গাছ লাগাতে লাগে মাটি, টব, সার, চারাগাছ। এগুলো আবার সঠিক পরিমাণে না দিলে চারাগাছ মারাও যেতে পারে। অথচ একটি পাতা মাটিতে ফেলে দিলেই কিছুদিন পর চারাগাছ গজাবে। ভাবছেন, এভাবে হেলাফেলায় জন্মানো গাছ শুধুই জায়গা নষ্ট করবে বা জঙ্গল হবে? ধারণাটা ভুল। গাছটা অনেক রোগের ঔষধ তো বটেই এবং কয়েক বছর আগে আবিষ্কার হয়েছে, গাছটা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। Kalanchoe Pinnata বা Bryophyllum pinnatum এর বৈজ্ঞানিক নাম। কফপাতা, পটিয়াপুরী নামে পরিচিত হলেও বাংলাদেশে এটা ‘পাথরকুচি’ নামেই সর্বত্র পরিচিত।
পাথরকুচি
পাথরকুচি পাতাকে বৈজ্ঞানিক জগতে ব্রায়োফাইলাম নামে ডাকা হয়। এ পাতার এতটাই ঔষধি গুণ বিধায় একে ‘মিরাকল লিফ’ ও বলা হয়। পাতা থেকে পাথরকুচি গাছের জন্ম হয়। এর মূলত বীজ হয় না। একটি পাতা থেকে ৫ থেকে ১০টি গাছ উৎপাদন সম্ভব।
সাধারণত কাঁকরমাটিতে জন্মে থাকে। তাছাড়া ভেজা, স্যাঁতস্যাঁতে মাটিতেও জন্মে এই উদ্ভিদ।
বীরুৎজাতীয় এই উদ্ভিদটি খুব একটা লম্বা হয় না। ১ থেকে ২ ফুটের মতো লম্বা হয়ে থাকে। পাতার রং সবুজ। পাতা ডিম্বাকৃতি, মাংসল এবং পুরু। পাতার চারপাশে খাঁজের মতো অংশ রয়েছে। খাঁজকাটা এই অংশ মাটিতে ফেলে রাখলেই নতুন গাছ জন্মায়।
পাঠকমনে এবার নিশ্চয়ই প্রশ্ন জাগছে, কেন এই গাছ পাতার খাঁজকৃত অংশ থেকে জন্মে? কারণ, এই গাছের পাতার খাঁজের অংশে রয়েছে Epiphyllous Buds, এতে শেকড় এবং কাণ্ড জন্মাবার ক্ষমতা আছে। সাইটোকাইনিন নামে হরমোন পাতার কিনারায় জমে কোষ বিভাজনকে উদ্দীপ্ত করে মূল উৎপন্ন করে।
পাথরকুচিকে বলা হয় ‘জগতের বিস্ময়’
এর রয়েছে ব্যাপক ঔষধি গুণ। আফ্রিকা, ভারত, দক্ষিণ আমেরিকায় পোকামাকড়ের কামড়, জখম, আলসার, ফোড়া, পোড়া, প্রদাহ, শুষ্কতার জন্য পাথরকুচির পাতা ব্যবহার করা হয়। চর্মরোগ, ফুসকুড়ি, ডায়রিয়া, কলেরা রোগেও এটা ব্যবহার হতো। ছোট শিশুদের ঠাণ্ডা লাগার প্রতিকার হিসাবেও এটা ব্যবহার করা হতো। সাধারণ কাশি, ব্যথা, ব্রংকাইটিস, ইনফ্লুয়েঞ্জা, নিউমোনিয়া, ডার্মাটাইটিসের জন্য ব্রাজিলে পাথরকুচি ব্যবহার হতো।
ভারতের বুন্দেলখণ্ড অঞ্চলে জন্ডিসের চিকিৎসায় পাথরকুচির তাজা পাতার রস ব্যবহার হতো। পশ্চিমাঞ্চলের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে নবজাতক শিশু এবং তার মাকে এই পাতার রস খাওয়ানো হয়। সিঙ্গাপুরে এই রস জ্বরের ঔষধ হিসেবে খাওয়ানো হতো। কিডনি এবং পাকস্থালীর ঔষধ হিসেবে নিয়মিত এই পাতার স্যুপ খাওয়া হয়। বিশ্ব জুড়ে এর বিস্তৃত পরিসরের ব্যবহারের কারণেই একে ‘জগতের বিস্ময়’ বলা হয়।
মেহ হলো সর্দির কারণে শরীরের বিভিন্ন অংশে ফোঁড়ার মতো অংশ। এই মেহ শরীরে তীব্র ব্যথার সৃষ্টি করে। দীর্ঘদিন সর্দি থাকলে মেহ দেখা দেয়। মেহ সারাতে তাজা পাথরকুচির পাতার রস নিয়মিত সকালে এবং বিকালে খেতে হবে। সাথে সর্দিও চলে যায় এবং কাশি থেকেও রেহাই পাওয়া যায়। কাটাছেঁড়া সারাতেও পাথরকুচির পাতা বেশ কার্যকর। ক্ষতস্থানে পাথরকুচির পাতা হালকা গরম করে তাপ দিলে আরাম পাওয়া যায় এবং ক্ষত দ্রুত শুকিয়ে যায়।
অনেকের পিত্তথলির কারণে রক্তক্ষরণ হয়ে থাকে। প্রতিদিন দু’বেলা করে টাটকা পাথরকুচি পাতার রস খাওয়ালে সেরে যাবে। পাইলস এবং অর্শরোগ থেকে মুক্তি পেতে প্রতিদিন পাথরকুচি পাতার রস গোলমরিচের গুঁড়ার সাথে মিশিয়ে খেলে উপকার পাওয়া যাবে।
কলেরা, ডায়রিয়া কিংবা রক্ত আমাশয়ে ভুগছেন? সজীব পাথরকুচি পাতার সাথে জিরা গুড়া এবং ঘি মিশিয়ে কিছুদিন সকালে খালি পেটে পান করুন। পাথরকুচি পাতার রসের সাথে আধা কাপ গরম পানি মিশিয়ে পান করলে শরীরের জ্বালাপোড়া দূর হয়। জন্ডিস নিরাময়ে এবং উচ্চ রক্তচাপ আয়ত্বে রাখতে পাথরকুচি পাতার রস অনেক কার্যকরী।
দিনে দুই-তিনবার চিবিয়ে অথবা রস করে পাথরকুচির পাতা খেলে, কিডনির পাথর দূর হয়। এভাবে খেলে জন্ডিসও উপশম হয়।
প্রায়ই অনেকের দেখা যায়, পেট ফাঁপা হয়ে আছে, প্রস্রাব আটকে আছে, বায়ু সরছে না। তখন পাথরকুচি পাতার রসের সাথে চিনি এবং হালকা গরম পানি মিশিয়ে খাওয়াতে হবে। তাহলে বায়ু সরবে, মূত্রের বেগ হবে, পেট ফাঁপাটাও কমবে। মৃগীরোগে আক্রান্ত ব্যক্তির রোগাক্রান্ত সময়ে কয়েক ফোটা এই উদ্ভিদের রস খাওয়ালে তাৎক্ষণিক রোগের উপশম ঘটবে। কানের ব্যথার উপশম কমাতে সামান্য কয়েক ফোঁটা রস কানে দিলে উপকার পাওয়া যাবে। যারা ত্বক সম্পর্কে সচেতন, তারা মাঝেমধ্যে পাথরকুচি পাতা বেটে ত্বকে লাগাতে পারেন। এতে প্রচুর পানি আছে। ত্বক ঠাণ্ডা, নরম ও সতেজ থাকবে। এছাড়া ব্রণেও পাথরকুচি পাতার প্রলেপ দিলে উপকার পাওয়া যায়।
পাথরকুচি পাতা থেকে বিদ্যুৎ আবিষ্কার
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. মো. কামরুল আলম খান ২০০৮ সালে পাথরকুচি পাতা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সফল হন। তার গবেষণা মূলত শুরু হয় ১৯৮৯ সাল থেকে। গবেষণায় সাফল্য দেখতে পান ২০০৮ সালে পাথরকুচি পাতা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে। সে সময়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ে মেধাস্বত্ব নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেন এবং ডিসেম্বরে তার উদ্ভাবনী কাজ নিবন্ধিত হয়।
১৯৮৯ সালের দিকে মাস্টার্সের ছাত্র থাকাকালীন থিসিসের কাজ শুরু করেন তিনি। কাজ করতে গিয়ে মনে আসে, কীভাবে স্বল্প খরচে এবং নতুন উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। বিভিন্ন গাছের পাতা, যেমন আম, তেঁতুল, টমেটো, আলু এসব দিয়ে গবেষণা করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যর্থ হন। পরে পাথরকুচি পাতা নিয়ে গবেষণা করে দেখতে পান, এর রসে আছে এসিডিক হাইড্রোজেন আয়ন, যা থেকে বিদ্যুৎ উৎপন্ন সম্ভব।
১৯৮৯ সাল থেকে শুরু হওয়া গবেষণা ২০০৮ সালে এসে বাস্তবে রূপ নেয়। ২০০৮ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির দিকে পাথরকুচি পাতা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। সেসময় মুন্সিগঞ্জ থেকে তার ছাত্রকে দিয়ে কিছু পাতা সংগ্রহ করে শুরু করেন গবেষণা। কয়েক মাস পর তিনি পেয়ে যান তার কাঙ্ক্ষিত ফলাফল। পরীক্ষার জন্য পাথরকুচির রস থেকে ১২ ভোল্ট বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে ল্যাম্প জ্বালাতে সফল হন। এই উদ্ভাবন নিবন্ধিত হবার পর বড় আকারে গবেষণা করে যাচ্ছেন, যাতে এই পদ্ধতিতে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হয়।
পাথরকুচি পাতার রস থেকে উৎপন্ন বিদ্যুৎ দিয়ে গত দশ বছরে বৈদ্যুতিক বাতি, টেবিল ফ্যান, এনার্জি বাল্ব, কম্পিউটার, সাদাকালো টেলিভিশনসহ বিভিন্ন বৈদ্যুতিক যন্ত্র চালিয়ে ড. মো.কামরুল আলম খান সফল হয়েছেন। ১ কেজি পাথরকুচি পাতা থেকে ২০ ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব।
পাথরকুচি পাতা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন পদ্ধতি
পাথরকুচি পাতা থেকে কীভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়, সে সম্পর্কে বলতে গিয়ে ড. কামরুল আলম খান বলেন, পাথরকুচি পাতা থেকে তৈরি দ্রবণই বিদ্যুৎ তৈরির মূল উপাদান। পাথরকুচি পাতার মধ্যে এসিডিক (অম্লীয়) হাইড্রোজেন আয়ন থাকে। যে পদার্থে এসিডিক (অম্লীয়) হাইড্রোজেন আয়ন বেশি থাকে সেই পদার্থ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব।
তিনি বলেন, পাথরকুচি পাতায় সাইট্রিক এসিড, আয়োনো সাইট্রিক এসিড, মেলিক এসিড ও অন্য আরো কিছু অজানা জৈব এসিড রয়েছে। এগুলো সবই দুর্বল জৈব এসিড। এই এসিড থেকে হাইড্রোজেন আয়নের নির্গমণ খুবই ধীরগতিতে হয়। ফলে পাথরকুচি পাতার বিদ্যুতের স্থায়িত্বকাল বেশি, যা বিদ্যুৎ উৎপাদনে খুবই সহায়ক।
পাথরকুচি পাতা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন পদ্ধতিও খুব সহজ। প্রথমে পাথরকুচি পাতা সংগ্রহ করে ব্লেন্ডার মেশিনে দিয়ে দ্রবণ তৈরি করে নিতে হবে। গবেষণার প্রথম পর্যায়ে দ্রবণে পাতা ও পানির পরিমাণ ৮ঃ১ রাখা হতো। কিন্তু পরে দ্রবণের এই অনুপাত পরিবর্তন করে পানির পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া হয় এবং দ্রবণকে ছেঁকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়। সাধারণত এক্ষেত্রে আমরা আপাতত ব্যাটারির প্লাস্টিকের খোলস ব্যবহার করছি। সেই ব্যাটারির খোলসের ভেতরে পাতার দ্রবণ ঢেলে তার মধ্যে একটি তামা ও একটি দস্তার পাত ডুবিয়ে দেওয়া হয়।
দ্রবণের সংস্পর্শে আসামাত্রই রাসায়নিক বিক্রিয়ার কারণে তামার পাতে ধনাত্মক ও দস্তার পাতে ঋণাত্মক বিভব সৃষ্টি করে। কারণ দ্রবণে রয়েছে বিদ্যুৎবাহী আয়ন। বিপরীতমুখী এই বিভবের দ্বারাই দুই পাতের মধ্যে বিভব পার্থক্য হয়। এতেই বিদ্যুৎ প্রবাহ সৃষ্টি হয়। বেশি বিদ্যুৎ পেতে হলে একাধিক তামা ও দস্তার পাত ঘন করে সমান্তরালভাবে বসাতে হবে। এই উৎপাদিত বিদ্যুৎকে ডিসি বিদ্যুৎ বলা হয়। এর সঙ্গে ইনভার্টার সংযোগ দিয়ে এসি বিদ্যুতে পরিণত করে সহজেই সব কাজে ব্যবহার করা যাবে এবং তা জাতীয় গ্রিডেও যোগ করা যাবে। (তথ্যসূত্র: দৈনিক সমকাল, ২৭ জুন, ২০১৫)
ফিচার ইমেজ – fresh75.blogspot.com