উইলিয়ামস বোনদের রাজত্বে হানা দিয়ে গত বছর তিনেক তারকা হয়ে উঠেছেন গারবিনে মুগুরুজা। এবার উইম্বলডনের শুরুতে এই টেনিস তারকা কথা বলেছেন নিজের উঠে আসা নিয়ে।
২২ বছর আগের কথা।
ভেনিজুয়েলার কারাকাস শহরের উপকণ্ঠের একটি দৃশ্য। একটি ছোট্ট মেয়ে গ্রিলের ওপাশ থেকে টেনিস কোর্টের দিকে চেয়ে আছে। তার মুখটা গ্রিলে চেপে ধরা, চোখ দুটো বড় বড়। বিস্ময়ের সাথে খেলা দেখছে। দুটি ছেলে কোর্টের এ পাশ থেকে ও পাশে বল পাঠাচ্ছে। তিন বছর বয়সী এই মেয়েটিই আমাদের গারবিনে মুগুরুজা। শিশু মুগুরুজার তখনও বোঝার কথা নয় যে, সে কী খেলা দেখছে। কিন্তু সে এটুকু বোঝে যে, তার ভাইয়েরা যে খেলাটি খেলছে, সেও এই খেলাটা খেলতে চায়।
মুগুরুজার দুই ভাই আসিয়ের ও ইগর যখন অনুশীলন করতো, শিশু মুগুরুজা প্রতিদিন এদের অনুসরণ করতো। বড় বড় চোখ আর শক্তিশালী দু’টো পা নিয়ে দুই ভাইয়ের পেছনে ছুটে বেড়াতো। সে অপেক্ষা করতো কখন বল ছুঁড়ে দেওয়ার একটি সুযোগ আসে কিংবা কখন বলটা চুরি করে নিয়ে নিজেই খেলার একটা সুযোগ আসে!
মুগুরুজা বলছিলেন,
আমি বেড়ার ওপাশে থাকতাম। ওদের দিকে চেয়ে থাকতাম। আমি ছিলাম ওদের ক্ষুদে বল গার্ল। আমাকে সবসময় কোর্টের বাইরে থাকতে হতো। আমি বোকার মতো কাজ করতাম আর ওদের বিরক্ত করতাম।
ভেনিজুয়েলার সেই হার্ড কোর্টে মুগুরুজা পরিবারের তিন শিশুর একটি ছবি এখনও টিকে আছে। আসিয়ের আর ইগর পেছনে বসে আছে; দু’জনের আঙুলে পেশাদারদের মতো ধরা দুটো ব্যাট। সামনে একটি ব্যাট টেডি বিয়ারের মতো করে ধরে বসে আছে গারবিনে মুগুরুজা।
সেই সময়ের কথা বলতে গিয়ে মুগুরুজা বলছিলেন,
আমি টেনিস খুব ভালোবাসতাম। আমি তো টেনিস কোর্টেই বেড়ে উঠেছি। আমি যখন খুব ছোট ছিলাম, তখন থেকে দুই ভাইকে খেলতে দেখছি। আমি ওদের মতো হতে চেয়েছি। আমি হয় টেনিস খেলতাম, নইলে রোলার ব্লেডে চড়তাম। এই দু’টো ব্যাপারই আমি ভালোবাসতাম। তবে আস্তে আস্তে যখন আরও আরও লম্বা হয়ে উঠলাম। তখন ভাবলাম, এই রোলার ব্লেড ব্যাপারটা আমার জন্য নয়।
ছোট্ট মুগুরুজা গত ২২ বছরে অনেক অনেক বড় হয়ে গেছেন। এর মধ্যে তিনি দু’টি গ্র্যান্ড স্লাম জিতেছেন। এখন যে উইম্বলডন চলছে, সেটারও গত আসরের চ্যাম্পিয়ন তিনি। টেনিস কোর্টে তার শক্তি এখন আলোচনার বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। তবে এই অবধি আসতে মুগুরুজাকে অনেক ধৈর্য ধরতে হয়েছে।
তিনি বলছিলেন,
আমি জন্মের বহু আগে থেকেই আমার দুই ভাই টেনিস খেলা শুরু করেছে। ফলে আমার বয়স যখন তিন, তখন আমার বাবা-মা ঠিক করলেন, তাদের একটি মেয়ে আছে, তাকেও টেনিস খেলোয়াড় বানাতে হবে। কিন্তু ক্লাবের কোচ বললেন, না। কারণ আমি তখন খুব ছোট ছিলাম। আমাকে অপেক্ষা করতে হলো। আমার ঠিক মনে নেই। তবে মা বলেন, আমি নাকি প্রতিদিন তাকে বিরক্ত করতাম। বলতাম, আমি কবে খেলার সুযোগ পাবো।
কয়েক বছরের মধ্যে মুগুরুজা পরিবার তাদের ব্যাগ-বাক্স গুছিয়ে স্পেনে রওনা হলো। এবার তারা ছুটলো পরিবারের স্বপ্নের পেছনে। আসিয়ের ও ইগরের মধ্যে একটা সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছিলো পরিবারটি। স্পেনে তাদের খেলোয়াড় হয়ে ওঠার একটা পথ তৈরি হবে বলে তারা বিশ্বাস করছিলেন।
মুগুরুজা বলছিলেন,
টেনিসের জন্য আমরা এটা করলাম। আমার দুই ভাইয়ের জন্যও। আমার বাবা ছিলেন স্প্যানিশ। তিনি জানতেন, স্পেনে অসাধারণ সব অ্যাকাডেমি আছে। তিনি চাইতেন তার সন্তানরা কঠোর পরিশ্রম করুক এবং নিজেদের সেরা চেষ্টাটা করুক।
মুগুরুজার অবশ্য এখনকার মতো তারকা হওয়ার স্বপ্ন কখনোই ছিলো না। পৃথিবীর তিন নম্বর র্যাংকিংধারী টেনিস তারকা হবেন, দু’টি গ্র্যান্ডস্লাম জিতবেন; এসব স্বপ্ন তিনি দেখেননি। তিনি বলছিলেন,
‘আমার ভাইয়েরা টেনিস খেলোয়াড় ছিলো। আমি স্রেফ ওদের অনুসরণ করতে চেয়েছিলাম।’
কিন্তু মুগুরুজার প্রতিভা আস্তে আস্তে প্রকাশিত হতে থাকলো। সেটা অন্তত আর চেপে রাখা গেলো না।
বার্সেলোনার বুরুগুয়েরা টেনিস অ্যাকাডেমিতে নিজেকে বিকশিত করতে থাকলেন মুগুরুজা। দ্রুতই এই খেলাটিতে একেবারে নিবিষ্ট হয়ে যেতে হলো তাকে এবং স্বাভাবিক কৈশোর হারিয়ে একজন পেশাদার অ্যাথলেটের জীবনে ঢুকে পড়লেন। অবশ্য মুগুরুজার কাছে এটা কখনোই অস্বাভাবিক মনে হয়নি,
আমি কখনোই মনে করিনি, আমার ভিন্ন কোথাও থাকার কথা ছিলো। হয়তো আমি আমার বন্ধুদের সাথে সিনেমা হলে থাকতে পারতাম। কিন্তু আমি জানতাম, আমাকে আমার জীবনের পুরষ্কারটা পেতে গেলে এই ভ্রমণটা করে যেতে হবে; আমার স্বপ্নটা তাড়া করতে হবে।
‘হ্যাঁ, কখনো কখনো খুব কষ্ট লাগতো। যখন বন্ধুরা থিম পার্কে বেড়াতে যাচ্ছে, তখনও আমাকে কোর্টেই ছুটতে হচ্ছে। কিন্তু আমার জীবন তো এমনই।
‘আমার একটা বড় সৌভাগ্য হলো, আমার পরিবারের রুটিরুজির জন্য আমার দিকে চেয়ে থাকতে হয়নি। অনেক পরিবার আছে, যেখানকার বাচ্চারাই তাদের পরিবারের একমাত্র ভরসা। আমার ক্ষেত্রে আমি সেটা কখনো অনুভব করিনি। আবার বাবার ভালো চাকরি ছিলো। আমি ছিলাম আমার পরিবারের স্বপ্ন পূরণের জন্য শেষ সন্তান। আমার নিজের কিছু চাপ ছিলো। কিন্তু আমি কখনো পরিবার থেকে কোনো চাপ টের পাইনি। আমি নিজেই নিজেকে চাপ দিতাম।
প্রথমে লক্ষ্যটা ছিলো র্যাংকিং যতটা সম্ভব বাড়িয়ে নেওয়া। কিন্তু আস্তে আস্তে সে যখন বড় হতে থাকলো (লম্বাও বটে, এখন সে ৬ ফুট লম্বা) লক্ষ্যটা আরও সুনির্দিষ্ট হলো। মুগুরুজা বলছিলেন,
আমার যখন ১৭ বছর বয়স, তখন আমি ভাবলাম, ‘ভাই, আমাকে ফ্রেঞ্চ ওপেন খেলতে হবে। আমি উইম্বলডনে যেতে চাই। আমি সেইসব কোর্টে খেলতে চাই, যা অনেক দেখেছি।
২০১৪ সালে, মুগুরুজার বয়স যখন ২১, তখন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ভেনিজুয়েলা নয়, স্পেনের হয়ে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে অংশ নেবেন। মুগুরুজা বলেন, তার এই বাছাইটা করতে না হলেই ভালো হতো। তবে স্পেনকে বেছে নিয়েও ভেনিজুয়েলাকে ভোলেননি মুগুরুজা। তিনি নিজেকে আর দশ জন ভেনিজুয়েলানের মতোই মনে করেন,
আমি নিজেকে লাতিন মনে করি। আমি উন্মুক্ত ব্যক্তিত্ব পছন্দ করি; নাচা, চিৎকার করা, একটু নাটকীয়তা। আমি সঠিক সিদ্ধান্ত (স্পেনকে বেছে নেওয়া) নিয়েছি। কিন্তু তাতে দুনিয়া জুড়ে আমার ভেনিজুয়েলার প্রতিনিধিত্ব করতে কোনো বাঁধা নেই।
ভেনিজুয়েলার অর্থনৈতিক সংকটে এখন দেশটি থেকে অনেকেই বাইরে পাড়ি জমাচ্ছে। এর ফলে মুগুরুজাও অনেকদিন হলো দেশে ফেরেন না। তিনি বলছিলেন,
দেশের অবস্থা এখন ভালো না। আবার দেশের অবস্থা যখন ভালো হবে, আমি দেশে ফিরে যাবো। এখন দেশের অবস্থা তো ধ্বংস্তস্তুপের মতো। আমি খোঁজ রাখি। কিন্তু অর্থহীন মনে হয়; অন্য সবার মতোই।’
২০১৫ সালে মুগুরুজা প্রথম নিজের নামটা দুনিয়াকে জানিয়ে দিতে পারেন। যখন তিনি উইম্বলডন ফাইনালে ওঠেন; যদিও তখন সেরেনা উইলিয়ামসের কাছে হেরে গিয়েছিলেন। পরের বছর ফ্রেন্স ওপেনে ওই উইলিয়ামসকেই হারিয়ে প্রথম গ্র্যান্ড স্লাম জেতেন। আর গত বছর সেন্টার কোর্টে ভেনাস উইলিয়ামসকে হারিয়ে জেতেন উইম্বলডন। রাতারাতি দুনিয়া জুড়ে তারকা হয়ে যান তিনি।
ফাইনালে সেই জয়ের স্মৃতি এখনও ভালোমতো মনে রেখেছেন মুগুরুজা,
আপনি সবসময়ই চাইবেন একটি ম্যাচ সুন্দর একটি শটে জেতার জন্য। এটা ছিলো ভুতুড়ে একটা সময়। আমার কোর্টে ঢোকার সময়টাও মনে আছে। সব মানুষ অপেক্ষা করছিলো। খুব শান্ত পরিবেশ।
যে ফাইনালটিতে আমি হেরেছিলাম, সেটাও মনে আছে। সেটা ছিলো আমার প্রথম গ্র্যান্ড স্লাম ফাইনাল। আমি তখনও বুঝে উঠতে পারিনি, এর অর্থ কী। দুই বছর পর আমি বুঝেছি। এরপর মনে মনে বলি, আমি তৈরী।
ফিচার ইমেজ – elpais.com