কখনো ভেবেছেন কি, আমাদের পরিত্যক্ত আবর্জনা কোথায় যাচ্ছে? অনেকেই জানেন, এসব আবর্জনার একটা বিশাল অংশকে আবারো ব্যবহারোপযোগী পণ্য বা কাঁচামালে রূপান্তরিত করা হয়। যদি এই ব্যবস্থা না থাকত, গোটা পৃথিবী ডুবে যেত আবর্জনার সাগরে।
৩০ বছর ধরে চীন অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে অনেক বেশি আবর্জনাকে পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে তুলেছে। এর ভেতরে রয়েছে কাগজের বাক্স থেকে শুরু করে উঁচুদরের বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি; যেমন কম্পিউটার বা গাড়ি! এসব করে চীন যে শুধু মিলিয়ন মিলিয়ন টন কাঁচামাল বাঁচিয়েছে তা-ই নয়, বরং অন্য দেশগুলোর কারখানাতে সস্তা কাঁচামালের সুবিধাও নিশ্চিত করেছে। কিন্তু চলতি বছরের জুলাইয়ে চীন সারাবিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছে, তারা আর অন্যদের আবর্জনা নিতে পারবে না। তারা এটাও বলছে যে, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা খুব দ্রুতই বিভিন্ন প্রকারের আবর্জনা আমদানি নিষিদ্ধ করে দেবে। এর ভেতরেই তারা ২৫ ধরনের পণ্যের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। ফলে নানা দেশের কোম্পানি আর পুনর্ব্যবহার সংস্থা তাদের আবর্জনার নতুন ঠিকানা খুঁজতে হাহাকার করে চলেছে।
চীনের এই সিদ্ধান্তে শুরু হয়েছে বিরাট পুনর্ব্যবহার (রিসাইকেল) সঙ্কট। কিন্তু মনে হয় না এই সমস্যা বেশিদিন থাকবে। চীন সরকার দাবি করছে, প্রতিবছর আমদানি করা পণ্য থেকে যে পরিবেশ বিষয়ক জটিলতার শিকার হয় চীন, তা থেকে দেশটিকে রক্ষার উদ্দেশ্যেই তাদের এই প্রকল্প গ্রহণ। অবশ্য তাদের এই সিদ্ধান্ত শাপে বর হয়ে দেখা দিয়েছে উঠতি অর্থনীতি, প্রযুক্তিতে উন্নত দেশগুলোর জন্য। তারা তাদের সময়োপযোগী আর স্বচ্ছতর প্রযুক্তি দিয়ে পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্যগুলোকে দেবে নতুন চেহারা। মিলিয়ন ডলার বাঁচানোর সাথে সাথে তারা হবে নতুন কাঁচামালের উৎস। আর খুব সম্ভবত এক্ষেত্রে জাপানের মতো পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্য রপ্তানিকারক দেশের চেয়ে বড় প্রতিযোগী আর কেউ হবে না।
যখন থেকে মানুষ বুঝতে শুরু করেছে যে, যে পণ্যগুলো আমরা আবর্জনা ভেবে পাঠাচ্ছি ডাস্টবিনে, তারাও হয়ে উঠতে পারে মূল্যবান উৎপাদক, তখন থেকেই মূলত এই ব্যবসার সূত্রপাত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্র তার বার্ষিক উৎপাদিত অ্যালুমিনিয়ামের ৪০ শতাংশ উৎপন্ন করে পুনর্ব্যবহারযোগ্য সামগ্রী থেকে। চীনের অর্ধেকের মতো তামার যোগানও আসে এমনই সব বর্জ্য থেকে।
বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির বর্জ্য পুনরায় ব্যবহার যোগ্য করে তোলা এক হাড়ভাঙা খাটুনি। কিন্তু আপনি যদি বাতিল মোবাইল, টেলিফোন থেকে স্বর্ণ বের করে আনতে পারেন, তা অবশ্যই সম্ভাবনাময়। অচল মোবাইলফোন ঘেঁটে স্বর্ণ আনার দু’দিকে লাভ আছে। এক তো খনিতে শ্রম যত না ব্যয়বহুল, তারচে’ বেশি কষ্টকর। তার উপর খনি খনন করতে গিয়ে পরিবেশের বিপত্তিও কিন্তু ফেলে দেওয়ার মতো নয়। এক্ষেত্রে কিন্তু চীনের সাফল্য ঈর্ষণীয়। বৈদুতিক পণ্যের বর্জ্য বা ই-বর্জ্য থেকে চীন বার্ষিক ২০ টন স্বর্ণও উৎপাদন করেছে, যা ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের খনিজ স্বর্ণের ১০ ভাগ।
আপনি প্রশ্ন করতেই পারেন, এত লাভের পরও কেন চীন সরকার বন্ধ করে দিতে চাচ্ছে বর্জ্য আমদানি? হ্যাঁ, চীন অনেক লাভবান হয় সত্যিই, কিন্তু চীনের কাছে যথেষ্ট কারণ আছে এই শিল্প থেকে বিমুখ হওয়ার। ক্ষতিকর ইলেকট্রনিক বর্জ্য পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করে, যা একটি অস্বস্তিকর অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে চীনের বৈশ্বিক পরিচিতিতে। এক চীনের মানুষই বছরে যে পরিমাণ ইলেক্ট্রনিক পণ্য বাতিল করে, তাতে করে তার অন্য দেশ থেকে নতুন করে বর্জ্য আমদানি একধরনের বাহুল্যই বটে। কর্তৃপক্ষ এই নিষিদ্ধকরণ কর্মসূচি কিন্তু হুট করে চালু করেনি। বরং ধীরে ধীরে এ ধরনের আমদানি প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে নিরুৎসাহিত করেছে।
তাদের এই সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিকভাবে একটি মুক্তবাজার সৃষ্টি করেছে। জাপান যদি গবেষণার জন্য সরকারের দীর্ঘমেয়াদী সহায়তা নিয়ে বিকল্প ও পরিচ্ছন্ন একটি ব্যবস্থা তৈরি করতে পারে,তবে তা তাদের জন্য অসীম লাভজনক হবে। জাপানের কিছু বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান এই রাস্তাতেই হাঁটবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশে-বিদেশে তারা নিজেদের রিসাইক্লিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করে আসা চীনের সস্তা ও দূষণসৃষ্টিকারী প্রযুক্তিকে ছাপিয়ে যাবে।
মিতসুবিশি কোম্পানির কথাই ধরা যাক। তারা শত শত মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে আসছে দামি ধাতু নিষ্কাশনকারী প্ল্যান্টের পেছনে। এ থেকে তারা তৈরি করে বিভিন্ন বৈদ্যুতিক পণ্য ও লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি। কিন্তু চীনে বৈদেশিক বর্জ্য বন্ধ হওয়ার সাথেই মিতসুবিশির মতো কোম্পানিগুলোর প্রথম লক্ষ্য হবে জাপান। তারা নাকি নেদারল্যান্ডেও এ ধরনের প্ল্যান্ট তৈরি করবে, যাতে করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কিছু দেশ, যারা এককালে চীনের উপর নির্ভরশীল ছিল, তাদের ই-বর্জ্যও কিছুটা পাওয়া যায়। এসব প্ল্যান্ট যে সেবাযোগানকারীদের শুধু অর্থের সরবরাহ করবে, তা-ই নয়, বরং চীনের অনুপস্থিতিতে তারা আগামীতে কাঁচামাল রপ্তানির অভাবকেও মোকাবেলা করতে পারবে বলে মনে করে।
অবশ্য এই গবেষণা সস্তা তো নয়ই, বরং অনেকটাই সময়সাপেক্ষ। তাই মিতসুবিশি তাদের প্ল্যান্টগুলোকে ২০২১ সালের আগে ‘পুরোদমে চালু’ বলে ঘোষণা করতে চায় না। কিন্তু তারা আশা করে, একবার তাদের উৎপাদন শুরু হয়ে গেলে সারা বিশ্বে তারা মুক্তবাণিজ্য করবে। যেখানে আগে পাওয়া কাঁচামাল হবে দামি এবং কম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন, সেখানে মিতসুবিশি ও জাপান ভোগ করবে বিরাট অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত সুবিধা।
তারা যে বেশ তোড়জোড় নিয়ে কাজে হাত দিচ্ছে, তা বোঝা যায়। ২০২০ সালে অনুষ্ঠিতব্য জাপান অলিম্পিক গেমসের সব স্বর্ণ, রোপ্য ও ব্রোঞ্জ পদক আয়োজকেরা তৈরি করেছে জাপানি ভোক্তাদের ব্যবহৃত ই-বর্জ্য থেকে। তাদের এই উদ্যোগ পুনর্ব্যবহার তো বটেই, উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের সরকারদের জন্য উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে থাকবে।
আমেরিকার বিদ্যুৎ বিভাগের প্রকল্প, যা পুনর্ব্যবহারের প্রতি ঝুঁকেছিল, তাদের অর্থ বরাদ্দ বন্ধ করা হয়। ট্রাম্প সরকার স্রোতের বিপরীতে গিয়ে পুনরুৎপাদনকে উৎসাহিত করতে পারত। রিসাইক্লিং আমেরিকাতে প্রায় সাড়ে ৭ লক্ষ চাকরিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অবদান রেখে চলেছে। ফলে আমেরিকার সরকার যদি পুনর্ব্যবহারকে পুঁজি করা কর্মকান্ডে তাদের বরাদ্দ বৃদ্ধি করে, তবে এই চাকরি খাত বাড়বে বৈ কমবে না। বেসরকারি কোম্পানিগুলোর উচিত এ ধরনের পুনর্ব্যবহার কর্মসূচিতে লক্ষ্য রাখা, যাতে কম মূল্যে, কম দূষণে তারাও কাঁচামাল পেতে পারে। তাদের এই বিনিয়োগের ফলে দেশীয় রিসাইকেলিং উৎসাহিত হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা ‘ক্লোজড লুপ ফান্ড’ এর কথা। এরা নতুন নতুন পুনর্ব্যবহারজনিত বিনিয়োগকে বিভিন্ন সুবিধা প্রদান করে আসছে।
এখানে আমরা বাংলাদেশের কথাও বলতে পারি। ছোট্ট একটি জনবহুল দেশ, তার আনাচেকানাচে হাজার রকমের বর্জ্য। একটি পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, কেবল ঢাকারই মাত্র ৩৭% আবর্জনা ঠিকঠাক সংগৃহীত হয়। অর্থাৎ বাকি আবর্জনা কোনো না কোনো অবৈধ ও দূষণকারী উপায়ে পরিবেশে শেষ হয়। যেগুলো শেষ হয় না, সেগুলো নর্দমায় আটকে থেকে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে। সাথে রয়েছে অনেক জৈবরাসায়নিক বর্জ্য, যা পানিতে মাটিতে বায়ুতে মিশে যাচ্ছে রোজ। ফলে হুমকির মুখে পড়ছে গোটা পরিবেশ। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন জাপানের সংস্থা জাইকার (জাপান ইন্টারন্যাশনাল কর্পোরেশন এজেন্সি) হাত ধরে কিছু বড় বড় পরিকল্পনাতে কাজ করছে, যেখানে কঠিন বর্জ্যপদার্থকে পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে তোলা হবে।