বাইজোসের গল্প
আজ থেকে অনেকদিন আগের কথা, আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৬৬০ সাল ছিলো সময়টা। এথেন্সের কাছেই ছিলো এক শহর, নাম তার মেগারা। এই শহরেরই এক নাগরিক ছিলেন বাইজোস। গ্রীসের জনসংখ্যা দিনকে দিন বেড়েই চলেছিলো, আর এটা নিয়েই শঙ্কিত ছিলেন বাইজোস। এ বিষয়ে সঠিক কোনো দিকনির্দেশনা পেতে তাই তিনি চলে গেলেন ডেলফিতে।
উল্লেখ্য, প্রাচীন পৃথিবীতে দেবতা অ্যাপোলোর মন্দির হিসেবে ডেলফি ছিলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন দৈববাণী প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করা হতো এ জায়গাকে। এই ডেলফিতে গিয়েই নিজের শঙ্কার কথা ব্যক্ত করেছিলেন বাইজোস, জানতে চেয়েছিলেন তিনি কোথায় গিয়ে নতুন একটি বসতি স্থাপন করবেন। কথিত আছে যে, এর উত্তরে ফিসফিসিয়ে তিনি শুধু একটি কথাই শুনেছিলেন, “অন্ধদের বিপরীতে”!
এ কথাটির সঠিক কোনো অর্থ বুঝতে পারেন নি বাইজোস। তবে বসে থাকেন নি তিনি, এজিয়ান সাগর ধরে নতুন বসতি স্থাপনের আশায় বেরিয়ে পড়েন উত্তর-পূর্ব দিকে। এভাবে চলতে চলতে বসফরাস প্রণালীতে এসেই ডেলফিতে শোনা ভবিষ্যদ্বাণীর প্রকৃত অর্থ উপলব্ধি করেন তিনি। গ্রীক শহর চালসেডনকে দেখে তার মনে হয়েছিলো যে, এই শহরের গোড়াপত্তনকারীরা নিশ্চিত বোকা আর অন্ধ ছিলো! কারণ চালসেডন থেকে মাত্র আধা কিলোমিটারের মতো দূরত্বে বসফরাস প্রণালীর অপরপ্রান্তে ছিলো অত্যন্ত চমৎকার এক জায়গা। বাইজোস তাই চলে যান সেখানে, গড়ে তোলেন নতুন এক বসতি। তার নামানুসারে জায়গাটির তিনি নাম রেখেছিলেন বাইজান্টিয়াম।
এটা কিন্তু বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠারও প্রায় নয়শ বছর আগেকার কথা। কারণ বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো আনুমানিক ৩৩০ খ্রিষ্টাব্দে। সেই জায়গায় কিভাবে জনবসতি গড়ে উঠেছিলো তা নিয়ে বেশ ধোয়াশা রয়েছে ঐতিহাসিকদের মাঝে। তবে সবচেয়ে প্রচলিত ও এখন পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য ভার্সন হলো বাইজোসের কাহিনীই। এবার তাহলে শুরু করা যাক বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তনের কাহিনী।
বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন
১৮০ থেকে ১৯২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রোমের সম্রাট ছিলেন লুসিয়াস এইলিয়াস অরেলিয়াস কমোডাস। তার সময়েই রোমের অতীত গৌরব ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে বসেছিলো, জেঁকে ধরছিলো সাম্রাজ্য পতনের আশঙ্কা। ১৯২ খ্রিষ্টাব্দে খুন হন কমোডাস। এরপরই রোমের ক্ষমতা দখল নিয়ে বেঁধে যায় গৃহযুদ্ধ। এ লড়াইয়ে ছিলেন পার্টিনাক্স, ডিডিয়াস জুলিয়ানাস, পেসেনিয়াস নাইজার, ক্লডিয়াস আলবিনাস ও সেপ্টিমিয়াস সেভেরাস। শেষ পর্যন্ত এ লড়াইয়ে জয়ী হয়েছিলেন সেপ্টিমিয়াস। ১৯৩ থেকে ২১১ সাল পর্যন্ত রোমের শাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সিংহাসনের পাঁচ দাবিদারের মাঝে লড়াইয়ের এ সময়টি ইতিহাসে ‘Year of the Five Emperors’ নামে পরিচিত।
২২২ থেকে ২৩৫ সাল পর্যন্ত রোমের শাসকের দায়িত্ব পালন করেন সেভেরাস আলেকজান্ডার। ২৩৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি খুন হলে আবারো অরাজক পরিস্থিতিতে পড়ে যায় রোমান সাম্রাজ্য। সাম্রাজ্যের অর্থনীতির কোমর ভেঙে পড়েছিলো, রাজ্য জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিলো প্লেগের ভয়াবহতা, আক্রমণ করছিলো অন্যান্য প্রতিবেশী সাম্রাজ্যগুলো, সেই সাথে নিজেদের মাঝে গৃহযুদ্ধ তো ছিলোই। পরবর্তী প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে সিংহাসনের দাবিদার হিসেবে দেখা গেছে মোট ছাব্বিশজনকে! এদের অধিকাংশই ছিলো রোমান আর্মির জেনারেল।
২৮৪ খ্রিষ্টাব্দে রোমের সিংহাসনে বসেন ডায়োক্লেটিয়ান। তার শাসনামলেই মূলত রোম আবার স্থিতিশীল হতে শুরু করে। রাজ্যে অস্থিরতা দূর করতে তিনি নতুন এক শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন যেখানে রোমকে কয়েকটি অঞ্চলে ভাগ করে একেক ভাগ একেক শাসক নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। কিন্তু এ স্থিতিকালও খুব বেশি দিন স্থায়ী হয় নি। একসময় আবারো গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায় রোমান সাম্রাজ্যে। শেষ পর্যন্ত ম্যাক্সেন্টিয়াস ও লাইসিনিয়াসকে পরাজিত করে পূর্ব ও পশ্চিম রোমের শাসক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন কনস্টান্টিন দ্য গ্রেট, যিনি প্রথম কনস্টান্টিন ও সেইন্ট কনস্টান্টিন নামেও পরিচিত।
ভৌগলিক দিক থেকে বাইজান্টিয়ামের অবস্থান ছিলো বসফরাস প্রণালীর ইউরোপীয় অংশে। ইউরোপ ও এশিয়া মাইনরের মাঝে গুরুত্বপূর্ণ এক যোগাযোগ ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে কাজ করতো এটি। ৩৩০ খ্রিষ্টাব্দে এই বাইজান্টিয়ামে নিজের রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী স্থানান্তর করেন সম্রাট প্রথম কনস্টান্টিন। এ সময় তিনি বাইজান্টিয়ামকে নতুন রোম হিসেবে গড়ে তুলতে মনোযোগ দেন। সামরিক, আর্থিক ইত্যাদি বিভিন্ন দিক থেকে উন্নতি লাভ করতে থাকে শহরটি। শেষ পর্যন্ত কনস্টান্টিনের নামের সাথে মিল রেখে একসময় এর নাম রাখা হয় কনস্টান্টিনোপল। কনস্টান্টিন পুরো রোমান সাম্রাজ্যের শাসক থাকলেও তার মৃত্যুর পর খুব বেশি দিন এ অখন্ডতা ধরে রাখা সম্ভব হয় নি। ৩৩৭ খ্রিষ্টাব্দে মারা গিয়েছিলেন তিনি।
একটু এগিয়ে ৩৬৪ সালে চলে যাওয়া যাক। তখন রোমের শাসক ছিলেন প্রথম ভ্যালেন্টিনিয়ান। সিংহাসনে বসার অল্প কিছুদিনের মাঝেই তিনি সাম্রাজ্যের শাসনভার ভাগাভাগি করে নিয়েছিলেন তার ভাই ভ্যালেন্সের সাথে। পশ্চিমভাগের শাসনকাজ ভ্যালেন্টিনিয়ান দেখাশোনা করলেও পূর্বের ব্যাপারগুলো তার পক্ষে ভাই ভ্যালেন্স দেখাশোনা করতেন।
পুরো রোম সাম্রাজ্যের সর্বশেষ অখন্ড শাসক ছিলেন প্রথম থিওডোসিয়াস। অবশ্য সাম্রাজ্য ভাগাভাগির কাজটাও তিনিই সেরেছিলেন। তিনি সাম্রাজ্যের পশ্চিম (রোম) ও পূর্ব (কনস্টান্টিনোপল) অংশের দায়িত্ব দিয়েছিলেন যথাক্রমে তার দুই ছেলে অনারিয়াস ও আর্কাডিয়াসকে। কিন্তু এ ভাগাভাগিই যেন কাল হয়েছিলো পশ্চিম রোম সাম্রাজ্যের জন্য। এরপর হান, গথ ও ভ্যান্ডালদের একের পর এক আক্রমণ যেন মেরুদন্ডই ভেঙে দিয়েছিলো তাদের। ৪৭৬ খ্রিষ্টাব্দে বার্বারিয়ান ওডোয়াচেরের হাতে রমুলাস অগাস্টাসের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে পতন ঘটে পশ্চিম রোম সাম্রাজ্যের।
কেন টিকে গেল বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য?
যে কারো মনেই এখন প্রশ্ন আসতে পারে, পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য তাহলে আক্রমণের শিকার হলো না কেন? আসলে রোমান সাম্রাজ্যের এ অংশের টিকে থাকার পেছনে বড় ভূমিকা ছিলো ভৌগলিক অবস্থানের। রাজধানী কনস্টান্টিনোপল অবস্থিত ছিলো বসফরাস প্রণালীর কাছে। ফলে সেখান দিয়ে আক্রমণ করে ফায়দা লোটা ছিলো শত্রুপক্ষের জন্য বেশ কঠিন। রাজ্যে ধন-সম্পদের প্রাচুর্য ছিলো, ছিলো কঠোর প্রশাসন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। এছাড়া রাজ্যের অর্থনৈতিক ও সামরিক ব্যাপারগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোও আসতো পূর্ব ভাগের অনেক নেতার কাছ থেকে। এসব কারণে রোমান সাম্রাজ্যের এক অংশের পতন ঘটলেও অপর অংশ স্বমহিমায় ঠিকই টিকে ছিলো।
শিক্ষা ও ধর্মীয় অঞ্চল বন্টন
বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য পরিচালিত হতো রোমের আইন-কানুন অনুযায়ী। তবে ল্যাটিনই ছিলো এ অঞ্চলের প্রধান ভাষা। এছাড়া গ্রীকভাষী মানুষের সংখ্যাও ছিলো অনেক। শিক্ষার্থীরা গ্রীক ইতিহাস, সাহিত্য, সংস্কৃতি নিয়ে পড়াশোনা করতো।
৪৫১ খ্রিষ্টাব্দে কাউন্সিল অব চ্যালসেডন পুরো খ্রিষ্টান বিশ্বকে ৫টি অঞ্চলে ভাগ করেছিলো। এগুলো হলো- রোম, আলেকজান্দ্রিয়া, কনস্টান্টিনোপল, অ্যান্টিওক ও জেরুজালেম। এর মাঝে কনস্টান্টিনোপল অঞ্চলের দায়িত্বে ছিলেন বাইজান্টাইনের সম্রাট। তিনি একই সাথে চার্চের প্রধানও ছিলেন। অবশ্য সপ্তম শতকে মুসলিমরা আলেকজান্দ্রিয়া, অ্যান্টিওক ও জেরুজালেম জয় করে নিলে প্রাচ্যের অধিকাংশ খ্রিষ্টান দেশের আধ্ম্যাত্মিক নেতায় পরিণত হন বাইজান্টাইন সম্রাট।
প্রথম জাস্টিনিয়ানের শাসনামলে উন্নতি
৫২৭ থেকে ৫৬৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাইজান্টাইনদের সম্রাট ছিলেন প্রথম জাস্টিনিয়ান। তার সময়ে এ সাম্রাজ্যের ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়। উত্তর আফ্রিকার পাশাপাশি কালের গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের কিছু অংশও জয় করে নিয়েছিলো জাস্টিনিয়ানের বাহিনী। ফলে ভূমধ্যসাগরের উপকূলবর্তী অধিকাংশ অঞ্চলই তখন ছিলো বাইজান্টাইনদের অধিকারে। এ সময়েই গড়ে উঠেছিলো ইতিহাস বিখ্যাত অনেক স্থাপনা যার মাঝে সবচেয়ে পরিচিত হাজিয়া সোফিয়া। এছাড়া শাসন ব্যবস্থারও অনেক সংস্কার সাধন করেছিলেন তিনি।
জাস্টিনিয়ান যখন মারা যান, তখন বাইজান্টাইন ছিলো ইউরোপের সবচেয়ে বড় ও ক্ষমতাধর রাজ্য। অবশ্য ক্রমাগত যুদ্ধের ফলে রাষ্ট্রের ঋণের বোঝা বেড়ে গিয়েছিলো অত্যাধিক হারে। পরবর্তী শাসকেরা জনগণের ঘাড়ে অতিরিক্ত করের বোঝা চাপিয়ে এই ঋণমুক্তির পদক্ষেপ নেন। আবার বিশাল বড় এ রাজ্যের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সেনাবাহিনীও তখন ছিলো না। সপ্তম ও অষ্টম শতকে তাই পার্সিয়ান ও স্লাভদের আক্রমণের পাশাপাশি রাজনৈতিক অন্তর্দ্বন্দ্ব ও অর্থনৈতিক দুর্বলতা হুমকির মুখে ঠেলে দেয় সাম্রাজ্যের অস্তিত্বকেই। সপ্তম শতকে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের জন্য সবচেয়ে বড় ভয় ছিলো মুসলিমদের উত্থান। একের পর এক যুদ্ধে মুসলমানদের কাছে পরাজিত হতে থাকে তারা। এ শতকের শেষে সিরিয়া, জেরুজালেম, মিশর ও উত্তর আফ্রিকা বাইজান্টাইন মানচিত্র থেকে মুসলিম বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে নেয়।
বাইজান্টাইন আইকনোক্লাজম
ওদিকে সপ্তম শতকে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যে শুরু হয় আরেক অন্তর্দ্বন্দ্বের কাহিনী। বিভিন্ন ধর্মীয় চিত্র ও প্রতীক ব্যবহারের ব্যাপারে আপত্তি তোলা শুরু করে ইস্টার্ন চার্চ (ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চ, অরিয়েন্টাল অর্থোডক্স চার্চ, অ্যাসাইরিয়ান চার্চ অব দ্য ইস্ট ও ইস্টার্ন ক্যাথলিক চার্চগুলো) কর্তৃপক্ষ। বাইজান্টাইন আইকনোক্লাজম নামে পরিচিত এ সময়কাল দুটি অংশে বিভক্ত। ৭২৬-৭৮৭ সাল পর্যন্ত ছিলো প্রথম আইকনোক্লাজম, ৮১৪-৮৪২ সাল পর্যন্ত চলে দ্বিতীয় আইকনোক্লাজম। এর নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালীন বাইজান্টাইন সম্রাট তৃতীয় লিও। সেই সময় অনেক চিত্র ধ্বংস করা হয়, নির্যাতনের মুখোমুখি হতে হয় সেসব চিত্রকে শ্রদ্ধার সাথে দেখা মানুষগুলোকে। ওদিকে ওয়েস্টার্ন চার্চ তথা রোমান ক্যাথলিক চার্চ ছিলো এসব চিত্র ব্যবহারের পক্ষে। ফলে বিবাদ ক্রমশ বাড়তেই থাকে। অবশেষে ৮৪৩ সালে সম্রাট তৃতীয় মাইকেলের নেতৃত্বাধীন এক চার্চ কাউন্সিল ছবি ব্যবহারের স্বপক্ষে রায় দিলে অবসান ঘটে দীঘকাল ধরে চলা এ দ্বন্দ্বের।
শেষের আগের উত্থান
তৃতীয় মাইকেলের বংশধর বাসিলের হাতে গড়ে ওঠা মেসিডোনীয় রাজবংশের শাসনামলে অবস্থা পাল্টাতে শুরু করে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের। সময়টা ছিলো দশম শতকের শেষ ও একাদশ শতকের শুরুর দিককার। সম্রাট জাস্টিনিয়ানের সময়ের তুলনায় ব্যবসা-বাণিজ্যে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ, ধন-সম্পদ, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মর্যাদা ও প্রভাব প্রতিপত্তি- সবই বৃদ্ধি পায়। চিত্রকলায় আসা শুরু করে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। চার্চ, প্রাসাদ ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানকে ঢেলে সাজানো হয়, শুরু হয় গ্রীসের ইতিহাস ও সাহিত্য নিয়ে গবেষণা। তৎকালীন প্রশাসনিক কার্যক্রমের জন্য ব্যবহৃত হতো গ্রীক ভাষা। সন্ন্যাসীরা এতিমখানা, স্কুল, হাসপাতালের মতো জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা করতেন। মধ্য ও পূর্ব বলকান অঞ্চল এবং রাশিয়ার অনেক মানুষ তখন খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলো।
এগারোশ বছরের অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি
বাইজান্টাইনদের এ সুখ অবশ্য ক্ষণস্থায়ী ছিলো। ১০৯৫ থেকে মোটামুটি ১২৯১ সাল পর্যন্ত ক্রমাগত ক্রুসেডে বেশ নাজুক হয়ে পড়ে সাম্রাজ্যটি। ১২৫৯ সালে সম্রাট অষ্টম মাইকেলের হাত ধরে পালাইয়োলোগান সম্রাটদের যুগে প্রবেশ করে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য। এরপর থেকেই ধীরে ধীরে এর অর্থনৈতিক অবস্থা আরো খারাপ হতে শুরু করে। পতনের প্রান্তসীমায় অনেকবার গিয়েও ফিরে এসেছিলো সাম্রাজ্যটি। কিন্তু এবারের আর্থিক দুরবস্থা তাদের যেন তাদের কবরই খুঁড়ে দেয়।
১৩৭৩ সালে সম্রাট পঞ্চম জনের শাসনামলে বাইজান্টিয়াম ওসমানীয় সাম্রাজ্যের এক সামন্তরাজ্যে পরিণত হয়। তখন তাদেরকে নিয়মিত কর দেয়া লাগতো, বিভিন্ন যুদ্ধে ওসমানীয় বাহিনীতে দেয়া লাগতো সৈন্য সাহায্য। জনের পরবর্তী বংশধরেরা অবশ্য সাময়িকভাবে এ অবস্থার কিছুটা উন্নতি ঘটাতে পেরেছিলেন।
১৪২১ সালে সুলতান দ্বিতীয় মুরাদ ক্ষমতায় আসার পর অবশ্য বাইজান্টাইনদের কফিনে শেষ পেরেকটা ঠোকার কাজ শুরু করে দেন, শুরু হয় কনস্টান্টিনোপল অবরোধ। অবশেষে ১৪৫৩ সালের ২৯ মে সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদের শাসনামলে পতন ঘটে রোমান সাম্রাজ্যের পূর্ব ভাগের সন্তানটির। বীরের বেশে কনস্টান্টিনোপলে সেদিন প্রবেশ করেছিলো ওসমানীয় বাহিনী।
তৎকালীন বাইজান্টাইন সম্রাট একাদশ কনস্টান্টিনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অবশেষে পরিসমাপ্তি ঘটে ৩৩০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে যাত্রা শুরু করা বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের, শেষ হয় প্রায় এগারোশ বছর ধরে রচিত হতে থাকা ইতিহাসের আরো একটি অধ্যায়ের।