দীর্ঘদিন বার্ধক্যজনিত রোগে ভোগার পরে গত ১৬ আগস্ট চলে গেলেন ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী। মৃত্যুর সময়ে তার বয়স হয়েছিল ৯৩। সক্রিয় রাজনীতি ত্যাগ করার পরে বাজপেয়ী শারীরিকভাবে অনেকটাই অসুস্থ হয়ে পড়েন। ২০০৯ সালে একটি স্ট্রোক হওয়ার পরে তার কথা বলার ক্ষমতা অনেকটাই হারিয়ে যায় এবং পরে কিডনির সমস্যাতেও ভোগেন। গত নয় সপ্তাহ নয়াদিল্লির এইমস হাসপাতালে ভর্তি থাকার পরে অবশেষে ইহলোক ত্যাগ করেন ভারতরত্ন অটল বিহারি বাজপেয়ী।
তিন-তিন বার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন বাজপেয়ী
মাত্র আঠারো বছর বয়সে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ‘ভারত ছাড় আন্দোলন’-এ যোগ দেওয়া বাজপেয়ী ১৯৯৬ সালে প্রথমবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু কোয়ালিশন যুগের রাজনীতির প্যাঁচঘোঁচে তের দিনের বেশি টেকেনি তার সরকার। এরপর ১৯৯৮ সালে ফের প্রধানমন্ত্রীত্ব পান তিনি, কিন্তু সেবারেও তের মাসের বেশি টেকেনি তার শাসনভার। সংসদে মাত্র এক ভোটে হেরে পতন হয় বাজপেয়ীর। কিন্তু ততদিনে নেতা হিসেবে যথেষ্ঠ নাম কিনে নিয়েছেন এই ব্রাহ্মণ নেতা।
১৯৯৯ সালে তার দ্বিতীয় সরকার পড়ে যাওয়ার কিছুমাস পরে ফের ক্ষমতায় আসেন বাজপেয়ী এবং তার এই তৃতীয় ইনিংস চলে পুরো মেয়াদ, ২০০৪ সালে অপ্রত্যাশিত হার হওয়া পর্যন্ত।
বাজপেয়ী ছিলেন ভারতের দশম প্রধানমন্ত্রী এবং তার শাসনকালেই ভারতের রাজনীতি কোয়ালিশনের অস্থিরতার দিন থেকে বেরিয়ে পুনরায় স্থিতিশীলতার মুখ দেখে এবং সেটা বাজপেয়ীর নেতৃত্বের কারণেই। দেশের প্রথম অ-কংগ্রেসি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পূর্ণ মেয়াদ টিকে তিনি এক উন্নত বিকল্পের সন্ধান দেন ভারতীয় রাজনীতিতে।
সার্বিকভাবেই একজন দেশনেতা ছিলেন বাজপেয়ী
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বাজপেয়ীকে ইতিহাস কীভাবে মনে রাখবে? ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) এই নেতার সবচেয়ে বড় পরিচয় ছিল যে তিনি ডানপন্থী একটি রাজনৈতিক দলের সদস্য হয়েও নিজেকে একজন উদারবাদী নেতা হিসেবে প্রমাণিত করতে পেরেছিলেন। এবং তার কারণ ছিল, তিনি সমস্ত রাজনীতির উর্ধ্বে উঠে এক রাষ্ট্রনেতা হিসেবে দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। পরিকাঠামোগত উন্নয়ন বা অর্থনৈতিক সংস্কার তো বটেই, বাজপেয়ী নজর দিয়েছিলেন ভারতের প্রতিরক্ষা এবং বিদেশনীতিকেও বলিষ্ঠ করতে।
পরমাণু পরীক্ষার পর সারা বিশ্বকে দৃঢ়ভাবে জানিয়েছিলেন দেশের অবস্থান
১৯৯৮ সালে দ্বিতীয় পোখরান ঘটিয়ে ভারত যখন সারা পৃথিবীর চক্ষুশূল হয়েছে, তখন বাজপেয়ী একা সেই চ্যালেঞ্জ নিয়ে সকলের সামনে ভারতের অবস্থান রেখেছিলেন জোরালো বক্তব্যের সঙ্গে। তার সেই দৃঢ়তাকে উপেক্ষা করতে পারেনি বহির্বিশ্ব। মেনে নিয়েছিল ভারতের উত্থান। প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গে তিনি নিয়েছিলেন একের পর এক শান্তি উদ্যোগ। ১৯৯৯ সালে দিল্লি-লাহোর বাস কূটনীতি; ২০০১ সালে আগ্রা শীর্ষ সম্মেলন এবং ২০০৪ সালে ক্রিকেট কূটনীতির মধ্য দিয়ে বাজপেয়ী বারবার শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন পাকিস্তানী নেতৃত্বের সঙ্গে। প্রতিদানে কখনও পেয়েছিলেন কার্গিলের ষড়যন্ত্র বা কখনও ঘটেছে সংসদে জঙ্গি হামলা। কিন্তু বাজপেয়ী নিজের উদারবাদী মননকে কখনও উগ্রবাদী হতে দেননি। একই রকমভাবে, চীনের সঙ্গেও সম্পর্ক উন্নত করতেও আগ্রহী হয়েছেন।
বাজপেয়ী আজও কাশ্মীরে সমানভাবে বরণীয়
ঘরোয়া রাজনীতিতে বাজপেয়ীর এক বড় অবদান ছিল কাশ্মীর সমস্যার প্রতি তার মানবিক অবস্থান। কাশ্মীর সমস্যা মেটানোর জন্য বাজপেয়ীর ‘ইনসানিয়াত’, ‘জমহুরিয়াত’ এবং ‘কাশ্মীরীয়ত’- এর মডেল অনুসরণ করার আর্জি আজও তাকে উপত্যকার অন্যতম জনপ্রিয় নেতা করে রেখেছে। আজকে যখন কাশ্মীরে সমস্যা বেড়েই চলেছে; কড়া পন্থার সংঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সব পক্ষই, তখন বাজপেয়ীর সেই মানবিক প্রচারের কথা আরও যেন বেশি করে মনে পড়ছে।
বর্ষীয়ান এই নেতার মৃত্যুতে আজ সত্যিই শেষ হয়ে গেল একটি যুগ। বিশেষ করে, আজ ভারতের শাসকদল বিজেপির ইতিহাসে যেন একটি দিগ্পরিবর্তনকারী ঘটনা ঘটল। বিজেপি উত্থান বাজপেয়ী এবং লালকৃষ্ণ আদভানির হাত ধরে। ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই দলটি নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে ১৯৯৬ সালে প্রথম ক্ষমতার স্বাদ পায়। বরাবর কট্টর রাজনীতির পথ আঁকড়ে চলা বিজেপির পক্ষে রাতারাতি মেরুকরণের মধ্যে দিয়ে ভারতীয় রাজনীতিতে দাপট দেখানো সহজ কাজ ছিল না। আদভানির ভাবমূর্তি ছিল কট্টরবাদী নেতার, যিনি আশির শেষাশেষি এবং নব্বই দশকের শুরুর দিকে নানা কৌশলে দেশের হিন্দু ভোট বাগে আনতে চেয়েছিলেন।
১৯৯১ সালে বিজেপি এই মেরুকরণের রাজনীতির উপর ভর করে প্রথম মাথা তুললেও কেন্দ্রে তাদের একটি উদারবাদী মুখের প্রয়োজন ছিল এবং বাজপেয়ী সেই ভূমিকাটিই পালন করেছিলেন আস্থাভরে। যে বিজেপিকে তখন মানুষ সেভাবে চিনত না; তাদের হিন্দুবাদী পরিচয় নিয়ে আশঙ্কিত বোধ করত, তাদেরকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্যে প্রয়োজন ছিল সর্বাগ্রে একটি নরমপন্থী নেতৃত্ব এবং বাজপেয়ী সেই নেতৃত্বই দিয়েছিলেন। বিজেপিকে একটি নরমপন্থী দল হিসেবে তিনি প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন জাতীয় রাজনীতিতে।
হিন্দুত্ববাদী দলের নেতা হয়েও ভোলেননি রাজধর্মের কথা
পূর্ব ভারতের ওড়িশা রাজ্যে খ্রিশ্চান মিশনারি গ্রাহাম স্টেইনস ও তার দুই শিশুপুত্রকে জীবিত পুড়িয়ে মারার পর বাজপেয়ী চুপচাপ তা মেনে নেননি। বিজেপির ‘ধর্মগুরু’ আরএসএস-এর সঙ্গে কট্টরপন্থার বিষয়ে একমত হননি তিনি। ২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গার সময়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে রাজধর্ম পালন করার উপদেশ দেওয়া থেকেও পিছপা হননি বাজপেয়ী। একটি জায়গায় তার সমালোচনা রয়েছে, সেটি হলো, তিনি ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংস হওয়ার সময়ে তা আটকানোর যথেষ্ঠ প্রচেষ্টা দেখাননি বা ২০০২-এর দাঙ্গার পরে মোদীকে সরাননি দলের হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক খোয়ানোর ভয়ে।
বাজপেয়ীর অভাব বিজেপি ভুগেছে তার প্রস্থানের পর
বাজপেয়ীর মূল্যায়ন করতে গেলে বিজেপির চরিত্রটির বিবর্তনের কথা বিশ্লেষণ করা জরুরি। বাজপেয়ী-আদভানির সময়ে বিজেপি দ্বি-নেতৃত্বের দল ছিল। এই দুই পুরুষকে ঘিরেই আবর্তিত হতো দলের যাবতীয় ক্রিয়াপ্রণালী। পরের সারির নেতাদের মধ্যে ছিলেন আজকের সুষমা স্বরাজ, অরুণ জেটলি, প্রমোদ মহাজন এবং রাজ্য স্তরে ছিলেন মুখ্যমন্ত্রীরা যেমন মোদী, শিবরাজ সিংহ চৌহান, মনোহর পরীকর।
২০০৪ সালে অপ্রত্যাশিতভাবে বাজপেয়ী হেরে যান, যদিও বলা হচ্ছিল যে তার মতো প্রশাসককে হারানো তখনকার বিরোধীদের পক্ষে কষ্টসাধ্য কাজই হতো। কিন্তু রাজনীতি হলো অসম্ভবের শিল্প। ‘ভারত উদয়’ বা ‘ইন্ডিয়া শাইনিং’ প্রচার করেও শেষমেশ নির্বাচনী রাজনীতির চোরাস্রোতের টের বাজপেয়ী নেতৃত্বাধীন বিজেপি সেবারে পায়নি। অন্যদিকে, সোনিয়া গান্ধীর নেতৃত্বে জনমুখী কর্মসূচি নিয়ে বাজিমাত করে কংগ্রেস। ক্ষমতায় আসে প্রথম ইউপিএ সরকার। প্রধানমন্ত্রী হন মনমোহন সিংহ।
এই নির্বাচনের এক বছর পরেই সক্রিয় রাজনীতি থেকে সন্ন্যাস নেন বাজপেয়ী। এবং এরপরেই শুরু হয় বিজেপির রূপান্তরের অধ্যায়টি। বাজপেয়ীর অনুপস্থিতিতে আদভানি তার জায়গা নেওয়ার চেষ্টা করেন। নিজের কট্টর ভাবমূর্তি বদলানোর তাগিদে পাকিস্তানের জনক মুহম্মদ আলী জিন্নাহর স্তুতি গেয়ে বসেন তিনি, আর তাতেই হয় হিতে-বিপরীত। আরএসএস-এর সঙ্গে আদভানির তীব্র সংঘাত দেখা দেয়। এরপর ২০০৬ সালের শুরুর দিকে বিজেপির প্রথম সারির ম্যানেজার প্রমোদ মহাজন পারিবারিক কলহে প্রাণ হারালে বিজেপিতে নেতৃত্বে রীতিমতো সংকট দেখা দেয়। ক্ষয়িষ্ণু আদভানি বাজপেয়ীর জায়গা না নিতে পারাতে বিজেপি আটকে পড়ে। ২০০৯ সালের নির্বাচনে বিজেপিকে আদভানি নেতৃত্ব দিলেও সেই পরীক্ষায় ব্যর্থ হন তিনি এবং দল দুজনেই। তারপর নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে উঠে আসেন নরেন্দ্র মোদী এবং কোণঠাসা গেরুয়াবাহিনীকে দিশা দেখান।
এই বাজপেয়ীর রাজনীতি থেকে বিদায় এবং মোদীর উত্থানের মধ্যবর্তী সময়টিতে বিজেপি যে নেতৃত্বহীনতার সম্মুখীন হয় তাতেই বোঝা যায় যে, বাজপেয়ীর গুরুত্ব সেই দলের জন্য কতটা ছিল। যে দলকে বেশিরভাগ বিরোধীরাই অস্পৃশ্য মনে করত তাদের হিন্দুবাদী রাজনীতির জন্যে, সেই দলের একজন নেতা বিশেরও অধিক দল নিয়ে সরকার সাফল্যের সঙ্গে চালিয়ে মেয়াদ পূর্ণ করে প্রমাণ করেন যে নেতৃত্বের গ্রহণযোগ্যতা থাকলে প্রবল রাজনৈতিক বিভেদও কোনো অন্তরায় হয়ে ওঠে না। এখানেই বাজপেয়ীর মাহাত্ম্য। ভারতের রাজনীতির ইতিহাস বাজপেয়ীকে মনে রাখবে তার এই কাজের জন্যই।
ফিচার ইমেজ: Twitter handle of John Abraham @TheJohnAbraham