি দেওয়া যাক।
এই একাদশের অতিরিক্ত খেলোয়াড়ের তালিকায় সুযোগ পেয়েছেন আরো বেশ কজন।
শেষ কথা
বিশ্বকাপের এই একাদশটি সাজানো হয় মূলত সেরা খেলোয়াড়দেরকে নিয়েই। তবে আশ্চর্য হলেও সত্য যে, ৩টি বিশ্বকাপ খেলা হয়ে গেলেও সময়ের দুই সেরা খেলোয়াড় ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো আর লিওনেল মেসির এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপের অলস্টার টিমে জায়গা হয়নি। লিওনেল মেসি অবশ্য দর্শকদের ভোটে ২০১৪ বিশ্বকাপের ড্রিম টিমে একবার সুযোগ পেয়েছেন, কিন্তু ক্যাস্ট্রল পারফর্মেন্স ইনডেক্সের নির্বাচিত একাদশে সুযোগ পাননি। অথচ মাত্র ১টি বিশ্বকাপ খেলা ক্রুয়েফ প্রতিটি একাদশেই নিজের জায়গা করে নিয়েছেন।
দেখা যাক, এবারের বিশ্বকাপে কারা নিজেদের জায়গা করে নেন অলস্টার একাদশে এবং কারাই বা সর্বকালীন একাদশে আরেকজনকে সরিয়ে নিজের অবস্থান গড়ে তুলতে পারেন।
ফিচার ইমেজ: Wallpapers-Football.Net