প্রকৃতির শক্তিমত্তা আর অপরূপ সৌন্দর্যের অনন্য নিদর্শন হলো জলপ্রপাত। সাধারণত নদী যখন উচ্চভূমিতে প্রবাহিত হয় তখন নদীর পানির নিচে পতনের ফলে জলপ্রপাত সৃষ্টি হয়। নদীর গতিপথে পাথর থাকলে গতি শ্লথ হয়ে যায়। তখন নদী এ অনাকাঙ্ক্ষিত বাধা দূর করতে পানির নিচে থাকা পাথর ক্ষয় হতে শুরু করে। পাথুরেপৃষ্ঠের উপরের পাথরগুলো বেশি কঠিন হয় আর নিচের পাথরগুলো বেশি নরম হয়। নদীর স্রোত নরম পাথরগুলো কাটতে থাকতে। ফলে উপরের শক্ত পাথরটির চারদিকে শূন্যতার সৃষ্টি হয়। আর ভার দেয়ার মতো কিছু খুঁজে না পেয়ে ঘূর্ণিগতিতে নিচে পড়ে যায়। এর ফলে নদীর প্রবহমান স্রোত তীব্রগতিতে নিচে পড়তে শুরু করে। পড়ে যাওয়া পাথরটি মাটির ক্ষয় প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। এভাবে নদীটি আবারও মসৃণ গতি ফিরে পায়। নদীর স্বাভাবিক গতিপথ পুনরুদ্ধার করার প্রচেষ্টা থেকেই তৈরী হয় চোখ ঝলসানো সুন্দর আর চিত্তাকর্ষক সব প্রাকৃতিক জলপ্রপাত। কোনো কোনো জলপ্রপাত অনেক খাড়া, কোনোটি বিশাল এলাকা নিয়ে বিস্তৃত, কোনোটি আবার কয়েক স্তরে গঠিত। তবে কিছু কিছু জলপ্রপাতের পারিপাশ্বিক পরিবেশ, ভূতাত্ত্বিক গঠন, পানির রং প্রভৃতি অত্যন্ত অদ্ভুত। চলুন আজ তাহলে এমনই কিছু জলপ্রপাত সম্পর্কেই জানা যাক।
ডুবো জলপ্রপাত (মরিশাস)
আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে ভারত মহাসাগরের বুকে অবস্থিত দ্বীপদেশ মরিশাস। মরিশাস দ্বীপটি প্রকৃতির এক বিস্ময়। সবুজ দ্বীপের চারদিক থেকে বেষ্টিত হয়ে আছে ঘন নীল জলরাশিতে। মরিশাসের এই জলে প্রকৃতি লুকিয়ে রেখেছে অপার রহস্য। দ্বীপ ঘিরে বিস্তৃত মহাসমুদ্রের জলরাশিতে রয়েছে একটি বিস্ময়কর প্রাকৃতিক বিভ্রম। দ্বীপের চারপাশের জল দেখলে মনে হয় সাগরের জল নিচে আছড়ে পড়ে যেন একটি জলপ্রপাত তৈরী করেছে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, সাধারণত জলপ্রপাত পতিত হয় মাটিতে বা পাথরে। কিন্তু এই দৃশ্য দেখলে মনে হয় একটি জলপ্রপাত পতিত হয়েছে জলের উপরেই! এটি প্রকৃতপক্ষে কোনো জলপ্রপাত নয়। মহাসাগরের তলদেশে জমে থাকা লবণের সজ্জা এমনই যে তা দেখলে জলপ্রপাত বলে ভুল হয়!
হর্সটেইল জলপ্রপাত (ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র)
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার ইয়োসেমাইট ন্যাশনাল পার্কে অবস্থিত হর্সটেইল জলপ্রপাতটি একটি মৌসুমী জলপ্রপাত। সাধারণত শীতকালে এবং বসন্তের শুরুতে এই জলপ্রপাতটিতে জলের প্রবাহ দেখা যায়। এই জলপ্রপাতে পাশাপাশি প্রবাহিত দুইটি ঝর্ণাধারা রয়েছে। হর্সটেইল প্রপাত যদি ফেব্রুয়ারি মাসে সক্রিয় থাকে এবং আবহাওয়া ভালো থাকে, তাহলে সূর্যাস্তের সময় অস্তগামী সূর্যের আলোয় আলোকিত হয় এই জলপ্রপাতটি। তখন ঝর্ণার জলের রঙ হয় কমলা বা লাল। প্রাকৃতিক এই ঘটনাকে অনেকে বলে থাকেন ‘অগ্নিপ্রপাত’ বা Firefall! কথায় বলে, ঝর্ণা নাকি পাথরের কান্না। এই কথাটির সাথে তাল মিলিয়ে বলা যায়- অন্যান্য ঝর্ণায় পাথরের বুক ফেটে হয়তো কান্না ঝরে আর হর্সটেইলে পাথরের বুক ফেটে আগুন ঝরে!
রুবি জলপ্রপাত (টেনেসী, যুক্তরাষ্ট্র)
যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসী অঙ্গরাজ্যেের লুকআউট পর্বতমালায় অবস্থিত রুবি জলপ্রপাত ১৪৫ ফুট উঁচু একটি ভূগর্ভস্থ জলপ্রপাত। লুকআউট পর্বতমালার ভূতাত্ত্বিক গঠন খুবই অদ্ভুত। এখানে বিচিত্র রকমের পাথরের দেখা মেলে। তবে তার চেয়েও অদ্ভুত পর্বতের গর্ভে থাকা এই জলপ্রপাতটি। যে গুহায় প্রপাতটি অবস্থিত সেটি চুনাপাথরে তৈরী। ভূপৃষ্ঠ থেকে গড়িয়ে আসা সামান্য অম্লীয় জল যখন ভূগর্ভস্থ পানিতে মিশে তখন চুনাপাথরকে ক্ষয় করে গুহার গায়ে ফাটল তৈরী করে। এই ফাটল বড় হয়ে গেলে ঐ পানিপ্রবাহ ঝর্ণা হয়ে গুহার মাটিতে পড়ে। ১,১২০ ফুট মাটির তলায় অবস্থিত এই জলপ্রপাতের জল প্রাকৃতিক ঝর্ণা আর বৃষ্টির পানি থেকে আসে। পানি পড়ে নিচের একটি পুকুরে। এই পানির প্রবাহ গিয়ে পতিত হয় টেনেসী নদীতে।
ব্লাড ফলস (এন্টার্কটিকা)
উত্তর এন্টার্কটিকার ম্যাকমুর্দো ড্রাই ভ্যালিতে অবস্থিত ব্লাড ফলস আয়রন অক্সাইড মিশ্রিত লোনা পানির প্রবাহ যা টেইলর হিমবাহ থেকে প্রবাহিত হয়ে লবণাক্ত পানির লেক বনির বরফঢাকা পৃষ্ঠের উপর দিয়ে বয়ে গেছে। অতিরিক্ত লোনা পানিতে আয়রন অক্সাইড মিশ্রিত থাকায় এই জলপ্রপাতের পানির রং দেখতে একদম রক্তের মতো লাগে। যেন অজানা কোনো জায়গা থেকে ক্রমাগত রক্তের ধারা এসে পড়ছে বরফের গায়ে! এজন্যই এর নাম হয়েছে ব্লাড ফলস। ধারণা করা হয়, ব্লাড ফলসের নোনা পানির উৎস হলো বহুকাল আগে বরফে চাপা পড়া অজানা আয়তনের একটি হিমবাহ। যেখানে জলপ্রপাতটি তৈরী হয়েছে সেখানে বরফের গায়ে বিক্ষিপ্তভাবে তৈরী হওয়া ফাটল দিয়ে সেই হিমবাহের পানিই নির্গত হয়।
বিগার জলপ্রপাত (রোমানিয়া)
কিছু প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখলে আমরা বিশ্বাসই করতে পারি না যে, বাস্তবে তেমন কিছুর অস্তিত্ত্ব থাকা সম্ভব। রোমানিয়ার লেক বিগার এরকমই একটি প্রাকৃতিক বিস্ময়। অনিন্দ্যসুন্দর জলপ্রপাতটি দেখলে মনে হয় এটি যেন কোনো রুপকথার রাজ্য থেকে উঠে এসেছে। মসে আবৃত পাহাড় চূড়া থেকে বিক্ষিপ্তভাবে তৈরী হওয়া বেশ কিছু ভূগর্ভ্যস্থ ঝর্ণার সম্মিলিতভাবে পতিত হওয়া বিগার জলপ্রপাতকে পরিণত করেছে পৃথিবীর অন্যতম সেরা দর্শনীয় স্থানে।
পামুক্কেল জলপ্রপাত (তুরস্ক)
দক্ষিণ-পশ্চিম তুরস্কের মেন্দেরেজ নদীর উপত্যকায় উপত্যকায় অবস্থিত পামুক্কেল জলপ্রপাত তুরস্কের অন্যতম সেরা পর্যটন আকর্ষণ। তুর্কী ‘পামুক্কেল’ শব্দের অর্থ ‘তুলার প্রাসাদ’। এই এলাকা বিখ্যাত মূলত এর দারুণ সব গরম পানির ঝর্ণার কারণে। ঝর্ণার খনিজ লবণ সমৃদ্ধ পানি বয়ে চলার সময় পথে কিছু খনিজ রেখে যায়। এরা জমতে জমতে তৈরী করেছে দৃষ্টিনন্দন সাদা টেরেস। টেরেস জমে ঝর্ণার পানি।
আকাশের নীল রঙ প্রতিফলিত করে এই পানিও নীল রঙ ধারণ করে। আরামদায়ক এই পানিতে চাইলে আপনিও গোসল করতে পারবেন! শ্বেতশুভ্র টেরেসের পটভূমিতে নীল পানি অবিশ্বাস্য সুন্দর দৃশ্যের অবতারণা করে যা দেখলে পরাবাস্তব কোনো দৃশ্য বলে ভুল হয়! এই এলাকায় রয়েছে গ্রীক আর রোমানদের গড়া সুপ্রাচীন শহর ‘হেরাপুলিস’। একইসাথে প্রাকৃতিক ও মানুষের তৈরী আশ্চর্য দেখতে এখানে ভিড় করেন পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষ।
ক্যামেরন জলপ্রপাত (কানাডা)
কানাডার আলবার্টা প্রদেশের ওয়াটারটন ন্যাশনাল পার্কে অবস্থিত ক্যামেরন জলপ্রপাতের পানি সাধারণত স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ হয়ে থাকে। তবে গ্রীষ্মকালে এখানে ঘটতে দেখা যায় অত্যাশ্চর্য একটি প্রাকৃতিক ঘটনা। তখন জলপ্রপাতের নিরীহ সাদা পানি হয়ে যায় টমেটোর রসের মতো লাল! ভারী বর্ষণ হলে এই এলাকায় তৈরী হয় আর্গটেল নামে এক প্রকার পলল মাটি। এই পলিমাটি মিশ্রিত পানি গোলাপী-লাল রঙ ধারণ করে। তখন জলপ্রপাত থেকে পতিত হয় সেই লাল রঙের পানি।
বাতারা জলপ্রপাত (লেবানন)
লেবাননের শহর তান্নুরিন থেকে লাকলক যাওয়ার পথে পড়ে বালা নামক একটি গ্রাম। এই গ্রামে অবস্থিত নয়নাভিরাম বাতারা জলপ্রপাত। এই জলপ্রপাতটি জুরাসিক যুগীয় চুনাপাথরে গড়া একটি গুহায় পতিত হয়েছে। প্রপাতের সামনে আছে তিনটি প্রাকৃতিক সেতু কিংবা বলা যায় প্রপাতটি সেতু তিনটির পেছনে অবস্থিত। ২৫৫ মিটার উপর পড়তে থাকা পানি আর এই নান্দনিক সেতু জলপ্রপাতটিকে আকর্ষণীয় করেছে। জলপ্রপাতটির পানির উৎস বরফ গলা হিমবাহের পানি। তাই মার্চ-এপ্রিল মাসেই কেবল জলপ্রপাতটি সক্রিয় থাকে। লেবানন মাউন্টেন ট্রেইলের অন্তর্গত এই এলাকায় পাহাড়ে চড়া ও হাইকিংয়ের জন্যও বেশি উপযোগী।
প্রকৃতিতে বিস্ময়কর জিনিসের অন্ত নেই। জলপ্রপাতও প্রকৃতির একটি বিস্ময়কর উপাদান। আর এই চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্যের জলপ্রপাতগুলো মানুষের মনে আরও বেশি বিস্ময় জাগায়। বিস্মিত হতে এবং প্রকৃতির অনন্য রুপ-মাধুর্য্যে মগ্ন হতে আপনিও ঘুরে আসতে পারেন জলপ্রপাতগুলো থেকে!