গণআন্দোলনের মুখে গত সোমবার পদত্যাগ করেছেন জর্ডানের প্রধানমন্ত্রী হানি আল-মুলকি। তার পদত্যাগের পরেও অবশ্য আন্দোলন থামেনি। বাদশাহ আব্দুল্লাহর প্রতিশ্রুত সংস্কারের আশ্বাসে এবং নতুন প্রধানমন্ত্রীর কিছু তড়িৎ পদক্ষেপে আপাতত আন্দোলন যদি স্তিমিত হয়ও, তবুও দীর্ঘমেয়াদে জনরোষ নিবৃত্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক সামর্থ্য জর্ডানের নেই। এরকম পরিস্থিতিতে জর্ডানের সাহায্যে হয়তো এগিয়ে আসতে পারত তাদের দীর্ঘদিনের মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, আরব আমিরাত বা কুয়েত। কিন্তু অনেকেই সন্দেহ করছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে জর্ডানের এই তথাকথিত মিত্রদের অনেকেই হয়তো জর্ডানকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসবে না। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে শেষপর্যন্ত কাতারের মতো জর্ডানও হয়তো ঝুঁকে পড়বে ইরানের দিকে।
Jordan struggles for survival strategy in shadow of US-Israeli-Saudi axis https://t.co/yDSwn4mkxk pic.twitter.com/68d8nfqxs0
— Middle East Eye (@MiddleEastEye) June 1, 2018
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই জর্ডানের হাশেমী বংশীয় রাজপরিবার ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রাচ্যে তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র সৌদি আরবের প্রতি অনুগত। জর্ডানের নিজস্ব কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ নেই। দেশটি টিকেই আছে মোটামুটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সৌদি আরবসহ কিছু উপসাগরীয় রাষ্ট্রের অনুদানের উপর নির্ভর করে। আর সে কারণে মাঝে মাঝে নিজেদের স্বার্থে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়ালেও, মোটের উপর তারা ইসরায়েলের সাথে অন্যান্য আরব রাষ্ট্রের তুলনায় ভালো সম্পর্ক বজায় রেখে এসেছে। জর্ডান হচ্ছে দ্বিতীয় আরব রাষ্ট্র, ইসরায়েলে যাদের দূতাবাস এবং কূটনৈতিক মিশন আছে।
তবে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব এবং নিজেদের ক্ষমতা নিশ্চিত করার স্বার্থে জর্ডানের রাজপরিবার ইসরায়েলের সাথে মিত্রতা স্থাপন করলেও, তারা নিপীড়িত ফিলিস্তিনিদের পক্ষেও কাজ করে এসেছে। নীতিগতভাবে তারা সব সময় দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের ভিত্তিতে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে অবস্থান ব্যক্ত করে এসেছে। তারা জেরুজালেমের পবিত্র স্থানগুলো দেখাশোনা, সংস্কার ও নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন ছাড়াও বিপুল সংখ্যক ফিলিস্তিনি শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়া এবং ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংক্রান্ত বিভিন্ন সংকটে সমঝোতার ভূমিকাও পালন করেছে। দীর্ঘদিন পর্যন্ত সৌদি আরব এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অন্তত প্রকাশ্যে হলেও দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের পক্ষে অবস্থান ব্যক্ত করায় জর্ডানের সাথে তাদের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত চমৎকার।
“One of the main reasons for Jordan’s economic crisis was the cessation of financial support from Saudi Arabia and the UAE” | Mohammad Ayesh https://t.co/0CACO62re6
— Middle East Eye (@MiddleEastEye) June 5, 2018
কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একইসাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচিত হওয়া এবং সৌদি আরবে মোহাম্মদ বিন সালমান ও আরব আমিরাতে মোহাম্মদ বিন জায়েদের উত্থানের পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির সমীকরণ পাল্টে যেতে শুরু করে। গত বছরের ডিসেম্বরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন প্রথম ইসরায়েলে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দেন, তখন জর্ডান তার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়। অন্যদিকে সৌদি আরব এবং তার মিত্ররা প্রকাশ্যে বিলম্বে জেরুজালেমের পক্ষে দুর্বল সমর্থন ব্যক্ত করলেও বাস্তবে মার্কিন নীতির পক্ষেই অবস্থান নেয় এবং অন্যদেরকেও অবস্থান নেওয়ার ব্যাপারে প্ররোচিত করতে থাকে। ফলে সৌদি আরবের সাথে জর্ডানের সম্পর্কে ফাটল ধরতে শুরু করে।
জর্ডানে প্রায় ১৯ লাখ ফিলিস্তিনির বসবাস হওয়ায় রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার স্বার্থেই জর্ডানের পক্ষে ফিলিস্তিনে মোটামুটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখা জরুরি। ফলে সৌদি আরব এবং আরব আমিরাত পরিস্কারভাবেই দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের নীতি থেকে সরে আসলেও জর্ডানের পক্ষে তা সম্ভব না। তাই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জেরুজালেমে দূতাবাস স্থানান্তরের ঘোষণার পর বাদশাহ আব্দুল্লাহ এর বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ অবস্থান নেন। সেসময় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বিপুল ভোটের ব্যবধানে মার্কিন সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে যে প্রস্তাব পাশ হয়েছিল, সেই প্রস্তাবটির খসড়া প্রস্তুত করেছিল জর্ডান। এছাড়াও তুরস্কের উদ্যোগে আয়োজিত ওআইসির জরুরি সম্মেলনে, যেখানে সৌদি আরব এবং আরব আমিরাত পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের নিম্ন পর্যায়ের প্রতিনিধি পাঠিয়েছিল, সেখানে বাদশাহ আব্দুল্লাহ নিজেই ঐ সম্মেলনে উপস্থিত হয়েছিলেন।
interesting take @ramikhouri, How Saudi tried to bully Jordan and failed @AJEnglish https://t.co/W3wt5hTunz
— Marwan Bishara (@marwanbishara) December 19, 2017
জর্ডানের এ ভূমিকা সৌদি আরব এবং আরব আমিরাত পছন্দ করেনি। জর্ডানের সংসদ সদস্য বানি মুস্তফা দাবি করেন, সৌদি আরব এবং আরব আমিরাত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার জন্য জর্ডানের উপর চাপ সৃষ্টি করে আসছিল। জর্ডানিয়ান সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফাহাদ আল-কিতানের ভাষায়, সৌদি আরব এখন আর আরব-ইসরায়েল সংকট কিংবা জেরুজালেম ইস্যুকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে না। যেহেতু তাদের সাথে এখন ইসরায়েলের উষ্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, তাই সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান জর্ডানকে আর শান্তি আলোচনার জন্য প্রয়োজনীয় অংশীদার হিসেবে মনে করেন না।
জর্ডানের উপর কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টির পাশাপাশি সৌদি আরব জর্ডানকে বশে আনার উদ্দেশ্যে তাদের অর্থনীতির উপরও চাপ সৃষ্টি করতে শুরু করে। সৌদি আরব, আরব আমিরাত এবং কুয়েত জর্ডানকে পাঁচ বছর মেয়াদী যে ৩.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রকল্পের আওতায় সাহায্য করে আসছিল, ২০১৭ সালের পর তা আর নবায়ন করেনি। ফলে বর্তমানে জর্ডানে দ্রব্যমূল্য এবং আয়কর বৃদ্ধির প্রতিবাদে যে গণআন্দোলন চলছে, তার পেছনে সরাসরি সৌদি আরবের ইন্ধনের কোনো প্রমাণ না থাকলেও সৌদি আরবের অর্থনৈতিক সহযোগিতা বন্ধ করে দেওয়া এ আন্দোলন সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
Is Jordan paying the price from other Arab states for criticism of US President Trump’s Jerusalem announcement? https://t.co/s2Nvao8wJ3 pic.twitter.com/mPkM9J2bQ4
— Al Jazeera News (@AJENews) December 12, 2017
এছাড়াও ট্রাম্পের জেরুজালেমের ঘোষণার পরপরই সৌদি আরব দেশটিতে সফররত জর্ডানিয়ান কোটিপতি ব্যবসায়ী সাবেহ আল-মাসরিকে সাময়িকভাবে গ্রেপ্তার করেছিল। সাবেহ আল-মাসরি জর্ডানের রাজপরিবারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং জর্ডান ও ফিলিস্তিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগকারীদের একজন, যার মালিকানাধীন আরব ব্যাংক ইতোপূর্বে উভয় রাষ্ট্রকেই একাধিকবার ঋণ দিয়ে অর্থনৈতিক সংকট থেকে উদ্ধার করেছিল। ধারণা করা হয়, জর্ডানকে চাপে ফেলে ট্রাম্পের জেরুজালেমের সিদ্ধান্তের পক্ষে অবস্থান নিতে বাধ্য করার লক্ষ্যেই তাকে আটক করা হয়েছিল।
কিন্তু কাতার এবং লেবানেনের মতো জর্ডানের উপর চাপ সৃষ্টির সৌদি প্রচেষ্টাও এখন পর্যন্ত মোটামুটি ব্যর্থ হয়েছে। জর্ডানের বাদশাহ আব্দুল্লাহ তার জেরুজালেম সমর্থন নীতিতে এখনও অটল আছেন। বরং সৌদি আরবের সাথে সম্পর্কে শীতলতা তৈরি হওয়ায় সাম্প্রতিক সময়ে জর্ডানের মধ্যে ইরানের প্রতি পূর্বের তুলনায় নমনীয় মনোভাব লক্ষ্য করা গেছে। বাদশাহ আব্দুল্লাহ তুরস্ক এবং ইরানের নেতাদের সাথে একাধিক বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। এমনকি ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির সাথে তার হাত মেলানোর ঘটনাটিও অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। জর্ডানের একজন সংসদ সদস্য মোহাম্মদ জামেল জাবরিন আল-দেরাউই পরিস্কারভাবেই বলেছেন, জর্ডান এখন এ অঞ্চলে তাদের নতুন কৌশলগত মিত্র অনুসন্ধান করছে।
Amid shifting regional alliances, will #Jordan open up to Iran? Normalization of relations (if not realignment or alliance) might be prudent, writes @plato010 https://t.co/A9pIsdNeTs via @AlMonitor
— Curtis Ryan (@Curtisryan1) January 4, 2018
গত বছর এরকম সময়ে সৌদি আরব এবং তার মিত্ররা কাতারের উপর অবরোধ সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু এক বছর পরে অধিকাংশ বিশ্লেষকই মন্তব্য করছেন, অবরোধের ফলে কাতারের তেমন বড় কোনো ক্ষতি হয়নি, উল্টো কাতার ইরানের দিকে ঝুঁকে পড়ায় ইরান পূর্বের তুলনায় আরো শক্তিশালী হয়েছে। সৌদি আরবের দীর্ঘদিনের মিত্র জর্ডান যদি তাদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার ব্যাপারে সৌদি আরবের সাহায্য না পায়, তাহলে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে হয়তো তারাও শেষপর্যন্ত ইরানের দিকে ঝুঁকে পড়বে। সৌদি আরব ইরানকে বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্য ইসরায়েল এবং ট্রাম্প প্রশাসনকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে পরিাহসমূলকভাবে উল্টো ইরানকেই ধীরে ধীরে শক্তিশালী করে তুলছে।
Featured Image Source: Financial Tribune