গত ২৯ মে রাশিয়ার সাংবাদিক আরকাদি বাবচেনকোর নিহত হওয়ার খবর প্রচার করে ইউক্রেন। আর তাকে হত্যার অভিযোগ দেওয়া হয় রাশিয়ার উপর। কিন্তু এর ঠিক একদিন পরেই সবাইকে অবাক করে দিয়ে ইউক্রেনের কিভে এক সংবাদ সম্মেলনে হাজির হন বাবচেনকো।অর্গানাইজেশন ফর সিকিউরিটি অ্যান্ড কো-অপারেশন ফর ইউরোপের (ওএসসিইউ) এক কর্মকর্তা জানান, ইউক্রেন ভুয়া তথ্য ছড়াচ্ছিল। এছাড়াও সাংবাদিকদের মতে, এটি ছিল এক ধরনের তথ্য যুদ্ধ। এখন প্রশ্ন উঠেছে, কেন ইউক্রেন এই মিথ্যাচার করলো? এ ধরনের মিথ্যা তথ্য দেওয়া কি আসলেই সমীচীন? বাবচেনকোই বা ইউক্রেনের এ মিথ্যাচারে সহযোগিতা করলেন কেন?
ঘটনাটি যেভাবে সাজানো হয়েছিল
৪১ বছর বয়সী রুশ সাংবাদিক বাবচেনকো ইউক্রেনে নির্বাসিত জীবনযাপন করছিলেন। ইউক্রেনের পুলিশ ২৯ মে তারিখে জানায়, বাবচেনকোকে তার নিজের অ্যাপার্টমেন্টে কয়েকবার গুলি করা হয়। তার স্ত্রী জানান, মঙ্গলবারে তিনি বাবচেনকোকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাদের অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকের প্রবেশ পথে পড়ে থাকতে দেখেন। পরবর্তীতে তিনি অ্যাম্বুলেন্সে মৃত্যুবরণ করেন বলে জানানো হয়।
ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকোভ ইউক্রেন সরকারের কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে জানান, এই হত্যার পেছনে রাশিয়ার হাত রয়েছে। তারা আশা প্রকাশ করে যে, অন্যান্য দেশও সাংবাদিকদের আরও বেশি নিরাপত্তাদানের খাতিরে ইউক্রেনকে সমর্থন জানাবে।
তবে পরেরদিনই ইউক্রেনের কিভে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে হাজির হন বাবচেনকো। যারা তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন, সেখানে তিনি তাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানান।
কেন ইউক্রেন এ মিথ্যা তথ্য দিয়েছিল?
ইউক্রেন সিকিউরিটি সার্ভিসেস (ইবিইউ) এর প্রধান জানিয়েছেন, বাবচেনকোকে যারা মেরে ফেলতে চাচ্ছিল, তাদেরকে ধরতেই মৃত্যুর মিথ্যা নাটক সাজিয়েছিলেন তারা। ইবিইউ থেকে জানানো হয়, তারা ইউক্রেনে অবস্থানরত ৩০ জনকে হত্যা করার পরিকল্পনার কথা জানতে পেরেছে যাদের মধ্যে বাবচেনকো একজন।
বাকি ২৯ জনের নাম প্রকাশ না করলেও তারা একজন ইউক্রেনীয়কে আটক করেছে। তাদের দাবি, আটককৃত এই ব্যক্তিকে রাশিয়া নিয়োগ দিয়েছে যেন বাবচেনকোকে হত্যা করার জন্য সে কাউকে দায়িত্ব দেয়। এসবিইউ এর পক্ষ থেকে এও জানানো হয় যে, হত্যাকাণ্ড আয়োজনের জন্য ৪০ হাজার মার্কিন ডলার, হত্যাকারীর জন্য ৩০ হাজার ও মাধ্যম হিসেবে কাজ করার জন্য তাকে ১০ হাজার মার্কিন ডলার দেওয়া হয়।
এছাড়া আরও জানানো হয় যে, আটককৃত এই ব্যক্তিকে বেশ কিছু অস্ত্র ও বিস্ফোরক কেনার আদেশ দেওয়া হয়েছিল, যা ইউক্রেনের কেন্দ্রস্থল লুক্যে রাখা হবে। সাংবাদিকদেরকে আটককৃত এক ব্যক্তির ভিডিও দেখানো হয়।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট পেট্রো পোরোশেনকো জানান, বাবচেনকো ও তার পরিবারকে কিভ নিরাপত্তা প্রদানের প্রস্তাব দেবে। তিনি আরও বলেন, “মস্কো শান্ত হবে বলে মনে হয় না।”
বাবচেনকো কি আসলেই হত্যার জন্য চিহ্নিত ছিলেন?
বাবচেনকো রাশিয়ার যুদ্ধ বিষয়ক সাংবাদিক। তার ও তার পরিবারের ক্ষতি করা হবে এমন হুমকির কারণে তিনি দেশ ত্যাগ করেন বলে জানিয়েছিলেন। ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টের কারণে সরকার তার উপর ক্ষিপ্ত ছিল বলে তাকে জানানো হয় এবং এর জন্য তাকে হুমকি দেওয়া হয়। ফলে ২০১৭ সালের প্রথম দিকে তিনি রাশিয়া ছাড়তে বাধ্য হন।
ফেসবুকে তিনি রাশিয়া থেকে সিরিয়ায় যাত্রা করা বিমান বিধ্বস্ত সম্পর্কে পোস্ট করেছিলেন। বিমানটিতে ৯২ জন যাত্রী ছিলেন। পোস্টটিতে তিনি রাশিয়াকে আগ্রাসক হিসেবে উল্লেখ করেন।
২০১৭ সালে হারেটজ ম্যাগাজিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, তাকে বেশ কয়েকবার ডেকে হুমকি দেওয়া হয়। প্রথমবার ডেকে পাঠিয়ে তাকে জানানো হয়, এ কাজের পরিণাম ভোগ করতে হবে। এরপর তার ও আরেকজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানো হয়।
দ্বিতীয়বার হুমকির পরে কর্তৃপক্ষ পাঁচটি স্থানে তল্লাশী চালিয়েছে এবং একজনকে আটক করেছে। সেবার তিনি বেঁচে যান। তৃতীয়বার জানানো হয়, তার বিরুদ্ধে অপরাধের অনুসন্ধান চালানো হবে। এরপর তিনি রাশিয়া ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। গত এক বছরে তিনি প্রাগ, তেল আবিব ও কয়েক মাস আগে থেকে ইউক্রেনে বসবাস করছেন। তিনি জানান, প্রায় এক মাস আগে তিনি তার বিরুদ্ধে রাশিয়ার ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পারেন এবং ইউক্রেনকে সাহায্য করতে সম্মত হন।
ইউক্রেনের বিরুদ্ধে সমালোচনার কারণ কী?
মূলত সাংবাদিকদের বিশ্বাসযোগ্যতাকে খাটো করার জন্য ইউক্রেন সমালোচিত হচ্ছে। ওএসসিই এর গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংক্রান্ত প্রতিনিধি হারলেম দেসি বলেন, “একজন সাংবাদিকের জীবন সংক্রান্ত বিষয়ে ভুল তথ্য দেওয়ায় আমি আক্ষেপ প্রকাশ করছি। জনগণকে সঠিক তথ্য দেওয়া একটি রাষ্ট্রের কর্তব্য।”
রিপোর্টারস উইদাউট বর্ডারসের দলপ্রধান ক্রিস্টোফি দেলোইরি বলেন, “তথ্য যুদ্ধ হিসেবে ইউক্রেনের গোয়েন্দা সংস্থার মিথ্যাচারকে রিপোর্টারস উইদাউট বর্ডারস এর পক্ষ থেকে তীব্র নিন্দা জানাই।”
রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া
প্রথমে ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এই হত্যাকাণ্ড রাশিয়াকে দোষারোপ করার জন্য সংঘটিত হয়েছে। সঠিকভাবে ইউক্রেনকে এই হত্যার অনুসন্ধান করতে বলে তারা।
নিজেদের পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের সমাধান নিজেরাই করার কারণে ইউক্রেনকে অভিনন্দন জানিয়ে উপহাস করেছে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বাবচেনকো বেঁচে আছে জেনে তারা খুশি, তবে ইউক্রেন তার ঘটনাকে নিজেদের প্রপাগান্ডা হিসেবে ব্যবহার করেছে।মস্কো ইউক্রেনের এই মিথ্যাচারকে উস্কানিদাতা বলেও অভিহিত করেছে।
প্রকৃতপক্ষে ঘটনা কী ঘটেছে সে ব্যাপারটি অনেকটা ঘোলাটেই করে ফেলছে ইউক্রেন। প্রথমেই মিথ্যা দিয়ে শুরু করলে পরবর্তীতে সত্য বললেও অনেকেই তা বিশ্বাস করতে চায় না। উদ্দেশ্য যত মহৎই হোক না কেন, মিথ্যা মৃত্যুর তথ্য বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরা কতটা সমীচীন হবে, তা বিবেচনা করা উচিত ছিল ইউক্রেনের। এদিকে রাশিয়া বাবচেনকোকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল কিনা, সেটিও এখন নিরপেক্ষভাবে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
Featured Image Source: LongRoom.com