আজকাল আমাদের দেশে রেস্তোরাঁ ব্যবসা ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। গত কয়েক দশকে দেশের প্রতিটি ছোট বড় শহর ভরে গেছে অসংখ্য রেস্তোরাঁয়। চাকরি কিংবা পড়াশোনার পাশাপাশি অনেকেই শুরু করছেন এই ব্যবসা। তরুণ উদ্যোক্তারাও এখন ধীরে ধীরে উৎসুক হচ্ছেন এর প্রতি। তবে প্রতিদিন নিত্যনতুন যেসব রেস্তোরাঁ চালু হচ্ছে, তার সবগুলো কি এই ব্যবসায় টিকে থাকতে পারছে?
রেস্তোরাঁ ব্যবসায় একটি সাধারণ সমস্যা প্রায়ই দেখা যায়। আর সেটি হলো প্রথম প্রথম রেস্তোরাঁটি যথেষ্ট জনপ্রিয়তা লাভ করলেও আস্তে আস্তে এই জনপ্রিয়তা কমতে থাকে। ব্যবসায় লোকসান হতে থাকে। এ কারণেই রেস্তোরাঁ চালুর কয়েক বছরের মধ্যেই ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন এমন উদ্যোক্তার সংখ্যাও কিন্তু কম নয়। কিন্তু কেন এমন সমস্যা হচ্ছে, আর কীভাবেই বা একটি রেস্তোরাঁ তার জনপ্রিয়তা বজায় রাখতে পারে? চলুন আজকে আমরা সে বিষয়েই কিছু তথ্য জেনে নিই।
আমাদের দেশে আমরা প্রধানত দু’ধরনের রেস্তোরাঁ দেখতে পাই। প্রথমটি এমন রেস্তোরাঁ যারা মূলত আমাদের দেশের প্রচলিত ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলো পরিবেশন করে। আর দ্বিতীয়টি হলো এমন রেস্তোরাঁ যারা ভিন্ন ভিন্ন দেশের, ভিন্ন ভিন্ন পদের খাবার পরিবেশন করে। উভয় রেস্তোরাঁর ক্ষেত্রেই কিন্তু জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে খাবারে নতুনত্ব কিংবা ফিউশনের প্রয়োজন রয়েছে। চলুন জেনে নিই কিভাবে রেস্তোরাঁর নতুনত্ব ধরে রাখা যেতে পারে।
শেফ’স স্পেশাল
রেস্তোরাঁর নতুনত্ব ধরে রাখার একটি চমৎকার উপায় হলো শেফ’স স্পেশাল মেন্যু। নির্দিষ্ট সময় পর পর কিছু ভিন্ন ধরনের বিশেষ খাবার পরিবেশন করুন আপনার রেস্তোরাঁয়। হতে পারে সেটি সপ্তাহের নির্দিষ্ট কোনো দিনে কিংবা কোনো বিশেষ উৎসব উপলক্ষে। প্রতি সপ্তাহে যদি সম্ভব না হয়, তবে মাসে অন্তত কয়েকবার এই ভিন্ন ধাঁচের খাবারটি পরিবেশন করা যেতে পারে। এর ফলে আপনার রেস্তোরাঁয় যারা নিয়মিত খেতে আসেন, তারা ভিন্ন স্বাদের কিছু খাবার খেতে পারবেন। আবার সেই সাথে একই খাবার রান্না ও পরিবেশন করতে থাকা রেস্তোরাঁর কর্মচারীদেরও একঘেয়েমি দূর হবে।
অতিথির সাথে রাখুন ভালো সম্পর্ক
আপনার রেস্তোরাঁয় যারা খেতে আসেন, তাদের সাথে সবসময় ভালো সম্পর্ক রাখার চেষ্টা করুন। তাদের নিদিষ্ট কোনো অনুরোধ কিংবা মতামত থাকলে সেটি মন দিয়ে শুনুন ও রাখার চেষ্টা করুন। রেস্তোরাঁর নতুনত্ব ধরে রাখতে হলে এটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি উপায়। এছাড়াও আপনার কাস্টমারের মাধ্যমেই আপনি বুঝতে পারবেন আপনার এলাকার গ্রাহকরা আপনার কাছে ঠিক কী ধরনের খাবার আশা করেন। এছাড়াও রেস্তোরাঁয় নতুন কোনো মেন্যু চালু করলে তাদের তা একবার চেখে দেখতে বলতে ভুলবেন না যেন। খাওয়া শেষ হলে তাদের কাছে খাবার কেমন ছিল, জানতে চাওয়াও একটি ভালো অভ্যাস।
সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে মেন্যু ঠিক করুন
সময়ের সাথে সাথে আমাদের এই পৃথিবী বদলে যাচ্ছে। তথ্য-প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে মানুষ এখন অনেক স্বাস্থ্য সচেতন। খাবারের ব্যাপারেও তাই এখন মানুষ অনেক বেশি সজাগ। যে খাবারটি খাচ্ছি, সেটি তাজা উপাদান দিয়ে তৈরি কি না, খাবারে ভেজাল আছে কি না, এসব ব্যাপারে এখন প্রায় সবাই সচেতন থাকেন। এছাড়াও অনেক গ্রাহক আছেন, যারা প্রচলিত মশলাদার ও তৈলাক্ত খাবার বাদ দিয়ে স্বাস্থ্যকর কোনো খাবার খেতে চান। আপনার রেস্তোরাঁটিকে জনপ্রিয় রাখতে হলে আপনার উচিত হবে এসব ব্যাপারে নজর দেয়া। আপনি যদি শুধু প্রচলিত খাবারই পরিবেশন করতে থাকেন, তবে একটি বড় অংকের গ্রাহক হারাবেন আপনি।
প্রথম প্রথম হয়তো সব গ্রাহকের চাহিদা পূরণ করতে আপনার সমস্যা হতে পারে। তবে একটু সময় ও ধৈর্য ধরে কাজ করলে আপনি হয়তো এমন কিছু গ্রাহক পাবেন, যারা আপনার নিয়মিত গ্রাহকে পরিণত হয়ে যাবেন। নির্দিষ্ট গ্রাহকের জন্য করা সেই বিশেষ মেন্যুটিও কিন্তু হয়ে যেতে পারে আপনার রেস্তোরাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার।
অনুপ্রাণিত করুন রাঁধুনিকেও
শুধু রেস্তোরাঁর গ্রাহকদের সাথে ভালো সম্পর্ক রাখলেই কিন্তু হবে না, রেস্তোরাঁর রাঁধুনিদের সাথেও থাকা চাই নিয়মিত যোগাযোগ। রেস্তোরাঁ মালিক হিসেবে তাদেরকে অনুপ্রাণিত করার দায়িত্ব কিন্তু আপনার। নির্দিষ্ট একটি বাজেট ও নির্দেশনা ঠিক করে সেই অনুযায়ী আপনার রেস্তোরাঁর রাঁধুনিদেরকে তাদের সৃজনশীলতা কাজে লাগাতে বলুন। শুধু আপনার পছন্দের কিংবা প্রচলিত মেন্যুগুলো নয়, বরং তাদের নিজের ইচ্ছামতো নতুন কিছু তৈরি করতে বলুন। এভাবে তাদের নিজস্ব আইডিয়া ও দক্ষতাকে কাজে লাগাতে দিলে তারাও হয়তো নতুন কোনো খাবার তৈরি করে চমকে দেবে আপনাকে।
হালনাগাদ করুন রেস্তোরাঁর মেন্যু
গবেষকদের মতে, প্রতি ১৮-২৪ মাস পর পর রেস্তোরাঁর মেন্যু হালনাগাদ করা উচিত। এক্ষেত্রে হালনাগাদ মানে যে পুরো মেন্যুটাকেই বদলে ফেলতে হবে, এমন কিন্তু নয়। যে খাবারগুলো আপনার রেস্তোরাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয়, সেগুলোতে আনতে পারেন হালকা কিছু নতুনত্ব। কিংবা যে খাবারগুলোর গত কয়েক বছরেও কোনো চাহিদা দেখা দেয়নি, মেন্যু থেকে বাদ দিতে পারেন সেগুলো। এ ধরনের খাবারগুলো বদলে চালু করতে পারেন নতুন কোনো খাবার। রেস্তোরাঁর মেন্যুর এই হালনাগাদের ফলে বজায় থাকবে রেস্তোরাঁর নতুনত্ব।
গবেষণা করুন খাবার ও ব্যবসার কৌশল নিয়ে
রেস্তোরাঁ ব্যবসায় সফল হওয়ার অন্যতম প্রধান শর্ত হলো এ সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে তবেই কাজে লেগে পড়া। ভালোভাবে প্রস্তুতি না নিয়ে যদি আপনি মাঠে নামেন, তবে কখনোই সফল হতে পারবেন না। তাই রেস্তোরাঁ শুরুর প্রথম থেকেই রেস্তোরাঁর খাবার ও ব্যবসার কৌশল নিয়ে গবেষণা করা উচিত। পরিচিত কেউ এই ব্যবসায় জড়িত থাকলে, নিতে পারেন তার পরামর্শও। এছাড়াও এই ব্যবসায় অভিজ্ঞ কারো সাথে যোগাযোগ ও আলোচনার ফলে উঠে আসতে পারে নতুন কোনো আইডিয়া।
ধরে রাখুন খাবারের মান
উপরের সবকিছু মেনে চলার পরও আপনার রেস্তোরাঁটি জনপ্রিয়তা হারাতে পারে, যদি আপনি খাবারের মান ধরে রাখতে না পারেন। আমাদের দেশের বেশিরভাগ রেস্তোরাঁ শুরুতে খাবারের মান ভালো রাখলেও শেষ পর্যন্ত তা ধরে রাখতে পারে না। ফলে ধীরে ধীরে কমতে থাকে রেস্তোরাঁর জনপ্রিয়তা। আর খাবারের মান ধরে রাখতে হলে কিছুদিন পর পর খাবার নিজে চেখে দেখুন। কিংবা আপনার পরিচিত কোনো বন্ধুবান্ধবকে চেখে দেখতে বলে তাদের থেকে সৎ মতামত নিন। এর মাধ্যমে আপনি বুঝতে পারবেন আপনার রেস্তোরাঁর খাবারের মধ্যে কোনো পরিবর্তন আসছে কি না, যা আপনারে খাবারের মান ধরে রাখতে সাহায্য করবে।
ধৈর্য ধরুন
রেস্তোরাঁ ব্যবসায় প্রতিনিয়তই একজন রেস্তোরাঁ মালিককে নানা চাপের মধ্যে থাকতে হয়। সম্মুখীন হতে হয় নানা ধরনের সমস্যার। এসব সমস্যায় হাল ছেড়ে না দিয়ে ধৈর্য ধরে সমস্যাগুলো সমাধান করার চেষ্টা করুন। এছাড়াও এসব চাপ ও সমস্যার ফলে চলে আসতে পারে একঘেয়েমি। তাই সবসময় রেস্তোরাঁয় নিত্যনতুন আয়োজন ও নতুনত্ব আনার চেষ্টা করুন। তবেই আপনি ধরে রাখতে পারবেন আপনার রেস্তোরাঁর জনপ্রিয়তা এবং হতে পারবেন একজন সফল রেস্তোরাঁ মালিক।