সিনেমাপ্রেমীরা একবার চোখ বন্ধ করে কিংবদন্তি পরিচালক আলফ্রেড হিচককের সিনেমা ছাড়া সিনেমা দুনিয়াটা কল্পনা করে দেখুন তো। রক্ত দেখে যাদের মাথা ঘুরে যায়, খুনোখুনির রহস্যগুলো তাদের কাছে অজানা থাকতো। গোসলের দৃশ্য দেখে এবার কেউ খুন হবে নাকি, তা ভেবে কারো গা শিউরে উঠত না। ১২০ মিনিটের মধ্যে দুর্বোধ্য রহস্যের কঠিন প্যাঁচ খুলে শেষ মুহূর্তে সবাইকে “আচ্ছা, এই তাহলে কাহিনী!” বলতে বাধ্য করার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করার মানুষের অভাব সিনেমা জগতে থেকেই যেত।
‘মাস্টার অফ সাসপেন্স’ খ্যাত হিচককের মুভি এখন প্রতিনিয়ত রিপ্রিন্ট হচ্ছে, দর্শকদের চাহিদা পূরণ করতে প্রতিটি ফিল্ম ফরম্যাটে তা পুনঃনির্মাণ করা হচ্ছে, নতুন করে প্রেক্ষাগৃহে তা মুক্তি দেয়া হচ্ছে আর সেখানে উপচে পড়ছে দর্শকের ভিড়। অথচ একসময় এমনটা কল্পনায় আনাও সম্ভবপর ছিল না!
‘রোপ’ (১৯৪৮), ‘রেয়ার উইন্ডো’ (১৯৫৪), ‘দ্য ট্রাবল উইথ হ্যারি’ (১৯৫৫), ‘দ্য ম্যান হু নিউ টু মাচ’ (১৯৫৬) এবং ‘ভার্টিগো’ (১৯৫৮)- এই পাঁচটি সিনেমা মুক্তির সময় নির্মাতাকে থিয়েটারে মোটা অঙ্কের রয়ালটি ফি জমা দিতে বলা হয়েছিল। মুভিগুলো আদৌ চলবে কিনা, সে চিন্তা থেকেই সিকিউরিটি মানি জমা নেয়ার পাঁয়তারা করে প্রেক্ষাগৃহের মালিকেরা, যা হিচককের পক্ষে দেয়া সম্ভব ছিল না। যার ফলে প্রেক্ষাগৃহ থেকে সিনেমাগুলো উঠিয়ে নেয়া হয়।
১৯৮০ সালে হিচককের মৃত্যুর পর দলিল মোতাবেক মুভিগুলোর স্বত্বাধিকারী হন হিচককের কন্যা প্যাট্রিসিয়া। প্যাট্রিসিয়া প্রায় ৫ বছর পর ছবিগুলো পুনরায় মুক্তি দেন এবং রিপ্রিন্ট করার অনুমতি দেন। সব মিলিয়ে কেটে যায় প্রায় ৩০ বছর। এই দীর্ঘ সময় ধরে এই পাঁচটি চলচ্চিত্র থেকে বঞ্চিত হন হিচককপ্রেমীরা। এই পাঁচটি মুভিকে তাই বলা হয় ‘ফাইভ লস্ট হিচককস’, ‘দ্য মিসিং হিচককস’ অথবা ‘দ্য ফাইভ হিচককস’। ১৯৯০ সালে ইউনিভার্সালের অর্থায়নে ‘ভার্টিগো’ এবং ‘রেয়ার উইন্ডো’ সিনেমা দুটি পুনরুদ্ধার করেন রবার্ট অ্যা হ্যারিস এবং জেমস ক্যাটজ।
একনজরে জেনে নেয়া যাক সিনেমা পাঁচটি সম্পর্কে,
রোপ
১৯৪৮ সালে আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল ক্রাইম থ্রিলার ঘরানার এই সিনেমাটি নির্মাণ করা হয় ১৯২৯ সালে একই নামে প্যাট্রিক হ্যামিলটনের একটি নাটকের উপর ভিত্তি করে। আলফ্রেড হিচককের মতে, রোপ ছিল একটি এক্সপেরিমেন্ট, যা আসলে ঠিকমতো কাজ করেনি। সিনেমাটি তিন দশক ধরে রূপালি পর্দার বাইরে অবস্থান করায় খুশিই ছিলেন তিনি। হিচককের এক্সপেরিমেন্ট সফল হয়নি বটে, তবে বক্স-অফিস মাতানো কোনো পরিচালক এমন একটি ইন্টারেস্টিং প্রজেক্টে হাত দিতে পারেন, তা প্রমাণ করার জন্য হলেও সিনেমাটির প্রয়োজন ছিল।
জেমস স্টুয়ার্ট, জন ডাল আর ফার্লে গ্র্যাঙ্গারকে কেন্দ্রে রেখে, লিওপোল্ড-লোব হত্যারহস্যের উপর নির্মিত নাটকটি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ‘রোপ’ সিনেমাটি বানান হিচকক। তুলনামূলক দুর্বল এক সহপাঠীকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে দুই তরুণ। মৃতদেহ লুকিয়ে ফেলে তাদেরই অ্যাপার্টমেন্টে। এরপর বন্ধু-বান্ধব আর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে একটি পার্টির আয়োজন করে নিজেদের নিখুঁত অপরাধকে যেন পরোক্ষভাবে চ্যালেঞ্জ করে তারা, পারলে কেউ খুঁজে বের করুক কী কাণ্ড ঘটিয়েছে দুই বন্ধু। শেষ পর্যন্ত কি ধরা পড়েছিল তারা? হিচককের সিনেমায় আর যা-ই হোক, সাসপেন্সের কোনো অভাব হবে না!
রেয়ার উইন্ডো
আলফ্রেড হিচককের ‘রেয়ার উইন্ডো’ সিনেমার নায়ক আটকা পড়েছে হুইলচেয়ারের ফাঁদে, তার সাথে ‘আমরা’ মানে সাধারণ দর্শকরাও যেন আটকা পড়েছি নায়কের ফাঁদে। হুইলচেয়ারে বন্দি ফটোগ্রাফারের দৃষ্টিভঙ্গি, তার স্বাধীনতার অভাব, হাতে থাকা বিকল্প ব্যবস্থার সংকট- সব কিছু সিনেমার গণ্ডি পেরিয়ে ছুঁয়ে যায় দর্শকদেরও। দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী পার করার জন্য নির্লজ্জের মতো সে যখন প্রতিবেশীদের ব্যক্তিগত জীবনে উঁকিঝুঁকি দেয়াকে সঙ্গী বানিয়ে ফেলে, আমরাও তখন তার সাথে মোহগ্রস্তের মতো অন্যের জীবন নিয়েই মেতে থাকি। কারো উপর গোয়েন্দাগিরি করাটা অন্যায়, আমরা জানি। কিন্তু সিনেমার গোটা জগতটাই তো কারো ব্যক্তিগত জীবনে গোপন নজরদারির মতো। দর্শক হিসেবে আমরা যা করি, পরিচালক এখানে নায়ককে দিয়ে ঠিক তা-ই করিয়েছেন।
সিনেমা ইতিহাসের শুরুর দিকে রাশিয়ান পরিচালক কুলেশভ বেশ বিখ্যাত একটি এক্সপেরিমেন্ট করেছিলেন। ইচ্ছাকৃতভাবে নির্দিষ্ট কিছু শটের সাথে কুশীলবদের মুখ জুড়ে দিয়ে নতুন একটি মানে দাঁড় করাতেন তিনি। যেমন খাবারের দৃশ্যের পর শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে থাকা এক লোকের মুখ দেখিয়ে বুঝিয়ে দিতেন লোকটি ক্ষুধার্ত। ১৯৫৪ সালে নির্মিত এই সিনেমায় ঠিক একই কাজ করেছেন হিচকক। নিরপেক্ষ কিছু শটের মাধ্যমে মন্টাজ দিয়েই তৈরি করেছেন অর্থ। নায়ক জেফরূপী জেমস স্টুয়ার্টের চোখ দিয়ে আমরাও টের পাই, প্রতিবেশীদের মধ্যে রয়েছে একজন খুনি।
দ্য ট্রাবল উইথ হ্যারি
মৃত্যু নিয়ে কমেডি করতে গিয়ে ১৯৫৫ সালে ‘দ্য ট্রাবল উইথ হ্যারি’ সিনেমাটি তৈরি করেছিলেন হিচকক। ব্যক্তিগতভাবে এটি তার বেশ পছন্দ হলেও জনগণ তা মেনে নেয়নি। হ্যারির সমস্যা হলো, সে মারা গেছে। এখন তার মৃতদেহ নিয়ে ঠিক কী করা উচিত, তা নিয়ে সবার ভিন্ন ভিন্ন মতামতের কারণেই ঝামেলায় পড়ে গেছে বেচারা।
অ্যাকশন, সাসপেন্স, ক্লাইম্যাক্স, মোট কথা হিচককের ছবিতে হিচককীয় যেসব উপাদান অনিবার্য বলে ধরে নেয়া হয়, তার কোনোটিই খুঁজে পাওয়া যাবে না এই মুভিটিতে। ‘অ্যান্টি হিচককীয়’ এই সিনেমাটিতে রয়েছে নিখাদ বিনোদনের ভাণ্ডার। সূক্ষ্ম কৌতুকবোধ যাদের রয়েছে, তারা এখানে পাবেন নির্মল আনন্দের সাথে কিছু গোপন বার্তা, আর যারা খুব সিরিয়াস হয়ে মুভি দেখতে বসেন, তাদের জন্য এখানে এককথায় কিছুই নেই। হিচককের হাতেগোনা কয়েকটি শতভাগ কমেডি মুভির মধ্যে এটি একটি। সমসাময়িক সিনেমাগুলোর তুলনায় ডায়লগের ক্ষেত্রে এখানে বেশ স্বাধীনতা দেখিয়েছেন পরিচালক। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় জনের চরিত্রটির কথা। ম্যাকলেইনকে সে নির্দ্বিধায় জানায় যে তার নগ্ন প্রতিকৃতি আঁকতে চায় জন। তখনকার সময়ে এ ধরনের ডায়লগ বলার সাহস আর কোনো পরিচালক দেখাননি।
দ্য ম্যান হু নিউ ঠু মাচ
হিচককীয় ঘরানার, অর্থাৎ সাসপেন্স থ্রিলার এই মুভিটির কেন্দ্রীয় চরিত্রে রয়েছেন হিচককের অন্যতম তুরুপের তাস জেমস স্টুয়ার্ট এবং ডরিস ডে। ১৯৩৪ সালে এই একই শিরোনামে প্লট এবং স্ক্রিপ্টের দিক থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি সিনেমা নির্মাণ করেছিলেন তিনি। নামের ক্ষেত্রে এই রিমেক বা পুনর্নির্মাণ কতটা উন্নত মানের ছিল, তা বিভিন্ন সময় সিনেমাবোদ্ধারা উল্লেখ করতে কার্পণ্য করেননি। প্রতি উত্তরে হিচকক বলেছিলেন, “তাহলে ধরে নিন, প্রথম সিনেমাটি ছিল একজন প্রতিভাবান নবিশের প্রচেষ্টা, আর দ্বিতীয় সিনেমাটি ছিল একজন পেশাদার পরিচালকের সৃষ্টিকর্ম”।
মরক্কোতে ছুটি কাটাতে আসা এক পরিবার ঘটনাক্রমে হোঁচট খেয়ে পড়ে এক গুপ্তহত্যার চক্রান্তকারী দলের মধ্যে। ষড়যন্ত্রকারীরাও উঠে পড়ে লাগে কোনোক্রমে তাদের পরিকল্পনায় এই পরিবারকে হস্তক্ষেপ করতে না দেয়ার পাঁয়তারায়। অপহৃত বাচ্চাদের বাবা-মায়ের চরিত্রে দুই তারকা অভিনেতার পুরস্কার দর্শকের মন কাড়তে বাধ্য। কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত এই সিনেমাটি গানের জন্য অস্কার জিতেছিল।
ভার্টিগো
“ও কি তোমাকে শিখিয়ে দিয়েছিল? রিহার্সাল করিয়েছিল? কী করতে হবে, কী বলতে হবে সব বলে দিয়েছিল?” ব্যথিত হৃদয় নিংড়ে বেরিয়ে আসা এই আর্তনাদের মধ্য দিয়েই শেষ হয় আলফ্রেড হিচককের মাস্টারপিস ‘ভার্টিগো’। এখনো পর্যন্ত বিভিন্ন একাডেমিক কাজে বা সাইকোঅ্যানালাইসিসের ক্ষেত্রে বেছে নেয়া হয় এই সিনেমাটি। এক ভদ্রলোক প্রেমে পড়েছে এমন এক নারীর, মর্ত্যে যার কোনো অস্তিত্ব নেই। এই লোকের কষ্টে অচিরেই দুঃখিত হয়ে ওঠে দর্শকরাও। সত্যিকারের নারীর বেশে নায়িকা যখন তার সামনে আসে, সেই নায়িকার প্রেমও পারে না অস্তিত্বহীন সেই মানবীর অভাব পূরণ করতে। স্কটি ফার্গুসনবেশী জেমস স্টুয়ার্টকে ধোঁকা দিতে গিয়ে এক সময় নিজেই ধোঁকায় পড়ে যায় ম্যাডলিন রূপী বারবারা। এ যেন অনেকটা ‘কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল যে সে মরে নাই’ জাতীয় দ্বিধাদ্বন্দ্ব।
সান ফ্রান্সিসকোর সাবেক এক গোয়েন্দা স্কটিকে গুটি হিসেবে ব্যবহার করে নিজের পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করতে চায় তারই এক বন্ধু। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় স্কটির উচ্চতাভীতি। বন্ধুর স্ত্রীকে রক্ষা করতে গিয়ে নিজেই সে জালে ফেঁসে যাওয়া গোয়েন্দা, গোয়েন্দার বান্ধবী, বন্ধু, বন্ধুর স্ত্রী- সব মিলিয়ে সম্পর্কের টানাপোড়েনের পাশাপাশি জটিল এক চক্রান্তের গল্পই ‘ভার্টিগো’। জুডি চরিত্রটির মাধ্যমে পরিচালক এখানে এক নারীর প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি আবেগীয় অনুভূতিগুলো ফুটিয়ে তুলতে যে মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন, তা নিঃসন্দেহে সিনেমাটিকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে।
ফিচার ইমেজ- cinephiliabeyond.org