২২১ বি, বেকার স্ট্রিট। ঠিকানাটা খুব চেনা আমাদের সকলেরই। সবচেয়ে জনপ্রিয় এই ঠিকানা। লন্ডনে গিয়েছেন, অথচ ২২১ বি, বেকার স্ট্রিটের ঐ বাড়ির সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কেটে ভেতরে ঢোকেননি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কিন্তু খুবই দুস্কর। খোলা উচিত ছিল অনেক, অনেকদিন আগে। কিন্তু কিংবদন্তিসম ওই গোয়েন্দার স্মৃতি বিজড়িত সংগ্রহশালা চালু হলো ১৯৯০ সালের ২৭ মার্চ।
লন্ডনের যেকোনো স্থান থেকেই ঐ স্থানে যাওয়া যেতে পারে। পাতাল রেলে চেপে বেকার স্ট্রিট যেতে সময়ও তেমন একটা লাগে না। স্টেশনে নামা মাত্রই পর্যটকদের হাতে কেউ এসে গুঁজে দেবে ডিটেকটিভ শার্লক হোমসের সুদৃশ্য ভিজিটিং কার্ড।
পর্যটকদের মনে না থাকলেও ঐ ভিজিটিং কার্ড আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সবাইকে মনে করিয়ে দেয় শার্লক হোমসের গন্তব্যস্থলের কথা। একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে মাদাম তুঁসোর বিশ্বখ্যাত মোমের মিউজিয়াম।
সামনে আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে যেতে থাকলে চোখে পড়বে শার্লক হোমসের পেল্লাই একটি মূর্তি। মাথায় ‘হ্যাট’, হাতে ‘পাইপ’। বেকার স্ট্রিট আন্ডার গ্রাউন্ড স্টেশনের বাইরেও হালে বসেছে শার্লক হোমসের ৯ ফুট উঁচু এক বিশাল মূর্তি।
গত ১০০ বছর ধরে কত ভক্ত চিঠি লিখছেন শার্লক হোমস ও তার বন্ধু ড. ওয়াটসনকে এই ঠিকানায়। এখন সেই গুণগ্রাহীরা স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছেন হোমসের ব্যবহৃত অনেক জিনিসপত্র। জানতে পারছেন, সেই ভিক্টোরীয় আমলে কেমনভাবে থাকতেন সেই প্রবাদ প্রতিম গোয়েন্দা।
আর্থার কোনান ডয়েলের লেখায়, ঐ বাড়িতে হোমস আর ওয়াটসন কাটিয়েছেন ১৮৮১ সাল থেকে ১৯০৪। টানা প্রায় ২৫ বছর।ডয়েলের লেখায় জানা যায়, ঐ বাড়িটি একসময় ছিল সরাইখানা। বাড়ির মালিক ছিলেন জনৈকা মিসেস হাডসন।
শার্লক হোমসের জন্ম ১৮৫৪ সালের ৬ জানুয়ারি। সেকেন্ড এ্যাংলো আফগান যুদ্ধ থেকে ফেরা হোমসের গোয়েন্দাগিরির পট তৈরি হয়েছিল ১৮৮১ সালে। হোমসের গোয়েন্দা কাহিনী প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৯১ সালে একটি সাময়িকীতে। চারটি দীর্ঘ গল্প ও ৫৬টি ছোট গল্প লিখেছেন আর্থার কোনান ডয়েল হোমসের গোয়েন্দাগিরি নিয়ে। সেসবের বিশ্লেষণ হয়েছে নানাভাবে। তবু যেন কল্পকাহিনীর এই নায়ক থেকে গেছেন রহস্যের অদৃশ্য বর্মের আড়ালে।
প্রথম উপন্যাস প্রকাশের পরে তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি। কিন্তু বছর দুয়েক পরে ব্রিটেনের ঘরে ঘরে সমাদৃত হয় শার্লক হোমস। চারটি বাদে সব কটি কাহিনীই হোমসের বন্ধু তথা জীবনীকার ড. জন ওয়াটসনের জবানিতে লেখা এই গোয়েন্দা গল্প। স্যার আর্থার কোনান ডোয়েলের সৃষ্ট চরিত্র শার্লক হোমস ও হোমসের সেই অনবদ্য গল্পকার চিকিৎসক বন্ধু ওয়াটসন যে সত্যিই ছিলেন কি না তা নিয়ে শুরু হয় নানান গবেষণা। বিষয়টি উস্কে দেন লেখক নিজেই।
এক সাক্ষাৎকারে কোনান ডয়েল বলেছিলেন যে, হোমসের চরিত্রটির অনুপ্রেরণা হলেন ডা. জোসেফ বেল, যাঁর অধীনে এডিনবরা রয়্যাল ইনফার্মারিতে করণিক হিসেবে ডয়েল কাজ করতেন। তাই কল্পনার জাল ছড়াতে থাকে প্রতিনিয়ত। স্বয়ং ইংল্যান্ডের বাসিন্দাদেরই একটা বিশাল অংশ মনে করতেন যে শার্লক কেবলই একটি গোয়েন্দা গল্পের চরিত্র নয়, লন্ডন শহরের বেকার স্টিট ধরে হয়তো হোমসের পদচারণা ছিল কোনো এক সময়। ডয়েলের লেখা গল্পের সার্থকতা এখানেই।
প্রতিটি গল্পের বুনট এমন রহস্যময়তায় বিন্যস্ত হতো যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বোঝার উপায় থাকতো না কোনটা বাস্তব আর কোনটা কল্পনা। ‘এ স্টাডি ইন স্কারলেট’, ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চার্স’, ‘দ্য মেমোয়ার্স’, ‘দ্য রিটার্ন’, ‘দ্য ভ্যালি অব ফিয়ার’, ‘হিজ লাস্ট ব্লো’, ‘দ্য কেস বুক’,‘ অ্যাডভেঞ্চার্স অব শার্লক হোমস’- প্রতিটিতে বেশ ক’টি করে গোয়েন্দাকাহিনী। পাঠককে টানটান করে ধরে রাখতে সেসব গোয়েন্দা কাহিনীর জুড়ি মেলা ভার।
সেকালের লন্ডনের একটা স্পষ্ট ছবি পাওয়া যায় আর্থার কোনান ডয়েলের সৃষ্ট এই গোয়েন্দা গল্পে। কুয়াশার চাদরে ঢাকা বেকার স্ট্রিট, পাশে গ্যাস বাতি। এরকম প্রেক্ষিতই তো দুষ্কর্মকারীদের জন্য আদর্শ। আর এই পটভূমিতে একের পর এক জমে উঠেছে হোমসের গোয়েন্দাগিরি।
দীর্ঘ, কৃশকায় হোমস ছিলেন নম্র, কিন্তু কিছুটা নার্ভাস প্রকৃতির। মৃদুভাষী, সঙ্গীত অনুরাগী এবং এতোটাই ভুলোমনের ছিলেন হোমস যে, মাঝে মাঝে খাওয়ার কথাই মনে থাকতো না। কিন্তু তিনি বেশ যুক্তিবোধ সম্পন্ন লোক, যেকোনো ছদ্মবেশ নিতে ওস্তাদ এবং ফরেনসিক বিজ্ঞানে তার দক্ষতা প্রশ্নাতীত।
যুক্তি আর বিজ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে কিনারা করেছেন হরেকরকম রহস্যের। তার অ্যাডভেঞ্চারের সময় সঙ্গী থাকত পিস্তল, পাইপ, ম্যাগনিফাই গ্লাস ও ডিয়ার স্ট্যাকাজ ক্যাপ। যে কোনো বিষয়ে ভয়শুন্য থাকা মানুষের মন বুঝে ফেলা এবং বন্ধুত্ব করা তার সহজাত গুণ। তার সহকারী ড. ওয়াটসন দয়ালু, সৎ এবং বন্ধুবৎসল এক ইংরেজ ভদ্রলোক। গল্প বলায় পারদর্শী, ভাল শ্রোতা, দেহরক্ষী এবং পরামর্শদাতা হিসেবেও সফল। এক-আধ সময় দেখে মনে হতে পারে বড় বোকা। আসলে কিন্তু তা মোটেই নয়।
হোমসের স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটি তৈরি হয়েছিল ১৮১৫ সালে। রাজ-সনদের বিশেষ ধারা বলে বাড়িটিকে ঐতিহ্যপূর্ণ ভবনের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৮৬০ থেকে প্রায় ৭৪ বছর ওই বাড়ি ছিল নিছকই একটি থাকার জায়গা। ১৯৩৪ সালে ‘শার্লক হোমস ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি’ বাড়িটি কিনে তৈরি করে শার্লক হোমস সংগ্রহশালা।
লাইন দিয়ে টিকিট কেটে ঢুকতে হয় শার্লক হোমস সংগ্রহশালায়। বেকার স্টিটের ওপরে দোতলায় একটা ছোট্ট পড়ার ঘর। নীচ থেকে ১৭টি সিঁড়ি ভেঙে দোতলায়। ঘরটি যে সত্যি ছোট, তা ড. ওয়াটসনের লেখাতেই এসেছে একাধিকবার। রাস্তার ধারের দুটি জানালা দিয়ে যেটুকু আলো আসতো। পাশেই হোমসের শোয়ার ঘর।
কেবল ওই ঘর দু’টিতেই নয়, পুরো বাড়িটাতেই সময় যেন থেমে গিয়েছে সেই উনিশ শতকের শেষ সীমায়। সেই ফায়ারপ্লেস, ভিক্টোরীয় যুগের সেই কাচের আলমারি, তাতে সাজিয়ে রাখা হোমসের কাপ-ডিস ও অন্যান্য জিনিসপত্র।
গোয়েন্দা হোমসের হ্যাট মাথায় নিয়ে এবং সেই বিখ্যাত চুরুট মুখে দিয়ে তার চেয়ারে বসে বিদেশিরা প্রায় কেউই ছবি তুলতে ভোলেন না।
বাড়ির তিনতলায় মালকিন মিসেস হাডসনের ঘর। তার পাশে, বাড়ির পিছনদিকে ছিল ড. ওয়াটসনের শোয়ার ঘর। তার ঠিক নীচে ছিল এক চিলতে উঠোন।
ড. ওয়াটসনের ঘরে দর্শনার্থীরা সেই ভিক্টোরীয় আমলের বইপত্র, খবরের কাগজ দেখার সুযোগ পান। সমসাময়িক পেইন্টিং, ফটোগ্রাফের হদিশও মেলে সেখানে। মিসেস হাডসনের ঘরের ঠিক মাঝখানে শার্লক হোমসের ব্রোঞ্জের এক সুদৃশ্য আবক্ষমূর্তি। হোমসকে লেখা নানাজনের চিঠি বা তার ভক্তদের লেখা গোয়েন্দার চিঠির উত্তরের একাংশ দেখা যায় এই ঘরে। বাড়িটির তিনতলারই একপাশে থাকতেন পরিচারিকারা। এখন সেখানে স্মারক বিক্রির দোকান। নানারকম উপহার, চাবির রিং, সিরামিকের জিনিস, তাস, টি-শার্ট, বই, মূর্তি এখানে কিনতে পাওয়া যায়। পর্যটকেরা প্রকাশিত ‘দ্য ডিটেকটিভ ম্যাগাজিন’-এর বিভিন্ন সংখ্যার খোঁজ পাবেন এই সংগ্রহশালায়।
পাওয়া যাবে দ্য হাউন্ড অব দ্য বাস্কারভিলস্’-এর পাঁচটি অডিও-সিডির সেট। এছাড়াও রয়েছে ভেলভেটের কেসে হোমসের ১৪ ক্যারেটের সোনার মেডেল, ১২ ইঞ্চি চওড়া ও ১৫ ইঞ্চি দীর্ঘ পোস্টার, ২ ইঞ্চি দীর্ঘ টেডি বিয়ার। সুদৃশ্য কফি মগের একদিকে গোয়েন্দা হোমসের ছবি, অন্যদিকে তার কোনো উক্তি। শার্লক হোমসের স্মৃতি ধরে রাখতে আগ্রহী দর্শনার্থীরা কেনেন এসব। বাড়ির একতলায় ছিল মিসেস হাডসনের রেস্তোরাঁ। এখনও সেখানে কিনতে পাওয়া যায় ভিক্টোরীয় যুগের সুস্বাদু নানা পদের খাবার।
বিংশ শতকের গোড়ার দিকে শার্লক হোমসকে জার্মানি, অস্ট্রিয়া ও সুইজারল্যান্ডের বাসিন্দাদের কাছে জনপ্রিয় করে তোলেন রিচার্ড গুটস্মিথ। জার্মান ভাষায় শার্লক হোমসের ‘দ্য সাইন অব দ্য ফোর’ হয়েছে ‘ডাস ৎসাইশেন ডেয়ার ফিয়ের’। ‘দ্য হাউন্ড অব দ্য বাস্কারভিল’ হয়েছে ‘ডেয়ার হুন্ড ফন বাস্কারভিল’, ‘স্টাডি ইন স্কারলেট’ হয়েছে ‘স্পেট রাশে’। বইগুলি ছাপিয়েছেন স্টুটগার্টের রবার্ট লুত্জ। বাংলায় অনূদিত হয়েছে শার্লক হোমসের সবকয়টি গল্প।শার্লক হোমসের ওপর প্রতি বছর ক্যালেন্ডার প্রকাশিত হয়। ২০১৭ সালের সুন্দর ক্যালেন্ডারটি ১৭ ইঞ্চি লম্বা, চওড়া ১১ ইঞ্চি।
প্রতিটি মাসের পাতায় সেই মাসের কোন তারিখে হোমসের তদন্ত শুরু এবং শেষ হয়েছিল, তার উল্লেখ রয়েছে। স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের জন্ম-মৃত্যুর দিন সহ উল্লেখযোগ্য বিভিন্ন ঘটনার হদিস পাওয়া যাবে ক্যালেন্ডারটিতে। প্রতিটি পাতার বাঁদিকে রয়েছে বিভিন্ন শহরের ‘শার্লকিয়ান সোসাইটি’র ঠিকানা।
কারো কারো যদি কোনো সমস্যা থাকে, কোনো রহস্য সমাধান করতে হয়, তবে নিশ্চিন্তে চিঠি লেখা যাবে এ ঠিকানায়, যা পৌঁছে যাবে বিশ্বখ্যাত গোয়েন্দার কাছে।
যোগাযোগের ঠিকানা
Mr. Sherlock Hoimes 221 B. Baker Street, London, England, UK