আপনাকে যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে, পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন শহর কোনগুলো। উত্তরে কোন কোন শহরের নাম বলবেন? রোম, এথেন্স, ব্যাবিলন? কিন্তু সমরকন্দের কথা কখনো ভেবেছেন? উজবেকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং গুরুত্বপূর্ণ এই শহরটি রোম ও ব্যাবিলনের সমসাময়িক সময়ে প্রতিষ্ঠিত। ২,৭৫০ বছরের পুরনো সমরকন্দ প্রত্যক্ষ করেছে ইতিহাসের নানা পট পরিবর্তন। সাক্ষী হয়েছে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট, চেঙ্গিস খান, তৈমুর লংয়ের মতো বিশ্ববিজেতাদের উত্থান-পতনের।
মুসলমানদের অগ্রাভিযানের সময় অনেক মুসলিম বীরের পদধূলিতেও ধন্য হয়েছে সমরকন্দের মাটি। এজন্যই সমরকন্দের সংস্কৃতিতে ইরানি, ভারতীয়, মঙ্গোলিয়সহ প্রাচ্য ও খানিকটা পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ঘটেছে। এছাড়া বিখ্যাত সিল্করোডের কেন্দ্রে অবস্থিত হওয়ায় বিভিন্ন দেশের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্কের সূত্রেও সমরকন্দের সংস্কৃতি সমৃদ্ধি লাভ করেছে। জাঁকজমকপূর্ণ এবং সুসজ্জিত এই নগরীর রয়েছে পর্যটক, কবি, ঐতিহাসিকসহ সব ধরনের মানুষকে আকর্ষণ করার বিস্ময়কর ক্ষমতা। ঐতিহাসিক ও কবিগণ সমরকন্দ সম্পর্কে বলেন, ‘প্রাচ্যের রোম, মুসলিম সাম্রাজ্যের মুক্তা’।
কিংবদন্তীতুল্য এই নগরী কত অসংখ্য ধ্বংস ও পুর্নজাগরণের সম্মুখীন হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। এক শাসক সমরকন্দকে ধ্বংস করেছেন তো আরেক শাসক একে গড়েছেন। সমরকন্দ এভাবে বারবার তার হারানো গৌরব ফিরে পেয়েছে। প্রতিবার হয়ে উঠেছে আরো সুন্দর, আরো মনোরম। আজকের সমরকন্দ নিঃসন্দেহে প্রাচীনত্বের অনন্য আধার বলা যেতে পারে। সমরকন্দের গৌরবজ্জ্বল অতীত আর চোখধাঁধানো স্থাপত্যসম্ভার নিয়েই আজকের আয়োজন।
সমরকন্দ শহরটি অবস্থিত উত্তর-পূর্ব উজবেকিস্তানে, জারাফশান নদীর উপত্যকায়। সমরকন্দের সাথে সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দ ও আরেক ঐতিহাসিক শহর বোখারার। সমরকন্দ থেকে তাজিকিস্তান সীমান্ত মাত্র ৩৫ কি.মি. দূরে।
ইতিহাসের পাতায় সমরকন্দ
সুবিধাজনক ভৌগলিক অবস্থান, অনুকূল জলবায়ু, প্রাকৃতিক ঝর্ণা ও স্বাদুপানির প্রাচুর্য, নিকটবর্তী পর্বতে খাবারের জন্য শিকারের সহজলভ্যতা, প্রবাহিত জারাফশান নদী প্রভৃতি নানা কারণে সমরকন্দে সেই প্রাচীনযুগেই বসতি স্থাপিত হয়েছিল। সমরকন্দ ঠিক কখন স্থাপিত হয়েছিল তা সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে প্রত্মতাত্ত্বিক গবেষণা থেকে ধারণা করা হয়, এটি খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম বা সপ্তম শতকে স্থাপিত হয়েছিল। প্রত্যক্ষদশী এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সেনাদের বর্ণনা থেকে জানা যায়, খ্রিস্টপূর্ব ৩২৯ অব্দে গ্রিক বীর আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট সমরকন্দ জয় করেন। আলেকজান্ডারের আক্রমণের ফলে প্রাথমিকভাবে কিছু ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হলেও গ্রিকদের তত্তাবধানে দ্রুতই সমৃদ্ধির শিখরে আরোহণ করে।
এরপর সমরকন্দ পারস্যের সাসানি সম্রাটদের হস্তগত হয়। উমাইয়্যা খিলাফতের সময়ে আরব মুসলমানরা বীর কুতায়বা বিন মুসলিমের নেতৃত্বে সমরকন্দ অধিকার করেন। এই সময়ে সমরকন্দ পরিণত হয় বৈচিত্র্যময় ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মিলনস্থলে। তবে অনেকেই আরবদের মাধ্যমে ইসলাম ধর্মকে সাদরে গ্রহণ করেন। এরপর ১২২০ সালে সমরকন্দ দেখেছে চেঙ্গিস খানের নির্মম, নির্দয় ধ্বংসযজ্ঞ। তলোয়ার আর আগুন দিয়ে চেঙ্গিস খান ছিন্নভিন্ন করে ফেলে সাজানো গোছানো সমরকন্দ। ১৩৭০ সালে সমরকন্দ বিশ্ববিখ্যাত বীর তৈমুর লংয়ের রাজধানীর মর্যাদা লাভ করে।
তিনি সমরকন্দকে পুনর্নির্মাণ করেন এবং শহরটির সৌন্দর্যবর্ধন করেন। তৈমুর শত্রুর প্রতি নিষ্ঠুর ছিলেন, কিন্তু শিল্পের প্রতি তার মমত্ববোধ ও আকর্ষণ প্রশংসার দাবী রাখে। শৈল্পিক স্থাপত্য দিয়ে তিনি তার রাজধানীকে সাজাতে কুন্ঠিত হননি। তৈমুরের মৃত্যুর পর তার পু্ত্র ও পৌত্রগণ সমরকন্দ শাসন করেন। তৈমুরের নাতি উলুগবেগ প্রায় ৪০ বছর সমরকন্দ শাসন করেন।
তিনিই সম্ভবত সমরকন্দের ইতিহাসে সবচেয়ে শান্তিপ্রিয় শাসক ছিলেন। চৌদ্দ থেকে পনের শতককে বলা যায় সমরকন্দের ইতিহাসের স্বর্ণযুগ। এই সময় নগরীর বেশিরভাগ শক্তিশালী দুর্গ, রাস্তা, সুদৃশ্য গম্বুজ আচ্ছাদিত ভবন গড়ে ওঠে। ১৫১০ সালে উজবেকরা সমরকন্দ দখল করে। তারপর সমরকন্দ রাশিয়ার জারদের শাসনে চলে যায়। ১৯৯১ সালে উজবেকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর এটি উজবেকিস্তানের মধ্যে পড়ে এবং ঐতিহাসিক এই নগরীটি উজবেকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়।
যোগাযোগ ব্যবস্থা
চীনকে ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার সাথে সংযোগ সাধনকারী বিখ্যাত সিল্করোডের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল সমরকন্দ। সেই সূত্রে এটি ছিল মধ্য-এশিয়ার অন্যতম প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র।
এই গুরুত্বপূর্ণ নগরীর সাথে আশেপাশের এলাকার যোগাযোগের জন্য ১৮৮৮ সালের মে মাসে আমুদরিয়া নদীর উপর একটি রেলসেতু নির্মিত হয় এবং সমরকন্দ ট্রান্স-কাস্পিয়ান রেলওয়ের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়। শহরটিতে প্রথম ট্রামলাইন স্থাপিত হয় ২০১৭ সালে। আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার সব উপকরণই রয়েছে প্রাচীন এই শহরটিতে।
ঐতিহ্য
মধ্য-এশিয়ার অন্যান্য শহরের মতোই সমরকন্দেরও দুটি অংশ; নতুন শহর ও পুরাতন শহর। নতুন শহরে রয়েছে প্রশাসনিক ভবন, সাংস্কৃতিক ভবন এবং উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পুরনো অংশে রয়েছে ঐতিহাসিক স্থাপনা, পুরনো দোকান ও পুরনো বাড়ি। তিমুরি রাজবংশের শাসনামলে নির্মিত অসাধারণ স্থাপত্যগুলোর দেখা মেলে শহরের পুরনো অংশে। এখন থাকছে সমরকন্দের ঐতিহাসিক কিছু স্থাপনার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা।
রেজিস্তান
রেজিস্তান স্কয়ার সমরকন্দ শহরের একদম কেন্দ্রে অবস্থিত। এটি শহরের প্রধান চত্বর। প্রাচ্যের চমৎকার স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শন হিসেবে এর খ্যাতি বিশ্বজোড়া। এই চত্বরটির তিনপাশে রয়েছে কেন্দ্রের দিকে মুখ করা তিনটি মাদ্রাসা। মাদ্রাসাগুলোর দু’পাশে রয়েছে নীল রঙের সুদৃশ্য উঁচু মিনার।
ভবনের ছাদে থাকা দৃষ্টিনন্দন নীল মিনারও সহজেই দৃষ্টি কাড়ে। অনন্যসাধারণ এই স্থাপত্যের নির্মাণশৈলী দেখে প্রাচীন নির্মাতাদের প্রতি নিজের অজান্তেই মনে শ্রদ্ধাবোধ জেগে ওঠে। ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও স্থাপত্যশৈলীর কারণে ২০০১ সালে ইউনেস্কো রেজিস্তান চত্বরকে ‘বিশ্বঐতিহ্য’ বলে ঘোষণা করে।
‘রেজিস্তান’ শব্দের অর্থ বালুময় প্রান্তর। আগে আজকের ভবনবেষ্টিত চত্বর এখানে ছিল না, ছিল খোলামাঠ। রাজকীয় ফরমান শোনার জন্য আগে এখানে লোকজন জমায়েত হতো। যেকোনো জাতীয় উৎসবও পালন করা হতো এই চত্বরে। আজকের উজবেকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ চিহ্নে পরিণত হয়েছে রেজিস্তান।
গুর-এ-আমির
গুর-এ-আমির তৈমুর লং এবং তার উত্তরসূরীদের কবরের উপর নির্মিত স্মৃতিসৌধ। প্রথমদিকে এটি ছিল তৈমুরের নাতি মুহাম্মাদ সুলতানের মাদ্রাসা। তার মৃত্যুর পর শোকাহত তৈমুর নাতির মৃতদেহেকে মাদ্রাসার এককোণে সমাহিত করেন এবং তার উপর স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেন।
পরে তৈমুর, তৈমুরের দুই পুত্র এবং নাতি উলুগবেগকেও এখানে শায়িত করা হয়। স্মৃতিসৌধের উজ্জ্বল নীল গম্বুজ এবং নীল টাইলসের কারুকার্য সত্যি আকর্ষণীয়।
রাতে বিচিত্র আলোকসজ্জা এর সৌন্দর্য বহুগুণ বৃদ্ধি করে।
বিবি খানম মসজিদ
বিবি খানম মসজিদ উজবেকিস্তানের অন্যতম বৃহৎ এবং দৃষ্টিনন্দন স্থাপনাগুলোর একটি। বিবি খানম তৈমুরের স্ত্রী সারায় মুলক খানম এর ডাকনাম ছিল। কেউ কেউ বলেন, তৈমুরের ভারত বিজয় অভিযানকে স্মরণীয় করে রাখতে তার স্ত্রী এই মসজিদটি তাকে উপহার দেন। কেউ কেউ বলেন, তৈমুরের নিজের আদেশেই এটি নির্মিত হয়।
যিনিই নির্মাণ করুন না কেন, এর সৌন্দর্য এবং স্থাপত্যশৈলীর বিশেষত্ব সম্পর্কে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। মসজিদের বাইরের অংশে রয়েছে জ্যামিতিক কারুকাজ, ফুলেল নকশার কাজ।
আফ্রাসিয়াব জাদুঘর
ঐতিহাসিক শহর আফ্রাসিয়াবের ধ্বংসাবশেষের পাশে অবস্থিত আফ্রাসিয়াব জাদুঘর ভবন। জাদুঘরের ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো মূলত সমরকন্দ শহর ও এর আশেপাশের এালকার গল্প বলে। সমরকন্দ যখন সোভিয়েত শাসনের অধীনে ছিল তখন এক আর্মেনিয়ান স্থপতির দিকনির্দেশনায় এটি নির্মিত হয়। সমরকন্দের প্রাচীন যুগের তরবারি, তীর-ধনুক, মুদ্রা, পান্ডুলিপি ও বইয়ের বিশাল সংগ্রহ রয়েছে এই জাদুঘরটিতে।
ফিচার ইমেজ – wikipedia