গত ১৭ই সেপ্টেম্বর, সোমবার রাশিয়ার সোচিতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়িব এরদোয়ানের মধ্যে সিরিয়ার ইদলিব প্রদেশের ভবিষ্যত নিয়ে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। সমঝোতা অনুযায়ী সিরিয়ার সরকার আপাতত ইদলিবে কোনো সামরিক অভিযান পরিচালনা করবে না, বরং ইদলিবের সীমান্ত বরাবর ১৫-২০ কিলোমিটার প্রস্থ বিশিষ্ট একটি বাফার জোন প্রতিষ্ঠা করা হবে, যেখানে তুর্কি এবং রাশিয়ান সেনারা যৌথভাবে টহল দিবে। এর পূর্বেই অবশ্য ঐ এলাকা থেকে উগ্রপন্থী সবগুলো গ্রুপকে সরে যেতে হবে এবং ট্যাংক, রকেট লঞ্চারসহ সব ধরনের ভারী অস্ত্রশস্ত্র সরিয়ে ফেলতে হবে।
Russia, Turkey agree to create buffer zone in Syria’s Idlib https://t.co/IWLICX1wwQ pic.twitter.com/LLPRzEi3PM
– Reuters Top News (@Reuters) September 17, 2018
পুতিনের সাথে এরদোয়ানের এ বৈঠকের ১০ দিন আগেই অবশ্য এই দুজনের সাথে ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির একটি ত্রিদেশীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ইরানের রাজধানী তেহরানে। তেহরান সম্মেলন ব্যর্থ হওয়ার পরেও কী কারণে রাশিয়া এবং তুরস্কের মধ্যে সমঝোতা সম্ভব হলো, এ নিয়ে আমাদের পূর্ববর্তী একটি প্রবন্ধে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করেছি। কিন্তু পুতিন এবং এরদোয়ানের মধ্যে স্বাক্ষরিত নতুন এ সমঝোতার ভবিষ্যত কী হতে পারে, তা নিয়েই আমাদের এবারের বিশ্লেষণ।
এর আগে একটি প্রবন্ধে ইদলিবের প্রধান প্রধান বিদ্রোহী সংগঠনগুলোর পরিচয় দিতে গিয়ে আমরা উল্লেখ করেছিলাম, ইদলিবে অনেকগুলো বিদ্রোহী সংগঠন থাকলেও এদের মধ্যে দুটি প্রধান। একটি হচ্ছে তুরস্কের প্রতি অনুগত ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট (এনএলএফ), অপরটি হচ্ছে সাবেক আল-কায়েদাপন্থী জিহাদী সংগঠন হাইআত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস)। সমঝোতা স্মারকের আওতায় যেহেতু সাধারণ বিদ্রোহীদেরকে হালকা অস্ত্র সাথে রাখার অনুমতি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তাই আশা করা যায় এনএলএফের অন্তর্ভুক্ত সংগঠনগুলো এতে খুশি হবে এবং এর পক্ষে তাদের সমর্থন ব্যক্ত করবে।
কিন্তু হাইআত তাহরির শামসহ সন্ত্রাসী হিসেবে তালিকাভুক্ত গোষ্ঠীগুলো এ চুক্তির আওতাভুক্ত না বলে তারা কী ধরনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবে, তা এখনও পরিষ্কার না। এর আগে বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত অন্যান্য এলাকায় সামরিক অভিযান চালানোর সময় কিছুদিন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পর বিদ্রোহীদের অনেকেই সরকারের সাথে সমঝোতায় গিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত অন্যান্য এলাকায়, বিশেষ করে ইদলিবে এসে আশ্রয় নিতে পেরেছিল। কিন্তু ইদলিবই যেহেতু বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা সর্বশেষ উল্লেখযোগ্য এলাকা, তাই এবার তাদের যাওয়ার আর কোনো জায়গা নেই।
যদিও সিরিয়ান সরকার এবং তার মিত্ররা হাইআত তাহরির শামকে সরাসরি আল-কায়েদা হিসেবে অভিযুক্ত করে, কিন্তু বাস্তবতা কিছুটা ভিন্ন। দুই বছর আগেই সংগঠনটি আনুষ্ঠানিকভাবে আল-কায়েদার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল এবং প্রথমে নাম পাল্টে জাবহাত ফাতাহ আল-শাম (জেএফএস) এবং পরবর্তীতে হাইআত তাহরির শাম (এইচটিএস) নাম গ্রহণ করেছিল। যদিও তাদের আদর্শ আল-কায়েদার খুবই কাছাকাছি, এবং তাদের অনেক নেতা আল-কায়েদার অধীনে থাকার সময়েও নেতৃত্ব দিয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে তারা আল-কায়েদা বা অন্য কোনো আন্তার্জাতিক সংগঠনের অধীনস্থ না। এমনকি, ইদলিবে সরাসরি আল-কায়েদার অধীনস্থ কিছু গ্রুপের সদস্যদের সাথে তার সংঘর্ষও হয়েছে একাধিকবার।
এই বিষয়টিও ইদলিবের শান্তির পক্ষে হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। যারা সরাসরি আল-কায়েদা বা অন্য কোনো আন্তর্জাতিক সংগঠনের অধীনস্থ, তারা হয়তো ইদলিব তথা সিরিয়া থেকে বেরিয়ে অন্য কোনো দেশে চলে যাওয়ার সুযোগ চাইতে পারে। কিন্তু এইচটিএসের অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা না থাকায় তাদের পক্ষে শেষপর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা না-ও থাকতে পারে। তুরস্ক অবশ্য দীর্ঘদিন ধরেই এইচটিএসকে বিলুপ্ত হয়ে এনএলএফের সাথে মিশে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তারা এই শর্তে রাজি হয়নি। ভবিষ্যতেও হবে কি না, কিংবা হলেও সিরিয়া তা মানবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
তবে শুধু এইচটিএস না, ইদলিবে উগ্রপন্থী সংগঠন আরো আছে। পুতিন এবং এরদোয়ানের সংবাদ সম্মেলনে এরদোয়ান বলেছিলেন, তারা সকল মৌলবাদী গ্রুপকে এ এলাকা থেকে সরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে একমত হয়েছেন, কিন্তু কারা মৌলবাদী, তা উভয় রাষ্ট্রের কর্মকর্তারা মিলে পরবর্তীতে নির্ধারণ করবে। এই সংজ্ঞায়ন নিয়েও পরবর্তীতে তুরস্কের সাথে রাশিয়ার বিরোধ সৃষ্টি হতে পারে। এইচটিএস, যাকে জাতিসংঘ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেকেই আরো আগেই সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছিল, তাকেই তুরস্ক সন্ত্রাসী হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে তেহরান সম্মেলনের মাত্র এক সপ্তাহ আগে।
#Syria: Burning question of the day: where will #Idlib’s radical fighters (many factions, many agendas) actually go?
— Sara Firth (@Sara__Firth) September 18, 2018
কিন্তু এর বাইরেও ইদলিবে সক্রিয় আরো অনেক সংগঠন আছে, যাদেরকে সিরিয়া, ইরান এবং রাশিয়া উগ্রপন্থী হিসেবে বিবেচনা করলেও তুরস্ক তাদেরকে মধ্যপন্থী বিদ্রোহী সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, তুরস্কের অনুগত এনএলএফের অন্তর্ভুক্ত রুদ্দিন আল-জিঙ্কি এবং জাইশ আল-আহরার সংগঠনদুটির বিরুদ্ধেও শিরশ্ছেদসহ বিভিন্ন মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ আছে, এবং এদেরকে অনেকেই সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করে। রাশিয়া যদি সন্ত্রাসী হিসেবে তালিকাভুক্ত করে এদেরকেও ইদলিবের বাফার জোন থেকে বহিষ্কার করতে চায়, তাহলে তুরস্ক সেটা মেনে নেবে কি না, কিংবা সংগঠনগুলোও সেক্ষেত্রে তুরস্কের নির্দেশ মানবে কি না, এখনও পরিষ্কার না।
কিন্তু তুরস্ক এবং রাশিয়া যদি এসব ব্যাপারে একমতও হয় এবং এইচটিএসও যদি নিজেদেরকে বিলুপ্ত করে, তারপরেও যে বাশার আল-আসাদ শেষপর্যন্ত ইদলিব আক্রমণ করবে না, তারও খুব একটা নিশ্চয়তা নেই। কারণ ইতোপূর্বে আস্তানা সম্মেলনে ডি-এস্কেলেশন জোন হিসেবে ঘোষিত প্রতিটি এলাকাই বাশার আল-আসাদের সেনাবাহিনী জোরপূর্বক দখল করে নিয়েছিল। এবারও সিরিয়ার সরকারের পক্ষ থেকে এ সমঝোতা স্মারককে স্বাগত জানানো হয়েছে ঠিকই, কিন্তু একইসাথে এটাও উল্লেখ করা হয়েছে যে, তারা সিরিয়ার ভূমির প্রতিটি ইঞ্চি মুক্ত না করা পর্যন্ত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখবে। এই সমঝোতা স্মারককে তাই অনেক বিশ্লেষকই সাময়িক এবং অস্থায়ী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
Anything that postpones a possible bloodbath in Syria’s Idlib province is to be welcomed, but remain wary, given the long history of Putin-Assad forces agreeing to delay their slaughter of civilians only to resume it when pressure on them eases. https://t.co/JMx3c5VNrl
— Kenneth Roth (@KenRoth) September 18, 2018
তবে এবারের সমঝোতার একটি বিশেষত্ব হলো, এটি পুতিন এবং এরদোয়ান দুজনে সরাসরি আলোচনা করে স্বাক্ষর করেছেন। ফলে এটি যদি শেষপর্যন্ত কার্যকর না হয়, তাহলে যে পক্ষ ভঙ্গ করবে, আন্তর্জাতিক অঙ্গণে তার গ্রহণযোগ্যতা অনেক হ্রাস পাবে। এরদোয়ান এবং পুতিন ইরান, সিরিয়া কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়াই নিজেরা আলোচনা করে একটি সমঝোতায় পৌঁছে প্রমাণ করেছেন, সিরিয়ার দুই বিপরীত পক্ষকে প্রকৃতপক্ষে তারাই প্রতিনিধিত্ব করছেন। কিন্তু আসলে এরদোয়ান সিরিয়ার বিদ্রোহীদেরকে এবং সেই সাথে এইচটিএসের মতো সন্ত্রাসী তালিকাভুক্ত সংগঠনগুলোকে, আর অন্যদিকে পুতিন বাশার আল-আসাদকে এবং ইরানকে কতটুকু নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন, তার উপরেই নির্ভর করবে এই চুক্তির প্রকৃত সাফল্য।
আরও পড়ুন:
ইদলিব: রক্তবন্যার আশঙ্কায় ত্রিশ লাখ মানুষ
ইদলিবের ‘বিদ্রোহী’রা আসলে কারা?
এরদোয়ান-পুতিন কীভাবে ইদলিবের ব্যাপারে ঐক্যমতে পৌঁছলেন?
ফিচার ইমেজ: Alexander Zemlianichenko/Pool via REUTERS