“আমি স্বপ্ন আঁকি না, আমি আমার নিজের বাস্তবতাকে আঁকি।”
তুলির অনন্য আঁচড়ে যে ফ্রিদা এঁকেছেন নিজের জোড়া ভ্রূ আর পুরুষালী গোঁফ, সেই ফ্রিদাই আবার নিজের জীবন থেকে গোপন করেছেন তিন তিনটি বছর। ১৯০৭ সালে মেক্সিকোর কয়োকান শহরে জন্ম নেয়া ফ্রিদা দাবি করতেন যে তিনি ১৯১০ সালে জন্ম নিয়েছেন, যাতে ভক্তরা মেক্সিকোর বিপ্লবের সাথে সহজেই তার সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে! তিনি নিজেই বলেছেন, সেই সময় গুলিবর্ষণ শুরু হলেই তাদের মা তাদের নিয়ে লুকিয়ে পড়তেন, অনেক সময় বিদ্রোহীরা তাদের উঠোনে সাহায্য চাইতে আসতেন। ফ্রিদার মা তখন বিদ্রোহীদের জন্য খাবারের আয়োজনে লেগে যেতেন!
পুরো নাম তার ম্যাগদালিনা কারম্যান ফ্রিদা কাহলো ই ক্যালদেরন। পিতা গিলেরমো কাহলো (১৮৭২-১৯৪১) যখন জার্মানির ফোরজেইম শহরে চিত্রশিল্পী-স্বর্ণকার জ্যাকব হেনরিখ কাহলো আর হেনরিয়েট ই কফম্যান এর ঘরে জন্ম নেন, তখন তার নাম রাখা হয়েছিল কার্ল উইলহেম কাহলো। উনিশ বছর বয়সে তিনি জার্মানি থেকে মেক্সিকো আসেন, সেই সাথে বদলে ফেলেন নিজের নামও।
যদিও ফ্রিদা দাবি করতেন তার বাবা ইহুদী-হাংগেরিয়ান বংশোদ্ভূত, ২০০৫ সালে গিলেরমোকে নিয়ে লেখা একটি বইয়ে তার জার্মান মূলের ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য প্রমাণিত হয়। ১৯৩০ সালে জার্মানীতে যখন নাৎসিবাদিতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে, তখন ফ্রিদা নিজের নামের বানান লিখা শুরু করেন Frieda, যা জার্মান Frieden (শান্তি) শব্দটির অপভ্রংশ!
ফ্রিদার মা মাটিলডা ক্যালদেরন ই গঞ্জালেজ ছিলেন একজন স্প্যানিশ-নেটিভ আমেরিকান ক্যাথলিক নারী। গিলেরমোর প্রথম স্ত্রী তাদের দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যুবরণের পর মাটিলডাকে বিয়ে করেন তিনি। বিবাহিত জীবনে সুখী না হলেও জন্ম দিয়েছিলেন চারটি সন্তানের, যাদের মাঝে ফ্রিদা ছিলেন তৃতীয়। ফ্রিদা সবসময়েই বলতেন, তিনি বেড়ে উঠেছেন নারীদের পৃথিবীতে।
ছয় বছর বয়সে ফ্রিদা পোলিওতে আক্রান্ত হন, যার ফলে তার ডান পা, বাঁ পা থেকে সরু আর খাটো হয়ে যায়। এই বিষয়টি ঢেকে রাখতে তিনি সবসময় লম্বা স্কার্ট পরতেন । এছাড়াও তার স্পাইনা বাইফিডা নামের একধরনের জন্মগত রোগ ছিল, যা তার মেরুদণ্ড আর পায়ের বৃদ্ধি ব্যাহত করে। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকার পরেও কৈশোরে তিনি বক্সিংসহ বিভিন্ন খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করতেন।
ফ্রিদা তার প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার বাবার খুব কাছাকাছি ছিলেন, তাকে বিভিন্ন সময় স্টুডিওতে বিভিন্ন কাজে সহযোগিতাও করতেন, যেখানে তিনি ডিটেইলিংয়ের জন্য তীক্ষ্ণ দৃষ্টি অর্জন করেন। তবে তার মূল আকর্ষণ ছিল বিজ্ঞান। মেডিক্যাল সায়েন্সে উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে ১৯২২ সালে মেক্সিকোর অন্যতম প্রিমিয়ার স্কুল প্রিপারেটোরিয়াতে ভর্তি হন ফ্রিদা। গোটা স্কুলে মাত্র পঁয়ত্রিশজন মেয়ের একজন ছিলেন তিনি।
স্কুলে ভর্তির পরপরই একটি দলে ভিড়ে যান তিনি, পড়ে যান দলনেতা আলেজান্দ্রো গোমেজ আরিয়াসের প্রেমে। সেই সময়ে মেক্সিকান বিদ্রোহ অব্যাহত ছিল বলে তিনি মেক্সিকোর রাস্তাঘাটে সহিংস সশস্ত্র সংগ্রামের সাক্ষী হয়ে থাকেন। সেই সময় স্কুলের অডিটোরিয়ামের দেয়ালে কাজ করতে আসেন বিখ্যাত শিল্পী দিয়েগো রিভেরা, যার সান্নিধ্যে ফ্রিদার ভিতরের শিল্পীসত্ত্বা আবার জেগে ওঠে।
১৯২৫ সালে একটি দুর্ভাগ্যজনক বাস দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হন তিনি। আঘাত এতই গুরুতর ছিল যে এর জন্য জীবদ্দশায় মোট ত্রিশবার অস্ত্রোপচার করতে হয় তার। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই দুর্ঘটনার পর তার মেডিক্যাল পড়াশোনার ইতি ঘটে।
একটি দরজা যখন বন্ধ হয়, সম্ভাবনার হাজার দুয়ার তখন খুলে যায়। আরোগ্য লাভের সময়টাতে ফ্রিদা ছবি আঁকতে শুরু করেন। পুরাতন শিল্পীদের কাজ নিয়ে পড়াশোনা করেন। তিন মাসের অচলাবস্থায় আঁকা নিজের প্রতিকৃতি তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে। তার মা তাকে বিশেষ ধরনের ইজেল বানিয়ে দিয়েছিলেন, যাতে শুয়ে থেকেই ছবি আঁকা যেত। বাবার থেকে পেয়েছিলেন রঙ আর তুলি।
সেই সময়ে আঁকা আত্মপ্রতিকৃতি সেলফ পোর্ট্রেট ‘ওয়ারিং অ্যা ভেলভেট ড্রেস (১৯২৬)’-এ কাহলো অন্ধকার পটভূমিতে ঘোলাটে মসৃণ আঁচড়ে নিজের কোমর অবধি রাজকীয় ধাঁচের প্রতিকৃতি আঁকেন। মোটামুটিভাবে বিমূর্ত হলেও পেইন্টিংয়ে তাঁর মুখাবয়বের কোমল প্রকাশ তাঁর বাস্তবতাপ্রিয়তাকে প্রকাশ করে। ছবিতে তার নির্বিকার দৃষ্টি, অপেক্ষাকৃতভাবে অতিমাত্রায় দীর্ঘ করে আঁকা গ্রীবা আর আঙুল ম্যানারিস্ট শিল্পি ব্রোঞ্জিওর প্রতি তার অনুরাগ স্পষ্ট করে তোলে।
“আমি নিজেকেই আঁকি, কেননা প্রায়শই আমি একা থাকি, আর বিষয়বস্তুগুলোর মাঝে
নিজেকেই সবচেয়ে ভালো জানি।”
আরোগ্য লাভের পর ফ্রিদা মেক্সিকান কমিউনিস্ট পার্টি (PCM) এ যোগ দেন। সেখানেই তার সাথে আরেকবার দেখা হয়ে যায় দিয়েগো রিভেরার। ফ্রিদা তার কাজে অনুপ্রেরণার জন্য রিভেরার দ্বারপ্রান্তে আসেন। রিভেয়া দ্রুত ফ্রিদার প্রতিভা বুঝতে পারেন, আর তাকে উৎসাহিত করেন। তাদের এই পারস্পরিক বোঝাপড়া, ভালোলাগা এবং ভালোবাসায় গড়াতে সময় নেয় না। ১৯২৯ সালে মায়ের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও বিশ বছরের বড় দিয়েগো রিভেরার তৃতীয় স্ত্রী হিসেবে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ফ্রিদা। ফ্রিদার বাবা এই বিয়েকে উপমা দিয়েছিলেন ‘হাতি ও ঘুঘুর বিয়ে’ বলে।
বিয়ের পরে ফ্রিদার ছবি আঁকার নিজস্ব ভঙ্গিতে আসে পরিবর্তন। ঐতিহ্যবাহী তিহুয়ানা পোশাক হয়ে ওঠে তার ট্রেডমার্ক। এই পোশাকে ছিল ফুলেল পাগড়ি, ঢোলা ব্লাউজ, স্বর্ণালংকার এবং এলোমেলো ফোলা স্কার্ট। তার পেইন্টিং ‘ফ্রিদা এন্ড দিয়েগো রিভেরা (১৯৩০)’-এ কেবল তাঁর নতুন পোশাক নয়, বরং মেক্সিকান লোকশিল্পের প্রতি তার আগ্রহও প্রকাশ পায়। এই ছবিটি তার আগের যেকোনো ছবি থেকে অনেক বেশি বিমূর্ত। এই ছবিতে রিভেরার অবস্থান, ফ্রিদার গায়ের রঙ পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়, রিভেরা ফ্রিদাকে কেমন দেখতে চান: একজন ঐতিহ্যবাহী মেক্সিকান স্ত্রী।
এই কাজটি ফ্রিদা করেন রিভেরার সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণের সময় (১৯৩০-৩৩)। এ সময় রিভেরা সরকারিভাবে মূর্তি বানানোর কমিশন পেয়েছিলেন। এই সময়টিতে ফ্রিদা বেশ কয়েকবার গর্ভধারণ করেন, প্রতিবারই গর্ভপাত হয়। ডেট্রয়েট শহরে আরেকটি গর্ভপাতের পর নিজের মাকেও হারিয়ে ফ্রিদা তার জীবনের সবচাইতে যন্ত্রণাদায়ক কাজগুলো করেন। ‘হেনরি ফোর্ড হসপিটাল’ (১৯৩২) ছবিতে তিনি অনুর্বর উষর ভূমি আঁকেন আর ‘মাই বার্থ’ (১৯৩২) এ এক নারীর সন্তান জন্মদানের দৃশ্য আঁকেন।
কাহলো গভীরভাবে আদিবাসী মেক্সিকান সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন, যা তাঁর উজ্জ্বল রং এবং নাটকীয় প্রতীকবাদের ব্যবহারে স্পষ্ট হয়। ছবিতে তিনি প্রায়শই প্রতীকী বানর অন্তর্ভুক্ত করতেন। মেক্সিকান পৌরাণিক কাহিনীতে বানর কামের প্রতীক, তবুও কাহলো তাদেরকে চিত্রিত করেছেন প্রতিরক্ষামূলক প্রতীক হিসেবে। খ্রিস্টীয় এবং ইহুদি বিষয় প্রায়ই তার কাজের মধ্যে চিত্রিত হতে দেখা গেছে। তিনি আর্কাইটিস্ট রেডিংয়ের সাথে ক্লাসিক ধর্মীয় মেক্সিকান ঐতিহ্যের উপাদানগুলোকে সংযুক্ত করেছিলেন।
১৯৩৩ সালে কাহলো এবং রিভেরা মেক্সিকোতে ফিরে আসেন, যেখানে তারা একটি নতুন বাড়ি নির্মাণ করে সেখানে বসবাস শুরু করেন। বাড়িটি শিল্পীদের এবং রাজনৈতিক কর্মীদের জন্য একটি সমাবেশের স্থান হয়ে ওঠে। এই দম্পতি লিয়ন ট্রটস্কি এবং আন্দ্রে ব্র্যাশোনের মতো শিল্পবোদ্ধাদের আপ্যায়ন করেন। ব্র্যাশোন ফ্রিদার প্রথম একক প্রদর্শনীর ভূমিকাটি লিখেছিলেন, তাকে একজন স্ব-শিক্ষিত অধিবাস্তববাদী হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন। ১৯৩৮ সালে নিউইয়র্কে জুলিয়া লেভি গ্যালারীতে এই প্রদর্শনীটি অনুষ্ঠিত হয় এবং এটি অনেক সফল হয়। পরের বছর কাহলো তার কাজ প্রদর্শন করতে প্যারিসে ভ্রমণ করেন। সেখানে তিনি মার্সেল ডুশাম্পসহ একাধিক অগণতান্ত্রিক ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ল্যুভর মিউজিয়াম তার ‘দ্য ফ্রেম (১৯৩৮)’ ছবিটি কিনে নেয়। ফ্রিদা বিশ শতকের প্রথম মেক্সিকান শিল্পী, যার কাজ জাদুঘরটিতে স্থান পেয়েছে।
বিবাহিত জীবনে বহুগামিতা, বিশেষ করে রিভেরার সাথে কাহলোর ছোটবোনের সম্পর্ক আর কাহলোর সাথে লিয়ন ত্রটস্কি সহ অনেক শিল্পীর সম্পর্কের ফলস্বরূপ ১৯৩৯ সালে ফ্রিদা-রিভেরা দম্পতির দাম্পত্যজীবনের অবসান ঘটে। সেই বছর ফ্রিদা তার বেশ কিছু বিখ্যাত শিল্পকর্ম করেন; যেমন- ‘দ্য টু ফ্রিদা’স’, যেখানে তিনি দেখিয়েছেন তার রিভেরার প্রত্যাখ্যান করা তার চরিত্রের অংশটিকে।
১৯৪০ সালে এই দম্পতি পুনরায় একত্র হন এবং কয়োকানে ফ্রিদার বাল্যকালের বাসা ‘দ্য ব্লু হোম’ এ বসবাস শুরু করেন। ১৯৪৩ সালে তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ফাইন আর্টস স্কুল লা এসেমেরাল্ডাইয়ে পেইন্টিংয়ের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। দিনে দিনে ফ্রিদার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে আর তিনি সাময়িক আরামের জন্য ড্রাগ এবং অ্যালকোহলের শরণাপন্ন হতে থাকেন। ১৯৪০ থেকে ১৯৫০ সাল এর ভেতর তিনি ক্রমাগত বেশ কিছু অস্ত্রোপচারের মধ্য দিয়ে যান, শেষের দিকে তার হাঁটার জন্যও সাহায্যের প্রয়োজন হতো। এ সময়ের আত্মপ্রতিকৃতিতে তাকে হুইলচেয়ারে দেখা যায়।
১৩ জুলাই, ১৯৫৪ সালে মৃত্যুর কিছুদিন আগে ফ্রিদা তার ডায়রিতে লিখেছিলেন,
“আমি আশা করছি প্রস্থান আনন্দের হোক, আমি আর প্রত্যাবর্তনের আশা করছি না! – ফ্রিদা”
পরবর্তীতে, নিজের আত্মজীবনীতে ডিয়েগো রিভেরা লিখেছিলেন, যেদিন কাহলো মারা গিয়েছিলেন, সেই দিনটি তার জীবনের সবচেয়ে দুঃখজনক দিন ছিল। তিনি আরও বলেছিলেন যে, খুব দেরি হয়ে গেছে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে তার জীবনের সুন্দরতম অংশ ছিল তার জন্য ফ্রিদার ভালবাসা।
Feature Image: artsy.net