বাবা-মায়ের কাছে অন্যতম আনন্দের এক মুহূর্ত হলো যখন তাদের আদরের সন্তান হাঁটতে শেখে। বাবা-মায়ের হাত ধরে এক পা-দু’পা ফেলে একদিন একাই সে হাঁটতে শুরু করে। সাধারণত শিশুরা এক বছর বয়স হওয়ার আগে থেকেই একটু একটু করে হাঁটতে শুরু করে, কারো সময় লাগে আরো একটু বেশি। আদরের সন্তান কবে হাঁটবে, হাঁটতে শুরু করে দিলে কোন বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে- এমন সব প্রশ্ন ও নানা চিন্তা তাই সবসময় ভর করে বাবা-মায়েদের মনে।
বর্তমান যুগের অধিকাংশ অভিভাবকই সন্তানের বয়স এক বছর হবার পূর্বে সন্তানের জন্য কিনে আনেন বেবি ওয়াকার। বেবি ওয়াকারের মাধ্যমে চেষ্টা করতে থাকেন তাদের বাচ্চাকে দ্রুত হাঁটতে শেখাবার। কিন্তু আদতে অভিভাবকরা কখনোই ভেবে দেখেন না কতটুকু প্রয়োজন আছে এই বেবি ওয়াকারের। বরং এর ব্যবহারের ফলে বাচ্চার শারীরিক বিভিন্ন সমস্যাও যে হতে পারে, সে বিষয়েও অভিভাবকদের কোনো সচেতনতা নেই। এমনকি, অনেক ক্ষেত্রে বাবা-মা চিকিৎসক কিংবা শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়াই বাচ্চাদের তুলে দিচ্ছেন বেবি ওয়াকারে। আর সেই সাথে স্বপ্ন দেখতে থাকেন, অতি দ্রুতই তাদের সন্তান হাঁটতে শুরু করবে।
ওয়াকার ব্যবহার করলেই শিশু তাড়াতাড়ি হাঁটতে শিখবে- এই প্রচলিত ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ওয়াকার শিশুর নিজে নিজে হাঁটার ক্ষমতা ধীর করে ফেলে। এতে বরং শিশু নিজের পায়ে ভর দিয়ে হাঁটায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। বেবি ওয়াকার ছাড়াই একটি শিশু নিজে হামাগুড়ি দেওয়া থেকে ধীরে ধীরে দাঁড়াতে শিখবে। এটিই প্রাকৃতিক নিয়ম। এ বয়সে শিশুর দেহের ওজন বহন করার জন্য উপযোগী থাকে না তার মেরুদণ্ড। আর এ কারণে বেবি ওয়াকার ব্যবহার মোটেই একটি শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ নয়। বরং তা আরো বিপদ ডেকে আনতে পারে। ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অফ পেডিয়াট্রিক্স এর সাবেক প্রেসিডেন্ট ড. রোহিত আগরওয়াল এর মতে, বেবি ওয়াকার শিশুর নিতম্বের স্বাভাবিক ক্রমবিকাশে বিপত্তি সৃষ্টি করে এবং শারীরিক গঠনেও প্রভাব ফেলে। এক গবেষণায় দেখা যায়, যেসব শিশু ওয়াকার ব্যবহারের মাধ্যমে হাঁটতে শেখে ও যেসব শিশু স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে শেখে, তাদের মাংস পেশির গঠনে ভিন্নতা দেখা যায়। আর এসব কারণেই পশ্চিমের অনেক দেশে, যেমন- যুক্তরাজ্য, কানাডাতে শিশুদের জন্য ওয়াকার ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
বেবি ওয়াকার ব্যবহারে দুর্ঘটনার ফলে প্রতিদিন প্রচুর শিশু শারীরিকভাবে আহত হচ্ছে। এমনকি অনেক অভিভাবক চিরতরে হারাচ্ছেন তাদের সন্তানদের। শিশু স্বাস্থ্য বিষয়ক একটি স্বনামধন্য জার্নাল ‘পেডিয়াট্রিক’ এ প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যায়, শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিগত ১৫ বছরে ২ লাখ ৩০ হাজারের বেশি শিশু ওয়াকার দুর্ঘটনায় মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে। এদের মধ্যে ৯০ ভাগ শিশুই মাথায় ও ঘাড়ে আঘাত পেয়েছে, যা তাদের দীর্ঘমেয়াদী অনেক শারীরিক সমস্যার দিকে ঠেলে দিয়েছে।
বেবি ওয়াকারে অধিকাংশ দুর্ঘটনাই ঘটে সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে। আর এতে শিশুদের মাথায় বা ঘাড়ে মারাত্মক আঘাত পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অনেক ক্ষেত্রে শিশুরা বেবি ওয়াকার উল্টেও মাথায় বা শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাত পেয়ে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার স্কুল অব মেডিসিনের পেডিয়াট্রিক বিশেষজ্ঞ ড. নীনা সাপিরোর মতে, ওয়াকারে দুর্ঘটনার শিকার হওয়া অধিকাংশ শিশুর বয়সই গড়ে ৮ মাস বা তার কাছাকাছি। অথচ এই বয়সে একজন শিশুর হাঁটবার কথা নয়। এই বয়সে সর্বোচ্চ একটি শিশু হামাগুড়ি দিতে পারে। কিন্তু তাদের অভিভাবকদের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে তারা এমন দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। বেবি ওয়াকারের এসব সমস্যা উপলব্ধি করেই কানাডা সর্বপ্রথম রাষ্ট্র হিসেবে ২০০৪ সালে শিশুদের হাঁটানো শেখানোর জন্য বেবি ওয়াকার ব্যবহার নিষিদ্ধ করে দেয়। এমনকি এর বিক্রিও নিষিদ্ধ করে দেয়।
এত কিছুর পর অনেক অভিভাবকের মনেই প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক, তাহলে বেবি ওয়াকার ছাড়া তাদের সন্তানদের হাঁটানো শেখাবেন কীভাবে? এক্ষেত্রে অভিভাবকদের মনে রাখা জরুরি, একটি শিশুর হাঁটতে শুরু করা একটি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। সাধারণত ১১ মাস বয়স থেকেই যেকোনো সময় একটি শিশু হাঁটতে শুরু করতে পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, প্রতিটি শিশুই আলাদা, তাই ঠিক কোন সময়ে আপনার সন্তান হাঁটতে শুরু করবে, তা বলা মুশকিল। তবে ৯ মাস বয়সের পর থেকেই বাচ্চারা সাধারণত একটা কিছুকে অবলম্বন করে মাটিতে পা ফেলে এগোতে চায়। এভাবে এক পা-দু’পা ফেলতে ফেলতেই একসময় শিশু হাঁটতে শিখে যায়। অনেক শিশু ৭ মাস বয়স থেকেই দাঁড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, আবার অনেক শিশুর ক্ষেত্রে সেটা ১৮ মাসে গিয়েও ঠেকতে পারে। তবে সাধারণত ১৪ মাস বয়স থেকেই শিশুদের পায়ের মাংশপেশি শক্ত হতে শুরু করে।
শিশুরা হাঁটতে শুরু করলেই অনেক অভিভাবক ভয়ে থাকেন এই বুঝি তাদের সন্তান পড়ে যাবে ব্যথা পাবে। এই ভয়ে অনেকে শিশুকে হাঁটতে দিতে চান না। কিন্তু হাঁটতে গিয়ে শিশুরা পড়ে যাবে এবং অনেক ক্ষেত্রে সামান্য ব্যথাও পেতে পারে- এটাই স্বাভাবিক। বরং ভয় না পেয়ে এক্ষেত্রে সর্বদা শিশুর প্রতি নজর রাখতে হবে। প্রয়োজনে শিশুর হাতের কনুই ও পায়ের হাঁটুতে নি-ক্যাপ ব্যবহার করতে পারেন, যাতে শিশু পড়ে গিয়ে ব্যথা না পায়।
তবে একটি শিশু যখন হাঁটতে শুরু করে তখন সর্বপ্রথম খেয়াল রাখতে হবে বাসাটি যেন হয় শিশুর জন্য নিরাপদ। শিশু হাঁটতে শেখার পর শিশুর যাতে দুর্ঘটনা না ঘটে সেজন্য নিরাপত্তার জন্য যে বিষয়গুলোতে বেশি খেয়াল রাখা প্রয়োজন-
১. শিশু যেন হাঁটতে হাঁটতে সিঁড়িতে যেতে না পারে সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে। সম্ভব হলে সিঁড়িতে যাওয়ার আগে নিরাপত্তা দরজা বসানো যেতে পারে।
২. শিশু নতুন হাঁটা শিখলে প্রায়ই পুরো বাসা জুড়ে বিচরণ করতে শুরু করে। এই সময় শিশুকে বৈদ্যুতিক তার, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, গ্যাসের চুলা, গরম জিনিসপত্র ও অন্যান্য বিপদ থেকে নিরাপদ রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
৩. গ্রামাঞ্চলে ও নদী বা হাওড় প্রবণ এলাকায় যাদের বাড়ির পাশে নদী বা পুকুর রয়েছে তাদেরকে আরো সচেতন থাকতে হবে। কোনোভাবেই যেন শিশু হাঁটতে হাঁটতে পানিতে না পড়ে যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
অনেক অভিভাবকই তাদের সন্তানের দেরিতে হাঁটা নিয়ে চিন্তিত থাকেন। আপনার সন্তানকে হাঁটতে সাহস দিন, সে নিজে নিজেই হাঁটতে শিখবে তার সময় মতো। অনেক ক্ষেত্রে শিশুদের হাঁটতে দ্বিধাগ্রস্ত দেখা যায়, হাঁটতে গিয়েও ভয় পায় তারা। সেক্ষেত্রে শিশুকে সাহস ও উৎসাহ দিন। শিশুর সামনে তার পছন্দের খেলনা ধরে তাকে কাছে আসতে উৎসাহ দিতে পারেন। শিশু পড়ে গেলে তাকে তুলে আবার হাঁটতে উৎসাহ দিন বা হাত ধরে ধরে তার সাথে হাঁটুন।
তারপরও যদি কোনো অভিভাবকের মনে হয় তার সন্তান হাঁটতে পারছে না- সেক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সহায়তা নিন। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিন।
ফিচার ইমেজ: kidsii.com
গবেষণা তথ্য সংগ্রহ: পেডিয়াট্রিক জার্নাল
গবেষণা প্রবন্ধ: “Infant Walker–Related Injuries in the United States”
লেখক: Ariel Sims, Thitphalak Chounthirath, Jingzhen Yang, Nichole L. Hodges, Gary A. Smith
প্রকাশকাল: সেপ্টেম্বর ২০১৮