কখনো কি ভেবেছেন, বিশ্বে সর্বমোট প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা কত? উত্তরটা অবশ্য অনেকগুলো বিষয়ের উপর নির্ভর করবে। যেমন প্রথমেই সংজ্ঞায়িত করতে হবে বই বলতে ঠিক কী বোঝায়? প্রাচীন কালের হাতে লেখা পাণ্ডুলিপিগুলোকেও কি বই হিসেবে বিবেচনা করা হবে? অথবা একটি সাময়িকীর সবগুলো সংখ্যাকে কি পৃথক পৃথক বই হিসেবে ধরা হবে? বা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স এবং পিএইচডির থিসিসকে কি বই হিসেবে গণ্য করা হবে? এসব প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট কোনো উত্তর নেই। তারপরেও ২০১০ সালে ‘গুগল বুকস’ তাদের নিজেদের সংজ্ঞা অনুযায়ী অনুমান করেছে, সারা পৃথিবীতে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা প্রায় ১৩ কোটি।
গুগলের হিসেবটি প্রধানত ইউরোপ এবং আমেরিকাভিত্তিক। সে হিসেবে বিশ্বে প্রকৃত বইয়ের সংখ্যা আরো অনেক বেশি হওয়ার কথা। তবে তারপরেও ১৩ কোটি একটা বিশাল বড় সংখ্যা। কাজেই কেউ যদি বলে যে, বিশ্বের সবগুলো বই সে সংগ্রহ করতে চায়, তাহলে সেটা বিশ্বাস করা একটু কঠিনই হবে। কিন্তু ষোড়শ শতকে বইয়ের সংখ্যা এখনকার চেয়ে অনেক কম ছিল। তখন সবগুলো বই সংগ্রহের চেষ্টা করেছিলেন ইউরোপের এক বইপ্রেমী অভিযাত্রী।
সারা দুনিয়া ঘুরে তিনি গড়ে তুলেছিল তৎকালীন ইউরোপের সর্ববৃহৎ ব্যক্তিগত লাইব্রেরি। বই সংগ্রাহক ছাড়াও তার ভিন্ন একটি পরিচয় আছে। তিনি ছিলেন ক্রিস্টোফার কলম্বাসের সন্তান ফার্দিনান্দ কলম্বাস, যিনি হের্নান্দো কোলন নামেই সমধিক পরিচিত।
হের্নান্দো কোলনের জন্ম ১৪৮৮ সালে স্পেনের কর্ডোভায়। তার বাবা ক্রিস্টোফার কলম্বাস প্রথম বিয়ে করেছিলেন ১৪৭৯ কি ১৪৮০ সালে, পর্তুগালের ফিলিপা মনিজকে। সে ঘরে দিয়েগো নামে তার একটি সন্তানও হয়েছিল। কিন্তু ১৪৮৪ সালে স্ত্রী ফিলিপা মারা গেলে কলম্বাস পুত্র দিয়েগোকে নিয়ে পর্তুগাল ছেড়ে স্পেনে চলে আসেন। সেখানে তিনি রাজা ফার্দিনান্দ এবং রানী ইসাবেলার আতিথেয়তায় বসবাস করতে থাকেন এবং তাদেরকে তার নতুন বিশ্ব অভিযানের জন্য অর্থায়ন করার ব্যাপারে রাজি করানোর চেষ্টা করতে থাকেন। ফার্দিনান্দ এবং ইসাবেলা তাকে সাহায্য করার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন, কিন্তু তখনো তাদের প্রধান মনোযোগ ছিল গ্রানাডায় মুরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উপর। কাজেই তারা কলম্বাসকে অপেক্ষা করতে বলেন।
এরকম সময়ই কলম্বাসের সাথে দিয়েগো দে আরানা নামে এক ওয়াইন ব্যবসায়ীর ঘনিষ্ঠতা হয়। তার মাধ্যমে কলম্বাস পরিচিত হন তার এতিম খালাতো বোন বিয়েট্রিজ এনরিকেজের সাথে। ৩৫ বছর বয়সী কলম্বাস ২০-২১ বছর বয়সী বিয়েট্রিজের প্রেমে পড়ে যান। এর মধ্যেই ১৪৮৮ সালে তাদের ঘরে জন্মগ্রহণ করে তাদের সন্তান হের্নান্দো কোলন। বিয়েট্রিজরা নিচু বংশ মর্যাদার হওয়ায় কলম্বাস কখনো তাকে বিয়ে করেননি, কিন্তু কোলনকে তিনি ঠিকই তার পুত্র হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। বাবার পরিচিতির সুবাদে কোলনেরও স্পেনের রাজদরবারে যাওয়া-আসা ছিল। কৈশোরে তিনি রানী ইসাবেলার ছেলে ডন হুয়ানের দেখাশোনার দায়িত্বও পালন করেছিলেন। পরবর্তীতে কিছুদিন তিনি রানীর অধীনেও কাজ করেন।
কলম্বাস প্রথম জীবনে শুধুই অভিযাত্রী হিসেবে পরিচিত হলেও পরবর্তীতে যখন তিনি তার আবিষ্কৃত নতুন বিশ্বের এক অংশের গভর্নর নিযুক্ত হন, তখন থেকেই তার প্রকৃত রূপ বের হয়ে আসতে থাকে। তিনি ছিলেন প্রচণ্ড অত্যাচারী, দাস ব্যবসায়ী এবং নির্মম শোষক। স্থানীয় আদিবাসীদেরকে ঠকিয়ে, নির্যাতন এবং শোষণ করে কলম্বাস এবং তার ভাইয়েরা দিনে দিনে ধনী হয়ে উঠছিলেন। কলম্বাসের অর্জিত সম্পত্তি দ্বারা সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছিলেন হের্নান্দো কোলন। আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকায় তিনি তার পুরো সময় ব্যয় করতে পেরেছিলেন জ্ঞান অর্জনের পেছনে। কৈশোর এবং যৌবনেই তিনি বিদ্বান হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেছিলেন।
কোলন অবশ্য তার বাবার সাথে একটি অভিযানেও গিয়েছিলেন, কিন্তু জাহাজ ঝড়ের কবলে পড়ায় তার এক বছরের অভিযাত্রা জীবনের অধিকাংশ সময়ই কেটেছিল ভাঙ্গা জাহাজের ভেতর। সেখানেও তার সময় কেটেছিল সাথে করে নিয়ে যাওয়া বই পড়ে।
হের্নান্দো কোলনের বই পড়ার চরম নেশা ছিল। একইসাথে তার বই সংগ্রহ করারও বাতিক ছিল। তিনি চেয়েছিলেন বিশ্বের সবগুলো বই সংগ্রহ করতে। বই কেনার উদ্দেশ্যে তিনি দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াতেন এবং যেখানে যত বই পেতেন, সবগুলোই কিনে নেওয়ার চেষ্টা করতেন। শুধুমাত্র ১৫৩০ সালেই বই কেনার উদ্দেশ্যে তিনি রোম, মিলান, ভেনিস, ইন্সবার্ক, অ্যন্টওয়ার্প, প্যারিসসহ ইউরোপের আটটি দেশের অন্তত ১৯টি শহর ভ্রমণ করেছিলেন। শুধুমাত্র ১৫২১ সালের ক্রিসমাসের সময়ই তিনি জার্মানির ন্যুরেমবার্গ থেকে ৭০০টি বই কিনেছিলেন। পরবর্তী মাসে জার্মানির বেইঞ্জ থেকে কিনেছিলেন আরো এক হাজার বই। তার ইচ্ছে ছিল এমন একটি বিশ্বমানের লাইব্রেরি তৈরি করার, যেখানে বিশ্বের সকল ভাষার, সকল বিষয়ের, সকল বই থাকবে।
প্রথম প্রথম কোলন সবগুলো বই নিজেই পড়তেন। তিনি প্রতিটি বই কেনার সাথে সাথে তা তালিকাভুক্ত করে ফেলতেন– কোথা থেকে এবং কী পরিস্থিতিতে বইটি কিনেছেন, কত দাম দিয়ে কিনেছেন, এবং ঐ দিন মুদ্রার বিনিময় হার কত ছিল। প্রতিটি বই পড়ার পর তিনি তার সারাংশও লিখে ফেলতেন। একই সাথে লিখে রাখতেন বইটি পড়ার সময় তিনি কোথায় ছিলেন, পড়ার পর তার কী অনুভূতি হয়েছিল এবং বইটির লেখকের সাথে তার সাক্ষাৎ হয়েছিল কিনা, হলে কী কথাবার্তা হয়েছিল, ইত্যাদি। কিন্তু শীঘ্রই কোলন বুঝতে পেরেছিলেন, তার একার পক্ষে এত বিপুল সংখ্যক বই পড়ে শেষ করা এবং সেগুলোর সারাংশ লিপিবদ্ধ করা সম্ভব হবে না। ফলে তিনি পূর্ণকালীন কর্মচারী নিয়োগ করতে শুরু করেন, যাদের কাজ ছিল বইগুলো পড়ে সেগুলোর সারাংশ তৈরি করা এবং সেগুলোকে সাজিয়ে রাখা।
কোলনের বই সংগ্রহ অভিযান স্থায়ী হয়েছিল প্রায় তিন দশক, ১৫০৯ সাল থেকে শুরু করে ১৫৩৯ সালে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত। আর এই সময়ের মধ্যে তিনি সংগ্রহ করেছিলেন প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাজার বই, যে সেময়ে ইউরোপের অধিকাংশ লাইব্রেরিতে বইয়ের সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ তিন থেকে চার হাজারের মধ্যে। শুধু বই না, কোলন একইসাথে সংগ্রহ করেছিলেন প্রাচীন পাণ্ডুলিপি, ছোট পুস্তিকা, পোস্টার, মানচিত্র, মুদ্রিত ছবি- অর্থাৎ পড়া কিংবা জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব, এরকম সবকিছুই তিনি সংগ্রহ করার চেষ্টা করেছিলেন। বইয়ের বাইরে তার সংগ্রহে থাকা মানচিত্রসহ এ ধরনের টুকরো কাগজের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩,০০০। তিনি ছিলেন একইসাথে স্পেনের তথা আধুনিক বিশ্বের সর্বপ্রথম আধুনিক মানচিত্র নির্মাতাদের মধ্যে একজন। ৬,৬৩৫টি ভুক্তি বিশিষ্ট ‘ডেসক্রিপশন অব স্পেন’ গ্রন্থের রচয়িতা এবং তার বাবা কলম্বাসের প্রথম জীবনীকারও ছিলেন তিনি।
বিপুল সংখ্যক বই সংগ্রহের পর কোলনের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় সেগুলোকে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা। বলতে গেলে তার হাত ধরেই নির্মিত হয় আধুনিক গ্রন্থাগারের প্রথম বইয়ের তাক, যেখানে একের পর এক বইগুলো খাড়া অবস্থায় তাদের স্পাইনের উপর সজ্জিত থাকে। তিনি এবং তার সহকর্মীরা বইগুলোকে বিষয়বস্তু অনুযায়ী বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করেন। যেসব বইকে কোনো বিভাগেই স্থান দেওয়া যেত না, তাদের স্থান হতো ‘আনম্যাপড’ বা ‘ডেড’ নামক বিভাগে। বইয়ের তথ্যগুলোকে সহজে খুঁজে পাওয়ার জন্য তার সহকারীরা প্রতিটি বইয়ের সারাংশ একটি ক্যাটালগে সংযুক্ত করতেন, যার নাম ছিল লাইব্রো ডি এপিটোমেস (Libro de Epitomes)। এই সারাংশগুলো সাহিত্য, চিকিৎসা, ইত্যাদি বিভাগ অনুযায়ী সজ্জিত ছিল।
কোলনের এতো বিপুল সংখ্যক বই সংগ্রহের একটা ভিন্ন উদ্দেশ্যও ছিল। কলম্বাসের সময় থেকে স্পেন যেভাবে নতুন বিশ্বের নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করেছিল, তাতে কোলন বিশ্বাস করতেন একসময় স্পেন সমগ্র বিশ্বেরই নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হবে। তার আশা ছিল, সেক্ষেত্রে তার বিশ্বজনীন গ্রন্থাগারটি হবে সেই নতুন সাম্রাজ্যের মস্তিষ্ক স্বরূপ, যেখানে বিশ্বের সকল জ্ঞান একত্রে সঞ্চিত থাকবে। বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের যেকোনো মানুষের যেকোনো প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে তার গ্রন্থাগারের সুবিন্যস্ত সুবিশাল সংগ্রহের মাঝে। সহজে তথ্য খুঁজে পাওয়ার জন্য তিনি তার গ্রন্থাগারের একটি ব্লু-প্রিন্টও তৈরি করেছিলেন, যেখানে হায়ারোগ্লিফিক পদ্ধতিতে প্রায় ১০,০০০ পৃষ্ঠা জুড়ে বিভিন্ন কীওয়ার্ড লিপিবদ্ধ ছিল।
দুঃখের বিষয়, হের্নান্দো কোলনের এত সমৃদ্ধ লাইব্রেরিটি শেষপর্যন্ত টিকে থাকতে পারেনি। মৃত্যুর পূর্বে কোলন তার লাইব্রেরি দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে যান তার ভ্রাতুষ্পুত্রের হাতে। কিন্তু বইয়ের প্রতি তার তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না। ফলে ১৫৫২ সালের পর থেকে সেগুলোর স্থান হয় স্পেনের সেভিল শহরের সেভিল গির্জার (Seville cathedral) চিলেকোঠায়। কালক্রমে ধীরে ধীরে অনেক বই সেখান থেকে হারিয়ে যায়। বিবলিওটেকা কলম্বিনা নামে পরিচিত হের্নান্দো কোলনের সেই স্বপ্নের লাইব্রেরির মাত্র হাজার তিনেক বই বর্তমানে অবশিষ্ট আছে।
ফিচার ইমেজ- Eugenio Mazzone