বিচ্ছিন্নতার মাঝে লুকিয়ে থাকা এক অবিচ্ছিন্নতা, একতা। দূর থেকে দেখলে মনে হবে এ কেমন ক্যাম্পাস…সবকিছু আলাদা আলাদা ছন্নছাড়া! কিন্তু না, একটু কাছে গেলেই পাবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মিলিত সত্ত্বার ছোঁয়া।
টিএসসির সড়ক দ্বীপে চারদিক ঘিরে থাকে অনেক প্রাণোচ্ছলতা, ভুল শব্দে লিখে রাখা সাইনবোর্ড নিয়ে পানিপুরিওয়ালা, রঙিন বেলুন আর বেলুন হাতে ইতস্তত দাঁড়িয়ে থাকা ধূসর চোখের কিশোরটি। অনেকগুলো ধোঁয়া ওঠা চায়ের দোকান, মালাই চা…মাল্টা চা…লেবু চা…আদা চা…প্রায় বিশ থেকে পঁচিশ রকমের চা তো পাবেনই, তাই যখন ইচ্ছে মিটিয়ে নেয়া আপনার চায়ের তৃষ্ণা! স্বোপার্জিত স্বাধীনতা ভাস্কর্যটিতে চিত্রিত অত্যাচারের দৃশ্য ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে এরই এক কোণে অবস্থান করছে।
প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন উদযাপনে মুখরিত টিএসসি অডিটরিয়াম, সামনের বারান্দায় বহু সাংস্কৃতিক কর্মশালার আহবান নিয়ে বসে থাকে একঝাঁক বিদ্যার্থী। ভেতরের ক্যান্টিন, প্রাঙ্গন, মাঠ সব ভরে থাকে আড্ডার কলকাকলিতে। ছোট ছোট পথকলিরা কিছু ফুলের মালা বা চকলেট নিয়ে ঘুরতে থাকে এদিক ওদিক, অনেকটা জোর করেই যেন গছিয়ে দিতে চায়। ফুল নিলে বা একটু কুশল শুধালে ওদের মুখের হাসিটা ফুলের কৌমার্যকেও হার মানায় যেন। সামনেই সন্ত্রাসবিরোধী স্মারক রাজু ভাস্কর্য মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে যেন সকল অশুভ থেকে টিএসসিকে আগলে রাখতে।
বামপাশ দিয়ে বাংলা একাডেমী, একুশে বইমেলার প্রাঙ্গন,অন্যদিক দিয়ে সামনে আরেকটু এগোলে আলো-ছায়ার ঘেরাটোপে থাকা চারুকলা অনুষদ। এর দেয়ালে দেয়ালেই মেলে চারুকলার শিক্ষার্থীদের সৃষ্টিশীলতার আঁচ। বাইরে চুড়ি নিয়ে বসে থাকা অক্লান্ত কিছু মুখ, চুড়ির বেসাতি এরা বয়ে আনেন প্রতিদিন নিয়ম করে, নিয়ম করেই বলে দেন কোন চুড়ি কার হাতে কেমন মানাবে; তার নিজের হাতে থাকে কয়েকগাছি মলিন থেকে মলিনতর হয়ে যাওয়া চুড়ি। আর লোকজ বাদ্যযন্ত্র নিয়ে বসে থাকা উদাস করা কিছু চেহারা দৃষ্টি কেড়ে নেবেই নেবে। কারো হাতে হয়তো একটা বাঁশের বাঁশি ফুঁ দেয়ার অপেক্ষায়, কেউবা একটু দেখে নিচ্ছেন একতারা কিংবা দোতারাটাই।
কলাভবনের রয়েছে বেশ কয়েকটি প্রবেশদ্বার যা খানিকটা গোলকধাঁধাঁর বোধ দিয়ে ফেলে নবাগতদের! কোনোটা কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার ও রোকেয়া হলের মধ্য দিয়ে, কোনটি আবার অপরাজেয় বাংলার সাথে। হাকিম চত্বর,মিলন চত্বর, মল চত্বর, ভিসি চত্বর…সব চত্বরে মিলেমিশে একাকার কলাভবনের এলাকাটি।
পলেস্তারা খসা প্রায় হলদেটে দেয়াল, জানালা-দরজার কাঠের পুরনো সবুজ, বাইরের মধুদা’র আবক্ষ ভাস্কর্যে আজো শুকনো ফুলের মালা আর ভেতরের দেয়ালে লম্বা পোর্ট্রেট যেন একটি নির্দিষ্ট সময়কেই এখনো ধারণ করে আছে; এর আবহাওয়াতেই মিশে আছে প্রাচীনত্বের গন্ধ। পাশে অভিজাত ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ, যার প্রাঙ্গনে প্রায়ই সমবেত হয় বাণিজ্যিক স্টলগুলো শিক্ষার্থীদের জন্য অনেক সুযোগ নিয়ে।
কলাভবনের শিক্ষার্থীদের মুখে প্রায়শ ধ্বনিত নাম ‘শ্যাডো’…কবে কখন কীভাবে এর নামকরণ হয়েছে কে জানে! এই ‘শ্যাডো’ হলো মোটামুটি সরু ও লম্বা একটি গলি যার দু’ধারে কর্মকর্তা-কর্মচারী-শিক্ষকদের গাড়ী ও বিপরীতে শিক্ষার্থীদের সাইকেল রাখা জড়ো করে। খাবারের দোকান, ফটোকপির দোকান…অনেক সমৃদ্ধ জায়গা বলা চলে একে।এর কাছাকাছিই ‘ডাকসু’, সাম্যবাদিতার বাণী ও চিত্রে ভরপুর দেয়াল-স্তম্ভ নিয়ে ডাকসু ভবন, এর সিঁড়ি অতি পরিচিত সদস্য কলাভবনের। এর পেছনের অংশটা ঝোপঝাড়ে ভরা, লম্বা শেকড়ের দৃষ্টিতে অরণ্যের অনুভব নিয়ে দু’এক পা তো হাঁটাই যায়!
কলাভবন যেমন সবসময় ভীড় ঘেঁষা, জনমুখর…ঠিক তার বিপরীত নিরিবিলি হাওয়া বয় কার্জন হল আর ফুলার রোডের এলাকাতে। স্মৃতি চিরন্তন পেরিয়েই প্রবেশ ঘটে ফুলার রোডে, প্রায় ফাঁকা চলার পথ মাঝে মাঝে চোখে পড়ে ঈশা খান ও অন্যান্য আবাসিক এলাকা থেকে আগত কিছু গাড়ি। আবাসিক এলাকায় ঢুকে পড়লে ভুলেই যেতে হয় এর একটু দূরে আছে অত ব্যাস্ত মোড়, পথ। কেমন শান্ত সুনিবিড় জায়গা, উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা খেলছে, অলস বসে থাকা কারো কারো। সামনেই বৃটিশ কাউন্সিলের জ্ঞানচর্চার অভিজাত সীমানা, কড়া নজরদারি। আর একটু এগিয়ে গেলেই অদ্ভূত এক চত্বর, স্বাধীনতা সংগ্রাম ভাস্কর্য চত্বর…শামিম শিকদারের নিপুণ হাতে গড়ে তোলা এক একটি মুখাবয়ব-অবয়ব। এই চত্বরে ঢুকে পড়লে তাদের ভীড়ে হারিয়ে যেতেই হয়, সবক’টি মুখ মনে রাখতে ইচ্ছে হয় কিন্তু পারা যায় না।
ভাস্কর্যের কথা উঠলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবগুলো ভাস্কর্যের নাম একবার নিতেই হয়! তিন নেতার মাজার, সপ্তশহীদ স্মৃতিস্তম্ভ, ঘৃণাস্তম্ভ, স্বামী বিবেকানন্দ ভাস্কর্য, স্বোপার্জিত স্বাধীনতা, রাজু ভাস্কর্য, অপরাজেয় বাংলা…কত কত নাম! একেকটি নাম বহন করছে ইতিহাসের একেকটি খন্ডাংশ। জগন্নাথ হলের বুদ্ধমূর্তিটির কথা তো বলাই হলো না! বিশাল এই বুদ্ধমূর্তির সামনে সবার একবার হলেও দাঁড়ানো উচিত, ধ্যানগ্রস্ত বুদ্ধ যেন দর্শককেও আচ্ছন্ন করে ফেলতে চান তার ধ্যানে! ভাল লাগবে।
কলাভবন থেকে বেরুলেই হাকিম চত্ত্বর থেকে একটু দূরে গুরুদুয়ারা নানকশাহী… ইচ্ছে করলেই দেখে নিতে পারেন উপাসনালয়টি। মসজিদের পাশে কবি নজরুলের সমাধি যা দেখলেই মনে পড়ে যায় কবির শেষ ইচ্ছা, “মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই”…শুধু কবিই নন, পাশে আছে দেশের আরেক গুণী সন্তান শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের সমাধিও। আর কার্জন হলের ওদিকটাদে ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সমাধি। দেশের ইতিহাসের কারিগরেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকাতে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।
আরেকটি সম্পূর্ণ পৃথক এলাকা হচ্ছে কার্জন হলের লালচে অভিজাত ভবনের নীরব সৌন্দর্য, শহীদুল্লাহ হলের পুকুরপাড়… সব মিলিয়ে একটি সুনসান পরিবেশ। কার্জন হলের মধ্য দিয়ে হেঁটেই পৌঁছে যেতে পারেন দোয়েল চত্বরে, দুইদিকে এত কুটিরশিল্প আর এত গাছগাছালির সমাহার যে মনে হয় প্রতিদিনই এখানে মেলা বসেছে! সন্ধ্যেবেলা দোয়েল চত্বরের দোকানগুলোর আশেপাশে হাঁটলে একটা অদ্ভূত মায়া এসে যায় রঙ বেরং এর আলোর ছায়ায়। বাঁশ, কাঠ বা মাটির তৈরি ঝুলন্ত ল্যাম্পশেডগুলোতে ওরা সন্ধ্যায় আলো জ্বালে, আর পাশের রাস্তা থেকে দেখে মনে হয় আলোর মেলা বসেছে, একঝাঁক আলো নেমেছে ঝুপ করে!
এই ক্যাম্পাসের সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এর একটি অংশের সাথে অপরটির দারুণ অমিল রয়েছে। আর এই অমিলই একে করে তুলেছে বৈচিত্রপূর্ণ ও সমৃদ্ধ। এর দেয়ালে দেয়ালে এত লেখা আর ছবি রয়েছে যে মনে হয় পথের দু’ধারে দেয়ালগুলোও কথা বলে চলছে। ইট-সুরকি নয় শুধু, এখানে প্রতিনিয়ত প্রাণ বয়ে যায় কর্মে-আলস্যে।
ঢাবির ক্যাম্পাস নিজের মধ্যেই একটি বহুমাত্রা হয়ে আছে। এর সীমানায়, বিস্তৃতিতে, স্বাতন্ত্র্যে যে কাউকেই আকর্ষণ করবে শাহবাগের বেশ বড় এলাকাজুড়ে অবস্থিত এই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসটি।