![](https://assets.roar.media/assets/gDhJFtTPsHAtxgfg_rsz_1img_20201227_070131.jpg?w=1200)
সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, “বঙ্গবাসীদের কেবল মাঠ দেখা অভ্যাস, মৃত্তিকার সামান্য স্তূপ দেখলেই তাদের আনন্দ হয়।” সত্যি তো! বঙ্গদেশের মানুষ সমতলে থাকতেই অভ্যস্ত। ছোট্ট পাহাড় যে তাদের মনে ব্যাপক আনন্দের সঞ্চার করবে তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। তাইতো ভ্রমণ পিপাসু মানুষ বারবার ছুটে যায় ছোট্ট পাহাড়ি বম পাড়ার টানে। যদি আপনি পাহাড়প্রেমী হন তবে বান্দরবান হতে পারে সেরা জায়গা। দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ পাহাড় আর তার উপর সাদা মেঘের আনাগোনা বান্দরবানকে করে তুলেছে দেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটন জেলা। তবে, আপনার মনে যদি পর্যটক সত্ত্বার চেয়ে অভিযাত্রী সত্ত্বার প্রভাব বেশি থাকে তবেই আপনি উপভোগ করতে পারবেন বান্দরবানের আসল সৌন্দর্য। নিজের অভিযাত্রী মনের খোরাক মেটাতে বান্দরবানের গহীনে চলে যেতে পারেন বিনা সংকোচে। দুর্গম পাহাড়ি পথ আর অধিবাসীদের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি আপনাকে মুগ্ধ করবে এ কথা বাজি ধরেই বলা যায়। আর দেরি না করে চলুন ঘুরে আসা যাক বান্দরবানের পাহাড়ি পথ থেকে।
![](https://assets.roar.media/assets/k2HOcs9zry5nvfrb_rsz_img_20201227_085307.jpg)
বান্দরবানে বহু পর্যটনকেন্দ্র রয়েছে। সবুজ পাহাড়ের বুকে সাদা মেঘের ভেলায় ঘুরে আসার জন্য সেসবের বিকল্প নেই। যদি রোমাঞ্চের স্বাদ পেতে চান তবে আপনাকে চলে যেতে হবে বান্দরবানের পাহাড়ের গহীনে। রেমাক্রি-নাফাখুম-আমিয়াখুম রুট ট্রেকিংয়ে গেলে পেতে পারেন প্রকৃতির আসল সান্নিধ্য। এর জন্য প্রথমে আপনাকে যেতে হবে বান্দরবানের থনাচি উপজেলায়। বান্দরবান মূল শহর থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরত্বের থানচি বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী উপজেলা। বান্দরবান শহর থেকে স্থানীয় চান্দের গাড়ি বা জিপে করে যাত্রা শুরু করতে হয়।
চান্দের গাড়িতেই শুরু হয় বান্দরবানের প্রকৃতি উপভোগের। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা বেয়ে জিপ যখন ছুটে চলে তখন সবুজের বুকে সাদা মেঘের চাদর পর্যটকের মনে যে উন্মাদনা সৃষ্টি করে তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। ৩ ঘণ্টার চান্দের গাড়ি ভ্রমণ শেষে পৌঁছা যায় থানচি বাজারে। এখান থেকেই আপনার মূল অভিযানের শুরু। বিজিবি ক্যাম্পে নাম তালিকাভুক্ত করে অনুমতি নিতে হয় পাহাড় ট্রেকিং এর জন্য। এখানে বলে রাখি পাহাড়ি রাস্তা কিন্তু সত্যিই দুর্গম। তাই এই রুট ভ্রমণের জন্য একজন স্থানীয় গাইড অবশ্যই সঙ্গে নিতে হবে। গাইড ছাড়া ভ্রমণের অনুমতি দেওয়া হয় না। স্থানীয় পাহাড়ি আদিবাসীরাই গাইডের কাজ করে। তাদের আচার-আচরণ ও আতিথ্য সমতলের মানুষের থেকে একদমই ভিন্নরকম। তারা প্রায় সবাই-ই বেশ বন্ধুসুলভ এবং মানুষ হিসেবে অমায়িক।
![](https://assets.roar.media/assets/qfRAK40pmvu2E6dg_rsz_120201227223608_img_1961.jpg)
থানচি বাজার থেকে গাইড নিয়ে শুরু হয় নৌকায় সাঙ্গু নদী ভ্রমণ। সাঙ্গুর বুক চিড়ে ছোট্ট নৌকা আপনাকে পৌঁছে দেবে রেমাক্রি ফলসে। এরপর শুরু হয় পায়ে হাঁটার অভিযান। সাঙ্গুর উপনদী ধরে থুইস্যাপাড়ার উদ্দেশ্যে শুরু হয় ট্রেকিং। একদিনের পায়ে হাঁটা পথ শেষে সন্ধ্যার পরে পৌঁছা হয় পাহাড়ি ছোট্ট গ্রাম থুইস্যা পাড়ায়। সারাদিনের ট্রেকিং শেষে ক্লান্ত অবসন্ন শরীর এলিয়ে পড়ে বম পাড়ার পাহাড়ি মাচার ঘরে। তার পূর্বেই অবশ্য জুমের ভাত আর পাহাড়ি মুরগি সহযোগে উদরপূর্তির কাজটা সেরে নেওয়া হয়। সেইসাথে শুরু হয় পরের দিনের মানসিক প্রস্তুতি। দুর্গম দেবতা পাহাড় নামা আর আমিয়াখুমের সৌন্দর্য অবলোকনের প্রস্তুতি।
আমিয়াখুম রুটের সবচেয়ে বিপদজনক পাহাড় হলো দেবতা পাহাড়। খুব খাড়া এই পাহাড় ট্রেকিংয়ের জন্যই আসলে অভিযাত্রী পর্যটকদের মূল আকর্ষণ এই রুট। ভয়ংকর রকমের খাড়া, কোথাও পিচ্ছিল, কোথাও রুক্ষ, ঝুরঝুরে মাটি হওয়ায় দেবতা পাহাড় ট্রেকিং আদতে বেশ বিপদজনক। তাই দেবতা পাহাড় ট্রেকিং করার সময় থাকতে হয় খুব সাবধানে। উচ্চতাভীতি থাকলে দেবতা পাহাড়ে না যাওয়াই ভালো। তবে, ভয়কে জয় করার জন্যও এটা হতে পারে ভালো উপায়। গাইডের দেখানো পথ ধরে পাহাড়ের নিচে নেমে যেতে সময় লাগে প্রায় ঘন্টা খানেক।
পাহাড় ট্রেকিংয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার বোধহয় মনোবল। চারপাশের ‘ভয়ংকর সুন্দর’ প্রকৃতির সে চ্যালেঞ্জ যে বেশ রোমাঞ্চকর তা বলতেই হয়। তবে, পর্যটকদের সুবিধার্থে এখন দেবতা পাহাড়ের কিছু ঝুঁকিপূর্ণ অংশে বাঁশ দিয়ে সুরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে। তবু, দেবতা পাহাড়ের বিপদ তাতে কমেনি কোনো অংশে। ট্রেকিংয়ের মাঝে হঠাৎই সামনের খাড়া উঁচু পাথুরে পাহাড় পর্যটকের মনে যে বিষাদমাখা আনন্দের অনুভূতি সৃষ্টি করবে তার তুলনা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ভয়ংকর সুন্দর বুঝি একেই বলে! কিন্তু, কথায় আছে কষ্ট করলে কেষ্ট মেলে। দেবতা পাহাড় যদি কষ্ট হয়, তবে তার কেষ্টটা আমিয়াখুম জলপ্রপাত। দেবতা পাহাড়ের বিপদসংকুল ও রোমাঞ্চকর অভিযান শেষে প্রকৃতি আপনার জন্য সাজিয়ে রেখেছে দেশের সবচেয়ে সুন্দর জলপ্রপাত!
![](https://assets.roar.media/assets/KK9nP804U4QQgTbm_rsz_20201229021134_img_2304_edited.jpg)
আমিয়াখুম দেশের অন্যতম সুন্দর জলপ্রপাত। পাথুরে নদীর বুক চিড়ে বেয়ে আসা সাদা ফেনার পানি যখন মাধ্যাকর্ষণের আবদার মেটাতে বড় পাথরের বুকে আছড়ে পড়ে তখন যে মোহনীয় পরিবেশের সৃষ্টি হয় তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আমিয়াখুমের জলধারা যেকোনো পর্যটকের মনে দাগ কেটে রাখবে এতটুকু বাজি ধরে বলা যায়। প্রকৃতি যেন তার সবটুকু সৌন্দর্য ঢেলে দিয়ে সৃষ্টি করেছে এই জলপ্রপাত।
জলপ্রপাতের সৌন্দর্যের পাশাপাশি মোহনীয় এর চারপাশের পরিবেশ। পাহাড়ি বুনো পরিবেশে জলপ্রপাতের শব্দ যে আদিম উন্মাদনা সৃষ্টি করে তার নেশায় বুদ হয়ে কাটিয়ে দেওয়া যায় ঘণ্টার পর ঘন্টা। নিজের সবটুকু বিস্ময় উজাড় করে দিয়ে পর্যটকরা অবলোকন করেন আমিয়াখুমের জলপ্রপাত। পাহাড়ি রাস্তায় টানা ট্রেকিং আর খাড়া দেবতা পাহাড় নামার যে ক্লান্তি, তা নিমিষেই দুর হয়ে যায় যখন চোখের সামনে ধরা দেয় আমিয়াখুমের স্বচ্ছ সাদা জলধারা। প্রকৃতপক্ষে, আমিয়াখুমের সৌন্দর্য মুখে বলে কিংবা ছবিতে দেখে অনুভব করা সম্ভব নয়। প্রপাতের পাথরের উপর বসে পানির কলকল শব্দে কিছু সময় কাটালেই শুধু বুঝতে পারা যায় প্রকৃতি কত সুন্দর!
![](https://assets.roar.media/assets/VoQl5fFC6nzSITNc_rsz_20201228222320_img_2057.jpg)
দেবতা পাহাড় ট্রেকিং করে নামার পর আমিয়াখুম ছাড়াও ভেলাখুম ও সাতভাই খুম যাওয়া যায়। দেবতা পাহাড় থেকে নেমে ডানদিকে বাঁশের ভেলায় শান্ত, নিস্তব্ধ পরিবেশে কিছুদূর এগিয়ে গেলেই ভেলামুখ। এখানেও রয়েছে একটি জলপ্রপাত। আর দেবতা পাহাড়ের বাম দিকে আমিয়াখুম ডিঙিয়ে সামান্য এগোলেই সাতভাই খুম। সবমিলিয়ে ছোট-বড় পাথর আর স্বচ্ছ পানির ধারা আপনাকে উপহার দিতে পারে দারুণ এক স্বাদ। আর সেই সাথে স্থানীয় পাহাড়িদের বৈচিত্র্যময় জীবনযাপনের কৃষ্টি পাবেন বোনাস হিসেবে।
শহরের যান্ত্রিকতা থেকে বহু দূরে আদিবাসী পল্লীতে হারিয়ে যাওয়ার সুবর্ণ সুযোগ নিয়ে অপেক্ষা করছে দেশের দক্ষিণের এই পার্বত্য জেলা। বছরের একেবারে শেষ সপ্তাহে ভ্রমণে গেলে পেয়ে যাবেন কিছু আদিবাসী উৎসবও। বড়দিনের উৎসবেও অংশ নিতে পারবেন যদি ভাগ্য প্রসন্ন থাকে। বৈচিত্র্যময় পাহাড়ি জীবন উপভোগ আর সবুজ পাথুরে পাহাড়ের বুকে অভিযানের জন্য প্রকৃতি আপনাকে হাতছানি দিচ্ছে। আপনি প্রস্তুত তো?
![](https://assets.roar.media/assets/C2D8E59DeVVe0uzK_rsz_11img_20201228_163745.jpg)
![](https://assets.roar.media/assets/HedHvictm5DChz5J_rsz_20201227205029_img_1899.jpg)
![](https://assets.roar.media/assets/U6d9iRTHwSM7c7Vi_rsz_20201227221543_img_1914.jpg)