ভারতের খ্যাতনামা চিত্রতারকা শ্রীদেবীর দুবাইতে আকস্মিক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ভারতের গণমাধ্যমে যে আলোড়নের সৃষ্টি হয় তা স্বাভাবিক হলেও, যেভাবে এই ঘটনার কভারেজ করতে শামিল হয় বিভিন্ন নিউজ চ্যানেল, তা অত্যন্ত নিন্দনীয়। প্রথমে অভিনেত্রীর মৃত্যু হৃদরোগে হয়েছে বলে জানানো হলেও পোস্ট-মর্টেম রিপোর্টে বলা হয়, তিনি দুবাইয়ের হোটেলের স্নানঘরে বাথটাবের পানিতে ডুবে গিয়ে প্রাণ হারান। আর এই খবর প্রকাশে আসতেই যেন পোয়াবারো হয় ‘সত্যান্বেষী’ মিডিয়ার।
শ্রীদেবীর মৃত্যুর কারণ নিয়ে ভারতের বিভিন্ন মিডিয়ায় অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানে যে কদর্য রুচির পরিচয় পাওয়া যায়, তাতে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে তারকারা, এমনকি সাংবাদিকদের একাংশও। ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক বরখা দত্ত তো সরাসরি একে ‘খবরের মৃত্যু’ হিসেবেও অভিহিত করেন।
যেভাবে শ্রীদেবীর মৃত্যুকে ভারতীয় টিভির পর্দায় পেশ করা হয়েছে, তা যেমন একদিকে কদর্য, অন্যদিকে আরও একটি ঘটনাও দেখায় খবর পরিবেশনার ক্ষেত্রে ভারতের গণমাধ্যমগুলোর পক্ষপাতদুষ্ট মানসিকতা।
যেদিন রাতে শ্রীদেবীর মৃত্যু হয়, সেদিন সকালেই ভারতের বিহার প্রদেশের মুজফ্ফরপুর জেলায় এক স্থানীয় ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) বিধায়কের বেপরোয়া গাড়ি চালানোর ফলে প্রাণ হারায় নয়-নয়টি স্কুলপড়ুয়া শিশু। শিশুগুলো যখন একটি জাতীয় সড়ক পার হচ্ছিল, তখন ওই নেতার গাড়িটি তাদেরকে পিষে দেয়। আহত হয় আরও কিছু শিশু। অভিযোগ করা হয়, ওই নেতা স্বয়ং মদ্যপ অবস্থায় গাড়িটি চালাচ্ছিলেন। অভিযুক্ত নেতা যে তাদের দলেরই লোক, তা বিজেপির পক্ষ থেকে পরে মেনে নেওয়া হয় এবং তিনি নাকি পরে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন।
এই দুটি ঘটনাই যথেষ্ঠ পীড়াদায়ক। মাত্র ৫৪ বছর বয়সে এক জনপ্রিয় শিল্পীর চলে যাওয়া যেমন দুঃখের, তেমনই নয়টি খুদে প্রাণকে এভাবে একজনের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার জন্যে হারানো কম বেদনাদায়ক নয়।
দুটি ট্র্যাজেডি, কিন্তু গণমাধ্যমের দু’রকম প্রতিক্রিয়া
কিন্তু প্রশ্ন ওঠে গণমাধ্যমের নিরপেক্ষতা নিয়ে। মিডিয়ার কাজে তো কোনো পক্ষপাতিত্ব বা রং দেখে আচরণ থাকা উচিত নয়। তবে কেন শ্রীদেবীর মৃত্যুর পরে অপ্রয়োজনীয় এবং অনৈতিক সাংবাদিকতায় তারা ব্যস্ত হয়ে পড়ে, যখন তাদের দরকার আরও বেশি করে ঠিক প্রশ্নগুলো দেশের সরকার-প্রশাসনের সামনে তুলে ধরা?
নয়টি নিষ্পাপ শিশুকে হারিয়ে যখন তাদের পরিবারগুলি শোকস্তব্ধ, তখন তাদের হয়ে দেশের শাসক-প্রশাসকদের কাছে জোরালো প্রশ্ন না তুলে এই গণমাধ্যম ভেবে বের করার চেষ্টা করছে, সুদূর দুবাইয়ের ওই হোটেলের স্নানঘরে কি শ্রীদেবী দুর্ঘটনাবশত বাথটাবে ডুবে গিয়েছিলেন নাকি অন্য কিছু? মানুষের মন রহস্য ভালোবাসে ঠিকই, তাই গোয়েন্দা গল্পও পড়তে পছন্দ করে। কিন্তু মিডিয়ার কাজ নিশ্চয়ই গোয়েন্দাগিরি করা নয়। তার কাজ হলো ঠিক ঠিক সময়ে ঠিক ঠিক প্রশ্নগুলো তোলা, গণতন্ত্রের প্রহরী হিসেবে কাজ করা।
আসলে আরও অনেক কিছুর মতোই এখন মিডিয়াও বাজারমুখী। খবরকে চাকচিক্যের মোড়কে বাঁধা পণ্যের মতো যে যত দামে বাজারে বেচতে পারবে, সেই তত মুনাফা ঘরে তুলবে। আর বাজারের এই পণ্যের জন্যে গ্ল্যামারের থেকে যুৎসই আর কী-ইবা হতে পারে? তাই শ্রীদেবীর মৃত্যুর খবরটি জাঁকিয়ে বসে গণমাধ্যমের সিংহাসনে, আর প্রান্তিক শিশুরা হারিয়ে যায় চিরতরে। এমনকি যারা বেঁচে আছে তারাও।
মিডিয়াও বাজার আর মুনাফাসর্বস্ব হয়ে উঠলে তার কাজ কে করবে?
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, সাংবাদিকতার মতো দায়িত্বপূর্ণ কাজেও যদি বাজার এবং মুনাফা বড় হয়ে ওঠে, তবে তা গণতন্ত্রের পক্ষে খুবই চিন্তার ব্যাপার। আদর্শের জন্য নয়, সাংবাদিকতার ন্যায়বোধ থাকা দরকার দেশের ও দশের ভালোর জন্যে, তার নিজের অস্তিত্বের জন্য। আর এই গুরুদায়িত্ব থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেওয়ার অর্থ সমগ্র সমাজকে বিপদের দিকে ঠেলে দেওয়া।
শ্রীদেবীর মৃত্যুর ঘটনার পরে নানাবিধ কল্পনা করে চটকদার প্রাইমটাইম অনুষ্ঠান না করে গণমাধ্যমগুলো কি বিহারের ওই ভয়াবহ ঘটনার উপরে জোর দিতে পারত না? একেবারেই যে কেউ তা করেনি, তা নয়। কিন্তু জাতীয় চ্যানেলগুলো, যাদের গলার জোর বিভিন্ন সময়ে স্টুডিওর ছাদ ফুঁড়ে দেয়, তারা কি এ ব্যাপারে কোনো অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারল?
শ্রীদেবীর মৃত্যুর পিছনে গোয়েন্দাগিরি না করে বিহার নিয়ে প্রশ্ন করতে পারত গণমাধ্যম
গ্রামাঞ্চলের পথেঘাটে কেন বেপরোয়া যান নিয়ন্ত্রণ করা হবে না? গ্রামাঞ্চলের শিশুদের পঠনপাঠন ব্যবস্থা আরও সুরক্ষিত কেন হবে না? একদিকে যখন ভারতের প্রান্তিক প্রদেশে প্রযুক্তি পৌঁছে দেওয়ার দাবি উঠছে, কেন শিশুদের অখাদ্য মিড-ডে মিল খেয়ে অসুস্থ এমনকি মৃত্যুবরণও করতে হবে? গরিব বলে কি এই পরিবারগুলো এবং তাদের শিশুদের জীবনের কোনো গুরুত্বই নেই?
এই অপ্রিয় প্রশ্ন আজ আর তোলে না কোনো গণমাধ্যম। তারা বরং আশ্রয় নেয় নিরাপত্তার আড়ালে। গ্ল্যামার দুনিয়ার এক মৃত সদস্যকে নিয়ে হৈচৈতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে- তার স্মৃতির প্রতি কোনো শ্রদ্ধা দেখিয়ে নয়, উল্টো তার ব্যক্তিগত জীবনকে টেনেহিঁচড়ে প্রকাশ্যে নিয়ে এসে তাতে নানা রঙের ছোপ দেওয়ার অধীর আগ্রহে। এই লেবু কচলানো চলতেই থাকলে, মানুষের কৌতূহলকে সুড়সুড়ি দিতেই থাকলে, ব্যবসা অন্তত দুটো দিন হলেও তো রমরমিয়ে চলবে। কোন বিহারের কোন প্রান্তে কয়েকটি শিশু মারা গেল কি না গেল, তাতে তাদের বয়েই গেল!
শ্রীদেবীর জন্য যেমন স্মৃতি রোমন্থন করা ছাড়া মিডিয়ার আর কিছু করার ছিল না; গাড়ি চাপা পড়ে শিশুমৃত্যুর এই ট্র্যাজেডিতে কিন্তু নতুন এক উদ্যোগ নেওয়ার অনেক সুযোগ ছিল। আমাদের গণমাধ্যম সেটি করে দেখাতে পারল না।
ভারতের সমাজ-সংস্কৃতি-অর্থনীতিতে আজ গ্রামাঞ্চলের কোনো গুরুত্ব নেই
গণমাধ্যমের এই বাজারমুখী কৌশলের আরও একটি কারণ হলো ভারতের শহুরে সেলিব্রিটিপিপাসু পাঠক বা দর্শক। ভারতের আসল প্রাণ তার গ্রামে- একথা লোকে মুখে শতবার বললেও বাস্তবে সেখানকার সমাজব্যবস্থা শহরমুখী। রাজনীতিতে গ্রামের গুরুত্ব তা-ও বা কিছু থাকলেও, অর্থনীতি এবং সমাজ-সংস্কৃতিতে মানুষ গ্রামের দিকে ঘুরেও তাকায় না।
কৃষকের দুর্দশা, হারিয়ে যেতে বসা মেঠো গীত বা কুটিরশিল্পের প্রতি আমাদের বিশেষ নজর পড়ে না। কারণ, আমাদের গণমাধ্যম সেগুলোকে নিয়ে সচেতনতা বাড়ানোর প্রয়োজন বোধ করে না। আমাদের দৈনন্দিন চিন্তাভাবনা, মননে সেগুলির জায়গা থাকে না বিশেষ। আর এসব কারণেই উপেক্ষিতই থেকে যায় বড় ঘটনাগুলোও।
এই পরিস্থিতির আশু বদল হওয়া প্রয়োজন। গণমাধ্যমের আজকে একটি বড় সামাজিক ভূমিকায় উপনীত হওয়ার সময় এসেছে। শর্টকাটে মুনাফা খোঁজার আশায় চলতে থাকলে তাদের আর সাংবাদিকতার তকমা দিয়ে লাভ নেই। কারণ তখন পাইকারি বাজারে আলু-মুলা বেচাকেনার ব্যাপারীর সঙ্গে তাদের কাজের বিশেষ পার্থক্য থাকবে না।
ফিচার ইমেজ: PUNIT PARANJPE/AFP/Getty Images