Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

৩৬০ আউলিয়ার দেশে ঘোরাঘুরি (শেষ পর্ব)

আগের পর্বের পর…

জাফলং

জাফলং যাওয়ার জন্য শহরের সোবহানঘাটের জাফলং বাসস্ট্যান্ডে লোকাল ও গেইটলক দুই ধরনের বাস পাওয়া যাবে। এছাড়া সামনে মোড়েই পাওয়া যাবে ভাড়া করার জন্য অটোরিক্সা। গেইটলক বাসে জাফলং যেতে দেড় ঘণ্টার মতো লাগবে। অপরদিকে লোকাল বাসে তিন ঘণ্টা পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। তবে সমস্যা হচ্ছে দিনের নির্দিষ্ট কিছু সময়েই গেইটলক বাস ছাড়ে। লোকাল বাসের মতো সারা দিন পাওয়া যাবে না। বাস একদম জাফলং জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত যায়।

জিরো পয়েন্ট থেকে দেখা যাচ্ছে ভারতের ডাউকির কিছু ঘর-বাড়ি ও মোটেল © সাকিব শরীফ

জাফলং যাওয়ার রাস্তা প্রথমদিকে ভালো মনে হলেও জৈন্তাপুরের কাছাকাছি গেলে সে ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। যারা বাসে একটু ঘুমিয়ে নিতে চান তাদের নিরাশ হতে হবে। ঘুমাতে না পারলেও চোখ জুড়িয়ে নেয়ার জন্য রয়েছে নির্মল প্রকৃতি। শ্রীপুরের দিকে বাস এগোতেই বাম দিকে চোখে পড়বে চা বাগান আর ডান দিকে পাহাড়। পাহাড়গুলো ভারতের ডাউকির অন্তর্ভুক্ত। পাহাড়ের গা বেয়ে নামছে ঝর্না। একটা নয়, বরং একটার পর একটা। যারা আগে ঝর্না দেখেননি তারা অবশ্যই এ দৃশ্য দেখে রোমাঞ্চিত হবেন। সম্পূর্ণ সবুজে ঘেরা পাহাড়ের গা বেয়ে সাদা পানির অথৈ ধারা নামছে। তবে এ দৃশ্য যে সব সময় দেখা যাবে তা নয়।  ঝর্না দেখতে হলে আসতে হবে বর্ষাকালে।

পাহাড়ের গায়ে সাদা সুতোর মতো, ওগুলোই ঝর্না © সাকিব শরীফ

স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা যায়, জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দূরের পাহাড়গুলোতে এসব ঝর্না দেখতে পাওয়া যায়। জাফলং এর কাছেই রয়েছে তামাবিল-ডাউকি বর্ডার পাস। সকাল ১০টা থেকে ৫টা পর্যন্ত ইমিগ্রেশন করা যায় এই পাস দিয়ে। রাস্তার দুই পাশে যখন স্তুপ করা অসংখ্য পাথর আর স্টোন ক্রাসারের সাইনবোর্ড দেখবেন, বুঝবেন আপনি জাফলং এসে গেছেন। জাফলং এর শেষ গন্তব্য জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত বাসে বা অটোরিক্সায় করে যাওয়া যায়।

জাফলং (প্যানারোমা); Image Source: thetouristplace.com

জিরো পয়েন্ট পৌঁছে টিলা থেকে নিচে নেমে ঘাটে গিয়ে নৌকা (ডিঙ্গি অথবা ইঞ্জিন চালিত) ভাড়া করে আশেপাশের স্পটগুলো ঘুরে দেখতে হবে। স্পটগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে গোয়াইনঘাট খাসিয়া পল্লী ও মায়াবতী ঝর্না। নৌকা নিয়ে স্পটগুলোতে যাওয়ার সময় পিয়াং নদী থেকে পাথর তোলার দৃশ্য দেখতে পাওয়া যাবে। আগে এখানে পাথর তোলার মেশিন থাকলেও পরিবেশ রক্ষার্থে এখন পাথর তোলা হয় হাতে।

পাথর নামানো হচ্ছে নৌকা থেকে; Image Source: nijhoom.com

পিয়াং নদী পার হয়ে সংগ্রামপুঞ্জী মদ্ধাপল্লী (অনেকে খাসিয়া পল্লী বলে থাকেন) যাওয়া যায়। ইজি বাইক ভাড়া করে গ্রামের ভেতর প্রবেশ করতে হবে। গ্রামের ভেতরে প্রবেশ করলেই চোখে পড়বে পান সুপারির বাগান। কুষ্টিয়ার মতো এখানে পানের বরজ দেখা যায় না। এখানে সুপারি ও অন্যান্য গাছ বেয়ে বেড়ে ওঠে পান গাছগুলো। আর প্রায় প্রত্যেক বাগানেই রয়েছে ছোট বড় আনারসের ঝাড়। এখানে বাড়িগুলোর গঠনশৈলীতে রয়েছে বিশেষত্ব। কাঠ বা কনক্রিট দু’ধরনের বাড়িতে রয়েছে এ বিশেষত্ব। বিশেষত্ব হচ্ছে বাড়িগুলো ভূমি থেকে বেশ উচুতে তৈরি। দেখে মনে হবে দোতলা বাড়ি, তবে নিচে সাধারণত ফাঁকা থাকে।

সংগ্রামপুঞ্জী গ্রামে রয়েছে খাসিয়া রাজার বাড়ি, তবে এটি দেখতে অনেকটাই আধুনিক। আর রয়েছে চা বাগান। এখানে ঘুরতে বেশি সময় না নেয়াই ভালো, কারণ সামনে অপেক্ষা করছে ঝর্না।

সংগ্রামপুঞ্জীর চা বাগান © মোহাইমিনুল ইসলাম

মায়াবী ঝর্না

এটি সংগ্রামপুঞ্জী ঝর্না নামেও পরিচিত। সংগ্রামপুঞ্জী ঘাট বা খাসিয়া পল্লী ঘাট থেকে সোজাসুজি নদী পার হয়ে পাশে যেতে হবে। পাড়ে নামার সাথে সাথে চোখে পড়বে অসংখ্য কুচি পাথর। দূর থেকে এগুলো দেখে বালু মনে হতে পারে। এখানে বার বার পানি পাড়াতে হয় বলে অনেকেই খালি পায়ে চলা শুরু করেন। কড়া রোদে এ ভুল কখনোই করবেন না, কারণ এ কুচি পাথরগুলো থাকে অত্যন্ত উত্তপ্ত। খালি পায়ে হাঁটলে পায়ে ফোসকা পড়ার সম্ভাবনা থাকে অত্যধিক।

ছাতা এখানে রোদ ও বৃষ্টি দুটো থেকেই বাচাবে © সাকিব শরীফ

ঘাটে নেমে চারদিকে অনেকটা মরুভূমির মতো দেখালেও ক্রমশ সামনে এগিয়ে গেলে কানে আসবে অনেক উঁচু থেকে পানি পড়ার শব্দ। হ্যাঁ, এটা ঝর্নারই শব্দ। সামনের দিকে যতই এগিয়ে যাবেন ততই বাড়বে শব্দ। কিছু অস্থায়ী দোকানপাট পেরিয়ে বাঁক নিলেই সামনে ঝর্না

ভরা মৌসুমে এমনই দেখায় মায়াবী ঝর্না © গুপাল দাস

এ ঝর্নাটি না খুব বড় না খুব ছোট, বরং মাঝারি ধরনের। এখানে এসে এক মুহূর্তের জন্য আপনার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, ঝর্না দেখতে এসেছেন না মানুষ দেখতে! ঝর্নার আকারের তুলনায় এখানে মানুষের উপস্থিতি অনেক বেশি। এ ঝর্নাটি ভারতের সীমানার মধ্যে, তাই ঝর্নার একদম উপরে ওঠার অনুমতি নেই। বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত বাংলাদেশি পর্যটকদের জন্য ঝর্নাটি উন্মুক্ত করে দেয়া হয়।

ঝর্না দেখবেন নাকি মানুষ দেখবেন? © সাকিব শরীফ

ঝর্নার নিচে পাথরগুলোর উপরে উঠে অনেকেই ছবি তুলে থাকেন। সাথে ক্যামেরা থাকলে সাবধানে উপরের দিকে উঠতে হবে। যারা মোবাইল ক্যামেরায় ছবি তুলতে চান তারা অবশ্যই মোবাইল ফোনটিকে ওয়াটার প্রুফ মোবাইল ব্যাগে ভরে নেবেন। ঝর্নার নিচে পাথরগুলোর উপরে ওঠার সময় বিশেষ সর্তক থাকতে হবে, কারণ কোনো কোনো পাথর অত্যন্ত পিচ্ছিল, আর স্রোত তো আছেই। এখানে পর্যাপ্ত ট্যুরিস্ট ফটোগ্রাফার রয়েছে। চাইলে এদের দিয়ে ছবি তুলিয়ে নিতে পারেন। প্রতিটি ছবি পাঁচ থেকে দশ টাকার বিনিময়ে তুলে দেয় তারা। ছবি নিতে হবে পেনড্রাইভ বা ডাটা ক্যাবল দিয়ে ফোনে। ছবি তোলার আগে অবশ্যই দর মিটিয়ে নেবেন এবং ফটোগ্রাফারের ফোন নম্বরটি রাখবেন।

ছবি নিতে হবে ঘাটে গিয়ে, ঠিক যেখান থেকে প্রথম নৌকায় উঠেছিলেন। তাই ঝর্না থেকে ফেরার সময় অবশ্যই ফটোগ্রাফারকে সাথে নিয়ে ফিরবেন এবং ঘাটে নেমে জিরো পয়েন্টের দিকে ওঠার আগেই ছবিগুলো সংগ্রহ করবেন। অনেক ফটোগ্রাফার পর্যটকদের আগে ঘাটে পাঠিয়ে নিজে পরে যায়, সেক্ষেত্রে আপনাকে/পর্যটককে ঘাটে অপেক্ষা করতে হবে। একবার ঘাট থেকে উপরে জিরো পয়েন্টে উঠলে আর নিচে নামতে শরীর সায় দেবে না। শরীর থাকবে তখন খুবই ক্লান্ত।

উপরে কিন্তু ওঠা নিষেধ © জাহিদ সানী

ঝর্নার পানিতে যারা নামবেন তাদের জেনে রাখা ভালো- এই পানি অনেক ঠান্ডা এবং বেশিক্ষণ ভেজা কাপড়ে থাকলে জ্বর আসাটা স্বাভাবিক। এখানে মেয়েদের কাপড় পরিবর্তন করার জন্য একটা অস্থায়ী ছাউনি রয়েছে, তবে ছেলেদের ভরসা উন্মুক্ত প্রকৃতি। দলে সদস্য সংখ্যা বেশি হলে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে পর্যায়ক্রমে ঝর্নার পানিতে নামা ভালো। এতে করে ব্যাগ-ব্যাগেজ ও জিনিসপত্রের উপর নজর রাখা সহজ হবে।

এখানে দুপুরে খাবার কোনো ব্যবস্থা নেই। খেতে হবে জিরো পয়েন্টে ফিরে গিয়ে। তাই সাথে হালকা খাবার রাখা সমীচীন। জিরো পয়েন্টে খাওয়া-দাওয়া করে পাঁচটায় শেষ বাসে শহরে ফেরা যাবে।

জাফলংয়ে কৈশোর © জাহিদ সানী

জাফলং যাওয়ার পথেই আরো কিছু স্পট রয়েছে। তবে একইদিনে জাফলং দেখে ঐসব স্পট দেখা কঠিন। জাফলং যাওয়ার বাসে করেই যাওয়া যাবে স্পটগুলোতে। এদিকে আছে জৈন্তাপুর রাজবাড়ি, লালা খাল, লোভাছড়া ইত্যাদি।

জৈন্তাপুর রাজবাড়ি

৭ম-৮ম শতাব্দীর পুরাণ, লোককথা ও ইতিহাসে জৈন্তাপুরের কথা পাওয়া যায়। এটি এতটাই পুরনো। এটি সিলেট শহর থেকে ৩৫ কি. মি. উত্তর-পশ্চিমে জৈন্তাপুর উপজেলায় অবস্থিত। এটি জাফলং থেকে ৫ কি. মি. দূরে সিলেট–তামাবিল সড়কের কাছেই সারিঘাটে অবস্থিত। বাসে বা অটোরিক্সায় করে যাওয়া যাবে এখানে। একসময়ের জৌলুসময় রাজবাড়ির এখন শুধুই রয়েছে ধ্বংসাবশেষ

রাজবাড়ির ধ্বংশাবশেষ; Image Source: khantraining.esy.es
দেশে, শুধুমাত্র এখানেই মেগালিথিক মনুমেন্ট রয়েছে © অনিক সরকার
ধারণা করা হয়, সবচেয়ে বড় মেগালিথিক মনুমেন্টটিতে বসতো রাজা © অনিক সরকার
জৈন্তেশ্বরী মন্দির; Image Source: flickr

লালাখাল

শহর থেকে জাফলং যাওয়ার বাসে বা অটোরিক্সায় করে যাওয়া যায় লালাখাল। বাসের হেল্পারকে বললেই নামিয়ে দেবে তামাবিল সড়কে। এখান থেকে সহজেই যাওয়া যাবে লালাখালে। লালাখালে গিয়ে মুহূর্তের জন্য আপনার মনে হতে পারে, কোনো খালে নয়, বরং সুইমিংপুলে আছেন। এখানকার সবুজাভ নীল স্বচ্ছ পানি আপনাকে মুগ্ধ করবে। এখানে ঘোরার জন্য রয়েছে ইঞ্জিনচালিত ও ইঞ্জিন ছাড়া দু’ধরনেরই নৌকা। লালাখালে গিয়ে কেউ কেউ কায়াকিং করে থাকে। কাছেই আছে ম্যাগনোলিয়া চা বাগান, চাইলে এটি ঘুরে দেখা যেতে পারে।

লালাখাল © সায়মা নাজনিন প্রভা (ToB)
সূর্যের রশ্মি পড়লে এমনই স্বচ্ছ দেখায় লালাখালের পানি © মৌসুমি সুলতানা (ToB)
এমনই নৌকায় করে লালাখাল ঘুরে দেখতে পারেন © সায়মা নাজনিন প্রভা (ToB)
এখানে অনেকেই সাথে হারমোনিকার মতো ছোট বাদ্যযন্ত্র নিয়ে আসে। পরিবেশের সাথে সুর মিলে মুহূর্তটি হয়ে যায় আরো উপভোগ্য © জাহিদ সানী

লোভাছড়া

লোভাছড়া কানাইঘাট উপজেলায় অবস্থিত। সিলেট–জাফলং সড়ক থেকে ডানদিকে দরবেশ বাজারে প্রবেশ করে কানাইঘাট পৌঁছাতে হবে। কানাইঘাট থেকে নৌকায় করে লোভাছড়া যেতে হবে। লোভাছড়ায় আছে এক পুরনো চায়ের বাগান, লোভাছড়া নদী, পুরনো এক কটেজ ও ফার্গুসান বাংলো। এখানে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ব্রিটিশ আমলে তৈরি স্টিলের এক ঝুলন্ত ব্রিজ। এখানকার প্রকৃতিতে আছে একধরনের নিবিড় স্থিরতা।

লোভাছড়ায় এই নিঃসঙ্গ গাছটি পর্যটকদের জন্য অপেক্ষমান © শেখ নাঈম ইসলাম
এটি ব্রিটিশ আমলের সেই ঝুলন্ত ব্রিজ © শেখ নাঈম ইসলাম
১৯২৫ সালে তৈরি এটি © জাহিদ সানী
এখান থেকে মেঘালয়ের পাহাড়গুলো দেখা যাবে © রিপন শেখ (ToB)

৩৬০ আউলিয়ার দেশে ঘোরাঘুরি সিরিজের তিনটি লেখার মাধ্যমে সিলেটের কিছু উল্লেখযোগ্য পর্যটন স্পট তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে এগুলোর বাইরেও ঘুরে দেখার মতো বেশ কিছু স্পট রয়েছে সিলেটে।

ফিচার ইমেজ © জাহিদ সানী

Related Articles