ছিলেন ক্রিকেটের রাজপুত্র, ক্রিকেটের মাঠে দাপিয়ে নেতৃত্ব দেয়া অধিনায়ক এখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। অনেক জল্পনা কল্পনা আর রাজনৈতিক হিসেব নিকেশের পর এ বছরের ১৮ই আগষ্ট শপথ গ্রহণের মাধ্যমে পাকিস্তানের ২২ তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিলেন তিনি। এ নিয়ে গত তিন-চার বছর ধরে তো বটেই, এখনো হয়ে চলেছে নানা আলোচনা। আর হবে না-ই বা কেন? কারণ ইমরান খান এমন একটি পদের দায়িত্ব নিয়েছেন, যা নিয়ে গত সত্তর বছর ধরেই লেগে আছে ঝামেলা, ১৯৪৭ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর গত সত্তর বছরে কোনো পাকিস্তানী প্রধানমন্ত্রীই তার ক্ষমতার পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি! হ্যাঁ তথ্যটা শুনে হয়তো আকাশ থেকে পড়লেন, কিন্তু এটাই বাস্তবতা। যেটা পাকিস্তানের রাজনীতির দেউলিয়াপনাকেই তুলে ধরে।
৭০ বছরের রাজনৈতিক ঐতিহ্যের কারণেই শুধু নয়, আরো নানাবিধ কারণেই অনেক রাজনৈতিক বিশারদ স্বভাবসুলভ ভবিষ্যৎবাণী করা শুরু করেছেন ‘ইমরানের পতন হলো বলে’। সে যাগই হোক, কী হবে সেটা সামনেই দেখা যাবে। পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্তির তো অনেক দেরি, আপাতত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে একমাস পূরণ করলেন ইমরান খান। আর গেল এই একমাসে তার কাজের ফিরিস্তি নিয়েই আজকের আলোচনা। বিশ্লেষকদের মতে, শুরুর দিকে ইমরানের কর্মকান্ডেই দেখা মিলবে আগামী দিনগুলো কেমন যাবে।
সুদর্শন, ক্যারিশমাটিক ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন ইমরান খান পাকিস্তানের জীর্ণ-শীর্ণ সমস্যা সংকুল পরিবেশে বিপুল আশা-আকাঙ্খা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। এই আশা-আকাঙ্খা পূরণে আবেগের চেয়ে দক্ষতা আর সমঝদার হওয়াটাই বেশি জরুরি। সমস্যা হলো, শুরুতেই নানা ব্যাপারে সমঝদারির চেয়ে আবেগের প্রাধান্যই বেশি দেখা গেছে। ফলে ইমরান ও তার সহযোগীদের অপরিপক্বতাই বারবার প্রকাশিত হচ্ছে।
সবকিছুতেই সিদ্ধান্তহীনতা আর সমন্বয়হীনতা অত্যন্ত প্রকট। এ নিয়ে সাধারণ মানুষ এবং বিশিষ্টজন সবার মধ্যেই মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে। এ মাসের ১৭ তারিখ করাচির এক জনসভায় ইমরান খান ঘোষণা দিলেন, পাকিস্তানে বসবাসরত প্রায় ২৫ লক্ষ আফগান শরণার্থীদের যেসব শিশু পাকিস্তান ভূ-খন্ডে জন্ম গ্রহণ করেছে, তাদেরকে নাগরিকত্ব দেয়া হবে। এ ঘোষণা আসার সাথে সাথেই করাচির বিভিন্ন আফগান শরণার্থী শিবিরে আনন্দের ধুম পড়ে যায়। মিষ্টি বিতরণ আর আনন্দ উপযাপনের রেশ কেটে যেতে না যেতেই আবার নতুন সিদ্ধান্ত কানে এলো সবার।
পরদিন শরণার্থীরা যখন এই খোঁজ নেয়ার জন্যে ঘোরাঘুরি করছিলেন যে তাদের সন্তানদের নাগরিকত্বের কার্ড কোথায় পাওয়া যাবে তখন জানা গেল এই মূহুর্তেই নাগরিকত্ব দেয়া যাচ্ছে না, প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছেন চাপে পড়ে। কেননা সামরিক বাহিনী, জাতীয়তাবাদী ও তারই নিজ রাজনৈতিক জোটের সদস্যরা এর বিরোধীতা করেছে। ফলে নির্বাচনের আগে দেয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ করা গেল না। তবে এটাকে যে সম্পূর্ণ বাতিল করে দেয়া হয়েছে তা নয়। ইমরান তার কৌশলী ভাষায় বলেছেন, “আমি সবসময়ই নাগরিকত্বের সমস্যা মেটানোর জন্যে কাজ করে যাব। আমরা এখন সমাধান না করলে কে করবে?”
এটা গেলো একটি উদাহরণ মাত্র। এরকম আরো বহু ঘটনা ঘটে চলেছে, যাতে অত্যন্ত প্রকটভাবে কৌশলী ও বাস্তবসম্মত উদ্যোগের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে, আবেগ প্রাধান্য পাচ্ছে। ফলে শেষপর্যন্ত ইমরান খানকেই বিব্রত হতে হচ্ছে। পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ইমরান খান নিয়োগ দিয়েছেন উসমান বুজদার নামক একজন রাজনীতিবিদকে। এই সিদ্ধান্ত চরম সমালোচিত হয় দেশের বিশিষ্টজনদের কাছে। কারণ উসমান বুজদার প্রশাসক হিসেবে অনভিজ্ঞ তো বটেই, উপরন্তু তিনি এমন একটি এলাকার প্রতিনিধিত্ব করেন যেখানে বিদ্যুৎ পর্যন্ত পৌঁছায়নি।
উসমানকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগের যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে, যেহেতু উসমান বুজদার গ্রামে বসবাস করেন, তাই তিনি গ্রামের মানুষের সমস্যা ভালো বুঝতে পারবেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, একজন লোক একটা প্রদেশ চালানোর জন্য সবার আগে যেটা দরকার তা হলো অভিজ্ঞতা, আবেগ নয়। কেউ যদি দেশের খারাপ অর্থনৈতিক অবস্থা দেখা আবেগে দুঃখিত হয়, এর মানে এই নয় সে অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানে যোগ্য ব্যক্তি।
অর্থনৈতিক প্রসঙ্গ যখন এলো তখন আরো একটি উদাহরণ দেয়া যাক। এটা নিয়েও ব্যাপক সমালোচনা ইমরানকে ঘরে-বাইরে সইতে হচ্ছে। তীব্র দেনার দায়ে পাকিস্তান এখন জর্জরিত। ক্ষমতা গ্রহণের দিনই ইমরান ঘোষণা করেছিলেন, তার জন্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করা। সেই লক্ষেই ইমরান খান গঠন করেন ১৮ জন বিজ্ঞ অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টাদের সমন্বয়ে ‘অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদ (ইএসি)’। এই পরিষদে ১৮ জনের মধ্যে একজন ছিলেন ড. আতিফ মাইয়ান, যিনি কি না আবার ধর্ম বিশ্বাসের দিক দিয়ে আহমদিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত।
ড. আতিফ যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (এমআইটি) থেকে পড়াশোনা করা অর্থনীতিবিদ, যিনি এখন যুক্তরাষ্ট্রেরই প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। অর্থনীতিতে অত্যন্ত পন্ডিত ড. আতিফ বিশ্বের শীর্ষ ২৫ জন তরুণ উদীয়মান অর্থনীতিবিদের একজন। প্রবাসী পন্ডিত এই অর্থনীতিবিদ ক্রান্তিলগ্নে নিজ দেশকে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন, ইমরান খানও তাকে পরিষদে নিয়োগ করে দূরদর্শীতার পরিচয় দিয়েছেন।
তবে ইসলামী কট্টরপন্থীরা অর্থনৈতিক পরিষদে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের কাউকে নিয়োগ দিতে বাঁধা প্রদান করে। পরিস্থিতি এতটাই জটিল আকার ধারণ করে যে ড. আতিফকে বাদ দিতে হয়, উপরন্তু আহমদিয়া কাউকে নিয়োগ দেয়া ঠিক হয়নি এরকম লজ্জাকর স্বীকারোক্তিও তথ্যমন্ত্রী ফাওয়াদ চৌধুরীকে করতে হয়। অথচ তথ্যমন্ত্রী ফাওয়াদ এর আগে মাইয়ানের মনোনয়নে জোর সমর্থন জানিয়ে বলেছিলেন যে, ধর্মীয় সংখ্যালঘুরাও গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার অধিকার রাখে।
এই ঘটনাকে পাকিস্তানের বিশিষ্টজনেরা ন্যাক্কারজনক বলে অভিহিত করেছেন। তারা প্রশ্ন তুলেছেন, ইমরান খান কি তবে আগের শাসকদের মতোই চরমপন্থীদের কাছে নত হবেন? আর ড. আতিফ আহমদিয়া হওয়ার ফলে অর্থনৈতিক পরিষদ থেকে তাকে বাদ দেওয়ার প্রাসঙ্গিকতা কী? তাকে তো আর ধর্ম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়নি। ইমরান খান নিজে যতই প্রগতিশীল হোন না কেন, তার আশেপাশের লোকদের কারণে যে তার পথ চলা সহজ হবে না বিশ্লেষকরা আগেই তা সতর্ক করেছিলেন।
আবার অনেকগুলো দল নিয়ে জোটবদ্ধ হয়ে ক্ষমতায় আসার ফলে ইমরানের সরকারের মধ্যে দ্বিধার ভাব অত্যন্ত প্রবল। প্রথমে বেলুচিস্তানের গভর্নর হিসেবে ড. আমির মোহাম্মদ খানের নাম ঘোষণা করা হয়। মজার বিষয় হলো এর ঘন্টাখানেক পরেই বলা হলো তাকে প্রাথমিকভাবে মনোনীত করা হয়েছে, চূড়ান্ত নিয়োগ করা হয়নি। অর্থাৎ এরই মধ্যে হয়তো কোনো মহল থেকে আপত্তি আসায় এক ঘন্টার মধ্যে সুর বদল করতে হলো।
ইমরান তার ক্ষমতা শুরু করেছেন তার সরকারের কৃচ্ছসাধন নীতির মাধ্যমে। শপথ গ্রহণের পরদিন জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে তিনি খোলাসা করেছেন কীভাবে সরকারি খাতে দেদার অর্থ অপচয় হয়। এর পরদিনই ব্যাপকভাবে তিনি সরকারি খরচ হ্রাস ও দুর্নীতির অবসান ঘটানোর ঘোষণা দেন।
তো এই খরচ কমানোর জন্যে শুরুর দিনই প্রধানমন্ত্রীর জন্যে নির্ধারিত সুবিশাল বাংলো বাদ দিয়ে তিন কামরার ফ্লাটে উঠেছেন, বাসভবনের কর্মচারীর সংখ্যা ৫২৪ থেকে কমিয়ে ২ জনে নামিয়ে এনেছেন। নিজে এবং সরকারি কর্মকর্তা কেউই বিমানে ফার্স্ট ক্লাসে ভ্রমণ না করা এবং দামি নৈশভোজ ও চা নাশতার খরচ কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বলা বাহুল্য, আসল কাজে হাত না দিয়ে শুধু চা-নাশতার খরচ কমিয়ে ব্যয়ের লাগাম টানা যাবে না। বহুদিন ধরে ফুলে-ফেঁপে ওঠা ধনী সম্প্রদায়ের উপর ন্যায্য করারোপ, সামরিক বাহিনীর উচ্চ বাজেট হ্রাস ইত্যাদিতে এখনো হাত দেয়ার কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি।
পররাষ্ট্র নীতির দিক থেকে খুব বেশি কিছু বোঝা না গেলেও মোটামুটি ভারতের প্রতি শান্তির আহ্বানই জানিয়েছেন তিনি। তার ভাষায়, “ভারত যদি এক কদম এগিয়ে আসে আমি দুই কদম এগিয়ে আসবো”। বিভিন্ন ছুটি বাতিল করে নিয়মিত মন্ত্রীদের সাথে বৈঠক করে কর্মপন্থা ঠিক করছেন ইমরান খান। মন্ত্রীদের প্রতিদিন ১৪-১৬ ঘন্টা কাজ করার নির্দেশও আছে।
আপাতদৃষ্টিতে বিপুল কর্মস্পৃহা নিয়ে এগোনোর চেষ্টা করছেন ইমরান খান। তার এই কর্মস্পৃহা কতদিন অব্যহত থাকে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
ফিচার ইমেজ- Reuters