আমি রিবাতেজো প্রদেশের ছোট্ট গ্রাম জিনহাগাতে জন্ম নিয়েছিলাম। আমার বাবা-মা ছিলেন ভূমিহীন কৃষক। আমাদের আবাসস্থল ছিল লিসবন শহর থেকে প্রায় একশ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে আলমন্ডা নদীর ডান পাশে। আমার বাবার নাম জোসে ডি সোসা এবং মাতার নাম মারিয়া দ্য পাইডেড। তালিকাভুক্তির আগপর্যন্ত আমার নিজের নামও ছিল জোসে ডি সোসা, এটা আমার বাবার ইচ্ছাতেই হয়েছিল। পরবর্তীতে আমি আমার নামের সাথে ডাকনাম ‘সারামাগো’ যোগ করি এবং সেই নামেই গ্রামের মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে উঠি। জানিয়ে রাখা ভালো যে, সারামাগো একটি বন্য ভেষজ উদ্ভিদের নাম, সে সময়ে গরীব মানুষের জীবন রক্ষায়; পুষ্টিকর খাদ্য হিসাবে এই উদ্ভিদটি ব্যবহৃত হতো। আমার বয়স যখন সাত বছর, তখন আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি শনাক্তকরণ নথিতে আমার নাম তালিকাভুক্ত করতে হয়, তখন থেকেই আমার নাম হয়ে যায় হোসে ডি সোসা সারামাগো …।
নিজের পরিচয় নিজে এভাবেই তুলে ধরছিলেন ১৯৯৮ সালে সাহিত্যে নোবেল পাওয়া জগদ্বিখ্যাত ঔপন্যাসিক হোসে সারামাগো। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯২২ সালে। এই পর্তুগিজ লেখকের বহু গ্রন্থ বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন প্রভাবশালী ও স্বাধীনচেতা লেখক হিসেবে। তার শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘ব্লাইন্ডনেস’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৫ সালে। মূল পর্তুগিজ ভাষা থেকে বইটি ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয় ১৯৯৭ সালে।
জনপ্রিয় এই সাহিত্যিকের বই অনূদিত হয়েছে ২৫টিরও বেশি ভাষায়। সারা বিশ্বে তার বইসমূহ ২০ লাখেরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছে। আদর্শগতভাবে তিনি ছিলেন উদার সমাজতান্ত্রিক। উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে লেখালেখির কারণে তিনি বিভিন্ন সময়ে গোঁড়া ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সমালোচনার শিকার হয়েছেন, বিশেষ করে ক্যাথলিক চার্চ কর্তৃক। রাজনৈতিক পরিসরেও তিনি ছিলেন প্রতিবাদী লেখক, ফলে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ড (আইএমএফ) এর বেশ কিছু কর্মকাণ্ডেরও তিনি বিরোধিতা করেছিলেন। তাই এসব প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেই তিনি সর্বাধিক সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছিলেন। একপর্যায়ে তার লেখালেখির ওপর নিজ জন্মভূমি পর্তুগালের সরকার ও রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ নিয়ে মনঃক্ষুণ্ণ হন। এমনকি ১৯৯২ সালে তার রচিত গ্রন্থ ‘দি গসপেল অ্যাকর্ডিং টু জিসাস ক্রাইস্ট’ ইউরোপের প্রভাবশালী ‘অ্যারিস্টিয়ন পুরস্কার’ এর সংক্ষিপ্ত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হলে পর্তুগালের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অ্যানিবাল কভাকো সিলভা তা প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন। সরকারের এমন ব্যবহারের ফলে তিনি স্বেচ্ছা নির্বাসন গ্রহণ করে স্প্যানিশ দ্বীপ লানজারোতে চলে যান। এবং সেখানেই নির্বাসিত থাকা অবস্থায় ২০১০ সালের ১৮ জুন তিনি মারা যান।
অভাবের মধ্য দিয়েই বড় হয়ে ওঠেন হোসে সারামাগো। এমনকি তাদের বসবাসের জন্য ভালো ঘরও ছিল না। ১৯২৪ সালে তার বাবা লিসবনে চলে যান এবং পুলিশের চাকরি নেন। এই চাকরির জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে কোনো শর্ত ছিল না, ফলে তার বাবা চাকরিটি পান। এরপর তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়। তবে সে বছরই তার বড় ভাই মারা যাওয়ার কারণে তাদের পরিবারে শোক নেমে আসে। এরপর তারা লিসবনে আরেকটি পরিবারের সাথে যৌথভাবে একটি ছোট বাড়িতে বসবাস করার সক্ষমতা অর্জন করেন। তখন হোসে সারামাগোর বয়স ১৩ বছর।
অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে তিনি পর্তুগালের ‘গ্রামার স্কুল’ বা মূলধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়তে সক্ষম হননি, ফলে তিনি টেকনিক্যাল স্কুলে ভর্তি হন। সেখানে তিনি তার প্রতিভা তুলে ধরে সবাইকে চমকে দিতে থাকেন। টেকনিক্যাল স্কুল থেকে পড়াশোনা শেষ করে তিনি প্রথমে একটি গাড়ির কোম্পানিতে দু’বছর চাকরি করেন।
১৯৪৪ সালে তিনি ইলদা রেইস নামে এক নারীকে বিয়ে করেন। সে বছরই তিনি সিভিল সার্জন হিসেবে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। তার স্ত্রীও রেলওয়েতে টাইপিস্ট হিসেবে চাকরি পেয়ে যান। এরপর ভালোই কাটতে থাকে। ১৯৪৭ সালে তাদের একমাত্র সন্তান ভায়লান্তে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৯৮ সালে তার স্ত্রী মারা যান।
একপর্যায়ে তিনি একটি টেকনিক্যাল স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। কিন্তু রাজনৈতিক কিছু কারণে চাকরি হারাতে হয়। তার নিজের ভাষায়-
রাজনৈতিক কারণে ১৯৪৯ সালে আমাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। তখন পর্যন্ত আমি একটি টেকনিক্যাল স্কুলের শিক্ষক ছিলাম। তারপর আমি একটি দাতব্য কোম্পানিতে চাকরি গ্রহণ করি, সেখানে আমি ম্যানেজার পদে নিয়োগ পাই।
একবছর পরই তিনি তার চাকরি পরিবর্তন করেন। ১৯৫০ সালে তিনি একটি প্রকাশনা সংস্থায় চাকরি গ্রহণ করেন। এটি তার জন্য পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। প্রকাশনা সংস্থায় চাকরির সুবাদে অনেক লেখক, সাহিত্যিক ও প্রকাশকের সাথে তার পরিচয় ঘটে। তিনি সাহিত্যের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। তখন থেকেই তিনি সাহিত্যের অনুবাদ শুরু করেন। তারপর নিজেই হয়ে ওঠেন একজন বিখ্যাত সাহিত্যিক। এরপর তিনি সাংবাদিকতা শুরু করেন এবং একপর্যায়ে একটি পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্বও পালন করেন।
তার অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ‘দি গসপেল অ্যাকর্ডিং টু জিসাস ক্রাইস্ট’, ‘দি হিস্ট্রি অব দি সিজ অব লিসবন’, ‘দি স্টোন র্যাফেট’, ‘দি ইয়ার অব দ্য ডেথ অব রিকার্ডো রিস’, ‘দি টেইল অব দি আননোন আইল্যান্ড’, ‘দি ম্যানুয়াল অব পেইন্টিং অ্যান্ড ক্যালিগ্রাফি’, ‘বালথাজার ও ব্লাইমুন্ডো’, ‘সিইঙ্গ’, ‘দি ডাবল’, ‘দি কেইভ’, ‘অল দি নেইমস’, ‘ডেথ অ্যাট ইন্টারভালস’ প্রভৃতি। উপন্যাসের পাশাপাশি তিনি অনেক কবিতাও রচনা করেছেন। তার সর্বপ্রথম বই ‘তেরা ডো পিকাডো’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪৭ সালে এবং সর্বশেষ বই ‘চাইন’ প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৯ সালে।
‘ব্লাইন্ডনেস’ তার একটি অসামান্য উপন্যাস। এর বিষয়বস্তু অগতানুগতিক, বিচিত্র ও বিস্ময়কর। এর রচনাশৈলী অভিনব এবং অনুসন্ধানধর্মী। আকস্মিকভাবে একটি শহর অভূতপূর্ব মহামারীতে আক্রান্ত হয়। কোনো কারণ ছাড়াই একের পর এক মানুষ অন্ধ হয়ে যেতে থাকে। চোখে কোনো ক্ষত হয় না, কোনো ব্যথা হয় না, কারো চোখ লালও হয় না, একমুহূর্ত আগে যার চোখে সবকিছু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল, পরের মুহূর্তে সেই মানুষটিই অন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এবং এই অন্ধত্বের চরিত্র ও প্রকৃতিও বিচিত্র। আমরা জানি যে, অন্ধ মানুষের সামনে সবকিছু কালো এবং অন্ধকার হয়ে যায়, কিন্তু এখানে অন্ধ মানুষটি সবকিছু দেখে সাদা, তার চোখ যেন একটি দুধের সাগরে ডুবিয়ে রাখা হয়েছে।
ফলে এই রোগের নামকরণ করা হয়েছে ‘শ্বেত অন্ধত্ব’। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এই রোগের উল্লেখ নেই। রোগটি ছোঁয়াচে কি না, তা-ও কেউ বলতে পারছে না। কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে কঠোর সাবধানতা অবলম্বন করতে শুরু করছে। যারা ইতোমধ্যেই এই শ্বেত অন্ধত্ব রোগে আক্রান্ত হয়েছে, তারা সহ যারা এসব লোকের কোনো প্রকার সান্নিধ্যে এসেছে ও যাদেরকে সংক্রমিত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে, এদের সবাইকে বিচ্ছিন্ন করে একটি পরিত্যক্ত মানসিক হাসপাতালে অন্তরীণ করে রাখা হয়েছে।
কিন্তু সেখানে নানা অপ্রত্যাশিত ও ভয়ঙ্কর সব ঘটনা ঘটতে থাকে। একদল অপরাধী শক্তি ওই অসহায় অন্ধ মানুষগুলোকে বন্দি করে রাখে এবং তাদের খাবার চুরি করে খেয়ে ফেলে, মেয়েদের সম্ভ্রমহানি করে। এই দুঃস্বপ্নতাড়িত বিভীষিকাময় দৃশ্যের চাক্ষুষ সাক্ষী মাত্র একজন- সে বাকি সাতজন অন্ধ মানুষকে পথ দেখায়। এদের মধ্যে বিশেষভাবে একজন মাতৃহীন ছোট বালক, একজন কালো চশমা পরা মেয়ে, একজন গাড়ি চোর ও একজন ডাক্তারের চরিত্র উল্লেখ্য। দুঃস্বপ্নের ওই চাক্ষুষ সাক্ষী সাতজন অপরিচিত মানুষকে নির্জন রাস্তা দিয়ে নিয়ে চলতে থাকে। শোভাযাত্রাটিও একটি উদ্ভট, অপার্থিব, রহস্যময় রূপ ধারণ করে আর তার চারপাশের দৃশ্যও হয়ে ওঠে মর্মবিদারী।
‘অন্ধত্ব’ মূলত একটি রূপকধর্মী কাহিনী। নিঃস্ব হয়ে যাওয়া, কোনোকিছু বুঝতে পারার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলা, পরস্পরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া তথা বর্তমান সময়ের এক ভয়াবহতাকে সারামাগো অসামান্য দক্ষতার সাথে তার এ উপন্যাসে চিত্রায়িত করেছেন। এই উপন্যাসে মানুষের নিকৃষ্টতম ক্ষুধা ও প্রবণতাসমূহ যেমন দক্ষতার সঙ্গে তিনি রূপায়িত করেছেন, ঠিক তেমনি এই সত্যটিকেও রূপায়িত করেছেন যে শেষপর্যন্ত মানুষের মধ্যেই আছে এক অবিনাশী শক্তি, যা সবকিছুকে মুক্তি, আনন্দ ও উল্লাসের সমুদ্রে ভাসিয়ে দিতে পারে।
সারামাগোর লেখার ভঙ্গি পাঠককে অপ্রতিরোধ্যভাবে আকর্ষিত করে। তার ভাষায় সূক্ষ্ম কারুকাজ ও বর্ণনায় শৈল্পিক ভঙ্গি পাঠককে অভিভূত হতে বাধ্য করে। আর তার এ সকল গভীর দৃষ্টিভঙ্গির পেছনে যে করুণা আর মানবিকতা বোধ পাঠক লক্ষ্য করেন তা-ও তার উপন্যাসকে একটি স্বতন্ত্র মাত্রায় ভূষিত করে। সমালোচকের বিবেচনায় ‘ব্লাইন্ডনেস’ এর আকর্ষণের মূলে রয়েছে উপন্যাসটির বিশেষ কণ্ঠস্বর। এখানে লেখক-পাঠকের মধ্যে একটি রসসমৃদ্ধ আদান-প্রদান চলতে থাকে। যার সঙ্গে জড়িয়ে যায় বর্তমানকালের যাবতীয় আতিশায্যের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ক্রোধ।
এই উপন্যাস অবলম্বনে ২০০৮ সালে ‘ব্লাইন্ডনেস’ নামে একটি চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়। নির্মাণ করেন ফার্নেন্দো মিরিয়ালস এবং অভিনয় করেন মার্ক রুফালো ও জুলিয়ান মুর।
বর্তমানে সময়ের একটি সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘স্লো ফয়িং অন সিডারস’ গ্রন্থের লেখক ডেভিড গুটারসন এ উপন্যাসটি সম্পর্কে বলেছেন-
গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ‘লাভ ইন দি টাইম অব কলেরা’র পর আমি যেসব উপন্যাস পড়েছি তার মধ্যে সারামাগোর ‘ব্লাইন্ডনেস’ উপন্যাসটি সর্বোত্তম। এই উপন্যাসে আছে অসামান্য দক্ষতা ও শক্তি।… সকল শ্রেষ্ঠ গ্রন্থের মতো এই গ্রন্থও একই সঙ্গে সমকালীন ও কালাতীত। সারামাগোর ‘ব্লাইন্ডনেস’ সন্দেহাতীতভাবে অসামান্য দৃষ্টিশক্তিরই ফসল।
রাজনৈতিক কারণে কয়েক দফায় হোসে সারামাগো চাকরিচ্যুত হয়েছেন। তবুও মাথা নত করেননি। লেখালেখি অব্যাহত রেখেছেন নিজ শক্তিতে। বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধেও ছিলেন সরব; বিশেষত ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি অত্যাচারের প্রতিবাদে করেছেন আমৃত্যু।
ফিচার ইমেজ- thedailybeast.com