শেষ হয়ে এলো ২০১৭ সাল। সারা বছর জুড়ে প্রত্নতত্ত্ববিদরা পৃথিবী জুড়ে চালিয়েছেন অনেক খোঁড়াখুঁড়ি। উদ্ধার করেছেন বহু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। আবিষ্কার করেছেন মানব ইতিহাসের বহু অজানা রহস্য। সৌদি আরবের ‘দ্বার’ নামে পরিচিত শত শত রহস্যময় পাথরের অবকাঠামো, পূর্বের অনাবিষ্কৃত একটি গুহায় খুঁজে পাওয়া ‘মৃত সাগরের স্ক্রল’ থেকে শুরু করে এমন এক মহিলাকে খুঁজে পাওয়া যায়, যিনি তার স্বামীর হৃদপিন্ডটি সাথে নিয়ে সমাধিস্থ হয়েছিলেন। এমনই আশ্চর্য সব জিনিস আবিষ্কৃত হয়েছে এই ২০১৭ সালে। চলুন তাহলে দেখে নেওয়া যাক ২০১৭ সালে আবিষ্কৃত হওয়া প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশনগুলোর মধ্যে থেকে সেরা ৮টি নিদর্শন।
১. সৌদি আরবের রহস্যময় দ্বার
এ বছরের শেষের দিকে প্রত্নতত্ত্ববিদরা সৌদি আরবের হাররাত খায়বার নামক স্থানে কয়েক হাজার বছরের পুরনো প্রায় ৪০০টির মতো রহস্যময় পাথরের অবকাঠামো আবিষ্কার করেন। দেখতে এগুলো ঠিক দেয়ালের মতো। পুরনো লাভার গম্বুজের পাশেই এগুলো অবস্থিত। উপর থেকে এই পাথরের দেয়ালগুলোকে দেখতে ঠিক মাঠে প্রবেশের দরজার মতো লাগছিল বলে প্রত্নতত্ত্ববিদরা এগুলার নাম দেন ‘গেটস’ বা দ্বার।
এই পাথরের দেয়ালগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়টি প্রায় ১,৭০০ ফুট লম্বা। দেয়ালগুলোর উপরে চাকা, পাখি প্রভৃতি পাথর দিয়ে নির্মিত কিছু আকৃতি দেখা গেছে যা কয়েক হাজার বছর পুরনো। রহস্যময় এই পাথরের দেয়ালগুলো আসলে কী ছিল বা এগুলো কারা নির্মাণ করেছিল তা এখনও জানা যায়নি।
২. মৃত সাগরের স্ক্রল
ডেড সি বা মৃত সাগরের পশ্চিম তীরের একটি স্থানের নাম ‘খিরবেত কামরান’। এখানে রয়েছে অনেকগুলো প্রাচীন গুহা। আর এই গুহাগুলোর মধ্যে ১১টি গুহায় ৭০ বছর আগে আবিষ্কৃত হয়েছিল বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন লিখিত স্ক্রল বা পুঁথি। কিন্তু এই স্ক্রলটি কয়েক দশক আগেই এই গুহাগুলো থেকে চুরি হয়ে যায়।
পরবর্তীতে এ বছর ফেব্রুয়ারী মাসে প্রত্নতত্ত্ববিদরা একই স্থানে আরেকটি লুকানো গুহা খুঁজে পেয়েছেন। এই গুহার মধ্যে পাওয়া গিয়েছে একটি স্ক্রল। তবে কিছুই লেখা নেই এটিতে। প্রত্নতত্ত্ববিদরা মনে করছেন, এমন আরেকটি গুহা অর্থাৎ ১৩তম গুহাটি ঐ স্থানের আশেপাশেই কোথাও লুকিয়ে রয়েছে। ২০১৮ সালের মধ্যে সেই গুহাটির খোঁজ পাওয়া যাবে বলে ধারণা করছেন তারা। পূর্বে পাওয়া স্ক্রোলগুলো ছিল প্রায় ২,০০০ বছরের পুরনো এবং এগুলোর বেশিরভাগে হিব্রু ভাষায় প্রাচীন বাইবেল লেখা ছিল।
৩. মিশরীয় রাজকুমারীর পিরামিড
মিশরের প্রত্নতত্ত্ববিদরা সম্প্রতি খোঁজ পেয়েছেন একটি ৩,৮০০ বছরের পুরনো পিরামিডের। পিরামিডটিতে মিশরীয় ফারাও আমেনি কিমাউয়ের নাম খাদাই করা রয়েছে। এই একই ফারাওয়ের নাম খোদাই করা আরেকটি পিরামিড খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল ১৯৫৭ সালে। সেই পিরামিডটি ছিল সদ্য আবিষ্কৃত পিরামিডটি থেকে ২,০০০ ফুট দূরে। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, সদ্য আবিষ্কৃত এই পিরামিডটির ভিতরের সমাধিকক্ষে পাওয়া গেছে একটি কাঠের বাক্স।
এই বাক্সটির ভিতরে পাওয়া গেছে ফারাও আমেনির কন্যা হাটশিপসেটের নাম, যিনি ছিলেন মিশরের অন্যতম বিখ্যাত নারী ফারাও। প্রত্নতত্ত্ববিদরা ধারণা করছেন, ফারাও আমেনি কিমাউয়ের কোনো পূর্বপুরুষ হয়তো এই পিরামিডটি বানিয়েছিলেন। পরবর্তীতে আমেনি এটি দখল করে নিয়ে এটিতে নিজের নাম খোদাই করেন এবং তার মেয়ের মৃত্যুর পর তার মৃতদেহ সমাধিস্থ করার জন্য ব্যবহার করেন এটি।
৪. সবচেয়ে প্রাচীন মানুষের কঙ্কাল
এ বছর প্রত্নতত্ত্ববিদরা খুঁজে পেয়েছেন এখন পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে প্রাচীন মানুষের কঙ্কাল। মরোক্কোর একটি গুহায় খুঁজে পাওয়া হোমো স্যাপিয়েন্স (Homo Sapiens) গোত্রের এই কঙ্কালগুলো প্রায় ৩,০০,০০০ বছর পুরনো। এর ফলে গবেষকরা ধারণা করছেন মানুষের আবির্ভাব আমাদের জানা সময়কালের আরো এক লক্ষ বছর আগেই হয়েছিল।
কঙ্কালগুলোর মধ্যে রয়েছে ৩টি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ, ১টি কিশোর ও ১টি শিশুর কঙ্কাল। আগে ধারণা করা হতো, হোমো স্যাপিয়েন্স গোত্রের আবির্ভাব সর্বপ্রথম পূর্ব আফ্রিকায় হয়েছিল। কিন্তু এই আবিষ্কারের ফলে জানা গেলো শুধু পূর্ব আফ্রিকায় নয়, বরং গোটা আফ্রিকা মহাদেশেই সর্বপ্রথম হোমো স্যাপিয়েন্সের আবির্ভাব ঘটে। গবেষকরা জানিয়েছেন, খুঁজে পাওয়া ৫টি কঙ্কাল আধুনিক মানুষের কঙ্কালের মতোই দেখতে।
৫. প্রেমের অন্যতম নিদর্শন
সম্প্রতি প্রত্নতত্ত্ববিদরা খোঁজ পেয়েছেন বিশ্বের অন্যতম উদ্ভট এক প্রেমের নিদর্শনের। ১৬৫৬ সালে মারা যান লুইস ডি কোয়েংগো নামে ৬৫ বছরের এক মহিলা। এই মহিলার স্বামী টোউসেইন্ট ডি পেরিয়েন ছিলেন ফ্রান্সের ব্রিট্টেনির একজন ধর্মীয় পৃষ্ঠপোষক। পেরিয়েন তার স্ত্রী মারা যাওয়ার ৭ বছর আগে মারা যান। পেরিয়েন মারা যাওয়ার পর তার ইচ্ছা অনুযায়ী করা হয় এক অদ্ভুত কান্ড!
তার মৃতদেহ থেকে হৃদপিন্ডটি কেটে আলাদা করা হয়। এরপর এটিকে একটি সুরক্ষিত খাপের মধ্যে সংরক্ষণ করা হয়। এর সাত বছর পর যখন পেরিয়েনের প্রিয় স্ত্রী মারা যান তখন সেই কেটে রাখা হৃৎপিন্ডটি তার মৃত স্ত্রীর কফিনের উপরে রেখে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে গবেষকরা দেখতে পান পেরিয়েনের স্ত্রীর শরীর থেকেও কেটে ফেলা হয়েছে হৃদপিন্ড এবং সেটিও হয়তো একইভাবে তার স্বামীর কফিনের উপর রাখা হয়েছিল। তবে এই হৃদপিন্ডটি খুঁজে পাননি গবেষকরা।
৬. আশ্চর্যজনক রত্ন পাথর
প্রত্নতত্ত্ববিদরা সম্প্রতি খুঁজে পেয়েছেন ৩,৫০০ বছরের পুরনো একটি রত্ন পাথর। পাথরটিতে একটি ছবি খোদাই করা রয়েছে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, একজন যোদ্ধা একটি মৃতদেহের উপর দাঁড়ানো অবস্থায় আরেকটি সৈন্যের কাঁধে তরবারি ঢুকিয়ে দিচ্ছে। এই পাথরটি গ্রীসের পাইলোসে অবস্থিত এক যোদ্ধার সমাধিতে পাওয়া গিয়েছে। সমাধির নিচে আরো ৩,০০০ জিনিসের সাথে চাপা পড়ে ছিল এটি।
রত্ন পাথরের গায়ে খোদাই করা এই চিত্রটি এতই সূক্ষ্ম যে, তা দেখতে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের প্রয়োজন হয়। ২০১৫ সালে এই সমাধিটির খোঁজ পেয়েছিলেন প্রত্নতত্ত্ববিদরা। তবে এটি খুঁড়ে ও পরিষ্কার করে এ বছরই এর ভেতরে লুকানো গুপ্তধনগুলোর খবর প্রকাশ করা হয়।
৭. প্রাচীন কাবিননামা
এখনো পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো কাবিননামার খোঁজ মিলেছে এ বছর। প্রায় ৪,০০০ বছর পুরনো একটি ফলকে লেখা রয়েছে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে হওয়া এই কাবিননামা।
আসসিরিয়ান ভাষায় লিখিত এই কাবিননামায় লেখা রয়েছে, যদি হাতালা নামের মহিলাটি দুই বছরের মধ্যেও কোনো সন্তান জন্ম দিতে ব্যর্থ হয় তবে সে তার স্বামী, লাকিপামকে একটি দাসী কিনে দিবে যে কিনা তার স্বামীর সাথে মিলিত হয়ে এই দম্পতিকে একটি সন্তান দান করবে। এই চুক্তি নামায় আরো লেখা রয়েছে, যদি এই দম্পতি কখনো একে অপরের সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটায় তবে যে বিচ্ছেদ ঘটাবে সে অন্যজনকে ৫ মিনা (ওজনের একক) ওজনের রূপা পরিশোধ করবে।
৮. সবচেয়ে প্রাচীন মদ তৈরির নিদর্শন
এ বছর জর্জিয়ায় পাওয়া গেছে ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীন মদ তৈরির নিদর্শন। এ থেকে জানা গেছে প্রায় ৮,০০০ বছর আগেও মানুষ মদ তৈরি করতো। জর্জিয়ার দুটি স্থানে গবেষকরা এই মদ তৈরির নিদর্শন খুঁজে পেয়েছেন।
নির্দেশনগুলোর মধ্যে রয়েছে কয়েকটি ভাঙা পাত্র যেগুলো মদ তৈরিতে ব্যবহৃত হতো। গবেষকরা এই পাত্রগুলোতে টারটারিক এসিডের উপস্থিতি খুঁজে পেয়েছেন যা প্রমাণ করে এগুলোতে একসময় আঙ্গুরের রস দিয়ে গাঁজন প্রক্রিয়ায় মদ তৈরি করা হতো। এই আবিষ্কারের ফলে বর্তমানে প্রচলিত মদ শিল্প ঠিক কত বছরের পুরনো তা জানা গেলো।
ফিচার ইমেজ – businessinsider.com